ঘুড়ির মতো উড়তে চেয়ে ছিল যে মেয়েটি,
স্বপ্নের ডানায় ভর করে,
কিন্তু সময়ের হাওয়া তাকে বেঁধে দিল
পরাধীনতার সূক্ষ্ম সুতোয়।
শৈশবের উঠোনে যে মেয়েটি ছুটে বেড়াত,
রোদে ভেজা গোধূলির আকাশ দেখে
স্বপ্ন বুনত চোখের তারায়,
সে-ই একদিন শাড়ির আঁচলে
ভাঁজ করল সমস্ত ইচ্ছে ।
নতুন সংসারের চৌকাঠ পেরিয়ে
সে চলল অজানা লড়াইয়ে,
যেখানে হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকে
স্বীকৃতির তৃষ্ণা,
আর ভালোবাসার নামে
অগণিত বোঝার ভার।
শৈশবের রোদ, কাঁচা আমের গন্ধ,
হাসি-ঠাট্টায় ভরা দিনগুলি
বদলে গেল এক অনিশ্চিত অন্ধকারে,
যেখানে সে শুধু এক "বউ",
এক "মা", এক নীরব যোদ্ধা।
একটি ফুটফুটে কন্যার জন্মে,
কন্যার মুখে প্রথম ডাক শুনে
হৃদয়ে জাগল অনির্বচনীয় আনন্দ,
কিন্তু সমাজের চোখে সে পরাজিত,
কারণ সে 'পুত্রবধূ হয়ে
'পুত্রজায়া' হতে পারেনি!
তবুও সে থামেনি,
পুত্রের আশায় আরও
এক কন্যা যখন এলো,
তার ভালোবাসা দ্বিগুণ হলো না,
পিতৃস্নেহ ব্যতীত বাড়ল সপ্তমসুরে গঞ্জনা।
এরপর;
যে হাত ধরেছিল সে, পথচলার শুরুতে,
সে-ই একদিন অজানা গন্তব্যে হারিয়ে গেল,
পিছু ফেলে গেল ঋণের ভার,
অবহেলার চিহ্ন,
আর দুটি অবুঝ শিশুর উজ্জ্বল চোখ।
তারপর ;
তারপর জীবন শিখিয়ে দিল সংগ্রামের মানে,
হাতের কাজ, সুঁই-সুতোর জাদুতে
সে বুনতে থাকল সংসারের পর্দা,
দিন গেল, মাস গেল, বছর গেল,
সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে
নিজেকে সে ভুলে গেল।
অভাবের কাঁধে বসে
স্বপ্ন বুনে চলল নিঃশব্দে;
তবুও একদিন ফিরে এল সে —
যে বহুকাল আগে ছেড়ে গিয়েছিল।
ফিরল একখন্ড ভগ্ন শরীর, ক্লান্ত চোখ,
দুটি বিকল বৃক্কের অক্ষমতায়,
তবু ফিরে এলো বাঁচার আশা নিয়ে ।
বুকভরা অনুশোচনা নিয়ে,
আর সেই নারী?
সে তখনও একই,
একটি বিশাল আকাশের নিচে
একাকী দীপশিখা,
যে আলো দেয়,
কিন্তু পুড়ে যায় নিজেই।
শেষ রাতের ঝড়ে নিভে গেল সিঁদুরে রাঙা রক্তিম সিঁথি,
তার সন্তানের বাবার পরিচয় রেখে গেল,
আর সেই নারী?
সে এখনও দাঁড়িয়ে আছে,
দুটি সন্তানের হাত ধরে,
বাতাসের সাথে যুঝে—
এক শক্তপোক্ত বৈধব্য বটগাছের মতো,
যে ঝড়ে ভেঙে পড়ে না,
শুধু শেকড় আরও গভীরে নামিয়ে দেয়।
শুধু তাদের জন্য,
যারা একদিন ডানা মেলবে
মায়ের স্বপ্নের মতো,
কিন্তু এবার আর কেউ কাটবে না সেই সুতো!
~~~~~~~~~