বহু দিন ধরি বহু দেশ ঘুরি,নিমাই আসিয়াছে আজ জাহ্নবী তীরে।
দলে দলে লোক হরিধ্বনি দেয়,যাইতেছে সবে নিমাই সাক্ষাতে ।
কেবল একটি কুটিরে বিরাজিছে নিস্তব্ধতা , রাত প্রদীপ নেভেনি তখনও,
সেথায় আছেন শচীমাতা আর যুবতী পুত্রবধূ একাকী নিঃসঙ্গ।
ভাসিছে বদন শচীমাতার আপন নয়ন জলে –
শচীমাতা : আজও সে কথা মনে আসে সর্বক্ষণ - ভুলিতে না পারি আমি নিমাইয়ের বদন,যত শোক চেপে রাখি আপন অন্তরে- পাছে তা কষ্টদেয় বিষ্ণুপ্রিয়ারে॥
মনেপড়ে এই আঙ্গিনা মাঝে, গোরাচাঁদ কৃষ্ণসাজে নাচিয়া বেড়াইতো –
মনে ছিল বল আছে মোর দুই সম্বল, দুঃখ করিবে দূর অভাবের সংসারে।
অচিরেই বিশ্বরূপ ত্যাগিলেন সংসার --
মোর স্নেহপাশে বন্দী হইলেন বিশ্বম্ভর
চোখে হারাতে নারি এমনই ছিল ব্যাকুল আমার অন্তর ।
পাঠে ছিলনা মন তাঁর ,ছিলনা মন ঠাকুর দেবতায়।
হঠাৎ পিতৃহীন হইলেন বিশ্বম্ভর ॥
অসহায় আমি করিয়া অনুনয় সঁপিলাম তাকে গঙ্গাদাস পণ্ডিত সকাশে,
মনে ছিল আশা মোর পুত্র হইবে বড় পন্ডিত একদিন নিশ্চয়॥
রূপে গুনে নিমাই করিলেন জয় সকল হৃদয়--
মনে ছিল সংশয় ,বাঁধিতে হইবে তাকে স্ত্রী পুত্র পাশে॥
স্ত্রী রূপে পাইলেন বিশ্বম্ভর এক রূপবতী রাজপন্ডিত কন্যা,
রূপে গুনে অতুলনীয়া,নাম বিষ্ণুপ্রিয়া ॥
করিতে পিন্ডদান যাইলেন গয়াধাম, ফিরিলেন নিমাই যেন অন্য রূপে,
মন নেই তার আর কোন কাজে,সদাই ব্যস্ত নিমাই ভাবের জগতে,
মুখে কৃষ্ণনাম,ঝরে অশ্রুবারি অবিরত ॥
অবশেষে এলো সেই দিন,যাহা করিতাম ভয় সর্বক্ষণ
অনুমতি চাহিতে এলেন নিমাই,ত্যাগিবে সংসার ধর্ম হবেন সর্বত্যাগী ॥
শচীমাতা : কেমনে সামলাইবো আমি পুত্রবধূরে ?
সদ্য যুবতী তিনি,কোমল হৃদয়,তব পানে চেয়ে আখি তার দিন যায়।
নিমাই : আমার হৃদয় হইয়াছে চঞ্চল,ত্যাগিয়াছি সর্ব আকর্ষণ এই পার্থিব সংসারে ।
অনুমতি দাও মাগো , ত্যাগিতে সংসার আজই !
শচীমাতা : রাজপন্ডিত কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়া -- দেখেনাই অভাব সংসারে,কেমনে চলিবে সংসার তুমি চলেগেলে॥
পিতৃহীন পুত্র তুমি - শতচেষ্টা করিয়াছি আমি,যাতে না বুঝিতে পারো পিতার অভাব।
সুপন্ডিত তুমি - দিকে দিকে খ্যাত তুমি আপন পরিচয়ে,তোমারে গুরু রূপে পাইবারে টোলে আজ স্থান সংকট।
তাই বলি,বিচার কর শুনিয়া মোর বাক্য - আরও একবার॥
নিমাই : আমার অন্তরে নাই আর কিছু অবশিষ্ট,যা আমি দিতে পারি আমার প্রিয়ারে।তুমি মোর মা,আমার অন্তরের ব্যথা আর কে-ই-বা বুঝিবে ভাল এই সংসারে ?
দাও অনুমতি মাগো - যাতে মিলিতে পারি আপন প্রাণের ঠাকুর সাথে।
শচীমাতা : চাহিতে পারি না আমি তাঁর মুখপানে -
বৃন্তচ্যুত হইলে পুষ্প যেমনে হারায় শোভা, নিমাইবিনে বিষ্ণুপ্রিয়ার তেমনি হইবে দশা। স্বামীহারা পুত্রহারা আমি একাকিনী , পুত্রস্নেহে অন্ধ আমি অভাগিনী
কেমনে ভুলিব তোমাকে পাইলেও স্বর্গসুখ এই ধরাতলে ?
নিমাই : মাগো, যে শরীর দেখিতেছো তুমি নিমাই বলে,ত্যাগীয়াছে মন সেই হতে -তাই বলি, দুঃখ পাইওনা আর অনুমতি কর ছাড়িতে সংসার॥
শচীমাতা : অবশেষে নিমাই ছাড়িয়া সংসার ধর্ম নিলেন সন্ন্যাস -- প্রকাশিলেন শ্রীচৈতন্য নামে পূর্ণব্রম্ভরূপে আপন ভক্তগণে --উদ্ধারিলেন জগাই-মাধাই আরও বহুজনে,সিক্ত করিলেন দেশ হরিনাম গানে॥
হরিনামে হইবে জীবের উদ্ধার এমনি ছিল তাঁর বিশ্বাস, প্রচার করিলেন তাহা দেশ দেশান্তরে ॥