পাঠপ্রতিক্রিয়াঃ
কাব্যগ্রন্থঃআদম পাহাড়
কবিঃশামশাম তাজিল

"পৃথিবীর পাঁচশো কোটি বছরের বেদনা বুকে নিয়ে তবেই কাউকে কবি হতে হয়"-এ ধরনের আত্মোপলব্ধি পাই কবি শামশাম তাজিলের "আদম পাহাড়" কাব্যগ্রন্থের সূচনাতেই।বস্তুত এই সত্যকে আত্মস্থ করেই তিনি এসেছেন কবিতার পথে।আদি মানব-মানবী আদম-হাওয়া থেকে শুরু করে হাবিল-কাবিলের হত্যাযজ্ঞসহ তার কবিতায় তাই অহরহ পাই ভারতীয় পুরাণ ও প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন শহরের নাম।কবিতায় বারবার উচ্চারিত হয় কর্ণ,কুন্তি,বৃহন্নলা,অর্জুন,কুরুক্ষেত্র,বেহুলা-লখিন্দর,ব্রম্মা,বিষ্ণু প্রভৃতি মিথাশ্রিত শব্দ ও হরপ্পা,মহেঞ্জোদারো,কালাপাহাড় ইত্যাদি প্রাচীন নগরী ও ব্যক্তিত্বের নাম।যেন পাঁচশো কোটি বছরের বেদনাকে ধারন করতে গিয়েই তিনি গুরুত্ব দেন প্রাচীন এইসব বিষয়কে।কেননা উপলব্ধিতে শুধু বর্তমানের কবি তিনি নন অতীত ও বর্তমান এ দুইই তার সমকাল।

কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রচুর যুক্তাক্ষরের ব্যবহার,যা কবিতার ধ্বনিসংঘাতকে করেছে স্পষ্ট ও উচ্চকন্ঠী।কিছু উদাহরণ দিলেই তা বুঝা যাবে..."শিখিনি কিছুই;গুণোত্তর ধারা,কারক,সমাস/-তবু ফিরে ফিরে আসে কেন্দ্রাতিগ পেন্ডুলামের স্মৃতি/শূণ্যের গুণে সব বৃত্তাকার,গম্বুজ শিখরে স্থিত আঙুলের বিচ্যুতি"।এরকমভাবে যুক্তাক্ষর আশ্রিত অজস্র পঙক্তি তুলে দেয়া সম্ভব তার বিভিন্ন কবিতা থেকে।কাব্যগ্রন্থে রয়েছে বেশ কিছু অন্ত্যমিলযুক্ত কবিতা।অন্ত্যমিলযুক্ত কবিতা লিখতে গিয়ে আমরা অনেক সময়েই ছড়া লিখে ফেলি।কিন্তু শব্দসাম্যের দক্ষতায় তিনি উতরে যান ছড়ার সীমানা।..."পাহাড় তোমার বুকের পরে রাত-বিরাতে কাঁদে/মৃত্যু আরও গভীর নিচে ঢেউ খেলানো খাদে/স্রোতের নেশায় ডুব দিতে চায় আর্ত জলরাশি/নোনা জলে নিস্পৃহ নই,মৃত্যু ভালবাসি"।কবিতায় আছে বৃত্তানুপ্রাসের সার্থক প্রয়োগ..."অলক অরণ্যে খুঁজি অলৌকিক সোনা/নিঃশব্দ নির্ঝড়ে নিবিড় ডুবিয়ে পা হোক মিথ্যের জালবোনা।"প্রথম ও দ্বিতীয় লাইনে পাচ্ছি যথাক্রমে 'অ' ধ্বনি এবং 'ন' ধ্বনির অনুপ্রাস।

কবিতায় আছে ক্ষুধাক্লিষ্ট মানুষের কৌতুকের স্বরে গভীর আর্তনাদের কথা.."হাড়জিরজিরে বউ আমার/একান্ত আহার"।একান্ত শব্দের 'ন্ত' যুক্তাক্ষরের জুড়ালো অংশে আর্তনাদ পাচ্ছে বিশেষ মাত্রা।আছে জীবনের বৃত্তে ঘুরপাক খাওয়া মানুষের দূরত্ব না পেরুনোর হতাশার কথা.."স্বপ্নেও কি তবে কোন দূরত্ব হই না পার?" জাতীয় পঙক্তি।আমাদের জাতীয় জীবনের রাজনৈতিক প্রহসনকে "উন্নয়ন" নামক এক কবিতায় তিনি তুলে ধরেন অত্যন্ত সুন্দর এক চিত্রের মাধ্যমে।কবিতায় প্রহসনমূলক উন্নয়ন বুঝাতে গিয়ে তিনি বলছেন..."বৃষ্টিতে জমেছে জল/রাস্তায় গা ধুয়ে নিচ্ছে হাঁস/একটি শিশু দেখছে নির্মল পুকুর।"প্রকৃতি বিনাশী সভ্যতার প্রতি কটাক্ষ করে উচ্চারণ করেন এ ধরনের কথাও..."নদীতো নারী;তবু তারে দিলে সুন্নতে খত্না,তার প্রবাহে দিলে দুর্মর বাধ"।তিনি পরাবাস্তবতার আশ্রয়ও নেন মাঝে মাঝে বিক্ষুব্ধ সময়কে প্রকাশ করতে..."আঙুলের নিতল ফাঁকে গলে যায় আমার বিবেক/শরীরের গোপন বাঁকে হয়তো অন্ধ দু'চোখ/খুঁজে পায় নদীর বেণী,খুঁজলে ঠিক পাওয়া যায়/শামুকের স্বপ্নে আকাশ উড়ে চিল কাদার ডানা"।তাছাড়া আত্মদর্শন ও প্রেম-বিরহের অবতাড়নায় সমৃদ্ধ হয়েছে তার বেশ কিছু কবিতা।

শামশাম তাজিল মূলত "আদম পাহাড়" কাব্যগ্রন্থে ধরতে চেয়েছেন সৃষ্টিলগ্ন থেকে বিশ্বে বয়ে যাওয়া সকল বেদনার সুর।যেন পৃথিবীর প্রাচীনকাল থেকে ঘটে যাওয়া সকল রক্তাক্ত ঘটনা ঘটে গেছে তারই প্রত্যক্ষে আর সেই প্রত্যক্ষ বেদনার ভ্রুণ লালন করেই তিনি প্রসব করেন রক্তবীজের মত তার কবিতাগুলো।