ইতিহাস বিখ্যাত কবিদের জীবন কখনও মসৃণ হয়নি।বলা যেতে পারে একটু বিশেষভাবেই অমসৃণ ছিল তাদের জীবন।উর্দু ভাষার কবি মির্জা গালিবের সাতজন সন্তান কেউই তিন মাসের বেশি বাঁচেনি।ফলে তিনি ছিলেন নিঃসন্তান।এমনকি নিজের ভাইয়ের বা বোনের কাছ থেকে দত্তক নেওয়া ছেলেটিও মাত্র ২১ বছর বয়সে মারা যায়।মির্জা গালিব তাই বলতেন যে,কাউকে ভালোবাসতে তার ভয় হয় কারণ তিনি যাকেই ভালোবেসেছেন তারই বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে।সেই উনিশ শতকের প্রারম্ভে সমস্ত জীবন--প্রায় ৫০ বছরের বেশি তিনি দিল্লি শহরে ভাড়া বাড়িতেই কাটিয়ে দিয়েছেন,সেই সময়ের জন্য যা চিন্তাতীত।ভাড়া মেটাতে না পেরে মালপত্র সহ গাছের তলায় নির্বাসিত হয়ে তাকে উৎসুক জনতার প্রশ্নের উত্তরও কবিতার ভাষায় দিতে হয়েছে।উচ্চবংংশীয় ছিলেন বলে আত্মসম্মান নষ্টের ভয়ে তিনি কখনও চাকরি করেননি।নিজের সম্পদের অংশ থেকে তিনি মাসে যে ২৭ টাকা পেতেন তাই দিয়েই জীবন নির্বাহ করতেন।
রবীন্দ্রনাথের আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলেও স্ত্রী বিয়োগ,অল্প বয়সে একের পর এক সন্তানের মৃত্যু,ছোটবেলার খেলার সাথী কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু ইত্যাদি তাকে মানসিকভাবে কখনও প্রশান্তি দেয়নি।তাই মহাকালের ভেতর আত্মবিসর্জন দিয়ে তিনি আজীবন এক মহাঅন্তর্যামীর সাথে একাত্ম বোধ করে নিজের দুঃখ ভুলতে চেয়েছেন।বিরহ তার কবিতায় বিশ্বপ্রেমের মহিমায় প্রকাশ পেয়েছে।
নজরুলের সংগ্রামী জীবনকাহিনী আমাদের জানা আছে।ছেলেবেলায় বাবাকে হারান।শুনা যায় যৌবনে কলকাতায় আসার পর কোন এক অজানা কারণে তিনি কোনদিন আর চুরুলিয়ায় ফিরে যাননি,এমনকি তার মায়ের মৃত্যুতেও!তার কারাবরণ,অভাবের সাথে দোস্তি,বিশৃঙখল জীবন ইত্যাদি আমাদের অপরিচিত নয়।বাংলার আরেক কবি জীবনানন্দের দাম্পত্য বিষাদ,বেকারত্ব ইত্যাদির কথা আমরা সবাই জানি।
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একটা সিঙ্গারা খেয়েও দুপুর পাড় করেছেন।পারিবারিক ও রাজনৈতিক কলহ তাকে স্থিরতা দেয়নি।তাই তার কবিতায় বিদ্রোহের এত তেজ দেখা যায়।সমকালের কবি হেলাল হাজিজ তো একজীবন মগবাজারের হোটেলেই নিঃসঙ্গ কাটিয়ে দিলেন।কেউ হোটেলে সারাজীবন বাস করতে পারে এটা কী ভাবা যায়!
কবিতায় সুখী,দুখী সবারই সমান অধিকার।তবে জীবনের কাছে তীব্র আঘাত পাওয়া লোকদের কলম থেকেই কেন যেন অমর বাণীগুলো বের হয়ে আসে।তাই কালজয়ী কবিমাত্রই কালজয়ী বেদনাভোগী।