বুদ্ধের ভায়োলিনঃভায়োলিনে নিবদ্ধ একান্ত গুপ্তচর

অয়ন্ত ইমরুলের কবিতার বিশেষ প্রবণতা হল,আমাদের জীবনাভিজ্ঞতার বাইরের আঘাতকেও প্রচ্ছন্নভাবে ধরার একটা আকাঙ্ক্ষা।চেনা শব্দের বুননে তৈরি অচেনা ভাষায় সেইসব আকাঙ্ক্ষাকে তিনি ছুঁয়ে দেন ইন্দ্রিয়প্রধান জাগতিকতার বাইরে গিয়ে।তার কবিতা সরাসরি সাময়িকের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বর্ণনা নয়,আড়ালপ্রিয়তার ভেতর দিয়ে সামগ্রিক ঘাত-প্রতিঘাতের গভীর এক অনুরণন।অনেকটা অ্যাবসার্ড শিল্পের মত--যে যার মত অর্থ করে নিতে পারে,যার যার জীবনাভিজ্ঞতার প্রতিফলন সেখানে নিজেদের মত করে দেখতে পায়।তার কবিতায় আছে সেই প্রিজমের ব্যবহার, যেখানে লাল,নীল,সবুজ প্রত্যেক রঙই নিজেদের আলাদাভাবে খুঁজে পায় কিন্তু প্রিজম সরিয়ে নিলে বাইরে থেকে তাদের চেনা খুব কঠিন হয়ে পড়ে।

'মাতৃভূমি' কবিতায় পাওয়া যায় প্রথাগত বৃত্তের প্রান্তস্পর্শী সেই বধির করা কম্পনের অনুভব,যেখানে  এসে এক হয়ে গেছে প্রকৃতি,সুষমা ও মৃত্যুর নিশ্চলত...

তুমি পাথর হলেই,শব্দ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পাখি ও নদী,
আকাশের শপিংমলে ঘোরে মেঘের ঘাঘরা
আমার মুখ থেকে আলগোছে সটকে পড়ে নলারোদ।
তুমি পাথর হলেই, মূর্তিতে নিবদ্ধ দেবতা,রাত্রির অবতলে অন্ধ অজগর--
অন্তর্মুখে হননের বাক-সুষমা,
আমাকে মূক ও বধির করে মৃত্যু সম্পাদনা করে
আশ্চর্য সব সরীসৃপ।

(মাতৃভূমি)

প্রাকৃতিক চিত্রকল্পের সাথে স্মৃতিজাগানিয়া কৈশোরিক মুগ্ধতা তার কবিতার প্রধান উপজীব্য।কবিতায় প্রায়ই ব্যবহার করেছেন রইরই,শাঁইশাঁই,ফিকফিক,খলবল,বাঁইবাঁই,ক্রিংক্রিং ইত্যাদি অনুকারধ্বনি।ফলে কবিতার ঘোরলাগা রহস্যের ভেতর তা জন্ম দিয়েছে বিশেষ এক ব্যঞ্জনা, দৃশ্যকল্পনার  স্বাধীনতার সাথে সাথে পাঠক অনুভব করেছেন কিছুটা শ্রবণকল্পনার স্বাধীনতাও।যেমন--

এইসব জলসাঘরে অমাবর্ষার ঋভু
জুলপি ভিজিয়ে পান করে মধুঅমৃতার দেহ
আর আমার মর্মরহীন মর্মরমূর্তি ঘিরে স্বহাস্যে লাফিয়ে ওঠে রিও টিনটোর জলঃ
এখানে রইরই ও বাঁইবাঁই করে ঘৃতকুমারীর বেণি ভেজানো দিন

(ড্রাগন বসা কাঠের নকশায়)।

এভাবে কল্পনা ও অনুভবের স্বাধীনতা থাকায় তার কবিতা হয়ে ওঠে সবধরনের মানুষের অভিজ্ঞতার আধার।সঙ্গত কারণেই দুর্বোধ্যতার অভিযোগও ওঠে এসব কবিতা সম্পর্কে,যেহেতু স্পষ্ট কিছু না বুঝিয়ে জীবনকে আলাদা পাত্রে নিয়ে তাকে ভিন্নভাবে সৃষ্টির একটা প্রক্রিয়া সেখানে থাকে।

কবিতাগ্রন্থে গ্রামীণ জীবনের নানা শব্দের সাথে প্রয়োগ আছে প্রচুর ইসলামিক শব্দের।ইসলামিক এই শব্দসমূহ কোথাও ধর্মীয় ঐতিহ্যকে ধারন না করে তা পুরোদমে অনুগত হয়েছে সামগ্রিক কবিতার।কবিতার শব্দগুলো মূলত আমাদের পরিচিত শব্দজগত থেকেই নেয়া।ফুল,চাঁদ,বর্ষা,আকাশ,রামধনু প্রভৃতি রোমান্টিক ধাঁচের শব্দগুলোকে আধুনিকতার দোহাই দিয়ে মোটেও অবহেলা করেননি তিনি।আবার শব্দগুলোর ব্যবহার ঠিক রোমান্টিক কবিতার মতোও হয়ে ওঠেনি কবিতায়।যেমন--

বর্ষা আসে,বর্ষা যায়,
শর্করা দানার মতো ফর্সা হয় যুবতীরা
কদমতলে ভাঙে আমার এহ্তেকাফ।
*        *           *          *          *          *
রূপকে আসে রূপের রুহিতন,
ক্রমে ক্রমান্বয়ে মাংসের চেতনায় উন্মত্ত হয় আকাঙ্ক্ষা;
মারফতে ডাকাতি হয় আমার বিদ্যা ও বিজ্ঞান।

(বর্ষা আসে,বর্ষা যায়)

কবিতাটিতে কপট সভ্যতার শ্লেষাত্মক ইঙ্গিতকে প্রকট করে তোলেছেন তিনি। অনুরূপভাবে 'ক্বাবার পিপাসা' ও 'নিরব নামছে' কবিতায়ও দেখা যায় ইসলামিক শব্দের যথেষ্ট ব্যবহার।এছাড়া জাপানি শব্দ ইকেবানা সহ ক্রিমসন,ম্যাচমেকার,ফ্লেক্সিবল,এ্যারোমেটিক,আইস সিম্ফনি,কম্প্রেশন ইত্যাদি ইংরেজি শব্দও ব্যবহৃত হয়েছে তার কবিতায়।তার বেশিরভাগ কবিতাই ক্লোজ এন্ডেড ও বহুরৈখিক।তবে সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে লেখা 'বুদ্ধের ভায়োলিনে' ও 'সূচির সূচিরোমা' কবিতার মত কিছু একরৈখিক ও ওপেন এন্ডেড কবিতাও আছে।'রিও টিনটোর পাশা' কবিতাটি আবার একরৈখিকতার পথে চলতে চলতে শেষের দিকে এসে বাঁক নিয়েছে বহুরৈখিকতার দিকে।বাঘ ও হরিণের উপমায় মার্ক্সবাদী দর্শনের প্রকাশ ঘটেছে 'এম ইন লাইফ' কবিতায়,'রক্তে ঝাঁকি দিচ্ছে বককধার্মিক' ও 'প্রাঞ্জল দিবসের কবিতা'র কিছু অংশে বিমূর্ত গল্পের আড়ালে ফুটিয়ে তোলেছেন সময়ের অস্থিরতা ও যুগের পুঁতিগন্ধময় যন্ত্রণাকে।সেইসাথে 'চিঠির মায়াবী মানুষ' কবিতায়...."সংলগ্নতার মাঝে অবাক কাকতাড়ুয়া/মায়াবী মানুষ"--পঙক্তিতে চিহ্নিত করেছেন মানুষের  করুণ ও রূঢ় বাস্তবতাকে।

কবিতাগ্রন্থে বাক্যের শব্দ ব্যবহারে বেশকিছু নতুনত্ব দেখা যায়।বাক্যের অর্ধেক পড়ে অধিকাংশ সময়ই অনুমান করা যায় না তার পরের অংশকে।তাই পাঠক বিচিত্রতার স্বাদ পান এক্ষেত্রে।সেই সাথে অভিযোগ আছে তার কবিতার বিচ্ছিন্ন পঙক্তি নিয়েও।কবিতায় কতগুলো চিত্রকল্প রঙিন মার্বেলের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে,অধিকাংশ সময়ই সেখানে সংযোগের দৃঢ় সুতো থাকে না বলে তাকে মালা করে চিরকালীন সামগ্রী করা যায় না।খেলা শেষে ফেলে যেতে হয় অথবা সাথী হয় শুধু খেলার স্মৃতিটুকুই।তবে খুবই দৃষ্টিননন্দন আর মনোমুগ্ধকর এইসব রঙিন মার্বেলসমূহ।অনেক সময় কবিতায় ছড়িয়ে থাকা অনুভূতির বিক্ষেপণগুলো কেন্দ্রীভূত নয় বলে পাঠকের মনে সমগ্র ছবিটি স্পষ্ট হয় না।যেমন--

এভাবে ছু্ঁয়ে যায় মধুমাছির হুল--
সে এক ভিন্ন পৃথিবীর;ক্রমে ওঠে বিস্তার,
ককিয়ে ওঠা ঘড়িয়ালের ঘন্টার ঢেউয়ে ভেসে যায় বহু শবের দেশ--
সে এক ভাতের চামেলি;
তার চুপকথায় চইচই হাঁসগুলো হারিয়ে ফেলে লীলায়িত ভঙ্গির হাঁটা।

এখানে মধুমাছি,ঘড়িয়াল,চইচই হাঁস ও ভাতের চামেলির চিত্রকল্প একধরনের মুগ্ধতা ছড়ালেও পারস্পারিক বৈসাদৃশ্যের কারণে তা সমস্ত উপাদান নিয়ে কবিতায় অর্থময় হয়ে ওঠেনি।সেই সাথে চিত্রকল্পসমূহের মধ্যে শক্ত গাঁথুনি না থাকায় তা এলিয়ে পড়েছে একেক দিকে,পূর্ণাঙ্গ রূপমাধুর্য নিয়ে তার বিকাশ ঘটেনি।কবিতার পরবর্তী পঙক্তিগুলোর সাথেও স্থাপিত হয়নি যথাযথ সংযোগ--

"আমার উদ্বিগ্নতা--
নূপুরের  জ্যোৎস্নায় তোমার উদ্যত পা থেকে খুলে রাখো সুখতলা।
এদিকে ওলাবিবির পিরান--
অনায়াসে লুকিয়ে ফেলে আমায় তার
ঢিলেঢালায়।

(নূপুরের জ্যোৎস্নায়)

কবিতাগুলো পাঠককে সহজ রাস্তায় কিছুদূর এগিয়ে নিয়ে তারপর তাকে নিয়ে কানামাছি খেলার পরিবর্তে শুরুতেই বেধে ফেলে একধরনের রহস্যের ভেতর।ফলে অনেক পাঠকের পক্ষে এসব কবিতায় প্রবেশক্ষমতা দেখানো কঠিন।পাঠকের মনকে কিছুটা কল্পনাপ্রবণ করে নিয়ে তারপর রস নিতে হবে এইসব কবিতার।কবিতার ভেতরে গিয়ে হয়তো তা আরও গাঢ় হবে,কিন্তু শুরুতেই কবিতার কাছ থেকে কল্পনার কোন সাহায্য তিনি পাবেন না।এতে করে কবিতার চিত্রকল্পগুলো অসংলগ্ন বলে মনে হলে খুব বেশি দোষ দেয়া যাবে না পাঠককে।পাঠকের জন্য আরও কিছু প্রবেশাধিকার রাখতে হবে কবিকে।অয়ন্ত ইমরুলের 'বুদ্ধের ভায়োলিন' কবিতাগ্রন্থের বেশকিছু কবিতা এক্ষেত্রে পাঠকের প্রবেশাধিকারকে অতিরিক্ত সীমাবদ্ধ করেছে।তবে তার কবিতা সবসময়ই পাঠকের কাছে খুব বেশি মনোযোগ ও সম্প্রসারণশীলতা দাবী করে।

তার 'কৈশোর' কবিতায় কৈশোরিক স্মৃতিময়তার সাথে  প্রাকৃতিক চিত্রকল্পের ব্যঞ্জনায় ফুটে ওঠেছে জীবনের জয়-পরাজয় ও ঠিকানা বদলের আখ্যান...

ডাস্টার সরিয়ে রাখে,ব্লাকবোর্ডের বুক থেকে,খড়িমাটির সুখগুলো।
পাইন আলোকাবৃত্তে,একটা পাঠশালার,অসমাপ্ত ঘূর্ণন।
কিছু কচিচোখের ফড়িং থেকে এরোপ্লেন ওড়ে,
রক্তিম আভার তল ছুঁয়ে
খুব দ্রুত দিগন্তে মিলিয়ে যায় কতগুলো সাপঘুড়ি--
কারো বিশেষ মশলা মিশানো সুতোর কাছে পরাজিত হয়ে গোত্তা খেয়ে পড়ে
দূর কোন জঙ্গলে,দূর কোন পাহাড়ে।

(কৈশোর)

'স' ও 'ফ' ধ্বনির অনুপ্রাসে আমাদের তন্ময়তার ভেতর একইভাবে বিশেষ দ্যোতনা দেয় তার 'তোমার বাড়ির পাশ থেকে' কবিতাটি...

তোমার বাড়ির পাশ থেকে সড়ক সরে গেলে
বোবা হয়ে যায় সাইকেলের বেল
টেলিগ্রাফের তালে ঘনিষ্ট ফালগুনের ফাঁকতালে
ঝোঁক হারায় লেজঝোলা ফিঙে
ব্যালকনির পায়চারি থেকে হাওয়া হয় কিছু রামধনুর আকাশ
*     *      *      *      *        *          *          *    
শীতকাল ঘনিয়ে আসার পূর্বেই
বিছানার দুপাশে বালিশগুলো বড্ড শীতল হয়ে থাকে--

(তোমার বাড়ির পাশ থেকে)

শেষ পঙক্তিতে ঠাণ্ডা বালিশের চিত্রকল্প সত্যি আমাদের অনুভূতিতে শীতল এক স্পর্শ বুলিয়ে যায়।লক্ষ্যণীয়,অনুপ্রাস রাখতে গিয়ে 'সরে' শব্দের সাথে রাস্তা এর পরিবর্তে 'সড়ক' শব্দের ব্যবহার ও 'ফালগুনের' সাথে 'ফাঁকতালে' শব্দের ব্যবহার।একইভাবে 'ঝোঁক হারায় লেজঝোলা ফিঙে'..কথাতেও 'ঝ' ধ্বনির একটা অনুরণন শুনা যায়।আবার 'পাখির রাংয়ে রাংচিতা' কবিতায় পাই 'র' ও 'ব' ধ্বনির অনুপ্রাস...

কেউ পাখির রাংয়ে রাংচিতা দেখে
রক্তবমি করে কিছুক্ষণ হাঁফিয়ে নিয়ে
বাজানো বার্ধক্যের বিউগলে কান পেতে দিল মধ্যাহ্নঘুম।

(পাখির রাংয়ে রাংচিতা)

এভাবে প্রায় সব কবিতাতেই পাওয়া যায় ধ্বনিগত অনুপ্রাসের ব্যবহার যা তার কবিতায় ধ্বনিমাধুর্যের এক অনুনাদ সৃষ্টি করে।কবিতায় ঝাঁকঝাঁক,কখনোসখনো,ঝড়তিপড়তি ইত্যাদি দ্বিরুক্ত শব্দ ও পদের ব্যবহারও একইভাবে কবিতার সংঘাতকে ব্যঞ্জনাধর্মী করে তোলে।তাছাড়া প্রচ্ছন্ন ভাবের পাশাপাশি রোমান্টিকতার প্রকাশ্য ইঙ্গিতও পাওয়া যায় 'প্রজাপতি,ধৈর্যের ওজন' নামক কবিতায়...

প্রজাপতি,
তোমার হৃদয় সড়কে জটিল জ্যামে আটকে আছি
ধৈর্যের ওজন মাপা শেষ হলে সবুজ বাতি জ্বালিয়ে দিও।

(প্রজাপতি,ধৈর্যের ওজন)

দুই

আড়াল তার কবিতার প্রিয় অনুষঙ্গ হলেও সমসাময়িক বিষয়সমূহ একদম এড়িয়ে যায়নি কবিতায়।সমকালীন রোহিঙ্গা ইস্যু যেমন এসেছে,ঠিক তেমনি কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে সামাজিক দাসত্ব,শোষণ ও যুগযন্ত্রণার প্রতিকর্ষও...

পীড়িত শব্দের পাশে হাঁটু মুড়ে বসি,
আমার ভিতর দাস ও দশার প্রতিকর্ষ--
টানে শহর,টানে গ্রাম।
প্রত্যহ আমার অঙ্গ-প্রতিঅঙ্গ
শৃঙ্খলের শিকল পড়ে নৃত্য করে
কৌতুকজলসায়--

(দুঃখী শব্দাবলী)

কবিতায় মাঝে মাঝেই পাওয়া যায় ইমপ্রেশনিজম ও এক্সপ্রেশনিজমের ব্যবহার।শব্দ ও গন্ধের চড়া কারুকাজে কল্পনার ঘুড়ি ছেড়ে দেয়া  ইমপ্রেশনিজমকে ধারন করে এমন কিছু পঙক্তির উদাহরণ--

কোথাও,মাদকতা ছড়ায় নাগকেশরের
ফুলের ঘ্রাণ :
দৃশ্যত মাথা লাটিমঝিম--
ঝিমের ঝুমঝুমিতে হেসে ওঠে নেকটাই পড়া মঙ্গোলয়েড।

(পুরোপুরি ডুবিনি)

আবার কখনও স্পষ্ট প্রকাশকে এড়িয়ে মিহি রঙের ব্যবহারে আঁকেন হার্দিক সব অনুভূতি,যা এক্সপ্রেশনিজমের ইঙ্গিত দেয় কবিতায়...

হলুদ কথা বলে পাতার শরীরে,
এভাবে বলো না অরূপ রূপের কথা--
তোমার কোলের কাছে পেশি শিথিল হয়ে আসে।
এভাবেই তো বিড়ালঘুম,
এভাবেইতো সন্ধ্যা,চুম্বন রাখে কপোলে।

(এভাবে বলো না)

কবিতায় প্রতীকি উপাদান বিদ্যমান থাকলেও,জাদুবাস্তবতা ও প্রতি কবিতার ইঙ্গিত খুব একটা পাওয়া যায় না।

অয়ন্ত ইমরুলের 'বুদ্ধের ভায়োলিন' এ ব্যবহৃত হয়েছে দেশীয় ঐতিহ্যকে ধারন করে এমনসব চিত্রকল্প এবং সেখানে ব্যবহৃত হয়েছে দেশীয় নানা পাখি,ফুল,জন্তু ও ফলের নাম।এই শব্দগুলো তার কবিতার সার্থক প্রকাশের অভাবকে কিছুটা হলেও ঘুঁচিয়ে দিয়েছে,যেহেতু আমাদের দৈনন্দিন জীবনের যাপন,মুগ্ধতা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার সাথে প্রতিনিয়ত শব্দেগুলোর একটা সম্পর্ক রয়েছে।ব্যবহৃত এমন কিছু শব্দের উদাহরণ এখানে দেয়া হল--

পাখিঃবক,মাছরাঙা,পায়রা,ফিঙে,ঘুঘু
কীটপতঙ্গঃবেলেমাছি,প্রজাপতি,ফড়িঙ,জোনাকি,ডেঁয়ো পিঁপড়ে,মশা,কাঠপোকা
ফুলঃজুই,গোলাপ,মোরগফুল,রক্তকরবী,সন্ধ্যামালতি
ফল ও সবজিঃটমেটো,ডালিম,তরমুজ
সরীসৃপ প্রাণীঃগোখরো,কুমির,ঘড়িয়াল
মাছঃইলিশ,কালবোস
অন্যান্য জীবজন্তুঃভামবিড়াল,হুলোবিড়াল,কচ্ছপ,খরগোশ,বাঘ,সিংহ,উট,কাঁকড়া ইত্যাদি।

এছাড়া আছে ভারতীয় সঙ্গীতের বাদ্যযন্ত্র এসরাজ এবং ঐতিহাসিক স্থান হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোরও নাম।এইসব অনুষঙ্গের ব্যবহার তার কবিতাকে বিশেষ মাত্রা দিয়েছে।ফলে কবিতা পড়ার সময় পাঠক অনুভব করতে বাধ্য হয়েছেন বিচিত্র চিত্রকল্পের কারুকাজ।

কবিতাগ্রন্থের বেশিরভাগ পঙক্তিই প্রবহমান।দুই থেকে চার-পাঁচ লাইন পর্যন্ত গড়িয়ে যায় পূর্ণাঙ্গ একটি পঙক্তির ভাব।বেশিরভাগ কবিতার দৈর্ঘ্য ১৫ থেকে ২০ লাইনের মধ্যে সীমাবদ্ধ।'উড়াল' শিরোনামের সর্বনিম্ন ৮ লাইনের কবিতা থেকে শুরু করে 'গেলাডুব' এর মত ২৮ লাইনের কবিতাও আছে,তবে কোন দীর্ঘ কবিতা নেই।ছয় থেকে সাত বা কোথাও দশ থেকে বারো শব্দের বাক্য দ্বারা সজ্জিত লাইনের মাঝে মাঝে তিনি ঢুকিয়ে দিয়েছেন দুই থেকে তিন শব্দের কিছু ছোট লাইনও।ফলে আঙ্গিকগতভাবে কবিতা পেয়েছে বৈচিত্র‍্যতা,বিষয়ের সাথে আঙ্গিকের সম্পৃক্ততা এ ক্ষেত্রে মোটামুটি সার্থক হয়েছে বলে মনে করি।

কবিতায় দৃষ্টিগোচর হয় অভিনব কিছু শব্দ সমবায়।যেমন-হাঁসকল,আলোকল,প্রস্থানপ্রিয়তা,প্রপঞ্চদিন,ঘনিষ্ট ফালগুন,পাতার প্রপেলার,উপদ্রুত বায়োলজি,পোলিওবৃষ্টি,ইচ্ছেবাঁশি,গেলাডুব ইত্যাদি।দক্ষতা দেখিয়েছেন নতুন নতুন চিত্রকল্পের ব্যবহারেও। উল্লেখ করছি তার স্বকীয়তাকে ধারন করে এমন কিছু পরাবাস্তব চিত্রকল্প...

ক.মৃত্যুর ভিতরে আমি পার হয়ে এসেছি কাঠকয়লার দিন
খ.একদিন আমরা খুব করে মনে করবো,অতীত-- তরমুজকাটা ত্রিভুজ
গ.এবার উজান স্রোতে ছেড়ে দেব ইলিশজীবন
ঘ.ইশারার বাল্বে আলোকিত হয় অতসীর তিথি
ঙ.দোয়াতের পাতালে জেগে উঠছে ইতিহাসের জলবাগ
চ.মায়াবিল হেঁটে আসে সাদা বকের দাঁড়ানোর ভঙ্গিমায়

বিশেষ কোন পঙক্তি তার কবিতার সারাংশকে ধারন করে না বরং তার উপাদান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সমস্ত অংশে থাকার কারণে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কবিতার বিস্তৃত অংশ তুলে ধরতে হয়।এটাও তার কবিতার একটা বৈশিষ্ট্য।

কবিতাগ্রন্থের বিভিন্ন কবিতায় বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যুক্তাক্ষরের ব্যবহার।স্থানে স্থানে এভাবে যুক্তাক্ষরের ব্যবহার আচ্ছন্ন বোধের দেয়ালে সজোরে ধাক্কা দেয় যেন।স্বভাবতই চিন্তার স্বাধীনতা আছে এসব কবিতায় কিন্তু কোথাও কোথাও ভেঙে পড়েছে যুক্তির শৃঙ্খলা।তবে তার চিত্রকল্পগুলো বোধজাতক,কারণ খন্ডিত হলেও তা আমাদের চেনা জীবনেরই অংশ।কোথাও কোথাও পূর্ববর্তী কবিদের কবিতার স্মরণীয় পঙক্তি থেকে শব্দ সমবায় ব্যবহার করতেও দ্বিধা করেননি তিনি।যেমন-'এই চলা চিহ্ন রেখে কবিতায়.."আমার সোনার বাংলাঃ/উচ্চারণে আবার কেঁপে উঠুক হিমালয়" অথবা 'রাঙাবাস' কবিতায়..."..পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়--/তার ভূপৃষ্ঠে রিও টিনটো ক্রমশ স্রোতে স্রোতে স্রোতঃস্বতী"। পঙক্তিগুলোয় সুকান্তের কবিতার শব্দ সমবায় ঢুকে গেছে অনায়াসে।কবিতার ভাবকে পূর্ণতা দিতে অগ্রজের ঋণগ্রহণে এক্ষেত্রে তিনি সামান্য কুন্ঠিত নন।যেন এই কবিতাগুলোয় কবিতাই লক্ষ্য,ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র রক্ষা সেখানে গৌণ ব্যাপার মাত্র।

উপমা ও উৎপ্রেক্ষার চেয়ে রূপকের ব্যবহারে চিত্রকল্প নির্মাণে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন তিনি।ছন্দের ক্ষেত্রে আধুনিক কবিতার প্রধান ছন্দ অক্ষরবৃত্তকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।৫৬ টি কবিতার মধ্যে একমাত্র 'পুণ্যশ্লোক' কবিতাটি স্বরবৃত্তে লিখেছেন,বাকিসব অক্ষরবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্তিক মেজাজের গদ্য কবিতা।'জারুল জারুল সময়' ও 'রিও টিনটোর পাশা' কবিতার শুরুতে মাত্রাবৃত্তের দোলা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা মিশে গেছে অক্ষরবৃত্তেই।বাংলা কবিতায় মাত্রাবৃত্তের সুযোগকে ব্যবহার করে উৎকৃষ্ট কবিতা লেখার নজির যখন খুবই কম,তখন এ ছন্দেও উল্লেখযোগ্য কিছু অবদান রাখতে এগিয়ে আসতে হবে অয়ন্ত ইমরুলের মত তরুণ কবিদের।ভবিষ্যতে আমাদের সে প্রত্যাশা তার কাছে থাকবে।

'বুদ্ধের ভায়োলিন' অয়ন্ত ইমরুলের দ্বিতীয় কবিতাগ্রন্থ।বইটির নান্দনিক প্রচ্ছদ করেছেন আইয়ুব আল আমিন।প্রকাশকঃমাইবম সাধন,তিউড়ি প্রকাশন।৬৪ পৃষ্ঠায় ৫৬ টি কবিতা সংবলিত বইটি পাওয়া যাবে ২০১৮-র একুশে বইমেলায়।

অতি আড়ালের অভিযোগের পাশাপাশি বর্তমানের ক্ষয়প্রবণ সংসর্গগুলো থেকে তিনি কবিতাকে বাঁচিয়ে নিয়ে গেছেন কৌশলে। ফলে সময় পেড়িয়ে গেলেও কবিতাগ্রন্থের বেশকিছু কবিতার আবেদন পাঠকের কাছে শেষ হবে না বলে মনে হয়।কিছু কবিতায় শব্দ অর্থের অনুগামী না হয়ে নিজেদেরই অলঙ্কারময় করে উপস্থাপন করেছে।দর্পনে নিজেকে দেখার চেয়ে পাঠকের চোখে দর্পনের সৌন্দর্যটাই সেখানে চোখে পড়বে আগে।তবে কোন কোন গভীর পাঠক নান্দনিক বৃত্তির অন্তর্নিহিত পথে নিজস্ব প্রতিচ্ছবিকেও খুঁজে নেবার দক্ষতা দেখাতে পারবেন বলে আশা করি।আর ঠিক তখনই নান্দনিকতা আর আত্মদর্শনের মিথস্ক্রিয়ায় নতুন ভূমি খুঁজে পাবে অয়ন্ত ইমরুলের এই বর্ণচোরা কবিতাসমূহ।


/ঢাকা থেকে প্রকাশিত ল্যাটল ম্যাগাজিন 'জলধি'র বই আলোচনা সংখ্যায় প্রকাশিত/