(**আমার কবিতায় প্রিয় কবি জাহিদ হোসেন রনজুর একটি আন্তরিক মন্তব্য থেকে এ লেখার সূত্রপাত,আজ প্রতিমন্তব্য দেওয়ার পর প্রিয় কবি, সমীর প্রামাণিক মহাশয়ের অনুপ্রেরণায় তা নিয়ে এলাম মন্তব্য ঘর থেকে আলোচনা পাতায় কিছু সম্পাদনার সাথে, উভয় কবির প্রতি তাই রইল আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা।)
এই ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে ঠিক পৌঁছে যাব
সেই চাঁদের পাহাড় দেখতে পাব
সেই চাঁদের পাহাড়,মাথায় যাহার ,
রামধনু রাঙা হয় দেখতে পাব
ঠিক পৌঁছে যাব....
দেখার ইচ্ছায় পথ চলা আর নানান ভাবনার সঙ্গমে মিলিত হওয়ার ইচ্ছায় কবিতা পাঠ। কিন্তু পথে যেমন বাধা আসে, তেমন কবিতা পাঠ ও ভাব হৃদয়ঙ্গমের মাঝে আসে দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, মতপার্থক্য (নিজের সাথেই) ,না বোঝার বেদনা। তবে কি একটি কবিতা সম্পূর্ণ উপলব্ধ না হলে, পাঠক ব্যর্থ, নাকি রচয়িতা কবি ব্যর্থ?আমি মনে করি কোনোটিই নয়।
একজন "নিরপেক্ষ পাঠক" হিসেবে তাই আপনাদের সাথে কিছু কথা ভাগ করে নিলাম।
ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়,
বিশেষত কবিতার ক্ষেত্রে, পাঠ ও উপলব্ধির তিনটি পর্যায় থাকে-
প্রথম পর্যায়: মূলত পাঠ ও প্রাথমিক ভাবকে বোঝা -
প্রাথমিক ভাবের আবার দুটি দিক,
এক: কবিতার প্রকৃতি
(যা বলে দেওয়ার অপশন আমাদের এই কবিতার আসরে আছে। যেমন বিরহের কবিতা, বিদ্রোহী কবিতা ইত্যাদি ইত্যাদি..)
দুই: বিষয়বস্তু সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা ।
দ্বিতীয় পর্যায় : বিষয়বস্তু পর্যবেক্ষণ ।
এখানে যে ধাপগুলি মূলত লক্ষ্য করতে হবে তা হল,
১। কবিতার উপস্থাপন ভঙ্গি- যেমন,
অ) ঘটনাভিত্তিক কবিতা হলে ঘটনার পর্যায়ক্রম
আ) চিত্রকল্পভিত্তিক হলে খেয়াল করতে হবে- তার স্থান, কাল, সময়
ই) পট পরিবর্তন ( তা হতে পারে সময়ভিত্তিক, স্থানভিত্তিক ইত্যাদি)
২। কবিতায় রূপকের ব্যবহার এবং কি প্রসঙ্গে রূপকটি ব্যবহৃত হয়েছে তা অনুধাবন।
৩। ঘটনা বা চিত্রকল্পের পারস্পরিক নির্ভরতা ।এটা হতে পারে পংক্তিভিত্তিক, হতে পারে স্তবকভিত্তিক।
৪। যতিচিহ্নের ব্যবহার। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা লেখক বা পাঠক হিসেবে আমরা অনেক সময় কম গুরুত্ব দিয়ে থাকি।
৫। এবং সবশেষে অবশ্যই কবির মতামত বা কবিতার মোটিভ
এ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই, রচয়িতা হিসেবে আমরা যে কোনো কবিতার ক্ষেত্রে কখনও "আমি" ,কখনও থার্ড পার্সন ,কখনও শুধুমাত্র এক পর্যবেক্ষকের ভূমিকা নিয়ে থাকি।(এই "আমি" র সাথে ব্যক্তি "আমি" র মিল থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে) এবং কবিতার মোটিভ "আমি" র মুখ থেকে বা উপরিউক্তের মুখ থেকে বলিয়ে নিই, তা হতে পারে সতর্কবাণী, কোনো সমস্যার আপেক্ষিক সমাধান, সমাজের প্রতি কোনো বার্তা, কোনো আশ্বাস, ক্ষোভ বা প্রেরণামূলক বিষয় হতে পারে,আবার হতে পারে কোনো ঐকান্তিক অনুভব (যা মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক, সার্বিক সমাজ বা প্রকৃতি সম্বন্ধিত নয়)
তৃতীয় পর্যায় : ভাবের উত্তরণ
উপলব্ধির শেষ পর্যায়, কিন্তু যার কোনো শেষ নেই;
একটি কবিতা প্রথমবার পাঠ করে যেরকম মনে হয়েছিল, এ পর্যায়ে উপনীত হয়ে, হয়ে যেতে পারে সম্পূর্ণ ভিন্ন, অর্থগত দিকে অথবা ভাবগত দিকে। এবং এই অনুভূতি সময়ের সাথে, জীবনের সাথে ,মননের সাথে পরিবর্তিত হতে পারে কবিতার গভীরতা ও সার্বজনীনতা অনুযায়ী ।অর্থাৎ এটি একটি চলমান প্রসেস, যা প্রতিবার পাঠে মনের ভিতর চলতে থাকে।
এবার আসি লেখকের ভূমিকায়
তিনি তাঁর কবিতাকে কোন পর্যায়ে শেষ করবেন তার ওপর নির্ভর করে পাঠকের কাজ কমবে বা বাড়বে...
উদাহরণস্বরূপ,
* কিছু কিছু কবিতা হয় স্ট্রেট ফরওয়ার্ড, ভাবের টু দ্য পয়েন্ট উপস্থাপন, যেখানে ছন্দ অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে। কারণ এক্ষেত্রে ছন্দের দোলাই পাঠককে একের অধিকবার পড়ার প্রেরণা যোগায়।
** কিছু কিছু কবিতা হয় বর্ণণা মূলক ,সেখানে উপমা অলংকারের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবহার পাঠকের মন জয় করতে পারে।
*** প্রচ্ছন্ন রূপক কবিতা, মূল রূপকটিকে আবৃত করে রাখা, যা না ধরতে পারলেও প্রদর্শিত ভাবকে আশ্রয় করে কবিতাটি ভালোলাগায় উন্নীত হয়ে যায়....
*** আদ্যপান্ত রূপক কবিতা , যার একটি শব্দ বা পংক্তিই কেবল রূপকাশ্রিত নয় বরং সমগ্র কবিতাটি ,অধিকাংশ রূপক কবিতাই বহুমুখী হয়। ঝিনুকের ভেতর লুকিয়ে রাখা মুক্তার মতই শব্দের অন্তরালে যে ভাব লুকোনো থাকে, পাঠক তার সন্ধানের মধ্যে দিয়েই তৃপ্তি লাভ করে, পরিচিত কবি(অবশ্যই কবিতা ভিত্তিক) বা অভিজ্ঞ পাঠক না হলে সামগ্রিক রূপক কবিতার অর্থোদ্ধার কষ্টসাধ্য।
(তাই কিছু কিছু কবিতা বোঝার জন্য প্রথম-দ্বিতীয় পর্যায়টি যথেষ্ট ,সেখানে তৃতীয় পর্যায়ের আলাদা করে কোনো ভূমিকা নেই। কিছু কিছু কবিতার ক্ষেত্রে তিনটি পর্যায়ই প্রাসঙ্গিক ও কিছুটা সময় সাপেক্ষ। অভিজ্ঞ পাঠক হলে কাজটি দ্রুত হয়ে যায় মাত্র। )
এসবের পাশা পাশি আরও যেসকল বিষয় উল্লেখ যোগ্য, তা হল কবির ভাবনার বিচরণ সম্পর্কে ধারণা, যা তৈরি হয় তাঁর অন্যান্য আরও কবিতা পাঠে ধারাবাহিক ভাবে। লিখন শৈলী মৌলিক হলে তা অনেক সময় কবির পরিচয় হয়ে ওঠে।
কোনো কবির সব লেখাই যে সব পাঠকের পছন্দ হবে ,এমন কোনো কথা নেই।
আবার পছন্দ হলে বা ভালো লাগলে সে মনোভাব চিরস্থায়ী হতে হবে, এমন বাধ্যবাধকতা নেই। সাহিত্যের মুক্ত অঙ্গনে মনকে জোর করে কিছু বোঝানো যায় না, হ্যাঁ বোঝানোর পন্থা অবলম্বন করে আমরা ভালোলাগা টুকুকে এক দিশা দেখাতে পারি মাত্র। (তবে অবশ্যই এই বিশ্বাস রেখে, যে কবি যা বলেছেন তা অহেতুক বা অকারণে বলেলনি, সে বিশ্বাস যদি তৈরি না হয় তবে তা বোঝার চেষ্টাই বৃথা)। একজন একনিষ্ঠ পাঠক কখনও নিরাশ হন না।
তাহলে, নিজেকে বা অপরকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত না করে আসুন একনিষ্ঠ পাঠক হয়ে উঠি। ভালোলাগার কবিতা গুলোকে মূল্যায়নের চেষ্টা করি। বোঝা- না বোঝার মধ্যে দিয়ে চলুক পাঠ পরিক্রমা, কে বলতে পারে কখন কোন সময়ে ভাবনার জট খুলে অবাক করে দেবে কোন কবিতা.........
সর্বোপরি , যে সকল কবিতা বারবার পড়তে মন চায় তা রসোত্তীর্ণ, ভালো লাগা পেরিয়ে পৌঁছে যায় হৃদয়ের কাছাকাছি, সে সকল কবিতাই কবির জীবনের সফলতা ও পাঠকের প্রাপ্তি.......
পরিশেষে জানাই, আপনাদের মূল্যবান সময় দিয়ে আলোচনাটি পাঠের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।সবাই ভালো থাকবেন।