কবিদের মধ্যে যারা পুরুষ,সম্বোধন বা উল্লেখের প্রয়োজনে তাদের কবি নামেই ডাকা হয় কিন্তু কবিদের মধ্যে যারা নারী তাদের বেলায় কেন প্রায়ই 'মহিলা কবি' বলে সম্বোধন করা হয় এই নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়ে গেছে।কবিতা রচনা একটা সৃষ্টিশীল ব্যাপার।এর সাথে অন্যান্য পেশাজীবী লিঙ্গভেদের মতো পুংলিঙ্গ-স্ত্রীলিঙ্গ চিন্তা করা উচিত নয়।কৃষাণের স্ত্রীলিঙ্গ যেমন কৃষাণী,বেদের স্ত্রীলিঙ্গ যেমন বেদেনী,কবির স্ত্রীলিঙ্গ কী--এই প্রশ্ন অবান্তর।তবু নানা পাঠ্যবই,পত্রিকা,সাহিত্য আলোচনা,ম্যাগাজিনসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নানা ক্ষেত্রে কবিদের মধ্যে যারা নারী তাদের মাঝেমধ্যেই 'মহিলা কবি' বলে উল্লেখ করা হয়।এতে উল্লেখিত কবিসহ শিল্প অঙ্গনের অনেকেই বিরক্ত হন বা যাকে উল্লেখ করে এই সম্বোধন করা হয় অনেক ক্ষেত্রে তিনি মনে করেন প্রকারন্তরে তাকে ছোট করার জন্যই 'মহিলা কবি' বলে সম্বোধন করা হয়েছে।
এই শব্দগুচ্ছের ব্যবহারে কারও কোন সংকীর্ণ উদ্দেশ্য থাকতে পারে,তবে আমার মনে হয় এর শেঁকড় অন্যত্র।সেটা হল আমাদের বহুকালের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ও আমাদের মানসিকতায় চেতনে-অবচেতনে তার ক্রিয়াশীল নানা অভিক্ষেপ।সবাই সংকীর্ণ উদ্দেশ্য নিয়ে কাউকে অপমান করার জন্য 'মহিলা কবি' বলে সম্বোধন করেন বলে মনে হয় না।যদি বলা হয় "একজন ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে"--তবে কল্পনায় আপনি কী দেখলেন?নিশ্চয় একজন পুরুষ মানুষকেই হেঁটে যেতে দেখেছেন।অথচ ব্যক্তির মাঝে পুরুষ ও নারী দুই'ই বোঝায়।এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?কারও অবচেতনের কল্পনার উপর তো আমাদের হাত নেই বা তার জন্য সেই কল্পনাকারীকে সংকীর্ণ চিন্তারও বলা যায় না।আবার চিরকাল রান্না-বান্না করতে নারীদের দেখে আসলেও " একজন ব্যক্তি রান্না করছেন"--এই বাক্য বললেও আমাদের কল্পনায় কোমরে গামছা প্যাচানো এক পুরুষ চরিত্রের কথাই সচরাচর ভেসে ওঠে।দীর্ঘদিনের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে জীবন-যাপন ও তার উপাদানে গঠিত মানসিকতাই এর কারণ।যেহেতু নারীরা আমাদের সমাজে চিরকালই অনগ্রসর ছিল,তাই সমাজের অগ্রসর কোন কর্মকান্ডে নারীকল্পনা আমাদের কদাচিৎ হয়।সেজন্য সুস্পষ্টভাবে বুঝাতে কেউ কেউ মহিলা কর্মকর্তা,মহিলা সাংবাদিক ইত্যাদি বলে থাকেন।কবি শব্দ ছাড়া নানা পদবীর সাথে মহিলা শব্দের ব্যবহার আজ পর্যন্ত তেমন কোন বিতর্ক তৈরি করেনি।কবি ও তার পরিমন্ডল একটি অত্যন্ত উচ্চমার্গীয় ব্যাপার বলে,নারী-পুরুষের ঊর্ধ্বে তার স্থান বলে,তার সাথে পুরুষ বা মহিলা শব্দের যোগ যুক্তিসঙ্গত ভাবেই বেমানান।
চর্যাপদ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের কবিতা,শিল্প-সংস্কৃতির নানা অঙ্গন প্রভৃতি ক্ষেত্রে নারীদের অবদান প্রাচীনকাল থেকেই স্বীকৃত।তবু সামাজিকভাবে নারীদের জন্য সৃষ্টিশীল কাজে আত্মনিয়োগের সুযোগ বরাবরই কম থাকে।শৈশব থেকে শুরু করে সর্বত্র নারীদের যাপনকে আমরা এত নিয়ন্ত্রিত,এত আবদ্ধ রাখি যে মুক্তচিন্তা,মুক্তবুদ্ধি ইত্যাদি ব্যাপার থেকে তাদের বঞ্চিত হতে হয়।খুব অল্প সংখ্যক নারীর পক্ষেই সম্ভব হয় চারপাশের সৃষ্ট এই সীমানা পেড়িয়ে নিজস্ব চিন্তার জগত তৈরি করা,পুরুষের সমকক্ষে গিয়ে নিজের সৃষ্টিশীলতাকে প্রকাশ করা।এসব কারণে বাংলা সাহিত্যে অনেক প্রতিভাবান নারী অবদান রাখলেও বটবৃক্ষের মতো কেউ বড় হয়ে উঠতে পারেননি।এটা মূলত পুরুষতান্ত্রিক সমাজেরই ব্যর্থতা।গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে কিছু নাম করা গেলেও কবিতায় কোন নারী রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দের মতো বড় সৃষ্টিশীলতা নিয়ে নিজেকে প্রকাশ করতে পারেননি।মূলত কবিতার জন্য যে অবাধ জীবন যাপন,ব্যাপক অভিজ্ঞতা,নিবিষ্ট চিন্তা ইত্যাদি দরকার আমাদের সমাজে নারীরা তার ছিটেফোঁটাও পান না। তাই নারীদের মধ্যে বড় কবি বলতে সুফিয়া কামাল ছাড়া কারও নাম আমরা এখনও করতে পারি না। আবার সুফিয়া কামালের কবিতায় নানা বিষয়ে সাফল্য,সার্থকতা ইত্যাদি থাকলেও তিনি রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দ স্থানীয় বড় কবি নন। কবিতায় মৌলিক চিন্তার জগত, মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি,মৌলিক প্রকরণ সৃষ্টি তার পক্ষেও যথেষ্ঠ সম্ভব হয়নি। এই কারণে কবিতায় কেউ যদি শুধু পুরুষেরই অধিকার মনে করেন তবে মারাত্মক ভুল হবে।
বর্তমানকালে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গেছেন। স্কুল-কলেজ,ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয়,গবেষণা,মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিসহ নানা জায়গায় তারা দক্ষতার সাথে কাজ করছেন। নারীরা জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মত সৃষ্টিশীলতার ব্যাপারেও এখন আগের চেয়ে অনেক স্বাধীন হতে পেরেছেন।তার ধারাবাহিকতায় তারা শিল্প-সাহিত্যেও পুরুষের সমস্থানীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখছেন।ফলে খুব দ্রুত বাংলা কবিতায় বটবৃক্ষের মতো, নিজস্ব বৈচিত্রে সমুজ্জ্বল মগ্ন দ্বীপের মতো নারী প্রতিভাও বিচ্ছুরিত হবে--তা যুক্তিসঙ্গত ভাবেই বলা যায়।
কোন নারীকে কেউ যদি উদ্দেশ্যমূলকভাবে 'মহিলা কবি' বলে উল্লেখ করেন,তাকে সত্যিই যদি ছোট করার উদ্দেশ্য চেতনায় রাখেন,এটা অবশ্যই ধিক্কার পাওয়ার যোগ্য।আবার কেউ যদি অতটা চিন্তার গভীরে না গিয়ে দীর্ঘদিনের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বসে কোন কবির নারী পরিচয় দিতে গিয়ে তাকে 'মহিলা কবি' বলে ফেলেন তাতেও যেন আমরা চট করে চটে না যাই।তার ভুলটা আমরা ধরিয়ে দিতে পারি।ঋদ্ধ মানুষ হলে দ্বিতীয়বার অবশ্যই এই ভুল তিনি করবেন না।কিন্তু কেউ কোন উদ্দেশ্যের বশবর্তী না হয়ে স্বভাবগতভাবে বলে ফেললে তাকেও যেন আমরা তৎক্ষণাৎ কূপমন্ডুক, নারীবিদ্বেষী,সংকীর্ণ ইত্যাদি বলে গালি না দেই। আশাকরি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় পরিবর্তন, সমাজে নারীর অবস্থান,জ্ঞান চর্চার বিকাশ, নারী-পুরুষের পারস্পরিক সহযোগিতা-সম্মান ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সমাজে 'ব্যক্তি' বলতে নারীকেও কল্পনা করা আমাদের জন্য সহজ হবে। ভুলবশতও 'মহিলা কবি' সম্বোধনের তখন আর হয়তো অবকাশ থাকবে না।
(লেখাটি যথেষ্ঠ যুক্তি-তর্কের অপেক্ষা রাখে।যেকোন যুক্তিসঙ্গত মন্তব্য বা বিতর্ক গ্রহণযোগ্য)