ছোট্ট বেলা
মায়ের কোলে শুয়ে বসে আকাশ দেখতাম
মায়ের আঁচল নাড়িয়ে বিশ্ব ঘুরে আসতাম।
মায়ের বুকে আমার রাজা হওয়া দেখতাম।
আমি ছিলাম মা-নেওটা। মা-অন্তঃপ্রাণ
মায়েরও আমি অন্তঃপ্রাণ যেমন সব মায়েরা হয়ে থাকেন।
মা আমার বুকে হাত না রাখলে গুনে গুনে কপাল না চুমলে
রাতভোর কারও চোখে ঘুম আসতো না।
তখন মা ছাড়া অন্য জগৎ আছে বলে জানতাম না।
আমার সামান্য সর্দি-কাশির উপসর্গ দেখা দিলে
মা’র দু’চোখ জেগে থাকা। বদ্যি কবিরাজ ডাকা
দেবদেবতার পূজো, মানত, ঝাড়পোঁছ, নানান টোটকা
নিজেকে উপোষে বেঁধে রাখা। অসম্ভব অস্থির থাকা।
অসুখ-বিসুখ জ্বর-জ্বালা হলে ছড়া-গান গেয়ে
নেড়ে দিতেন আমার শরীর
কঠিন শীতে সর্ষের তেলে রোদের থেকে আরাম তুলে
ডলে দিতেন আমার শরীর।
যখন ছোট্ট থেকে একটু বড় হলাম...
মা’র জ্বর হলে। মা অসুস্থ হলে
মায়ের পাশে এক ঠাই বসে থাকতাম
দু’হাতে প্রণাম করে বারবার বলতাম
হে ঠাকুর মাকে ভাল করে দাও।
মা ভাল নেই মানে
আকাশ নেই। খিদে নেই। পৃথিবী নেই।
আলো নেই। পায়ের তলায় মাটি নেই।
সবকিছু যেন এলোমেলো মনে হতো।
যখন ছোট্ট থেকে আরও একটু বড় হলাম...
মা ভোর বেলা আমাকে বাগানে নিয়ে যেত
আর আঙুল দেখিয়ে বলত...
ওই দ্যাখ সাদা গোলাপ লাল গোলাপ, টগর-বেলি-জুঁই
ওই দ্যাখ ফুটেছে কত রঙের গেঁদা আর সূর্যমুখী
আমার তখন দু’চোখ মায়ের হাতে লাগানো সজনে গাছে
চট করে উঠে যেতাম। এই দেখে
মা আঁতকে উঠত আর বলত পড়ে যাবি।
নেমে আয় নেমে আয়। আমি সজোরে বলতাম
না মা। না মা পড়ব না। পড়লে তুমি তো আছ।
তোমার জন্য ক’খান সজনে তুলে আনি।
তুমি যে সজনে খেতে খুব ভালবাস
আবার না বলে কখনও উঠে যেতাম নিমগাছে
কচি কচি নিমপাতা মায়ের হাতে তুলে দিতাম
মা খুব বকত তোর কী কোন ভয় ডর নেই,
পড়ে গেলে কি হতো বলত!
আমি তৎক্ষণাৎ মা কে জড়িয়ে নিতাম।
মা এক গাল হেসে বলত তুই আর সুবোধ হলি না
কবে যে তোর সুবুদ্ধি হবে। ঈশ্বরই জানেন।
এই ভাবে চলত আমার দস্যিপনা ।
আমার শৈশব আমার কৈশোর
ছুটোছুটির অগুনতি খামখেয়ালীর দুরন্তপনা।
আমার যত অবান্তর আবদার বায়না
আমার চোখে বানানো সামান্য কান্না
মা দেখলেই সত্যি ভেবে এক নিমিষে সব পূরণ করে দিতেন।
এই নিয়ে বাবা কথায় কথায় মা কে কথা শোনাতেন
অকারণে তোমার ছেলেকে দিচ্ছ প্রশ্রয়, একদিন ভুগবে
এখনও সময় আছে। পড়াশোনায় শতাংশ পেলেই হয় না
মা বাবা কে বুঝিয়ে বলতেন বড় হলে ছেলে ঠিক বুঝবে।
যতই সময়কে দেখেছি হতে অনুজ্জ্বল অনুর্বর চোখের সমুখে
ততই তিনি আমাকে আগলে রাখতেন স্নেহ-মমতার শিকড়ে।
মা ঈশ্বর। মা উপমা।
মা সুন্দর, মা ক্ষমা।
যেই একটু একটু করে আরও বড় হলাম...
ছোট কলেজ থেকে বড় কলেজ শেষ করলাম
গোল্ডমেডেল গলায় ঝুলিয়ে
নিজের উত্তরণ নিজেই অনুসরণ করতে শিখলাম।
মোটা টাকার মাইনে পাওয়ার জন্য
আমার বিদেশে পড়ার ইচ্ছে জানালাম মাকে,
মা বলল বেশ তো।
তুমি কি জান এর জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন!
মা বাবাকে জানালেন। বাবা বললেন ঠিক আছে।
আমি কিন্তু বিদেশ থেকে করতে চাই
বাবা বললেন এ তো অনেক খরচ আমার সাধ্যের বাইরে।
মা বাবা কে বোঝালেন ছেলে যখন করতে চায়
দাও না টাকার ব্যবস্থা করে। দরকার পড়লে এ ভিটে মাটি বেচে দাও।
অন্তত ওর জীবনে আর টানাপড়েন থাকবে না।
বাবার অনিচ্ছায় বাবা অবসর নিলেন। নিজেকে নিঃস্ব করে আমাকে
বিদেশ পাঠালেন নিজদের আগুপিছু না ভেবে।
মা জোর না করলে হয়তো হতো না।
কতবার বিরক্তির স্বরে বলেছি মা কে
এবার আমি বড় হয়েছি আর কতদিন আমাকে আগলাবে
কোলে কোলে রাখবে! এবার তো একটু একা একা ছাড়ো।
মা কে স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম...
আমি নিজের কেয়ার আমি নিজেই করতে পারি।
হয়তো সেদিন আমার কথায় মা কষ্ট পেয়েছিলেন।
এক নামী মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে মোটা টাকার
চাকরি পেলাম।
সেদিন মায়ের চোখে দেখেছিলাম অসীম উচ্ছলতা
অবাধ আনন্দ জল।
শেষ সম্বলটুকু দিয়ে থুয়ে
বাবা মা আমার ধুমধাম করে বিয়ে দিলেন
আপ্যায়নের কোন ত্রুটি রাখেন নি।
নিজের গর্ভজাত ছেলের বিয়ে দেখতে নেই বলে
অমঙ্গল হবে জেনে সেদিন মা ঘরেই থেকে গেলেন।
আশ্চর্য বিধির বিধান!
সমস্ত বিধি মেনে মা আমাদের বরণ করে
তুলে নিলেন ঘরে।
মায়ের যতটুকু গয়না ছিল, নিজের
আলমারির দেরাজ খুলে নিজের হাতে
তুলে দিলেন নতুন বৌমাকে আশীর্বাদ স্বরূপ।
কখন যে বড় হতে হতে মায়ের গোছালো ঘর
নিজের হেফাজতে নিয়ে নিলাম।
সংসারের চাবি এক আঁচল থেকে অন্য আঁচলে।
মায়ের আড়ালে মায়ের থেকে দূরে সরে এলাম।
শুধু নিজেরা নিজের মত করে ভাল থাকব বলে
নিজস্ব ভোগবিলাসে ভেসে গেলাম।
বাবা চলে গেলেন, মাকে আমার ভরসায় রেখে।
মা র পেনশন টুকু নিজের প্রাপ্য অধিকার বলে
রেখে দিতেও লজ্জা হল না।
খুব সুন্দর করে আদর সোহাগের ভাণ করে
বলতাম মাকে চিন্তা কর না। যা লাগলে বলো।
আমি আছি। যদিও মা কোনদিন কিছুই নিজের
চাওয়ার ইচ্ছের কথা বলতেন না। জিজ্ঞেস করলেই-
মায়ের মুখে সেই এক কথার আদুরে সুর
তোরা সুখে থাকলে আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারি।
মা নিজের সংসারে নিজের হাতে পায়েস রান্না করে
আমার জন্মদিন পালন করতে ভুলে যেতেন না।
যদিও আমরা সস্ত্রীক নিজেদের
বন্ধুবান্ধব নিয়ে ব্যস্ত থাকতে বেশি পছন্দ করতাম।
মা আমার ছেঁড়া জামা সেলাই করতে করতে
নিজের মনের সাথে গুন গুন করে গান বলত
আমি খেলাম কি না খেলাম দু’বেলা খোঁজ নিতেন।
মায়ের শরীর ভাঙতে শুরু হল
চোখেও কম দেখতে লাগলেন
মা সারা ঘর জুড়ে আমাদের সঙ্গে ছিলেন
আমরা হয়তো ছিলাম না।
মা দিনে দিনে যত নুয়ে পড়ে
ওষুধ পত্রের খরচ তত বাড়ে
মায়ের প্রতি বেশি যত্নশীল হওয়া মানে বাড়তি খর্চা
নিজের সঞ্চয় ভেঙে ভেঙে আর অপচয় করা ঠিক নয়।
আমাদেরও তো নিজস্ব ভবিষ্যৎ আছে।
তাই নিস্তার রেহাই এর পথ খুঁজতে লাগলাম।
মমত্ববোধ মাতৃ চুম্বন আজীবন সন্তানের অবলম্বন
তবুও মায়ের নুয়ে পড়া বয়সের মৃতপ্রায় শরীরকে
নিজের কাঁধে বয়ে নিয়ে যেতে অসহ্য লাগত
আমার মানুষ হওয়ার ইচ্ছে-আকাঙ্ক্ষা
দৈনন্দিন সাফল্যের ফসল নষ্ট না হয় ভেবে
সেই আশঙ্কায় নির্দ্বিধায়
মায়ের শহর ছেড়ে অন্য নতুন শহরে নতুন ফ্ল্যাটে
নিজের ঘর হয়ে উঠলাম। নিজদের মত করে।
শেষমেশ নিঃসঙ্কোচে মায়ের নিরাপদ আশ্রয়
মায়ের বাড়ি, বেচে সবটুকু নিজের ভাগ বুঝে নিলাম।
মা আরও ভাল থাকবেন বলে নামী বৃদ্ধাশ্রমের হাতে
সঁপে দিলাম। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম।
দিন যায় বয়স বাড়ে
শিশুর মত মন কাঁদে
আমার মহার্ঘ ড্রয়িং রুম আর ব্যালকোনি জুড়ে
এক ফোঁটাও রোদ্দুর ফোটে দিন-দুপুর-ভোরে
আকাশের উজ্জীবিত সূর্যালোক আর পড়ে না
আমার ঘরের চকিত পাথরে।
তখন আমার মধ্যে আর খুঁজে পাই না আমাকে
আমার ভেতরের মানুষগুলো কঠিন নির্মম পাকে
জন্মদাত্রীর লালন করতে ভুলে গেলাম কী করে!
তবে কী আমি
মা কে একটু একটু করে নিজের হাতে মেরে দিলাম!
না মারা গিয়েছিল বার্ধক্যের ব্যাধির অযত্নের পীড়ায়!
না একাকীত্ত্বের ধাক্কায়!
তখনও মা মৃত্যুর কোলে ঢলে তোরা ভাল থাকিস বলে
ক্ষমা সুলভ দৃষ্টির ভেতর
আমাদের মঙ্গল চেয়ে নিজের সুখের শেষ এক সুতোটুকুও
আঁচল খুলে বিলিয়ে দিয়ে চলে গেলেন নিঃশব্দে
কিছুই বেঁধে নিয়ে গেলেন না নিজের সাথে।