সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে (১৯০১-১৯৬০) বাংলা কবিতায় ধ্রুপদী রীতির প্রবর্তক বলা হয়।তবে তিনি
শব্দে ক্লাসিক,ঐতিহ্যে ক্লাসিক নন।তিনি বলতেন কবিতার মুখ্য উপাদান শব্দ,যেখানে জীবনানন্দ বলেছেন উপমাই কবিত্ব।বাবার কর্মসূত্রে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের শৈশব কাটে কাশীতে এবং সেখানেই তার পড়াশুনার হাতেখড়ি হয়।পরবর্তীতে কিশোরজীবনে কলকাতায় চলে এলেও বাংলা ভাষাটা তার স্বভাবজাতভাবে শেখা হয়নি।অধ্যয়ন ও চর্চার মাধ্যমে তাকে বাংলা ভাষা অাত্মস্থ করতে হয়েছিল।ফলে তার কবিতার ভাষা অনেকটা অভিধান ঘেঁষা হয়ে গড়ে ওঠে।তবে তার কবিতা সম্পর্কে দুর্বোধ্যতার যে অভিযোগ শুনা যায় বুদ্ধদেব বসু তাকে খণ্ডন করে বলেছিলেন যে, সুধীন্দ্রনাথের কবিতা দুর্বোধ্য নয়,দুরুহ।অর্থ্যাৎ সুধীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠকের অলসতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে পাঠকের নিবিষ্ট অনুশীলন প্রত্যাশী।রবীন্দ্রনাথ তার শব্দ অপরিচিত হলেও সজীব বলে সমর্থন করেছিলেন।সুধীন্দ্রনাথের কবিতা সমতল ভূমিতে পদচারণার মত নয়,তার কবিতা পড়তে গিয়ে যুক্তাক্ষরের ঘনঘন বাধা ও অপরিচিত শব্দে ঠেস খেয়ে পর্বতারোহণের অভিজ্ঞতা হয়।ফলে পরিশ্রমী ও শব্দে যথেষ্ট অধিকার থাকা পাঠকই একমাত্র তার কবিতার এই রোমাঞ্চ গ্রহণ করতে পারেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরোক্ষ কারণগুলোর উন্মেষ পর্বে প্রতিটি সমাজের অগ্রবর্তী মানসের বিশুদ্ধ নীতি,আদর্শ ও ধর্মবোধ ভেঙে পড়েছিল।ফলে স্বাভাবিকভাবে কবিতাতে শাশ্বতের প্রতি অবিশ্বাস,ক্ষণবাদী চিন্তার বিকাশ,কৌণিক প্রশ্ন ও সন্দেহ প্রকাশ পেতে থাকে।সুধীন্দ্রনাথের কবিতায় তার সবচেয়ে উচ্চকিত প্রকাশ দেখা যায়।ফলে তার কবিতা চিরায়ত রোমাণ্টিক প্রেমভাবনা থেকে তিরোহিত।কবিতায় ক্লাসিক রীতির প্রবর্তনে তাকে মাইকেলের সাথে তুলনা করা হলেও মাইকেলের কবিতায় ক্লাসিক্যাল সুর বেজেছিল মহাকাব্যিক আমেজে আর সুধীন্দ্রনাথের কবিতায় তা এসেছে লিরিক্যাল ব্যঞ্জনাধর্মী শব্দের আবহে।

সুধীন্দ্রনাথের ঘন ও সংহত শব্দকাঠামোর ব্যতিক্রম শাশ্বতী,সংবর্ত ও উটপাখির মত সহজবোধ্য অথচ তার মৌলিকতাকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করা কবিতাও দেখা যায়।মূলত অপেক্ষাকৃত এই সহজবোধ্য কবিতাগুলোই বেশি বিখ্যাত হয়েছে।রবীন্দ্রনাথের সাথে সুধীন্দ্রনাথের এক অম্ল-মধুর সম্পর্ক ছিল।১৯২৯ সালে তিনি রবীন্দ্রনাথের সফরসঙ্গী হয়ে কানাডা ও আমেরিকা ভ্রমণে যান।ফিরে এসে ১৯৩০ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ তন্বী প্রকাশ করেন যার উৎসর্গপত্রে রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন,ঋণ শোধের জন্য নয়,ঋণ স্বীকারের জন্য।বলা বাহুল্য এই ঋণ স্বীকার কবিতার শিল্প ও প্রকরণগত বিষয়ে নয়,কবিতার চিরকালীন আদর্শকে সামনে রেখে।রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর বাসায় এক ঘরোয়া বিতর্কে একদিন সুধীন্দ্রনাথকে তিনি বলেছিলেন যেকোন বিষয়ে লেখা যায় না,তার একটা প্যাটার্ন থাকতে হয়।জবাবে সুধীন্দ্রনাথ বিরোধীতা করায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন তুমি কি মোরগ নিয়ে কবিতা লিখতে পারবে?প্রতিউত্তর হিসেবে পরদিনই কুক্কুট নামে কবিতা লিখে দিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথকে বলাতে বাধ্য করেছিলেন যে তুমি জিতে গেছো।এভাবে ব্যক্তিগতভাবে রবীন্দ্রনাথের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধায় ও সান্নিধ্যে থেকেও প্রকরণ ও বৈচিত্র‍্যে  তার কবিতা সম্পূর্ণ মৌলিক হতে পেরেছিল।

সুধীন্দ্রনাথের স্বতন্ত্র শব্দকাঠামোর জন্য তার প্রতিটি কবিতাকেই মৌলিক বলা যায়।মধ্যযুগ ও রবীন্দ্রযুগের কবিতার চিত্রকল্প,উপমা কোনকিছুর সাথেই তার কবিতা মেলে না।কবিতা নিয়ে সচেতন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও প্রতিটি শব্দের পেছনে অক্লান্ত পরিশ্রম তাকে এই বিশেষত্ব দিয়েছে।শুনা যায় একটি কবিতায় উড়ে গেছে এই শব্দসমবায়ের পরিবর্তে উড্ডীন শব্দটি লিখতে তিনি এক সপ্তাহ সময় নিয়েছিলেন।এ কারণেই মাত্র ৬ টি কবিতাগ্রন্থ ও দুইটি প্রবন্ধের বই নিয়েও বাংলা কবিতায় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে তিনি উজ্জ্বল।

মহাকালে স্থান করে নেওয়ার জন্য স্মরণীয় পঙক্তি নির্মাণ যেকোন কবির জন্যই জরুরি বিষয়।সুধীন্দ্রনাথের কবিতার ভাষা কথ্যরীতি থেকে অত্যন্ত দূরবর্তী হওয়া সত্ত্বেও বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী,অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ হয়,আমি বিংশ শতাব্দীর সমান বয়সী ইত্যাদি পঙক্তি অত্যন্ত বিখ্যাত হয়েছে।এছাড়া শাশ্বতী কবিতার কয়েকটি পঙক্তি চিরকালের কবিতারসিক পাঠকের মনে স্থায়ী আসন গেড়ে নিয়েছে--একটি কথার দ্বিধাথরথর চুড়ে/ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী;/একটি নিমেষে দাঁড়ালো সরণী জুড়ে,/থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি।সুধীন্দ্রনাথের নাম উঠলেই এই পঙক্তিগুলো স্মরণে উদ্ভাসিত হতে বাধ্য।খেয়াল করে দেখা যায় তার এই বিখ্যাত পঙক্তিগুলো আবার কথ্যভাষার সমান্তরাল।সুতরাং স্মরণীয় পঙক্তি নির্মাণ পাঠকের বোধে চমক ও প্রজ্ঞার বিচ্ছুরণের পাশাপাশি সহজবোধ্যতাও দাবী করে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

সুধীন্দ্রনাথ শেষ জীবনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যে অধ্যাপনা করেছেন।তার আগে ১৯৫৭-১৯৫৯ সাল পর্যন্ত আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।শিক্ষাজীবনে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হন এবং পরবর্তীতে তা বাদ দিয়ে আইনশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা শুরু করলেও কবিধর্মের স্বাভাবিক বিশৃঙ্খলতার জন্য কোনটাই শেষ করতে পারেননি।তবু কবিতা বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্যের কারণেই তিনি এই বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় দু'টিতে অধ্যাপনার সুযোগ পান যা এই সময়ের জন্য অস্বাভাবিক ব্যাপার।কবিতা লেখার পাশাপাশি তিনি দীর্ঘ ১২ বছর পরিচয় পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন।তাছাড়া বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন ও প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্র পত্রিকার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।তিরিশ প্রণীত পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে তিনি অন্যতম একজন যিনি কবিতায় আধুনিক যুগের হতাশা,ক্লান্তি,নগর অভিজ্ঞতা ও ক্ষয়প্রবণতাকে বস্তুনিষ্ঠ অথচ শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন।১৯৩৫ সালে প্রকাশিত দ্বিতীয় কবিতাগ্রন্থ অর্কেস্ট্রার জন্য সুধীন্দ্রনাথ সবচেয়ে সমাদৃত হন।

সুধীন্দ্রনাথের কবিতায় সাধারণ পাঠকের জন্য আপাত প্রাচীর লক্ষ্য করা গেলেও তিনি নিজেই বলেছেন যে, যে লেখা সাধারণবুদ্ধ নয় তার কোন সার্থকতা নেই।সুধীন্দ্রনাথের কবিতায় শব্দগত বৈদগ্ধতা থাকলেও কোনভাবেই তা অবোধ্য নয়--এই কথাটি সেই বক্তব্যকেই সমর্থন করে।শব্দের বাধায় প্রতিহত হয়ে যে পাঠক ফিরে যায় তার জন্য সুধীন্দ্রনাথ নয়।তাই যেকোন অজুহাতে সুধীন্দ্রনাথ থেকে দূরে থাকলে বাংলা কবিতার এক ব্যতিক্রমী সূর্যকান্ত থেকে পাঠক নিজেই বঞ্চিত হবেন।

(প্রকাশ --দৈনিক ইনকিলাব,১৮.১১.২২)