কাদম্বরীর ডাইরি
বরুণ হালদার
আমি মাতঙ্গিনী,
স্বামীর সোহাগী হয়ে যেদিন ঠাকুর বাড়িতে এসেছি,
সেদিন আমার বয়স নয় বছর, রবির বয়স সাত,
আর আমার স্বামী দেবতা উনিশ বছরের পুরুষ।
নতুন জামা কাপড়, সোনার গয়না,
দুর্গা পূজার প্যান্ডেলের মতো সাজানো বড় বাড়ি,
প্রথম দু-একদিন আমার খারাপ লাগে নি,
পরে বুঝলাম বিয়ে মানে
নিজেদের ঘর, খেলার উঠান, আদরের বিড়াল, এমনকি বাবা মা ও দিদি দের ছেড়ে অন্য বাড়ি এসে থাকা।
স্বামী নামক ওই উঁচু লম্বা লোকটির কাছে বসতে আমার ভয় লাগতো,
সাত বছরের রবি ছিল আমার খেলার সাথি।
গৃহ শিক্ষকের কাছে একসাথে পড়াশুনা শিখতে শিখতে,
ঠাকুরবাড়ির লম্বা বারান্দায় চু-কিত কিত খেলতে খেলতে,
বড় হচ্ছি আমরা দুজন।
স্বামী দেবতার গলার আওয়াজ পেলে, দুজনেই ভয়ে লুকাতাম দরজার পিছনে।
আমাকে ধরে এনে খাটে বসিয়ে
আদুরে কন্ঠে বলতো,
কিরে কদম ?
আমাকে দেখে ভয় পাও কেন,
আমি কি বাঘ না ভাল্লুক ,
আমি তোমার স্বামী হই গো, স্বামী,
অমনি এক দৌড়ে চলে যেতাম অন্য ঘরে।
আমি বড় হচ্ছি সহপাঠী রবি বড় হচ্ছে,
সে নতুন কিছু লিখলেই প্রথমে আমায় শুনাতো।
শুধু কি তাই, সান বাধানো ঘাটে বসে, দোতলার ব্যালকনিতে বসে রবির মুখে কবিতা , গল্প, নাটক শুনতে শুনেতে, তার প্রতিভায় বিস্মিত হতাম।
জমিদার বাড়ির শিক্ষা, সংস্কৃতি, রক্ষণশীলতা, অনুশাসন, স্বামী দেবতার বীর বিক্রমে ওই বাড়ি আমার কাছে বদ্ধ খাঁচা মনে হতো।
অপরদিকে দু বছরের ছোট দেওরের সাথে শ্রদ্ধাশুলভ বন্ধুত্ব, সে ছিল আমার দক্ষিণা জানালা।
বড় হলাম স্বামী সংসার বিষয়টি বুঝতে পারলাম,
আমার থেকে এত বছরের বড় পুরুষটিকে জমিদার ছাড়া অন্য কিছুই মনে হয়নি কোনদিন।
কারণ লেখালেখি , জমিদারি, সেরেস্তা, খাজনা, হিসাবের খাতা ছাড়া অন্যদিকে মন দেওয়ার মতো সময় তাঁর ছিল না।
যে মানুষটির নামে শাঁখা সিঁদুর পরে আছি,
সে মানুষটির সাথে কথা বলতে হতো হিসাব করে, ভয়ে ভয়ে, অতি সঙ্কোচে।
আমার মনে বিকশিত শ্বেত শুভ্র খাতায় রঙিন ছবি আঁকার সময় কই,
সে ব্যস্ত থাকতো নাটকে সঙ্গীতে মুখ গুঁজে।
সময় চলতে থাকে,
এক সময় আমার খেলার সাথী, সহপাঠী, বন্ধু, প্রিয় দেওরটির বিয়ে ঠিক হলো।
আমার মনে হতে লাগলো,
বিয়ের পরে রবি হয়তো আর আগের মত
কবিতা গল্প শোনাতে পারবেনা।
অগ্নি সাক্ষ্মী করা স্বামী
আমার মন কোনদিনই বুঝল না,
হতাশার মধ্যে
রবির গল্প, কবিতা, নাটক আমার বাঁচার রসদ।
ষোল আনা জমিদারকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারিনি আমি,
অপরদিকে রবির বিয়ের পরে, সেভাবে আর গল্প কবিতা শোনাই হতো না,
আমার দম বন্ধ হয়ে আসতো।
এই দুই হতাশায় আমি রাতের পর রাত ঘুমোতে পারিনি, কতো রাত ভোর হয়েগেছে !
আমার স্বামীর কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না সে ব্যাপারে।
একসময় কঠোর সিদ্ধান্ত নিলাম ,
তার আগে মনের কথা লিখে যাই ডাইরির পাতায়,
অধিক বয়সী মানুষটিকে স্বামী হিসেবে আমি কোনদিনই মেনে নিতে পারিনি।
রবির সাথে আমার শুভ্র সুন্দর বন্ধুত্ব,
বস্তু জগতের ঊর্ধ্বে প্রেম,
বিদেহী প্রেম কামনা বাসনার থেকে অনেক দামী, যেমন প্রেম ছিল শ্রীকৃষ্ণ ও মীরা বাইয়ের ,
আমাদের মধ্যেও ছিল স্বর্গীয় টান।
আমার মৃত্যুর পরে
জমিদার বাড়িতে শোকের ছায়া নামবে,
পাড়ায় পাড়ায় কানাকানি হবে,
কোন একদিন রবীন্দ্র গবেষকেরা
আবিষ্কার করবেন,
আমার হাতে লেখা এই সুইসাইড নোট,
সেদিন, সদিন নিশ্চয়ই অণুমেয় ভুল ভাঙবে সকলের।
... ... ... ...