কোন সমাজ ও সভ্যতায় বড় ধরনের পরিবর্তন হলে শিল্প ও সাহিত্যেও বড় পরিবর্তন আসে।কারণ,সমাজ ও মানুষের সাথে শিল্প-সাহিত্যের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের পর নগর সভ্যতার পত্তনের ভেতর দিয়ে মানুষের জীবনে যে বহুমুখী সামাজিক ও মানসিক পরিবর্তন এসেছে তার প্রভাবে সেই সময়ের সাহিত্য ও চিত্রশিল্পে বহুমাত্রিক বিস্তার এসেছে,সৃষ্টি হয়েছে  নানা ধারা ও আঙ্গিক।শিল্পে যে নৈর্ব্যক্তিকতা সেটাও কিন্তু এই একঘেয়ে নগর বাস্তবতার ফল,ফলে নৈর্ব্যক্তিক হলেও সমাজ বাস্তবতার নিরিখেই তা নৈর্ব্যক্তিক এবং সমাজ বাস্তবতার আলোকেই তার প্রকৃত পাঠোদ্ধার সম্ভব।


করোনা ও যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে একই কারণে উত্তরাধুনিক কবিতাপর্ব শেষ হবার দিন ঘনিয়ে আসছে।জীবন কঠিন হচ্ছে।দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি,যুদ্ধ,মহামারি ইত্যাদির ফলে কবিরা আর বেশিদিন শব্দবিলাসে মেতে থাকতে পারবেন না।তারা আবার অনুভূতির কথা বলবেন,চারপাশের কথা বলবেন।সমাজ আবার প্রতিবিম্বিত হবে কবিতায়।যারা এখন লিখছেন তাদের মধ্য থেকেও এই ধারার কবিতা উঠে আসবে,আবার একদল নতুন কবিগোষ্ঠীও আত্মপ্রকাশ করবে।উত্তরাধুনিক কবিতা তাই বলে ব্যর্থ নয়।এটারও প্রয়োজন ছিল।কবিতার বিশেষ এক শাখা হিসেবে,নন্দনতত্ত্বের তিলোত্তমা হিসেবে এর নামও কবিতার ইতিহাসে লেখা থাকবে।সেই সাথে পাঠক বিমুখতার কলঙ্কও তাকে বয়ে বেড়াতে হবে।সম্ভবত গত ২০-৩০ বছরে কয়েক হাজার কবি উত্তরাধুনিক কবিতা লিখেছেন।তার মধ্যে সর্বোচ্চ ৫-১০ জনের নাম সাহিত্যের ইতিহাসে লেখা থাকবে।বাকিরা তাদের অনুচর,গুপ্তচর বা সমবৈশিষ্ট্যের অভিধায় ব্যক্তিস্বরের অভাবে হারিয়ে যাবেন।

করোনা পরবর্তী সংগ্রাম মুখর পৃথিবীতে তাই শুরু হয়েছে নতুনধারার সাহিত্য আন্দোলন।২৬ নভেম্বর,২০২১ মৌচাক টাওয়ার, মালিবাগে শরীয়তপুর সাহিত্য পরিষদ এর আয়োজনে সম্পন্ন হয় নতুন ধারার ইশতেহার ঘোষণার প্রথম আনুষ্ঠানিকতা।নতুনধারার সৃষ্টি বিষয়ে কবি ফাহিম ফিরোজের ভাষ্য হল-করোনায় যে ভাবে বিশ্ব আজ দলিতমথিত, দ্রুত পরিবর্তিত, মৃত্যু,আর্তনাদ, শোক,একাকীত্ব, সন্দেহ, খাদ্যাভাব, অর্থ সংকট,বেকারত্ব,জন্মহীনতা-- অতীত বিশ্ব কখনও এমন ভয়ংকর চিত্রের মুখোমুখি হয়নি মনুষ্য সমাজ।করোনাকালীন সৃষ্ট সাহিত্যই  বিশ্বে  নতুন ধারা। এটা করোনাকালে ধুমকেতুর মত হঠাৎ, দৈবিক সৃষ্টি। কোনো বিবর্তন নয়। বিবর্তন ঘটে ধীরে।কবি ফাহিম ফিরোজ তাই নিম্নোক্ত ইশতেহারের মাধ্যমে নতুনধারার ঘোষণা দিয়েছেন--


১)জরুরি প্রমিত ভাষার সাথে  স্থানীয় ভাষার কোমল মিশ্রণ। এদুটো বৈশিষ্ট্য নতুন পৃথিবীর নতুন ধারায় কবিতায় অনস্বীকার্য।


২)আধুনিকের মতো অভেদ্য নয়,এখন কিঞ্চিৎ সহজবোধ্য কবিতা হবে।কবিতার কোনো অংশকণা নিয়ে দীঘল ভাবনার অবসর কম থাকবে।

৩)নন্দন তত্ত্ব অনেকাংশে  শক্তি হারাবে। শিল্প, ছন্দ, অছন্দ থাকবে। উপমা,
রুপকল্পে  কাঠিন্য নয়,সহজ স্বাভাবিক রূপ থাকবে। অথবা না থাকলেও ক্ষতি নেই। কাব্য গঠনে শিথিলতা রবে।


৪)যা আধুনিকে ছিল না--মানুষ মৃত্যু আতংকে কম বেশি ধর্মমুখী হবে।আধুনিকরা যা পরোক্ষভাবে নিষিদ্ধ করেছিল।আস্তিকতা - নাস্তিকতা দুটোই থাকবে।

৫) পরিহার্য্য রাজনৈতিক কোন্দল। প্রকৃতি,
বিয়ং (রহস্যময়তা), কল্পনা, অলৌকিকতা  জরুরি।

৬)  নতুন শব্দের খেলা, ভোগবিমুখতা, নির্জনতা থাকবে। অসাম্যের মৃত্যু ঘটবে। নতুন পৃথিবী এগিয়ে যাবে প্রগতির চাকা ছুঁয়ে, সবুজ ও মৃত্তিকার মেলবন্ধনে।

৭)শুধু ইতিহাস ঐতিহ্য নয়,এবার পুরাকীর্তি  গণ্য হবে অধিক । পুরাকীর্তি না থাকলে সে ইতিহাস মিথ্যাময়।

৮)আত্মীয় আর সম্পর্ক বাচক শব্দের নাম সহ  প্রয়োগ অপরিহার্য।

৯) বহুরৈখিকতা আবশ্যক। আধুনিকের মতো শুধু মৌল নয়,গৌণদের কথাও থাকবে। সমাজ কাঠামো নির্মাণে তাদের প্রভূত অবদান।  

১০)ভালোবাসা, কাম,নারীর সৌন্দর্য ও ক্ষমতায়ন বৈধ। নতুন পৃথিবীতে সব কিছুই নবীনকরণ।

কবিতায় ঘটা করে ইশতেহার ঘোষণা অনেকের কাছেই জরুরি মনে না হতে পারে কিন্তু কবিতা যখন চারপাশ থেকে মুখ সরিয়ে কৃত্রিম আলোর ল্যাবরেটরিতে বসে গন্ধহীন ব্যতিক্রমের প্রতি সর্বশক্তি নিয়োজিত করে তখন ভিন্ন একটি স্রোতে শিল্পের চিরায়ত ধারাকে বিকাশের জন্য ইশতেহার ঘোষণা জরুরি হয়ে পড়ে।যে শিল্প আন্দোলন কবিতায় তার সময় ও চারপাশের জীবনকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলে তা অবশ্যই কোন গণ্ডীবদ্ধ সীমানা নয়।নিজস্ব সংজ্ঞার জন্যই তা সবসময়ের জন্য নতুন।

নিয়ম বেঁধে দিয়ে সাহিত্য আন্দোলন কখনও ফলপ্রসূ হয় না।তবে কখনও কখনও স্তিমিত বর্তমান থেকে নতুনের ধারাকে পৃথক করে বুঝার জন্য কিছু স্বল্পকালীন নিয়মের প্রয়োজন হয়।নদীকে যেমন দুইদিকে বাঁধ দিয়েই জলকে একদিকে গন্তব্যমুখী করতে হয় সাহিত্যেও কখনও কখনও এরকম নির্দিষ্ট কিছু নিয়ামক জরুরি হয়ে পড়ে।ব্যক্তিগতভাবে আমি কোন সাহিত্য আন্দোলনকে ধর্মের মত একমাত্র উপাস্য হিসেবে মানি না।সব ধারাই কম-বেশি সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।গত ২০-৩০ বছরে উত্তরাধুনিক ধারার প্রচুর কবিতা লেখা হয়েছে।আমি মনে করি এর থেকে যা পাওয়ার তা আমরা পেয়েছি।এখন শুধু নন্দনের ঘনঘটা করে এর চর্বিত অংশের চর্চা চলছে।ফলে বাংলা কবিতায় নতুন কিছু যোগ হচ্ছে না।গত ৩০ বছরে কয়েক লক্ষ কবিতা লেখা হলেও,সেখানে প্রতিভার স্বাক্ষর থাকলেও,দুঃখের সাথেই বলতে হয় সেখান থেকে একটি কবিতাও আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসতে পারেনি।এই সমগ্র কালখণ্ড আবুল হাসানের -ঝিনুক নীরবে সহো কবিতার তুল্য একটি দীপ্তিময় পঙক্তি আমাদের উপহার দিতে পারেনি ।গত ৩০ বছরের উত্তরাধুনিকতার চর্চা বাংলা কবিতায় আবুল হাসানের মত ক্ষণজীবি কবির স্থানও দখল করতে পারেনি।সেই অর্থে উত্তরাধুনিক কবিতা একপ্রকার ব্যর্থ হয়েছে।পাওয়ার মধ্যে যা পাওয়া তা হল এর নন্দনতত্ত্বের পরাকাষ্ঠা,যার খণ্ডাংশ ভবিষ্যতের নতুন কবিতায় ব্যবহৃত হতে পারে।

উত্তরাধুনিক কবিতা থেকে আরেকটি প্রাপ্তি হল তার ব্যর্থতা থেকে পাওয়া শিক্ষা।রবীন্দ্রোত্তর কবিতায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ছন্দের যাদু দেখিয়ে যা করেছিলেন উত্তরাধুনিকতাও নন্দনের যাদু দেখিয়ে অনেকটা তাই করেছে।সত্যেন্দ্রনাথ সমকালের পাঠকমহলে স্বল্পস্থায়ী অনুনাদ সৃষ্টি করতে পারলেও উত্তরাধুনিকতা তা থেকেও তিরোহিত।ভাবের অপুষ্টিতে সত্যেন্দ্রনাথ আজ অনুচ্চারিত।কাঠামো ও চিত্রকল্পের উচ্চাসন সত্তেও ভাব ও সমাজবিচ্ছিন্নতার চরিত্র উত্তরাধুনিক কবিতাকেও তেমনি একঘরে করে ফেলেছে।তাই এই শিল্পব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে পরিবর্তীত বিশ্বে শুরু হয়েছে নতুনধারার আন্দোলন।নন্দনের কষাঘাতকে নিয়ন্ত্রণ করে তা আবার সমাজের কথা,মানুষের কথা বলতে চাইছে।এটা খুবই আশার কথা।

নতুনধারা'র কথা শুনে ব্যক্তিগতভাবে আমি আনন্দিত হয়েছি।অনেকদিন থেকেই উত্তরাধুনিক কবিতার নন্দনচর্চার বাড়াবাড়ি,জনবিচ্ছিন্নতা,কবিতাকে অতিরিক্ত কবিতা করতে গিয়ে কবিতার মূল সত্ত্বা থেকেই দূরে সরে যাওয়া এসব অনেককেই পীড়া দিচ্ছিল।কবিতা আবার জীবনমুখী হবে এটাই প্রত্যাশা।তবে তা আবার শামসুর রাহমান,নির্মলেন্দু গুণের ভাষার দিকে গেলে আবার পুরনোতেই ফিরে যাওয়া হবে।'নতুনধারা'র ইশতেহারে প্রমিত ভাষার সাথে প্রচলিত ভাষার মিশ্রণের কথা বলা হয়েছে।এটা একটা নতুনত্ব আনতে পারে।তবে এ বিষয়ে কবিদের খুব দক্ষতা দেখাতে হবে যেন এর মিশ্রণ শিল্পীত হয়,যেন তা বেসুর মনে না হয়।যেকোন নতুন আন্দোলনের প্রথমদিকেই উৎকৃষ্ট ফসল পাওয়া যায় না,শুরুতে তা একটু লঘু থাকে।এতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই।মাটির রাস্তা প্রথমে পায়ের হাঁটার উপযোগী করেই পরবর্তীতে সেখানে গাড়ি চালানোর স্বপ্ন দেখা যায়।তাই এখন পায়ে হাঁটা আত্মবিশ্বাসী কিছু পথিক জরুরি যারা পথের পাশের নির্জনতা,শব্দময়তা সব মনোযোগ দিয়ে শুনবে।

কবিতায় কবি একান্তভাবে স্বাধীন।তিনি কী লিখবেন,কী লিখবেন না এ ব্যাপারে তার ইচ্ছাই চূড়ান্ত।তবে নিজের অবচেতনে বা সচেতনভাবে প্রকাশের দিক থেকে তিনি একটি ধারাকে অনুসরণ করে চলেন।এ কারণেই মধ্যযুগ থেকে মাইকেল আলাদা,মাইকেল থেকে রবীন্দ্র-নজরুল আলাদা।একই ধারাবাহিকতায় রবীন্দ্রযুগ থেকে তিরিশ আলাদা।এই যুগে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিকভাবেই তাই কেউ আর তাদের মত লিখেন না।তার মানে কবিতার বিবর্তনে প্রকাশভঙ্গি ও বিষয়ের বিবর্তনকে অগোচরে সবাই মেনে চলেন।উত্তরাধুনিকতাও কি কবিতার একটি আদর্শ বা ধারা মেনে চলছে না?নির্লিপ্ত দৃষ্টিভঙ্গি ও চিত্রকল্পের নিরীক্ষাধর্মী ব্যবহারে বিষয়হীন অবয়বই কি তার মূল লক্ষ্য নয়?সেই হিসেবে উত্তরাধুনিক কবিগোষ্ঠীও একটি দলের অন্তর্গত।

উত্তরাধুনিক কবিতায় ইতিহাস,ঐতিহ্য,লোকজীবন দারুণভাবে উপেক্ষিত হয়েছে।আমার বিশ্বাস নতুনধারায় বাঙালিপনা আবার নতুনভাবে জাগ্রত হবে।সেজন্য কবিদের বাঙালীর গত দুই হাজার বছরের ভাষা,সাহিত্য ও সমাজ বিবর্তনের ইতিহাস সম্পর্কে অন্তত ধারাবাহিক একটা ধারণা রাখতে হবে।মধ্যযুগের কবিতা থেকে শুরু করে আল মাহমুদ পর্যন্ত চুলচেরা পাঠ জরুরি।পাঠের অভ্যাস ছাড়া দৃষ্টি গভীর হবে না।ফলে লেখাও অগভীর থেকে যাবে,শুধু ভাষার শূন্য কাঠামো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।

চিত্রকল্পের অতিমাত্রার ব্যবহার থেকে বেরিয়ে এসে যতটুকু ব্যবহার কবিতাকে হৃদয়গ্রাহী করে ঠিক ততটুকুই ব্যবহার করতে হবে।দক্ষ রাধুনি মসলার ব্যবহার সম্পর্কে যেরকম সচেতন সেরকম সচেতন হতে হবে।হালের উত্তরাধুনিকতা দুধে হলুদগুড়া দিতেও দ্বিধা করে না।চমকই তার লক্ষ্য,চিরায়ত কিছুর লক্ষ্য তার নেই।আমার বিশ্বাস নতুনধারা প্রকাশে নতুন কিন্তু শিল্পের চিরায়ত আদর্শ মানুষ,জীবন ও প্রকৃতিকে সফলতার সাথে কবিতায় ফিরিয়ে আনবে।


কবিতার কোন ধারাই অন্য কোন ধারার সাথে বিরোধ পোষণ করে না।মূলত পারিপার্শ্বিকের প্রভাব ও প্রয়োজনেই তাদের চরিত্রে ভিন্নতা তৈরি হয়।প্রতিভাবান কবি কোন ধারাই মানেন না তবে তিনি তার যুগধর্মকে স্বীকার করেন।সেই যুগধর্ম আজ নতুন কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে।নিজের সংস্কৃতিকে যে পরিপূর্ণভাবে আত্মস্থ করতে পারেনি,ভিন্ন সংস্কৃতির উদযাপন তার সৃষ্টিতে মৌলিক কোন সংযোজন করে না।বেশিরভাগ সময়ে তা সম্পর্কহীন ও অনাশ্রিত কিন্তু কারও কারও কৌশলগুণে চোখ ধাঁধানো ব্যাপার সৃষ্টি করে।

একদিন সাহিত্যের ভাষাকে বইয়ের ভাষা থেকে মুখের ভাষায় আনার জন্য আন্দোলন গড়ে উঠেছিল,ফলে সাহিত্য অকৃত্রিম হয়েছিল।অথচ আজ সাহিত্য মুখের কথা তো দূরে থাক,হৃদয় থেকেও যেন বিতাড়িত।মধ্যযুগ থেকে কবিতা আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছিল এই মানুষেরই কথা বলা দিয়ে।এক হিসেবে বৈষ্ণব কবিতাতেও মানবিক আদলেই বাক ও মনোধর্মীতা পাওয়া যায়।কিন্তু তার ভাষা ব্রজবুলি ভাষার প্রভাবে ও সুরধর্মীতার জন্য অতি লালিত্যময় হওয়ার কারণে সেখানে আধুনিকতা সৃষ্টি হয়নি।তবে তার সময়ের জন্য সেটাই আধুনিক।সমকালের যা চাহিদা মেটায় তাই সেই সময়ের আধুনিকতা।মোটা চাল মেশিনে মিহি করে কাটলেই যেমন চিকন চালের স্বাদ পাওয়া যায় না তেমনি স্থূল ভাব  উপরচালাকি আঙ্গিকে সূক্ষ্ণধর্মী করে প্রকাশ করলেই তা কবিতা নতুন হয় না।কবিতায় ভাষা,উপমা,রূপক ও চিত্রকল্পের প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে।কবিতা নিয়ে নাড়াচাড়া করা যেকোন কবির পক্ষেই এসব ট্যাকনিক্যাল বিষয় এখন হাতের নাগালে।সুতরাং সেখানে আর বাজিমাত দেখানোর কিছু নেই।


বাংলা কবিতায় শামসুর রাহমান,আল মাহমুদের পর এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে।তাদের পর আমাদের ইতিহাস,ঐতিহ্য,লোকাচারকে বিস্তৃতভাবে ধারণ করে এরকম কবি আর আসেনি।বলতে গেলে বাংলা কবিতা তার রাজপথ থেকে সরে গিয়ে যাত্রা থামিয়ে কোন এক নান্দনিক বাগানে চড়ুইভাতিতে মেতে আছে।এই আনন্দ,শব্দের মগ্নতাকে ছোট করছি না।তার আলাদা গুরুত্ব অবশ্যই আছে।তবে বাংলা কবিতার চিরকালের যে প্রেরণা,তা ফিরিয়ে আনতে আবারও রাজপথের কবি দরকার।রাজপথের কবি মানেই তিনি রাজনীতি ও বিবৃতিধর্মী কবিতা লিখবেন তা নয়।তিনি মূলত বাঙালী সংস্কৃতি ও বিশ্ববোধকে এক বিস্তৃত সীমানায় ধারণ  করবেন এবং তার সৃষ্টিতে তার প্রকাশ ঘটাবেন।

মধ্যযুগের দেব বন্দনা,অনুবাদ সাহিত্য,মঙ্গল কাব্য এসবের ভেতর পুনরাবৃত্তিমূলক উপাদান থাকলেও,কবিতার যে ব্যাপক প্রেরণা তার কখনও অভাব ছিল না।জীবন ও সমাজের সাথে সেইসব কবিতার ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক,তার উপযোগিতা ছিল সমাজে।কবিতায় কবির জীবনের অবশ্যই ব্যাপক প্রভাব থাকে।কবিকে ভাল বা মন্দ হতে হবে এটা জরুরি নয় সত্যি,তবে কবিকে তার আদর্শে,তার বোধে,তার সীমানায় অনেক বড় হতে হয়।সমকালীন জীবন জটিলতা কবিকে সে সুযোগ দিচ্ছে না সেটা ভিন্ন কথা।এই অজুহাতে কোন কবিকে গ্রেস মার্ক দিয়ে বাংলা কবিতা তো তাকে সিংহাসনে বসাবে না।সৃষ্টির সাধনা দিয়েই তাকে তা অর্জন করতে হবে।কবিতার যত রথী-মহারথী আছেন তাদের সবাই বলে গেছেন যে কবিতা যখন মানুষের জীবন ও প্রকৃতির অবলম্বন থেকে দূরে সরে যায় তখন তা শুষ্ক ও প্রাণহীন হয়ে আসে এবং শিল্পের চিরায়ত আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়।সঞ্চয় ফুরিয়ে এলে ক্রমেই তা চমক ও আলোবাজির দিকে ঝুঁকে পড়ে।তাই ভাষাকে নিজের প্রয়োজনেই আবার মাটি ও প্রাণের কাছে ফিরতে হবে।

শূন্য ও দ্বিতীয় দশকের কবিতা তিরিশের কবিতার উত্তরসুরী।তবে তিরিশের কবিতা থেকে তা কতটুকু অগ্রগামী তা নিয়ে আমার ঘোর সন্দেহ।তিরিশের কবিরা মূলত লিখেছেন আধুনিক নগর মানুষের যাপন ও প্রকৃতি বিচ্ছিন্নতা।কখনও তাদের কবিতায় ক্ষীণ স্বরে দেখা গেছে বিপ্লবের সুর।উত্তরাধুনিকতা নামধারী শূন্য ও দ্বিতীয় দশকের কবিতা সেই অর্থে কোন বিশ্বাস বা আদর্শে বিশ্বাসী নয়।তা একধরনের আধ্যাত্মবাদী কিন্তু এটা ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতার মত নয়,জীবন ও জগত বিষয়ে এক ধরনের উন্নাসিক ভাব।উত্তরাধুনিক কবিতা তাই শব্দ সম্ভার ও নান্দনিকতার দিকে বেশি ঝুঁকে গেছে।তবে কেন যেন আমার মনে হয় তিরিশের কবিতার বিস্তীর্ণ পথের চেয়ে তা ক্রমশ ক্ষীণ ও সরু এক পথে হেঁটে চলেছে,বিস্তীর্ণ জীবনের গন্ধ ও আবেগ যেখানে উপেক্ষিত।একদল কবি মিলে একই সুর ও স্বরের কবিতা নিরবিচ্ছিন্নভাবে লিখে চলছে।যেখানে ব্যক্তিগতভাবে তাদের চেনা যায় না,পাওয়া যায় শুধু দলগত পরিচয়।প্রতিভার পরিচয় থাকলেও তা গন্তব্যহীন,সময়ের অনুরণনহীন ও চাতুর্যময়।


নতুনধারা মূলত মহামারি ও যুদ্ধসঙ্কুল পরিবর্তীত বিশ্বে মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তনের ইঙ্গিতকে প্রাধান্য দিতে চায় কবিতায়।সেই সাথে কবিতায় ইংরেজি শব্দের কৃত্রিম ব্যবহারের পরিবর্তে লোকজ শব্দকে গুরুত্ব দেয়।উপমা,চিত্রকল্প,শব্দের ব্যবহারে নন্দনের ভার কিছু কমিয়ে তা পাঠকের হাতে বোধের একটা ছিপ তুলে দিতে চায়।তবে তা একেবারে সরল বা বিবৃতিধর্মী বাক্যাবলীকেই তার উপকরণ করে না বরং তার দেহাবয়বে রহস্য থাকে।সেইসাথে সমকালীন কবিতায় আস্তিকতাকে যেভাবে উপেক্ষা করা হয় তা না করে আস্তিকতা,নাস্তিকতা দুই ধারাকেই এখানে গুরুত্ব দেওয়া হয়।ফলে ধর্মীয় বিষয়বস্তু এখানে শুধু মিথ নয় বিশ্বাসের উপকরণ হিসেবেও উপস্থাপিত হয়।
নতুন ধারা ইতিমধ্যেই সাহিত্য অঙ্গনে তার পরিচয় স্পষ্ট করতে পেরেছে।নানাজন নানা প্রতিক্রিয়া দেখালেও এর প্রতি সমর্থন আছে এরকম মানুষেরও অভাব নেই।কোন যন্ত্রাংশের ভেতর কী কী কারিগরি বিষয় আছে তা তার দক্ষতা নয়,যদি না তার প্রকাশে কোনো উপযোগিতা সৃষ্টি হয়। কোন দামি মোবাইলের মনিটর যদি নষ্ট থাকে তবে তার মূল্যবান সকল যন্ত্রাংশের সমন্বয় অর্থহীন।গত ৩০ বছরের বাংলা কবিতায় নান্দনিক যন্ত্রাংশের এই যে ঘনঘটা দেখা গিয়েছে দুঃখের বিষয় তার প্রকাশের স্থান খুবই সীমিত।ফলে যোগব্যায়াম ও শব্দের কসরতের মাধ্যমে  অহেতুক শিল্পের নন্দন জঞ্জাল বেড়েছে।


পৃথিবীর ইতিহাসে যখনই কোন সাহিত্য আন্দোলন গড়ে উঠেছে তখনই তাকে নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা ও বিরোধী মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে।কেউ তাকিয়েছেন তার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে,কেউ করেছেন রসিকতা।আবার যে কোন ধারার সাহিত্য কর্মীদের মাঝেও দেখা দিয়েছে নানা কোন্দল।এসব অপ্রত্যাশিত কিছু নয়,এর সবকিছুই ধারাবাহিক ক্রমবিকাশের স্তর মাত্র।আত্মবিশ্বাসে স্থির থাকলে,সময় ও জীবন প্রবাহের দিকে মনোযোগ দিলে শিল্পসাহিত্য কখনো নিরর্থক হয় না।।তাই যে কোন সাহিত্য আন্দোলনকে বেগবান করতে প্রথমত নিজেদের সৃষ্টির প্রেরণার প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখতে হবে।আশা করি নতুন ধারা কবিতার চিরায়ত আদর্শকে বহন করে ও মৌলিকতা অক্ষুণ্ন রেখে তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে।তার জন্য যে অপেক্ষা ও স্থিরতার প্রয়োজন তা আমাদের যথেষ্ট আছে।কোন ইশতেহারে যখন সমকালের অনুরণনকে আত্মীকরণের অঙ্গীকার করা হয় তখন তা প্রাচীর না হয়ে বরং প্রাচীরভেদী হয়,নানা মাত্রায় তা বিকশিত হয়।

নতুন যুগের কবিকে নিমন্ত্রণ।

( প্রকাশ--দৈনিক ইনকিলাব ২০.০১.২৩)