বাংলা সাহিত্যে নজরুল এক অসামান্য প্রতিভা।নজরুলের কথা উঠলেই সেখানে অনিবার্যভাবে রবীন্দ্রনাথ এসে পড়েন।আজ পর্যন্ত সেটাই দেখা গেছে।তার কিছু ঐতিহাসিক ও গোষ্ঠীগত কারণ রয়েছে।মূলত রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে পরস্পরের দিকে বিপরীতমুখী করে যেভাবে দেখা হয়,একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী চক্র যেভাবে দেখতে পছন্দ করেন তা এক সামাজিক ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়।তারা তো বিপরীত ননই বরং একই পথের পথিক।তাদের সাহিত্যচিন্তা,চিত্রকল্প,উপমা একই ধরণের।শুধু শব্দ নির্বাচন ও কণ্ঠের উচ্চ-মধ্য মাত্রা নির্ণয়ে তারা আলাদা।সহজভাবে বলতে গেলে নজরুল হলেন রবীন্দ্র কর্ষিত উর্বর মাটিতে সবচেয়ে পরিপুষ্ট ফসল।তাই বলে নজরুলকে রবীন্দ্রনাথের শিষ্য বলছি তা নয়।এটা মূলত এক মশাল থেকে আরেক মশালে আলো ছড়িয়ে যাওয়া,এক আগুনের আঁচ পেয়ে আরেক তৃণ জ্বলে উঠার প্রেরণা পাওয়া।জ্ঞাতসারে অজ্ঞাতসারে নজরুল যে রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রেরণা পেয়েছেন তা তার বিভিন্ন লেখাতেই বোঝা যায়।নজরুল যখন কিশোর রবীন্দ্রনাথ তখন নোবেল পুরষ্কার পাওয়া এক দিগন্ত বিস্তারকারী কবি।সুতরাং নজরুল কৈশোরেই মাথার উপরে এরকম জ্বলজ্বল করা এক প্রতিভা দেখে নিজেও অনুপ্রাণিত হবেন এ আর আশ্চর্য কী?
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের বয়সের পার্থক্যটা হল নানা-নাতি সম্পর্কে বয়সের যে পার্থক্য থাকে তার মতো।নজরুল নিজে রবীন্দ্রনাথকে সবসময় গুরুদেব বলে সম্বোধন করতেন।নজরুল তার সঞ্চিতা কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করতে গিয়ে লিখেছেন "বিশ্বকবি সম্রাট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর/শ্রী শ্রী চরণারবিন্দেষু'।এভাবে রবীন্দ্রনাথ কেন কোন মানুষকেই কেউ শ্রী শ্রী বলে অভিহিত করেননি কারণ হিন্দু রীতি অনুযায়ী শ্রী শ্রী উল্লেখ করা হয় শুধু ভগবানের ক্ষেত্রে।রবীন্দ্রনাথকে নজরুল কী পরিমাণ শ্রদ্ধা করতেন এ থেকে তা বোঝা যায়।
তাদের সম্পর্ক বেশ আত্মিক ছিল।নজরুল যখন বিদ্রোহের সুর দিকে দিকে বাজাচ্ছিলেন তখন রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে,তার মত বয়স থাকলে তিনিও একই ভাবে বিদ্রোহ করতেন।মূলত উপরের দিক থেকে নজরুল প্রতিভার এক বিরাট স্বীকৃতিও প্রথম আসে রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে।রবীন্দ্রনাথ যখন তার 'বসন্ত' নাটক নজরুলকে উৎসর্গ করেন তখন নজরুল কী পরিমান উৎফুল্ল হয়েছিলেন তা সেই আনন্দে কারাগারে বসে লেখা 'আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে' কবিতা থেকেই বোঝা যায়।সেই সময় এটা নজরুলের জন্য এক বিরাট প্রাপ্তি ছিল এবং সমসাময়িক অনেকেই নজরুলের এমন প্রাপ্তিকে হিংসার চোখে দেখেছিলেন।
নজরুলের সাহিত্য আলোচনা করতে গেলেই অনেকেই রবীন্দ্রনাথের সাথে তার তুলনা করে থাকেন একথা আগেই বলা হয়েছে।তুলনা করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় তাদের দুজনেই মহাপ্রতিভার অধিকারী।দুজনের অবস্থানই উচ্চ আকাশে।তবে একজন সূর্য দূরত্বের উঁচুতে একজন চন্দ্র দূরত্বের উঁচুতে।আমাদের মতো সাধারণ মানুষের সাধারণ চোখে তাদের উচ্চতার আসন একই রকম এবং দুজনকেই অসামান্য প্রতিভা হিসেবে বোঝার জন্য এই বোধই যথেষ্ট।তবে যারা সাহিত্যের সমালোচক বা যারা তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেন তারা জানেন রবীন্দ্রনাথ হলেন ঋষি টাইপের ধ্যানি প্রতিভা।তার এলাকা অনেক বিস্তৃত,চিন্তার মাঝে সৃষ্টির মাঝে সহজাত বিস্তৃতিজাত সুবিশাল শূন্যতা।যেখানে শিল্পমন যথেষ্ট অবসর নিয়ে নিয়ে রস গ্রহণ করতে পারে।রবীন্দ্রনাথের গান এইরকম শূন্যতার আনন্দ।যখন তা শুনা হয় মনে হয় মন কোন এক শূন্যে ভেসে যায়।প্রকৃতি যেমন তার সমস্ত কর্মকাণ্ড,কর্মজজ্ঞ লুকিয়ে শুধু তার রূপকে প্রকাশ করে রবীন্দ্র সাহিত্যও তেমনি তার কলকব্জার ঘনঘটা লুকিয়ে শুধু রূপকে প্রকাশ করে।এ এক দারুণ স্থিরতা ও অধ্যবসায়ের ব্যাপার।রবীন্দ্রনাথ এতটাই প্রাকৃতিক ও সহজাত যে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের ধারে কাছেও এ ব্যাপারে কারও তুলনা চলে না।
নজরুলের শিল্প প্রতিভা রবীন্দ্রনাথের মতো শূন্যের ও মিহি স্বাদ নয়।তা জীবনের তীব্র অনুভূতির উচ্চকিত প্রকাশ।ভালোবাসার,বিরহের,বিদ্রোহের।রবীন্দ্রনাথ খুব গভীরে নিয়ে যায় আর নজরুল প্রচণ্ড কাঁপায়।একজন উত্তর দেয় ভালোবাসি কেন এই গভীর নস্টালজিক প্রশ্নের,আরেকজন উত্তর দেয় ভালোবেসে পাইনা কেন এই তীব্র কর্কষ স্বাদের।রবীন্দ্রনাথের দুঃখের মাঝেও এক ধরনের আনন্দভাব,নজরুলের আনন্দ ভাবের মাঝেও কান্নার এক ধরণের সুর।মূলত অত্যন্ত সংগ্রামী ও মাটিঘেঁষা হওয়ায় নজরুল কখনও জীবনের দুঃখময় স্রোত থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেননি।তাই তার লেখা সাময়িকের এত উত্তেজনা ও কম্পন বহন করেছে।অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ সাময়িকতা থেকে শুধু নির্যাসটুকু নিয়ে চিরায়ত অনুভূতির সাথে তাকে মিশিয়ে দিয়েছেন।রবীন্দ্রনাথের স্বচ্ছল জীবন ও আন্তর্জাতিক বোধ তার এই শিল্পসত্ত্বা নির্মাণে সাহায্য করেছে।আবার নজরুলের শিল্পসৃষ্টি সাময়িকতা দ্বারা আক্রান্ত হলেও সেগুলো এত জীবন্ত যে এবং বিষয়গুলো সকল যুগের মানুষের সাথে এমনভাবে যুক্ত যে সাময়িক হয়েও তা চিরায়ত।
কবিতায় নজরুল সমাজের নানা বিষয়কে উপস্থাপন করেছেন দক্ষতার সাথে।তার প্রকাশভঙ্গিও সমসাময়িকদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।সবচেয়ে বড় কথা প্রকাশভঙ্গিতে তিনি তার সময়ের উচ্চমাত্রার চুম্বকীয় শক্তি রবীন্দ্রনাথ দ্বারা প্রভাবিত হননি।এটা তার আত্মশক্তির এক বড় পরিচায়ক।তিনি ফারসি কবিতা ও সাহিত্যের প্রচুর চর্চা করেছেন।কবি হাফিজ ও শেখ সাদীর কবিতা অধ্যয়ন করেছেন।ফলে তার কবিতা আরবী-ফারসি শব্দে ভিন্নমাত্রা পেয়েছে।তবে একথা বলতে হয় নজরুল যত বড় প্রতিভা কবিতায় তার সমান অবদান তিনি রাখতে পারেননি।সাধারণ লোকের কাছে এ কথা ঠাট্টার মতো শুনাতে পারে কিন্তু সমালোচকগণ এ ব্যাপারে একমত।নজরুল তার সাহিত্য চর্চার প্রথম দশ বছর ছিলেন কবিতা নিয়ে ব্যস্ত এক বহির্মুখী সত্ত্বা আর শেষ দশ বছর মূলত তিনি গানই রচনা করেছেন।কবিতায় সেই অর্থে মনোযোগ দেননি।এই শেষ পর্বে তিনি ছিলেন অন্তর্মুখী সত্ত্বা।উপন্যাসেও নজরুল সম্পর্কে একই কথা প্রযোজ্য।উপন্যাস রচনার মতো এত ধৈর্য্যশীল ব্যাপার নজরুলের চরিত্রের সাথেও যায় না।কোন এক সম্পাদক ধারাবাহিক উপন্যাস লেখাতে গিয়ে পত্রিকা প্রকাশের কয়েকদিন আগেও লেখা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে তন্নতন্ন করে খুঁজে একবাটি পান ও খাতা কলম দিয়ে তাকে একলা ঘরে দরজা বন্ধ করে রেখেছিলেন।তিনি জানতেন একবাটি পান পেলে নজরুলের আর কিছু লাগবে না।কিছুক্ষণের মধ্যেই নজরুল পরবর্তী সংখ্যার জন্য নির্দিষ্ট অংশটি লিখে ঘর থেকে বের হয়ে আসেন।এভাবে নজরুলকে দিয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি লেখাটি শেষ করাতে পেরেছিলেন।এমনই আনমনা ও বিপুল শক্তির অধিকারী ছিল নজরুল প্রতিভা।
নজরুল প্রতিভার সবচেয়ে উচ্চকিত প্রকাশ তার গান।তার গানের এত বিচিত্র সুর ও কারুকাজ,এত বিচিত্র পথে মনকে চঞ্চল করে তোলে যে তা আগ্রহী শ্রোতামাত্রই অনুধাবন করেন।দুখু মিয়া তার দুখের টানাটানিতে সুরধ্যানের এই চর্চা কখন কীভাবে করেছেন তা এক দারুণ আশ্চর্যের ব্যাপার।তিনি জীবন সংগ্রাম করতে করতেই হয়তো সুরের এই ব্যাপারগুলো আত্মস্থ করেছেন।এমনকি রবীন্দ্রনাথের মতো বড় শক্তিও তার গান থেকে কখনও উপকরণ নিয়েছেন।নজরুলের "আমি চিরতরে দূরে চলে যাব তবু আমারে দেব না ভুলিতে" গানের পর রবীন্দ্রনাথ লিখেন "তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে"।নজরুলও রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী দ্বারা বিভিন্ন সময় এভাবে প্রভাবিত হয়েছেন।
গান একটি গুরুমুখী বিদ্যা।একজন সাধারণ কণ্ঠশিল্পী হতে গেলেও যে কাউকে এ ব্যাপারে একটা নির্দিষ্ট পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হয় যা অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য ও সাধনার ব্যাপার।নজরুলের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের জীবনে তিনি তার অল্পই সুযোগ পেয়েছেন।কৈশোরে লেটো গানের দলে অল্পকিছুদিন গানের চর্চা করেছেন,বেশ কিছু উস্তাদের কাছে গানের তালিমও নিয়েছেন তিনি।কিন্তু এইসব বিচ্ছিন্ন ও অল্প পরিসরের চর্চা তার বাংলা গানের জগতে একজন এতবড় সুরস্রষ্টা হওয়ার পক্ষে সাধারণ দৃষ্টিতে যথেষ্ট হওয়ার কথা নয়।বীজ যেমন সহজাতভাবেই বৃক্ষকে ভেতর থেকে বের করে আনে তার বেলায় সেটাই হয়েছিল।তিনি বাইরে থেকে অল্প নিয়ে নিজের সহজাত প্রতিভায় তাকে বহুগুণে বিকশিত করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ হলেন শিল্পের মহাদেশ আর নজরুল নিজেই শিল্প।কবিতা,উপন্যাস,প্রবন্ধ,ছোটগল্প,গান ইত্যাদিতে রবীন্দ্র সাফল্য আকাশচুম্বী।শেষ জীবনে তিনি ছবিও এঁকেছেন।ভ্রমণ করেছেন পৃথিবীর নানা দেশ।তার সাথে সখ্য গড়ে উঠেছিল বিশ্বের সব বড় বড় ব্যক্তিত্বের,বইপাঠ ও ব্যক্তিগত সাক্ষাতে তাদের সাথে হয়েছিল তার চিন্তা ও ভাব বিনিময়।ফলে রবীন্দ্রপ্রতিভা বিশ্বময় বিস্তৃত প্রতিভা হতে পেরেছিল।অপরদিকে নজরুল প্রতিভা এত বিস্তৃত বিষয়কে অবলম্বন না করলেও নিজস্ব পরিধিতে তা সবচেয়ে প্রাণবন্ত,সবেচেয়ে নিপুণ।এক সমুদ্র জলকে একটি মাত্র গ্লাসে ভরে দেওয়া গেলে তা যে পরিমাণ টগবগে ও তেজি রূপ ধারণ করবে নজরুল প্রতিভা ছিল তার মতোই চঞ্চল।বাংলা সাহিত্যে একমাত্র তাকেই জ্ঞানে-অজ্ঞানে রবীন্দ্রনাথের সাথে তুলনা করা হয়।রবীন্দ্রনাথের সাথে একই সমান্তরালে উল্লেখ করার মত নাম বাংলা সাহিত্যে আর পাওয়া যায় না।
(প্রকাশ--২৬.০৮.২২,দৈনিক ইনকিলাব)