কবি হয়ে উঠার জন্য আলাদা কোন প্রতিষ্ঠান নেই।একজন কবি আর দশজনের মতো জীবন সংগ্রাম করতে করতেই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী ও তার চর্চার মাধ্যমে কবি হয়ে ওঠেন।তবে কবিতার পথে হাঁটতে গিয়ে স্বভাবতই তাকে অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়।বিসর্জনের এই জায়গাগুলো নিয়ে তখন কবির সাথে তার বাস্তব জীবনের সংঘর্ষ তৈরি হয়।বেশিরভাগ কবিই ব্যক্তি আমি ও কবি আমির দাবির মধ্যে ব্যালেন্স করতে পারেন।কারণ ব্যক্তি আমির যে নাভিশ্বাসময় জীবনসংগ্রাম সেখানে কবি আমি নিঃশ্বাস নেওয়ার মত স্থান খুঁজে পায় না।আবার কবি আমির পুরোপুরি স্বীকারুক্তি দিলে ব্যক্তি আমি জীবন সংগ্রামে পরাস্ত হয়।আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার যুগে মানুষের হয়তো টাকার অভাব আগের চেয়ে ঘুচেছে কিন্তু তার সময়ের অভাব বেড়েছে।সুতরাং মাস শেষে ব্যাংকে জীবনধারণের জন্য মৌলিক অর্থ ঢুকলেও সময়গত ধারণার ভিত্তিতে চেতনাহীন,চিন্তাশূন্য নতুন দরিদ্র্যশ্রেণীর সৃষ্টি হচ্ছে।একজন সাধারণ মানুষ হয়তো জীবনের অন্যান্য সংকল্প বাদ দিয়ে ক্ষুদ্র এই পরিধির ভেতর ভোগবিলাসে মত্ত থেকে নিজেকে ভুলে থাকার চেষ্টা করছেন।অপেক্ষাকৃত নিম্নশ্রেণী জীবনের নিতান্ত প্রয়োজন মেটাতে পেরেই সান্ত্বনার উপকরণ খুঁজছেন।কিন্তু একজন শিল্পী বা কবির সে উপায় নেই।একদিকে প্রতিযোগিতাময় জীবন সংগ্রামেও তাকে অংশ নিতে হচ্ছে আবার শিল্পসাধনার জন্য অবসরের তাগিদও তিনি অনুভব করছেন।প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের মত কোন রাষ্ট্রেই কবিদের জন্য নির্দিষ্ট কোন স্থান নেই।প্লেটো নিজেও কবি ছিলেন।তবু তার মত দার্শনিকই যখন আদর্শ রাষ্ট্রে কবিদের অবাঞ্চিত ঘোষণা করেছিলেন তখন যুগযন্ত্রণার এই দানবীয় সভ্যতার যুগে রাষ্ট্রে কবির অবস্থান কোথায় তা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য নয়।প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্রে কবিদের অবাঞ্চিত ঘোষণা করলেও কবিতা বিষয়ে তিনি একটি অবিস্মরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন তা হল কবিতা ইতিহাসের চেয়েও অপেক্ষাকৃত সত্যের নিকটবর্তী।
বর্তমানকালের কবিরা কমবেশি সবাই একটি জীবিকার সাথে জড়িত এবং তাদের বড় একটি অংশ নগরে বাস করে।জীবিকার সংগ্রাম সব মানুষকেই করতে হয়।মধ্যযুগের কবি কবির একজন তন্তুবায় ছিলেন।অবনীন্দ্রনাথ বলেছেন "খাঁচার পাখিও তো গান গায়"। তবে পুঁজিবাদের সর্বগ্রাসী বিকাশ ও নগর সভ্যতার পুতিগন্ধময় পরিবেশ এখন মানুষের জীবন খাঁচার পাখির চেয়েও অতিষ্ঠ করে তোলেছে।বলা যায় তার কণ্ঠই রুদ্ধ করে ফেলেছে।রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যার ভাব অনেকটা এরকম,গাছের বাঁচার জন্য তার কিছু অংশ মাটির নিচে রাখার অজুহাতে তার পুরো অংশটাই মাটির নিচে দাবিয়ে দেওয়া ঠিক নয়।বর্তমানে মানুষের জীবনে হয়েছে কিন্তু তাই।জীবিকার নামে তাকে সকাল থেকে রাতের প্রথম ভাগ পর্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।বাসায় এসে ক্লান্ত শরীর শ্রান্ত না হতেই তার ঘুমের সময় হচ্ছে।নইলে পরদিন যে জীবিকার বারোটা বাজবে।ফলে যে বইটা সে কয়েকমাস যাবত পড়তে চাইছে,যে গল্প-উপন্যাস নিয়ে বসতে চাইছে তা শুরু করলেও আর শেষ করতে পারছে না।ফলে একটা হতাশা ও বিচ্ছিন্নতাবোধ তাকে সবসময় ঘিরে রাখছে।তাই সে কাজের মাঝেও, ক্লান্তির মাঝেও ফেসবুকিং করে শিল্পের সাথে সামান্য হলেও যুক্ত থাকতে চাচ্ছে।ফলে অবসরের অভাবে তার শিল্পচিন্তা গভীর হয়ে তার সৃষ্টিতে উঠে আসছে না।আমি কাউকে অভিযোগ করছি না।পরিস্থিতিটা জাস্ট তুলে ধরার চেষ্টা করছি।আমাদের প্রতিভাবান শিল্পীরা বিশ বছর আগের একজন শিল্পমনা পাঠকের সমানও হয়তো শিল্প নিয়ে থাকতে পারছেন না।এর প্রত্যক্ষ প্রভাব আমাদের শিল্প-সাহিত্যে পড়ছে।এজন্য অপেক্ষাকৃত অধিক পরিশ্রমের বিষয় গল্প ও উপন্যাস রচনা অনেক কমে গেছে।শিল্পের এই ক্ষতির জন্য শুধু শিল্পীকেই দোষ দেওয়া ঠিক নয়।সমাজও দায়ী,সভ্যতাও দায়ী।
কবিতা ও কবি বিষয়ে প্লেটোর উক্তি বুঝতে গেলে সেই সময়ের গ্রীক নগর রাষ্ট্রের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বুঝতে হবে।সে সময় গ্রীসের ক্ষুদ্র নগর রাষ্ট্রগুলো সর্বদা একে অপরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকতো।এমনকি বাইরের নানা শক্তিকেও তাদের মোকাবেলা করতে হত।এথেন্স নগরীতে সামান্য শিথিলতা থাকলেও গ্রীসের আরেক নগরী স্পার্টা ছিল পুরোপুরি সামরিক মনস্ক রাষ্ট্র।সুতরাং গ্রীক নগর রাষ্ট্রে তখন বাস্তবতার সংঘাতে টিকে থাকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।তাই প্লেটো কল্পনা রাজ্যে বিচরণকারী কবিদের বিষয়ে এত কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।তিনি কবিতাকে অনুকরণের অনুকরণ বলে উল্লেখ করেছিলেন।তাই কবিতার কোন বাস্তব উপযোগিতা তার চোখে পড়েনি।তবে আধুনিক যুগে রাষ্ট্র ব্যবস্থা বদলেছে,ব্যক্তির নাগরিল অধিকার স্বীকৃত হয়েছে।তাই আধুনিক যুগে কবিরা ভিন্নমাত্রায় জনসমাজে মুল্যায়িত হচ্ছেন।কিন্তু কবি হয়ে ওঠার নিশ্চিদ্র পথ,একান্তভাবে কবি হয়েই টিকে থাকার নিবিড় আশ্রয় কবি কোন সমাজেই পাননি।মূলত জীবনের এই সংকটগুলোই মানুষকে কবি করে তোলে।কোন মানুষের সব সমস্যা যদি দৈব বাণীর মত সমাধান হয়ে যায়,তার যদি কোন ইচ্ছেই অপূর্ণ না থাকে,তার জীবন ও জীবিকার সমস্ত দায়িত্ব রাষ্ট্র নিয়ে যদি তাকে বলা হয় এবার তুমি শুধু কবিতা লিখো--তখন দেখা যাবে সে আর কিছুই লিখতে পারছে না।সুতরাং জীবনের এইসব সংকটের ভেতর দিয়েই কবিকে তার হৃদয়ের পথ খুঁজে নিতে হবে।
শহরে কোন চেতনা স্থির হয়ে তলানিতে জমতে পারেনা।সেখানে ঘটনা ও দৃশ্যের এত সমাহার থাকে যে একটি এসে আরেকটিকে দ্রুত সরিয়ে দেয়।বর্তমানের শহরগুলো এ বিষয়ে আরও ভয়ানক চিত্র নিয়েছে।তাই শহর সভ্যতা চিন্তার তলানীহীন বিক্ষিপ্ত মানুষ তৈরি করছে।ফলে তার সাহিত্যও চিন্তাহীন নন্দন কানন হচ্ছে।একসময় কবিরা কবি হবার আশায় দেশের নানা প্রান্ত থেকে ঢাকায় আগমন করতেন।মহাদেব সাহা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথের উপর থিসিস করা বাদ দিয়ে ঢাকায় চলে আসেন কবিতার নেশায়।কারণ তখন ঢাকায় কবিদের যে আড্ডা ও কানেক্টিভিটি ছিল তার মধ্যে ঢুকে যেতে পারলে নিজেদের সৃষ্টিশীলতা বিকশিত হত।আমার মনে হয় এখন হয়েছে তার উল্টো।কবিতা লিখতে হলে এখন কবিদের প্রথমত ঢাকা ছাড়তে হবে।যেখানে মানুষ পরিচয়টাই এত সংকোচিত,যেখানে রাস্তাতেই দিনের অর্ধেকটা যায়,যেখানে নিতান্ত প্রাণী পরিচয়টাও ধরে রাখা কঠিন সেখানে শিল্পসাধনা পরিহাস মাত্র।কলকাতার পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় না জানলেও এতটুকু নিশ্চিত জানি যে সেখানে জ্যাম পরিস্থিতি ঢাকার চেয়ে সামান্য ভাল হলেও নগরসভ্যতার অন্যান্য অত্যাচার পুরোদমে বর্তমান।
প্রযুক্তি বর্তমানকালের কবি ও লেখকদের জন্য যেমন পারস্পরিক যোগাযোগ ও নিজেকে প্রকাশের এক বিরাট সুযোগ এনে দিয়েছে,তেমনি তার কুফলও কম পড়েনি সাহিত্যের উপর।বর্তমানকালের প্রতিশ্রুতিশীল লেখকরাও যেভাবে ফেসবুকে সারাক্ষণ এক্টিভ থাকেন,সন্দেহ হয় তারা হয়তো উপন্যাস বা দীর্ঘ সময় ধরে টানা পড়তে হয় এরকম কোন গবেষণাধর্মী বিষয়ের সাথে যুক্ত থাকতে পারেন না।একটু পর পর নানা নটিফিকেশন চেক,তার প্রতিউত্তর ইত্যাদিতে তাদের মনোযোগ নিশ্চিত বিক্ষিপ্ত হয়। ফলে কোন দৃষ্টিভঙ্গি দীর্ঘ সময় জারিত হয়ে যেভাবে শিল্পরূপ পাওয়ার কথা তা হয়তো পাচ্ছে না।৫-১০ লাইনের কিছু লিখেই ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া পাওয়ার জন্য আমরা হয়তো খুব বেশি ব্যাকুল হয়ে উঠছি।ফলে দীর্ঘ পথের পথিক হওয়া আর আমাদের সম্ভব হচ্ছে না।তাই অল্পমূল্যের কিন্তু হরেক রকম হরেকমালের ফেরিওয়ালার সংখ্যা সাহিত্য জগতে অনেক বেড়ে যাচ্ছে।আত্মধ্যানে মগ্ন একটা নিজস্ব জগত অবশ্যই সব লেখককে নির্মাণ করতে হবে।সেটা কীভাবে অর্জন করবেন তার কৌশল সেই লেখককেই আবিষ্কার করতে হবে।
বর্তমান সভ্যতা হল বাণিজ্যিক প্রসার ও প্রচারের যুগ।যে যত প্রচার করতে পারবে তার পণ্যের প্রসার তত বেশি হবে--এই ধারণা থেকে সকল প্রতিষ্ঠান এখন পুঁজির বড় একটা অংশ প্রচারের পেছনে খরচ করছে।চারদিকে বিজ্ঞাপন ও বিলবোর্ডের এত জোয়ার যে কান ও চোখ বন্ধ করে রেখেও বিজ্ঞাপন থেকে নিজেকে রক্ষার কোন উপায় নেই।কেউ একজন পার্কে বসে যখন আইসক্রিম খাচ্ছে তখনও দেখা যাচ্ছে পাশের দোকান থেকে উচ্চ ভলিউমে ভেসে আসছে অর্ধেক মূল্য ছাড়ে কোন একটা পণ্যের বিজ্ঞাপন।দেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে এই যে এত বিলবোর্ড,আলোর ঝিকিমিকি,রঙ-বেরঙের ফানুসরূপী মানুষ,নানা যানবাহন ও নগরসভ্যতার মহাজাগতিক আওয়াজ--এর মাঝে নিতান্ত ঐশ্বরিক শক্তির অধিকারী না হলে কারও পক্ষে নিজের চিন্তাকে একমুখী করে রাখা সম্ভব নয়।ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি ঢাকা শহরের ব্যস্ত রাস্তায় হাঁটলে চারপাশ আমাকে এত অধিকার ও বিক্ষিপ্ত করে যে শিল্পচিন্তার একটা সাধারণ বিষয়েও আমার মস্তিস্ক তখন সাড়া দেয়না।সাম্রাজ্যবাদী সভ্যতার এই প্রচারসর্বস্ব চিত্র দেখেই সম্ভবত শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন "মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে"।আধুনিক যুগে মানুষের বাস্তবতা এত প্রত্যক্ষ যে তা থেকে নিজেকে আড়াল করে নিজের গভীরে ডুব দেওয়া খুব কঠিন।
বাঁশির ভেতরে শূন্যতা না থাকলে যেমন তা বাজে না তেমনি জীবনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিজ্ঞতাগুলো অবসরে সামান্য জারিত হতে না পারলে তা শিল্পরূপ পায় না।সুতরাং শত ব্যস্ততার মাঝেও জীবনের নানা চাহিদা ও অভ্যাসকে নিয়ন্ত্রণ করে হলেও শিল্পীকে শিল্পের জন্য একটা ব্যক্তিগত ব-দ্বীপ নির্মাণ করতেই হবে।শিল্পের প্রতি প্রগাঢ় মমতা থাকলে আশা করি তা দুরোহ হলেও অসম্ভব হবে না।
জীবনসংগ্রামের নানা জটিলতায় চিন্তা,বইপাঠ,আত্মপাঠ,জীবনপাঠ ইত্যাদি কমে যাওয়ায় বর্তমানকালের কবিতা অনেকটা অভিঘাতহীন নান্দনিক রথযাত্রায় পরিণত হয়েছে।ফলে আবেগ ও অনুভূতির চেয়ে কলাকৌশল এখন খুব বড় হয়ে উঠেছে।কবিতা অনেকটা খনিজ সম্পদের মত।খুব যত্নে তুলে আনতে হয় ভূ-গর্ভ থেকে।ঠিক যেভাবে অন্যান্য উপাদানের সাথে মনোভূমে তার গড়ে উঠা,ঠিক সেভাবেই তাকে বাইরে উপস্থাপন করা যায় না।কিছুটা বিশোধিত করে প্রকাশ করতে হয়।আবার অতি বিশোধনেও তা কৃত্রিম হয়ে পড়ে।সহনীয় বিশোধনে কিছুটা ধূলোবালিসহ তার অকৃত্রিমতা পাঠক আনন্দের সাথেই গ্রহণ করে।বুদ্ধদেব বসুও বলেছেন কবিতায় টেকনিকের বাড়াবাড়ি অমানবিক।নজরুলের কবিতায় আবেগের বিপুলতায় শব্দ ব্যবহারে নানা জায়গায় অসংলগ্নতা লক্ষ্য করা যায়,তবু অনুভূতির অকৃত্রিমতায় পাঠক তাকে গ্রহণ করে।জীবনানন্দের কবিতায় শব্দের পুনরুক্তি দেখে বুদ্ধদেব বসুও একসময় হতাশ হয়েছিলেন।তবু জীবনানন্দ আজও লিজেন্ড।কাজী মোতাহের হোসেন তার 'সংস্কৃতির কথা' বইয়ে এই দুই ধরনের লেখকের উল্লেখ করেছেন।একদল অতি বিশোধনে কৃত্রিম,আরেক দল সহনীয় বিশোধনে কিছুটা ধূলোবালি যুক্ত।তিনি দ্বিতীয় দলকেই শিল্পে অধিকতর স্বীকৃতি দিয়েছেন।কবিতায় অন্তরঙ্গ হৃদয়ের দুর্বলতাও গ্রহণ করা যায় কিন্তু হৃদয়হীনের দক্ষ হাত ইস্পাতের মত আঘাত করে।
বর্তমানকালের সর্বগ্রাসী ভোগবাদী সভ্যতা ও জীবিকাজটিল জীবনে সৃষ্টিশীলতা ধরে রাখা অনেকটা ঝড়ো হাওয়ায় দুহাত দিয়ে ঢেকে মোমের বাতি জ্বালিয়ে রাখার মতো ব্যাপার।জীবনে ক্লান্তি থাকবে,অবসরের অভাব থাকবে।এর মাঝেও নিজের সৃষ্টিশীলতাকে নিভতে দেওয়া যাবে না।অত্যন্ত সাধনায় তাকে সমস্তজীবনব্যাপী পরিচর্যার মাধ্যমে বয়ে নিয়ে যেতে হবে।পথ প্রসস্ত হলেই যে সবাই গন্তব্যে যেতে পারে তা নয়,সরু পথেও তীব্র সংকল্পের অধিকারী গন্তব্যে পৌঁছে যাবেন।পথ অনুযায়ী তাই বাহন ঠিক করতে হবে।মানুষের সত্য প্রেরণা কোনকালে বাধা পেয়ে থেমে থাকেনি বরং উথলে উঠেছে।তাই নিজের চেতনা ও বোধকে গুরুত্ব দেওয়া সবার আগে জরুরি।
তবে কি সমৃদ্ধ শিল্প-সাহিত্যের জন্য চব্বিশঘন্টার শিল্পী চাই যিনি আর কিছু না করে শুধু শিল্প নিয়েই থাকবেন সারাক্ষণ?বস্তুত এটা যে আদৌ জরুরি নয় সেটা প্রথমেই বলেছি।যিনি রান্না করেন রান্নার গন্ধে বেশিরভাগ সময় তার ক্ষুধা মরে যায়।ফলে বাসায় মেহমান এলে একটু বিশেষ রান্না হলে দেখা যায় মা আর তা খেতে পারেন না।শিল্পী সাহিত্যিকরা সারাজীবন শিল্পসংশ্লিষ্ট জীবিকা খুঁজে বেড়ান।কেউ কেউ পেয়েও যান কিন্তু সেটা অল্প কয়েকজনের জন্যই সুফল বয়ে আনতে পারে।এসি রুমে বসে যিনি ধান গবেষণা করছেন তার চেয়ে রোদে পোড়া কৃষকের চোখেই ফসলের সৌন্দর্য বেশি ধরা পড়ে।প্রত্যক্ষ জীবনের সংংগ্রামে যিনি আছেন নানা তত্ত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে তিনিই হয়তো প্রকৃত সত্য ও সুন্দরকে শিল্পের প্রতিমায় পর্যবসিত করতে পারেন।
নব্বই দশকের পর থেকে নানা কারণে কবিতায় স্মরণীয় পঙক্তি বিল্পপ্তির পথ গ্রহণ করেছে।কবিদের বর্তমান জীবনব্যবস্থা ও পারিপার্শ্বিকতা অবশ্যই তার একটি কারণ।সমাজের নানা ঘটনা অন্যান্য মানুষের মত এখন কবিদেরও খুব বেশি আলোড়িত করছে না।ব্যাপারটা খুবই ভাবনার বিষয়।যে পৃথিবীতে এখন মৃত্যু দিয়েও মানুষের মনোযোগকে বেশিক্ষণ ধরে রাখা যায় না সেই পৃথিবীতে কবিরাও হয়তো নগরসভ্যতার পরোক্ষ শিকারে পরিণত হয়েছে।ফলে কেউ কেউ যদি অভিযোগ তোলেন মানব সমাজের প্রতি সহমর্মিতা নেই এমন কোন অ্যালিয়েন কবিগোষ্ঠী সমকালের কবিতার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে কিনা--তবে তা কতটুকু অযৌক্তিক হবে ভেবে দেখা দরকার।এই বিষয়টি লক্ষ্য করেই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মহাশূন্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট স্থাপন করা নিয়ে একজন কিছুটা বক্রোক্তিমূলক মন্তব্য করেছেন এভাবে যে,যাক এই সুযোগে বাংলাদেশের কবিরা এবার হয়তো একটু আকাশের দিকে তাকাবেন।যাই হোক,কী কী কারণে কবিতা বা কবিতার একটি অংশ যুগের পর যুগ স্মরণীয় হয়ে থাকে-- সাহিত্যের ইতিহাসে বিভিন্ন যুগপর্যায়ে বিখ্যাত কবিতাগুলোর দিকে তাকালে আমরা হয়তো তার কিছুটা উত্তর পাব।মধ্যযুগে যেহেতু আখ্যানকাব্যই বেশি চলেছে তাই কাব্যগুণে কোন কোন কাব্যগ্রন্থ সেই সময় প্রসার লাভ করলেও বৈশিষ্ট্যগুণে বর্তমান পর্যন্ত অক্ষত দেহ নিয়ে টিকে আছে কয়েকটি পঙক্তি মাত্র।ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের "আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে", " নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়" কিংবা জ্ঞানদাসের "রূপ লাগি আখি ঝোরে গুণে মন ভোর/প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর" "সুখের লাগিয়া এ ঘর বাধিনু/আনলে পুড়িয়া গেল"--এই পঙক্তিগুলো এখনও স্বমহিমায় উজ্জ্বল।একইভাবে আধুনিক যুগেও যুগপ্রধান কবি ছাড়াও অনেক অপ্রধান কবিরও দুই-একটি পঙক্তি স্মরণীয় হয়ে গেছে।একটু খেয়াল করলে দেখা যায় যে,যে কবিতাগুলো বিখ্যাত হয়েছে তা মূলত অল্প ও অপেক্ষাকৃত সহজ শব্দে জীবনের গভীর দর্শনকে নান্দনিকতায় প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে।লেখাটি পড়ার সাথে সাথে সমস্তটা বুঝে উঠার আগেই হৃদয় ও বোধের অভ্যন্তর তা এমনভাবে দখল করে নেয় যে পাঠক তখন অভিভূত হয়ে পড়েন।স্মরণীয় পঙক্তি রচনার কোন নির্দিষ্ট রীতি নেই,চাইলেই কোন প্রতিভাবন কবিও নিজের মর্জিমতো তা সৃষ্টি করতে পারেন না।তবে এতটুকু বোঝা যায় যে,অনুভূতি ও প্রজ্ঞার বিস্ফোরণেই তার জন্ম হয়।অথচ অনুভূতিকে আড়াল করে নিজের অপারগতা ঢাকার কত নান্দনিক চিত্রকল্প তৈরি হয়েছে আজ পৃথিবীর শিল্পমানচিত্রে।স্বভাবজাত সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলাই কবিত্ব।ফুলের উপর রঙ করলে কি ভাল লাগে?
দুই
বলা হয়ে থাকে বর্তমানকালের বাংলা সাহিত্যে পাশ্চাত্যের মনোবিকলন চর্চার প্রচুর প্রভাব।কিছুটা মাইকেল থেকে শুরু করে তিরিশের কবিদের দ্বারা এটা আমদানিকৃত।এই ইতিহাস আমরা সবাই জানি।কিন্তু এর বাইরে আরেকটা কারণ আছে,সেটা হল সামাজিক জীবনের দিক থেকে আমরা তাদের পরবর্তী ধাপে রয়েছি।তারা তাদের গায়ের জামাটি পড়ে জড়াজীর্ণ করে আমাদের দিকে যখন ছুড়ে মারছে তারপর আমরা তা ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছি ও তার অভিজ্ঞতা শিল্প-সাহিত্যে প্রকাশ করছি,পাশ্চাত্য সাহিত্যে যা আগেই লেখা শেষ।যে সংকট তারা ২০০ বছর আগে পাড় করেছে তা আমরা এখন পাড় করছি।বর্তমানে শিল্প-সাহিত্যের যে নির্লিপ্ততা,একাকীত্ব,অবিশ্বাস তা তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই শেষ করে ফেলেছে।তাদের ফেলে দেওয়া হাড়টা আমরা এখন চাটছি।সুতরাং জীবনাভিজ্ঞতায় ও প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে থাকলে,বিশেষ করে পরবর্তী ধাপে থাকলে সামনে যারা আছে তাদের কোনভাবেই প্রভাবিত করা যায় না।কারণ তার অভিজ্ঞতাই পেছনের লোকদের নেই।
এই কারণে ইউরোপের সাহিত্য,দর্শন আমাদের চিন্তা-চেতনার চেয়ে আগাম কথা বলে বলে তাদের সৃষ্টি আমাদের অভিভূত করে।সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হয় যখন নিজের জীবনাভিজ্ঞতা দিয়ে অর্জন না করে তার বাংলা অনুবাদ করে সরাসরি তা আমাদের শিল্প-সাহিত্যে বা সমাজচিন্তায় আনি।তখন প্রায়ই মাঝরাতে ঢাকা শহরে বসেও ইংল্যান্ড বা আমেরিকার কোন বাদ্যযন্ত্রের গান শুনা স্বাভাবিক ব্যাপার বলে প্রচার হতে থাকে!
সমকালের পাশ্চাত্য সাহিত্যের সাথে বর্তমানে আমাদের নাড়ীর যোগাযোগ নেই।কেউ বড় কোন পুস্কার পেলেই বরং তাকে নিয়ে আমাদের গবেষণা শুরু হয়,দেখা যায় তার আগে আমাদের সবচেয়ে অগ্রসর পাঠকশ্রেণীও তার সাথে পরিচিত ছিলেন না।তাই পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রত্যক্ষ প্রভাব এখন আমাদের সাহিত্যে কমে গেছে,তবে প্রভাব রয়ে গেছে পাশ্চাত্য মানসিকতার।কারণ পাশ্চাত্য চেতনে ও অবচেতনে আমাদের জীবনের অনেক সূক্ষ্ণ বিষয়ও নির্ধারণ করে দিচ্ছে।স্বাধীনতা,গণতন্ত্র,মূল্যবোধ ইত্যাদি মেকি শব্দের আড়ালে পাশ্চাত্য কীভাবে আমাদের অর্থনীতি,রাজনীতি,সামাজিকতা,সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করছে তা সচেতন পাঠকমাত্রই জানেন।পাশ্চাত্য আগে নিজেকে প্রকাশ ও প্রচার করতো জ্ঞানের মাধ্যমে,শিল্পের মাধ্যমে,সাহিত্যের মাধ্যমে।ফলে তাকে উপেক্ষা করার উপায় আমাদের ছিল না।পাশ্চাত্য এখন নিজেকে প্রচার করছে পণ্যের মাধ্যমে,প্রযুক্তির মাধ্যমে,বাণিজ্যের মাধ্যমে।তাই পাশ্চাত্য সাহিত্যের সরাসরি জলপ্রবাহ থেকে বাংলা সাহিত্য মুক্ত হলেও পাশ্চাত্য প্রসারিত জীবনধারা ও মননের প্রভাব খুব ভালভাবেই পড়ছে আমাদের সাহিত্যে।এই প্রভাব অপ্রত্যক্ষ হওয়ায় বরং তা আরও বেশি ক্ষতিকর হয়ে দেখা দিচ্ছে।ফলে সমকালের বাংলা কবিতা প্রায়ই পাশ্চাত্যের কবিতাকলার বাংলা অনুবাদের মত খোসাবিশিষ্ট অন্তর্ঘাতহীন হচ্ছে।
শুধু সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে নয় আমাদের সমালোচনা সাহিত্যও কৌশলগতভাবে পাশ্চাত্য নির্ভর।বাংলা সাহিত্যের সমালোচনার ক্ষেত্রে প্রায়ই পাশ্চাত্য সাহিত্যের সাথে তার তুলনা করা হয়।এটা আসলে উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন ও পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ প্রভাব।বাংলা সাহিত্যের সাথে তুলনা হতে পারে মূলত যাদের সাথে আমাদের জীবনপদ্ধতির সমান্তরালতা আছে যেমন- হিন্দি,উর্দু,অসমীয়া,উড়িয়া,তামিল ইত্যাদি ভাষার সাহিত্যের।দুঃখের বিষয় হল প্রতিবেশি ভাষার সাহিত্য নিয়ে আমাদের আগ্রহ নেই,অনেকের বরং তার উল্লেখে সঙ্কোচ আছে।বরং বাংলা সাহিত্যের সাথে কোনভাবে ইউরোপীয় দর্শন জুড়ে দিতে পারলে আমরা জাতে উঠে যাই।অথচ ইউরোপের জীবন-যাপন এখনও আমাদের থেকে অনেক আলাদা।ফলে সাহিত্য সমালোচনাও ইউরোপীয় পদ্ধতিতে বাংলার জল হাওয়ায় ইউরোপীয় উপাদান সন্ধানের মত ব্যাপার।তাতেই বরং আমাদের আত্মশ্লাঘা!সেই হিসেবে কাউকে প্রাচ্যের বায়রন,প্রাচ্যের হোমার ইত্যাদি বলতে পারলে আমাদের ষোল কলা পূর্ণ হয়।
ইদানীং কবিতা আলোচনা-সমালোচনার ক্ষেত্রে প্রায়ই দশকী গণনা দেখা যায়।তবে কবিতায় দশকী গণনা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও কবিতার ধারাবাহিক বিবর্তন বুঝার জন্য একেকটা পর্যায়ের সৃষ্টিশীলতা,তার বিষয় ও উপকরণকে বুঝতে সেই সময়ের নিরিখে তাকে বিবেচনা করতে হয়।তাই সাহিত্য সমালোচনায় সময়,যুগধর্ম ও ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ।বাংলা কবিতায় প্রত্যেকটি বিবর্তনগত স্তরে বেশ কিছু কবির নাম মহাকালে টিকে গেছে।মধ্যযুগ,আধুনিক যুগ ইত্যাদির প্রতিটি পর্যায়ের অন্তত দশ বারোটি করে নাম এক্ষেত্রে উল্লেখ করার মত বা পাঠকমহলে তারা পরিচিত।
বাংলা কবিতায় নব্বই দশক পরবর্তী সময়ে অসংখ্য কবির উপস্থিতি দেখা যায়।বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে এ সংখ্যা কত হবে তা নির্ণয় সত্যিই দুঃসাধ্য।তবে এ সংখ্যা পূর্বের যে কোন সময়ের চেয়ে হাজার গুন বেশি।এককালে নিজের শিল্পপ্রতিভা সম্পর্কে যারা আত্মবিশ্বাসে প্রবল ছিল তারাই নিজের সমস্ত জীবনকে পুড়িয়ে শিল্পসাধনার পথকে বেছে নিত।একদিকে তারা সংখ্যায় অল্প হত এবং সঙ্গত কারণে তাদের সৃষ্টিও মহাকালে টিকে যাওয়ার উপযোগীই হত।ফলে কবি হিসেবে তাদের চেনা পাঠকের কাছে কঠিন হত না।
নিয়মিত কবিতা পড়েন এমন পাঠক বা লেখককেও যদি বলা হয় বর্তমানে আপনার প্রিয় ৫ জন কবির নাম বলুন।দেখা যাবে তারা প্রত্যেকে হয়তো এমন নামগুলো বলছেন যাতে একজনের তালিকায় আরেকজন নেই বা অন্যজন তাদের লেখার সাথে পরিচিতই নন।বাংলা কবিতায় বর্তমানে অন্তত ২০০ জন কবি একইসাথে একই ঘরানার ভাল কবিতা লিখছেন।তাদের সবার কবিতাই উন্নত,পড়ে দুর্বল বলার উপায় নেই।তবে তাদের কেউ কাউকে টপকে বিশেষ হতে পারছেন না।
বর্তমানে যুগপরিবর্তনকারী বড় কবিরাই শুধু লিখছেন না।এর মাঝে কবিতার কলাকৌশল জানা অসংখ্য মাঝারী প্রতিভাও আছেন।একদিকে 'কেউ কেউ কবি' জাতীয় কবিদের সাধনার অভাব অন্যদিকে মাঝারি প্রতিভার কলাকৌশলগত শব্দ ব্যবহার ও চিত্রকল্পের দাপটে কাউকেই বিশেষভাবে শনাক্ত করা যাচ্ছে না।ফলে আরও বিশ বছর পর এই সময়ের কবিতা নিয়ে যখন বিবর্তনগত ধারাবাহিক আলোচনা হবে তখন কোন কোন বিশেষ কবিকে নিয়ে সমালোচক আলোচনা করবেন তা এক বিশেষ সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।মঙ্গলকাব্য ধারার অজস্র কবির মত বিলীন হয়ে হয়তো গুটি কয়েকজনের নাম ইতিহাসে টিকে থাকবে।তবু সে আলোচনা সম্পূর্ণ হবে না।কারণ একই কাব্য লিখেও মুকুন্দ চক্রবর্তী বা বিজয়গুপ্ত যেমন বিশেষ হয়েছিলেন তেমন বিশেষ কাউকে দেখা যাচ্ছে না।আবার সমালোচকের পক্ষে সমমানের এত অজস্র নমুনা নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্ভব হবে না।ফলে যে কোন ব্যাখার প্রশ্ন থেকেই যাবে।
অনেকে মিলে যখন একই রকমের উৎকৃষ্ট লেখা লিখেন,কেউই প্রাণোচ্ছ্বল খারাপ লেখেননা--তখন বুঝতে হবে এটা সাহিত্যের জন্য মোটেও ভাল ব্যাপার নয়।তখন বুঝতে হবে সাহিত্যে এমন গুপ্তচরী অনুকরণ ঢুকে গেছে যে তাকে শনাক্ত করা যেমন কঠিন,তা থেকে বের হয়ে আসাও তেমনি কঠিন।সে তার নিম্নমানের কিছুও যেমন জন্মাতে দেয়না,তার চেয়ে উচ্চমানের প্রতিভা জন্মানোর উপকরণকেও সে নানা রাসায়নিক ক্রিয়ায় নষ্ট করে।
(সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত)
(প্রবন্ধ গ্রন্থঃ ত্রিকালের ধ্বনি,একুশে বইমেলা)