রবীন্দ্রসাহিত্য নিয়ে এখনও নানা উচ্চবাচ্য শোনা যায়।বর্তমানে কেউ কেউ অনাধুনিক বলে যেন তাকে খারিজ করে দিতে চান।তারা বলতে চান যে,রবীন্দ্রনাথ পাঠ এখন আর তাৎপর্যপূর্ণ নয়।মোটেই তা নয়।রবীন্দ্রনাথ খাতায় আঁকা সূর্যের মত নন যে চাইলেই পৃষ্ঠা উল্টিয়ে তার দীপ্তিকে আড়াল করে ফেলা যাবে।রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাঙালীর আবেগ এখনও শেষ হয়ে যায়নি।রবীন্দ্র রাজনীতিও কম হয়নি দুই বাংলায়।সব বড় কবিকে নিয়েই তা হয়।তবু সবকিছুর উর্ধ্বে রবীন্দ্রনাথ "মাথার উপর জ্বলিছেন রবি"র মতোই এখনও জ্বলছেন।
তিরিশের কবিরা রবীন্দ্রনাথের ভাষাকাঠামো থেকে বের হওয়ার জন্য উদগ্রীব ছিলেন।কিন্তু বিরোধিতা করতে গিয়ে তারা এতটা মগ্ন হয়ে গেলেন যে রবীন্দ্রভাবকেও কবিতা থেকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করতে চাইলেন।ফলে তাদের কবিতা ভিন্ন স্বাদের হল সত্যি,কিন্তু ঐতিহ্যগত দিক থেকে তা সংকীর্ণ হয়ে পড়লো।রবীন্দ্রসাহিত্যের এক প্রধান অংশ হল তার ভাবময়তা।এত গভীর আর সূক্ষ্ণ অনুভূতি এত সহজ করে,এত হৃদয়গ্রাহী করে বলতে পারাটা এক বিশাল ব্যাপার।বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ বিগব্যাং এর মতোই এক বিস্ফোরণ।কালের ধারাবাহিকতায় তার কবিতার প্রকাশধর্মীতা পুরনো মনে হলেও তার ভাব চিরদিনই নতুন থাকবে।প্রতিটি যুগের সাথে সঙ্গতি রেখে তার গান প্রতিদিনের প্রাসঙ্গিক বিষয়ের মতো হয়ে ওঠছে।রবীন্দ্রসঙ্গীত বাঙালীর চিরকালের সম্পদ।যতদিন বাংলা ভাষা ও বাঙালী আছে এটা কখনও পুরনো হবে না।মাঝে মাঝে ভাবি নিতান্ত এই ছোট্ট জীবনে এত ভাব তিনি আহরণ করলেন কখন আর এত বিস্তৃত শাখায় বিপুলভাবে নিজের স্বাক্ষর রাখলেন কী করে!বর্তমানের গদ্যধারার কবিতার যে অগ্রগতি সেটাও তো সেই রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই সূচিত হয়।'পুনশ্চ' ও 'লিপিকা' কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ সমাজের অত্যন্ত ক্ষুদ্র চরিত্র ও বিষয়কে কবিতার উপকরণ করেছেন,এতদিনের রবীন্দ্রসাহিত্যে যা ছিল উপেক্ষিত।
রবীন্দ্রনাথের সব সময়ই অচেনাকে চেনার এক বাসনা ছিল।তাই সবসময় অভিজ্ঞতার সীমানাকে স্বীকার করেও নিজেকে তিনি প্রতিনিয়ত প্রসারিত করতে চেয়েছেন।রবীন্দ্রনাথ একাই তার রচিত প্রভাত সঙ্গীত,কড়ি ও কোমল,বলাকা,গীতাঞ্জলি,পুনশ্চ,লিপিকা ইত্যাদি কবিতাগ্রন্থের ভেতর দিয়ে কবিতার ধারাবাহিক নানা স্তর অতিক্রম করেছেন।তার এই ধারাবাহিক বিবর্তনের ফলেই বাংলা কবিতা একধাপে তিরিশকে স্পর্শ করতে পেরেছিল।কবিতায় যে ধারার তিনি সূচনা করেছিলেন তিনিই সেই ধারার সর্বোচ্চ সমৃদ্ধি ঘটিয়ে,সেখানে আর কারও প্রবেশাধিকার না রেখে,তাকে সম্পূর্ণ করে দিয়ে গেছেন।শুধু তাই নয়,পূর্ব বর্ণনা অনুযায়ী তিনি কবিতায় গদ্য ছন্দেরও চর্চা করেছেন।'পুনশ্চ' কবিতাগ্রন্থে গদ্যছন্দকে তিনি কবিতার প্রথাগত কাঠামোর ভেতরই স্থাপন করেছেন কিন্তু 'লিপিকা' গ্রন্থে গদ্যছন্দকে তিনি কবিতার কাঠামোর বাইরে গিয়ে মুক্তগদ্যের কাঠামোতে লিখেছেন।লিপিকার রবীন্দ্রনাথ তাই অত্যন্ত আধুনিক এক রবীন্দ্রনাথ।রবীন্দ্রনাথের মত বড় প্রতিভার পক্ষেই মনে হয় এরকম বিবর্তন সম্ভব।অথচ দীপ্তি ত্রিপাঠী,আবু সয়ীদ আইয়ুব ও বুদ্ধদেব বসুর মত বড় সমালোচকগণও রবীন্দ্রনাথকে এড়িয়ে গিয়ে তিরিশের দশক থেকে বাংলা কবিতার যে আধুনিকায়ন বিবেচনা করেছেন তা অত্যন্ত খণ্ডিত আধুনিকতা।আধুনিকতাকে শুধু তিরিশের শব্দ ও ভাবগত বিশৃঙ্খলা দিয়ে বিবেচনা না করে বিষয় ও উপলব্ধির বহুমাত্রিকতা দিয়ে বিবেচনা করলে এই সংকীর্ণতা ঘুচে যায়।সেক্ষেত্রে আধুনিকতাকে তার চরিত্রলক্ষণ অনুযায়ী কিছু পর্বে ভাগ করা যেতে পারে যেখানে রবীন্দ্রনাথ প্রথম ধাপে এবং নজরুল ও প্রেমেন্দ্রমিত্র দ্বিতীয় ধাপে স্থান পেতে পারেন।
রবীন্দ্র সাহিত্যবলয় থেকে বের হতে গিয়ে আমরা তার ভাবসম্পদ থেকেও বের হতে চেয়েছি।কী সাংঘাতিক কথা।সৌন্দর্য চেতনা,প্রেম,বিরহ,প্রকৃতিপূজা,দ্রোহ,কামনা কোথায় নেই রবীন্দ্রনাথ?সুতরাং তার ভাবকে পরিত্যাগ করতে হলে পৃথিবীর বাইরের কোন প্রাণীর অনুভূতির কথা লিখতে হয়।সচেতনভাবে কোন পরিধির বিরোধিতা করে সাহিত্যআন্দোলন কখনও ভাল কিছু বয়ে আনে না।স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুগের চাহিদা অনুযায়ী সাহিত্যদল গড়ে উঠে।একজন যেদিকে গেছে সেদিকে আমি যাব না বললে নিজেকেই বরং অভিজ্ঞতাহীন করে রাখা হয়।বিষয় এক হয়েও আমার সাথে তার পার্থক্য হতে পারে প্রকাশের প্রকরণে।আর রবীবাবু ভাবসমুদ্রের,জীবনসমুদ্রের কোন শাখায় পা ফেলেননি কেউ কি বলতে পারবেন?সুতরাং তার বিষয়সমূহ শুধু তার নয়,মূলত সমস্ত মানবজাতির হাজার বছরের অভিজ্ঞতার সারাংশ।সুতরাং সচেতনভাবে,অন্ধভাবে তাকে এড়িয়ে চলতে গেলে মূলত মাছের জন্য জলকেই এড়িয়ে চলার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
রবীন্দ্র রচনাবলী তাই বাঙালীর চিরকালের সম্পদ।রবীন্দ্রনাথ তাই সবসময়ই প্রাসঙ্গিক।তিনি বাঙালীর জন্য নোবেল পুরস্কারের চেয়েও বড়--একথা উপলব্ধি করতে না পারলে বাঙালীর মুক্তি নেই।