কবি কেন কবিতা লেখে এই প্রশ্নটির কোন একরৈখিক উত্তর নেই।কবি তার চারপাশে যা কিছু দেখে,সেসব দেখে ও অনুভব করে বস্তুতন্ত্রের ভেতর যখন নিজের মনকে পুরোপুরি আসন দিতে পারে না তখন সে কল্পনা ও ভাবের সাগরে ডুব দেয়।কখনও আবার চেনা খণ্ডদৃশ্যের মুগ্ধতা তাকে নিয়ে যায় নতুন কোন বিমুগ্ধতার সন্ধানে।কখনও আবার চারপাশের নিপুণ অথচ সংযোগহীন উপাদানের মধ্যে তিনি এক নতুন যোগসূত্র দিতে চান।এভাবে এই প্রত্যক্ষ জগত কবিতার অপ্রত্যক্ষ জগতকে কবির মানসপটে প্রতিনিয়ত নির্মাণ করে চলে।
আমাদের জগত ও জীবন যতটা যুক্তিপূর্ণ মনে হয় আসলে ঠিক ততটা নয়।ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় দিন-রাতের আবর্তন হলেও সমস্ত প্রকৃতির নির্দিষ্ট ব্যাকরণ নেই।তা হয়তো একটি সাধারণ পথে চলে কিন্তু কখন কোন ঘুপচিগলিতে ঢুকে পরে নতুন পথ নির্মাণ করবে তার ঠিক নেই।প্রকৃতির মত মানুষের জীবনেও এই অনিশ্চয়তা সবসময় বিরাজমান।কী শরীর কী মন কোন কিছু সম্পর্কেই ভবিষ্যৎবাণী করা যায় না।আজ একজনের নাড়ীনক্ষত্র পরীক্ষা করেই বলা যায় না তিনি এতদিন সুস্থ থাকবেন বা এতদিন বাঁচবেন।মানুষের মনের জগত তো আরও অস্থিতিশীল।সর্বোপরি ব্যক্তির অস্তিত্বের সংকট,চারপাশের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সংঘাত ইত্যাদি তার চেতনাকে মহাজাগতিক ইশারার পথে নিয়ে যায়।পঞ্চইন্দ্রিয়ের বাইরে অথচ পঞ্চইন্দ্রিয়ের সমন্বয়ে নিজেকে আরও বৃত্তভেদীভাবে অনুভবের এই প্রেরণা তাকে কবিতার ভূমি নির্মাণে সহায়তা করে।
কবিতা হয়তো জীবনের অর্থহীনতাকে মহিমান্বিত করতে চায়।জীবনের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে যে মানুষ বিভ্রম আবিষ্কার করেন,যে বিভ্রমে না পড়েও যার উপায় নেই--এত এত ভুলের গুহায় নিক্ষিপ্ত মানুষ আত্মপরিশুদ্ধির জন্য কবিতা লিখবেন না তো কী করবেন?কবিতা মূলত এই বস্তুতান্ত্রিক জগতের বিপরীতে প্রতিস্পর্ধী এক ভাষিক জগত যেখানে ধ্যানমগ্ন কবি বুদ্ধের মত অনুসন্ধান করে চলেন নির্বাণের পথ।এই নির্বাণ একেক কবির কাছে একেক রকম।কেউ অর্থ খুঁজে পেয়ে খুশি কেউ অর্থহীনতার সৌন্দর্যে বিভোর।
মানুষ হিসেবে মানুষ যা যা নয়,আর যা যা সে হতে পারতো,আর যা যা তার গন্তব্যে থাকা উচিত ছিল কবিতা তার ক্ষতিপূরণের ট্যাবু ও টোটেম।
মানুষ জানে মহাকালে সে প্রান্তভেদী কোন রেখা নয়।মহাকালের কোন এক প্রান্তরে হঠাৎ জ্বলে উঠে হঠাৎ তার নিভে যাওয়া।কে তাকে জ্বালাচ্ছে কে তাকে নেভাচ্ছে--নানা মতবাদ থেকে সে তার উত্তর পেলেও নিজস্ব অভিজ্ঞতা দিয়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করতে পারে না।তাই সব বড় কবির রচনাতেই মৃত্যুচিন্তা ও অস্তিত্বের সংকট এক বিরাট প্রকল্প নিয়ে উপস্থিত হয়।ফলে অবচেতনের পথে সে সন্ধান করে বহুমাত্রিক জীবনের সংকল্প।
কবি কেন কবিতা লিখে এই প্রশ্নের সামান্য উত্তর দেওয়ার পর কিছুটা আলোকপাত করা যাক কবিসত্ত্বার উপর।কবি কেন কবিতা লিখে--মূলত এই প্রশ্নের উত্তরেই আছে কবিসত্ত্বার বৈশিষ্ট্য।কবি এমন এক সত্ত্বা যে ক্ষুদ্র বস্তুকেও মহজগতের সাথে একত্র করে তার বিরাট সৌন্দর্য দেখতে সক্ষম।ফলে আঙিনায় ঘোড়ার খুড়ের আঘাতে সামান্য গর্তে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে আকাশের প্রতিবিম্ব দেখতে তার সমস্যা হয় না।
আবার একই কারণে কবির এই বিশ্ববিক্ষণই তাকে কোন একক সৌন্দর্যে মগ্ন করে রাখতে পারে না।ক্ষুদ্র দেখেই সে যেমন চোখ সরিয়ে নেয় না তেমনই কোন বড় কিছুও আবার তার মনকে এককেন্দ্রিক করে ধরে রাখতে পারে না।ফলে দিনশেষে কবি কোন নির্দিষ্ট ঠিকানায় নিজেকে নিবদ্ধ করতে পারেন না।এক আশ্রয়হীন বোধের জগতে তখন চলতে থাকে তার যাযাবর জীবন।কবির এই ভেতরের আশ্রয়হীনতা তার বাইরের জীবনকেও বিক্ষিপ্ত করে।ফলে কবিকে ব্যক্তিগত জীবনে প্রায়ই হতে হয় বিচ্ছিন্ন,প্রতিভাবান হয়েও জাগতিক যৌক্তিক সাফল্যের পথে নিজেকে পরিচালিত করতে তিনি প্রায়ই ব্যর্থ হন।বাইরে ও ভেতরে বিক্ষত কবি তখন মাতৃখেকো কবিতার কাছেই নিজেকে সমর্পন করেন।এ ছাড়া তার আর কোন উপায় থাকে না।
(চলবে......)
২৬/০৩/২৩
২
বর্তমানে বাংলাদেশে বইমেলাকে কেন্দ্র করে সাহিত্যজগত যেভাবে আবর্তিত হচ্ছে তা একদিকে যেমন আশার অন্যদিকে তেমনি হতাশার।আশার এ কারণে যে,বইমেলাকে কেন্দ্র করে লেখক-পাঠক- প্রকাশকদের মাঝে যে উচ্ছ্বাস লক্ষ করা যায় তা আনন্দের।অন্যদিকে হতাশার এ কারণে যে বইমেলার বাইরে সাম্প্রতিক সাহিত্য জগত যেন অনুজ্জ্বল এক মৌন দ্বীপ হয়ে গেছে।বইমেলার বাইরে হাতে গুনা কিছু বই ছাড়া আর কোন নতুন বই প্রকাশ হয় না বললেই চলে।ফলে লেখক-পাঠকদের ধারাবাহিক বিকাশ প্রক্রিয়া এক্ষেত্রে লক্ষ করা যায় না।বছরের একটি সময় জ্বলে ওঠে বাকি সময়টা যেন তারা শীতনিদ্রায় চলে যান।
আবার দেশে একশ্রেণীর প্রকাশক তৈরি হয়েছে যারা শুধু বইমেলাতেই টাকার বিনিময়ে বই প্রকাশ করেন।ধরা যাক তিনি যদি বইমেলাতে ২৫ টি বই প্রতিটি ২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে প্রকাশ করেন তাহলে তার অন্তত দেড় লাখ টাকা লাভ হওয়ার কথা।বই বিক্রির কোন চিন্তা নেই,নতুন পাঠক তৈরির কোন মাথাব্যথা নেই---বইমেলার আগে মাত্র দুই মাস পরিশ্রম করে এই বাড়তি অর্থলাভ বৈষয়িক দিক থেকে খারাপ নয় নিশ্চয়!এবার বছরের বাকি সময়টা আয়ের অন্যপথে মন দিলেই হল।এভাবে এইসব হাইব্রিড প্রকাশকদের কাছে বাংলা সাহিত্য কুক্ষিগত হয়ে পড়ছে।অপরদিকে শৌখিন টাকাওয়ালা লেখকদের ভীড়ে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে জীবনঘনিষ্ঠ প্রকৃত লেখক।একবারে সব বই এর মহান ক্রেতা যখন লেখক নিজেই হয়ে যান তখন দুর্বৃত্ত প্রকাশকের পক্ষে বিত্তহীন লেখকের জন্য পাঠক খুঁজে মরাটা কাব্যিকতা ছাড়া কিছুই নয়।লেখককে রয়্যালটি দেওয়ার ব্যাপারটা তখন তার কাছে কাঁথামোড়ানো ঘুমে পানি ঢেলে দেবার মতোই আতঙ্কময়।
৩
ইতিহাসের যেকোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক তরুণ/তরুণী সাহিত্যচর্চায় মনোযোগ দিয়েছেন।ইতিহাসের যেকোন সময়ের চেয়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বই,বিশেষ করে কবিতার বই এখন প্রকাশিত হচ্ছে।তবু নব্বই পরবর্তী বাংলা কবিতা কবি ও কবিপ্রত্যাশীদের বাইরে বিস্তীর্ণ পাঠকের কাছে কেন পৌঁছতে পারছে না তা এক ভাবনার বিষয়।যারা সমকালীন কবিতা চর্চার সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত তাদের জিজ্ঞেস করে লাভ নেই,আপনি যদি দেশের কোন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীকে আচমকা পথে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করেন যে, এই সময়ের জীবিত কোন কবিকে সে চেনে কিনা--আমার বিশ্বাস কবিতায় সদ্য একুশে পদক পাওয়া কবিকেও সে চিনবে না।অপেক্ষাকৃত তরুণ কবিদের কথা তো অনেক দূরের বিষয়।
এটা ঠিক যে নব্বই পরবর্তী কবিতা এমন বৈশিষ্ট্যকে নিজের জন্য অপরিহার্য ঘোষণা করেছে যার ফলে জনপ্রিয় ধারার কবিতা তার পক্ষে লেখা সম্ভব হচ্ছে না।তবে কেউই টিকে থাকার মত বা পাঠক মহলে মনোযোগ পাওয়ার মত লিখছে না সেটাও সত্য নয়।নব্বই পরবর্তী কবিরা আসলে জনপ্রিয় কবিদের অজনপ্রিয় ধারার কবিতার মত করে লিখছেন।সেখানে বুদ্ধি,কৌশল,পরিশ্রমের চিহ্ন স্পষ্ট।আর এই চিহ্নের স্পষ্টতাই তাকে সহজপাচ্য হতে বাধা দিচ্ছে।সব মহৎ কবিতাতেই পরিশ্রমের এই চিহ্নগুলো অন্তরালে চলে গিয়ে তার প্রকাশটা বড় হয়ে ওঠে।ফলে পাঠক পঙক্তির প্রক্ষেপনে খুব গভীরভাবে মুগ্ধ হন।
ইতিহাসে যারা বিখ্যাত কবি তারাও এই ধরণের কবিতা লিখতে পারেন তাদের মোট কবিতার ৫-১০ শতাংশ।কেউ কেউ মাত্র ২ টি বা ৫ টি কবিতার জন্যই মহাকালে স্থান পেয়ে যান।তার নামে সেগুলিই বার বার পড়া হয়।বাকি কবিতাগুলি হয়তো উচ্চস্তরের গবেষকগণ বা কোন কবিপ্রত্যাশী তার কবিতার কৌশল উন্নয়নে পড়ে থাকেন।এই ২ টি বা ৫ টি কবিতা যে কেউ চাইলেই লিখতে পারেন না।স্বয়ং নজরুলও সমস্ত জীবনে আর 'বিদ্রোহী'র আশেপাশে কোন কবিতা লিখতে পারেননি।তবে যিনি শব্দ দিয়ে নয় জীবন দিয়ে কবিতা লিখেন তার কাছে এমন কিছু কবিতা একজীবনে ধরা দেয়ই যা তাকে মহাকালে টিকিয়ে রাখে।এজন্য কবি হতে গেলে নিজেকেও কিছুটা কবিতা হতে হয়।
৪
বর্তমানের ভাল লেখাগুলোও আমাদের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে।ফলে যারা ভাল লিখছেন তারা যথেষ্ট প্রাপ্য না পেয়ে আরও ভাল কিছু লেখার প্রেরণা পাচ্ছেন না।আসলে বর্তমানে সাহিত্যের কোন প্লাটফর্ম নেই।আর এত বই বছরের একটা সময়ে একসাথে প্রকাশ হয় যে সেখান থেকে প্রকৃত লেখাগুলো খুঁজে বের করা সম্ভব হয় না।একটা প্রধান সমস্যা হল আমাদের লেখাগুলোর যথার্থ আলোচনা /সমালোচনা হচ্ছে না।যা লেখা হচ্ছে বাংলা সাহিত্যে তার অবস্থান কোথায় তা নিয়ে কেউ লিখছেন না।প্রশংসা তো দূরের কথা,এখন নিন্দা করারও কেউ নেই।নিন্দা করতে গেলেও তো অন্তত কিছুটা পড়ে দেখতে হবে।একটা সময় ছিল যখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সমকালীন সাহিত্য নিয়ে নানা প্রবন্ধ লিখতেন।এখন সেই প্রবণতা একদমই দেখা যাচ্ছে না।এখন তারা শুধু চাকুরিজীবীতে পরিণত হয়েছেন।যেটুকু গবেষণা করছেন সেটাও ক্যারিয়ার গড়ার জন্য পিএইচডি বা অন্য কোন ডিগ্রী লাভের জন্য।সেই থিসিসও আবার প্রকাশিত হচ্ছে পরিপূর্ণ ইংরেজি ভাষায় যার কোন বাংলা অনুবাদ পর্যন্ত করা হচ্ছে না।ফলে জনগণের টাকায় সম্পাদিত এসব থিসিস আমাদের কোন উপকারেই আসছে না।শুধু রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দ আর নয়,নব্বই পরবর্তী বাংলা সাহিত্য নিয়েও গঠনমূলক থিসিস করার সময় এখন এসেছে।যেহেতু নব্বই পরবর্তী সাহিত্য অঙ্গনে বড় ব্যক্তিত্ব এখনও সামনে উঠে আসেনি সেক্ষেত্রে বর্তমানকালের নানা সাহিত্যিকের সম্মিলিত সাহিত্যিক প্রবণতা নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে।এক্ষেত্রে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর এগিয়ে আসা উচিত।কিন্তু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে না বলে সেই স্বপ্ন আজ হয়তো দুঃস্বপ্ন।
দেশের সাহিত্য পত্রিকাগুলোরও এখন করুণ অবস্থা।একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে তা পৌঁছতে পারছে না।কারণ এইসব সাহিত্য পত্রিকার যথেষ্ট প্রচারণা নেই এবং একটি নির্দিষ্ট পরিমণ্ডলের বাইরের লেখকেরা সেখানে লেখার সুযোগ পাচ্ছেন না।দেশের স্বনামধন্য দৈনিক পত্রিকাগুলোতে প্রতি সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে যে সাহিত্যপাতা বের হয় তার অবস্থা আরও করুণ।এগুলো এখন সমকালীন সাহিত্যের কোন প্রতিনিধিত্বই করে না।দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতাগুলোতে কদাচিৎ মানসম্মত লেখা দেখতে পাওয়া যায়।ছোট গল্পে কিছুটা সমৃদ্ধ থাকলেও নিতান্ত কাচা হাতের প্রবন্ধ ও কবিতায় ভরপুর থাকে পাতাগুলো।এর কারণ হল দক্ষ সম্পাদনার অভাব।সাহিত্য পাতার সম্পাদকরাও এটাকে জাস্ট একটা চাকরি হিসেবে নিয়েছেন মনে হয়।কোন রকমে নির্দিষ্ট দিনে পাতাটা ভরাতে পারলেই হল।এখানেও চেনা পরিমণ্ডলের বাইরের খুব কম লেখা প্রকাশিত হয়।অনেক ভাল লেখা তাদের মেইলে পড়ে থাকে কিন্তু অপরিচিত নাম হওয়ায় তা তারা পড়েও দেখেন না।এভাবে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতাগুলো পাঠকের মনোযোগ হারিয়েছে।ফলে এখানে নিয়মিত লিখেও কেউ সাহিত্য অঙ্গনে নিজস্ব স্থান নির্ণয় করতে পারছেন না।
৫
বর্তমানে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বিসিএসকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খাচ্ছে।অনার্স-মাস্টার্স পাশ করে একজন শিক্ষার্থীর যখন আরও উচ্চতর গবেষণায় আত্মনিয়োগ করার কথা তার পরিবর্তে সে বাধ্য হচ্ছে আবার ক্লাশ সিক্স থেকে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত ভুলে যাওয়া সকল বিষয় মুখস্ত করতে।এতে তার লেগে যাচ্ছে ২-৪ বছর।চাকরির জন্য প্রতিযোগিতা থাকবে এটা স্বাভাবিক কিন্তু তার সিলেবাস এমন হবে কেন যে তা একজন শিক্ষার্থীর সাম্প্রতিক অনার্স-মাস্টার্সের উপর না হয়ে পূর্বজন্মের মত ভুলে যাওয়া বিষয়ের উপর হবে?এটা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির মত তার সাম্প্রতিক সিলেবাসের উপর হলে কোথায় কী এমন বিপর্যয় সৃষ্টি হত!পরিবারের সবাই যখন তাকিয়ে আছেন তার ছেলে/মেয়ে একাডেমিক পড়ালেখা শেষ করে এবার পরিবারের হাল ধরবে এমন অবস্থায় কতজনের পক্ষে সম্ভব আবার ২-৪ বছর মেয়াদী রুদ্ধদ্বার পড়াশোনায় নিজেকে নিয়োজিত করা?সৃষ্টিশীল মানুষের পক্ষে এটা আরও অসম্ভব।তবু অনেককেই ছুটতে হচ্ছে এই সোনার হরিণের পেছনে।কারণ এর বাইরেও তাদের জন্য নিরাপদ কোন আশ্রয় নেই।এভাবে একটা সমাজ ও রাষ্ট্র যখন মানুষের সাথে প্রতারণা করে তখন তার সবকিছুই সংকোচিত হয়ে যায়।বাইরের মুক্ত হাওয়াতেও সে নিজেকে কারাবন্দী মনে করতে শুরু করে।
অপরদিকে আমাদের শিল্প-সাহিত্যে বিসিএস কেন্দ্রিক এই বিদ্যাচর্চার প্রভাব ভয়াবহ।দেশের বেশিরভাগ লাইব্রেরি পাঠকশূন্য।কারণ সাহিত্য পড়ে বা অন্যান্য জ্ঞান অর্জন করে কী লাভ যখন চোখের সামনে রয়ে গেছে বিসিএস নামক এত বড় পুলসিরাত।সুতরাং ওটা পাড় হওয়াই এখন সবার একমাত্র লক্ষ্য।এখন অনেকেই তাদের সন্তানদের পরামর্শ দিচ্ছেন যেন তারা অনার্স ফার্স্ট ইয়ার থেকেই বিসিএসের বইগুলোর উপর চোখ বুলাতে শুরু করেন!ফলে দেশের প্রথিতযশা পাবলিক লাইব্রেরিগুলোতেও এখন বিসিএস পরীক্ষার্থীদেরই ভীড়।আমি নিজেই এ দৃশ্য দেখেছি।এভাবে লাইব্রেরিতে সাহিত্য ও অন্যান্য গবেষণার বইগুলোতে শুধু সময়ের ধূলো জমছে ও জাতি এক মেধাহীন প্রজন্ম সৃষ্টি করছে।
এখন কালজয়ী সাহিত্য রচনা না করে কেউ যদি বিসিএস এর একটি ভাল বই লিখতে পারেন আশা করা যায় সেটা দিয়ে তার অনেক বেশি উপকার হবে।প্রকাশকদেরও এখন এদিকেই বিশেষ আগ্রহ।ইউটিউবে সাহিত্য বিষয়ক হাজার বুলি ছেড়ে লাভ নেই,বিসিএস বিষয়ক একটি ভিডিও ছেড়ে দেখবেন কয়েক মাসেই তার ভিউ হাজার থেকে লাখ ছাড়াবে।
এখন সাহিত্য চর্চা করবে কে....আর তা পড়বে কে....নাভিশ্বাস ফেলা,জ্যাম ঠেলা প্রাইভেট চাকরিজীবীগণ নাকি মুখস্তবিদ্যার কঠিন পথে নিজেদের সমস্ত সৃষ্টিশীলতাকে খুইয়ে আসা সেইসব অস্ত্রবিহীন ক্যাডারগণ....
৬
বর্তমানে উপন্যাস খুব সংকটজনক পরিস্থিতি পাড় করছে।মূলত তথ্যপ্রযুক্তির চানাচুর বিনোদনের এই যুগে উপন্যাস পড়ার মত লোক যেমন কম,উপন্যাস লেখার মত ধৈর্য্য দেখাবে এমন লেখকও কম।উপন্যাসের নামে বইমেলা উপলক্ষ্যে যা লেখা হচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা বড়গল্প ছাড়া কিছু নয়।উপন্যাসে একটা পার্শ্বচরিত্রের জীবনেও যে পরিমাণ উত্থান-পতন বা বৈচিত্র দেখা যায় এখন উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রেও তা পাওয়া যায় না।
হুমায়ূন আহমেদ বাংলা উপন্যাসে নিঃসন্দেহে একটি জনপ্রিয় ধারা সৃষ্টি করেছেন।কিন্তু সেই বোহেমিয়ান ও রূপক জীবনকেই আশ্রয় করে যদি সমস্ত সাহিত্য ঘুরপাক খায় তবে তা নিঃসন্দেহে আতঙ্কের কারণ।নদী তো চলবে বহু পথে,বহু শাখা-প্রশাখায় তার জল গড়াবে।নদীর সমস্ত জল যদি হলুদ রঙের পাঞ্জাবীতে আছড়ে পড়ে তবে বাংলার বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ-ঘাট দেখবে কে?তার জনপদের কথাইবা বলবে কে?
বর্তমানে আমাদের পৃথিবী যে ক্রান্তিকাল পাড় করছে,যুদ্ধ-মহামারী,আন্তর্জাতিক বা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ইত্যাদিতে মানুষের জীবন যেভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে তা নিয়ে কোন উল্লেখযোগ্য উপন্যাস লেখা হয়েছে বা হচ্ছে কি?
আসলে লেখবে কে?সময়টা এত সুস্বাদু প্রতারক.....
উপন্যাসের নায়ক তো কখনও উপন্যাস লেখে না।
৭
রবীন্দ্রসঙ্গীত মূলত বাণীপ্রধান।সাধারণভাবে সঙ্গীত একটি সুরপ্রধান শিল্প।সেখানে সঙ্গীত বিষয়ক নানা প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ গানে ভাবকে সুরের উপর যেভাবে প্রাধান্য দিয়েছেন তা খুবই ব্যতিক্রম।এখান থেকেই রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিশীলতার উৎস সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।ভাবকে আশ্রয় করায় এবং তার গানের সুর সেই ভাবের অনুগামী হওয়ায় রবীন্দ্রসঙ্গীত এখনও চিরনতুন।
নজরুল আবার ছিলেন সুরের পাগল।তিনি কবি হওয়াতে তার গানের বাণীও অসাধারণ হয়েছে কিন্তু তার গানে সুরই প্রধান।সুরের খুঁজে তিনি কোথায় যাননি!ভাটিয়ালি,জারি-সারি,ভারতীয় নানা প্রদেশের ক্লাসিক্যাল মিউজিক নানা জায়গা থেকে তিনি সুর আহরণ করেছেন।এমনকি ইরানি গানের সুরেও তিনি গান বেঁধেছেন।১৯৩০-৪০ এই দশ বছর সুরের এই তীব্র সাধনাই তাকে বাকরুদ্ধতার দিকে নিয়ে গেছে কিনা কে জানে!
রবীন্দ্র ও নজরুল--বাঙালী এই দুই সাধকের কাছে চিরকাল ঋণী।
পরবর্তীতে চলচ্চিত্র নির্ভর ও আধুনিক গানের নামে বাংলা গান একান্তভাবে মেলডি প্রধান হয়ে ওঠে।সুরের গুণে "তুমি কেন এলে না/আর ভাল লাগে না" জাতীয় অনেক বাণীও জনপ্রিয় গান হয়েছে।ব্যতিক্রম যে নেই তা নয় কিন্তু বাংলা গানে বাণী ও ভাবের জোয়ার সেইভাবে আর দেখা যায়নি।বাংলা গানে বাণীকে আবার কাব্যিকতায় ফিরিয়ে আনেন কবীর সুমন।কিন্তু তার পরবর্তী উত্তরসাধক আর দেখা যায়নি।বর্তমানে তো বাংলা গান প্রবেশ করেছে এক গুনগুনময় রিমিক্স সঙ্গীতে যার সবচেয়ে হিট গানটিও ছয়মাসের বেশি টেকে না।বর্তমানে তাই কবিদের আবার গানের দিকে কিছুটা মনোযোগ দেওয়া উচিত।
৮
হিন্দি ভাষাটা গানের জন্য খুবই উপযোগী।হিন্দি ভাষায় যুক্তবর্ণের শব্দ খুবই কম এবং শব্দগুলো অধিকাংশই মুক্তাক্ষর বিশিষ্ট।ফলে স্বরধ্বনিকে টেনে ইচ্ছেমত সুর করা যায়।এটা এমন এক লতানো ভাষা চাইলেই গানে একে মাটি থেকে তুলে আকাশে নিয়ে যাওয়া যায় আবার একনিমেষে মাটিতে নেমে যাওয়া যায়।হিন্দি গান তাই এত দ্রুত মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করে।
হিন্দি ভাষায় গান রচনার এই বিশেষ সুবিধার কথা নজরুলও উল্লেখ করেছেন।তাই তো লোভ সামলাতে না পেরে বাংলা গানেও তিনি নির্দ্বিধায় ব্যবহার করেছেন হিন্দি শব্দবন্ধ---"আলগা করো গো খোপার বাঁধন/দিল ওহি মেরা ফাসগেয়ি"।
৯
সুর একটি সর্বগ্রাসী ব্যাপার।কেউ যখন সুরের সাধনায় মগ্ন হন তার অন্যান্য প্রতিভা সেখানে তলিয়ে যায়।নজরুল তার সৃষ্টিশীল জীবনের শেষ দশ বছরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার গান লিখেছেন ও সুর করেছেন।তার মানে প্রতিদিন তাকে অন্তত একটি গান লিখতে ও সুর করতে হয়েছে!মাত্র দশ বছরে এত গান সৃষ্টি করা এক বিশাল ব্যাপার।এই দশ বছর তিনি কবিতা ও সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় একদমই মনোযোগ দিতে পারেননি।রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে হিসাব আলাদা।তিনি ঋষি প্রতিভা।তিনি আশ্চর্য সাধনায় তার সমস্ত সৃষ্টিশীলতার মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করতে পেরেছিলেন।
১০
সাধারণভাবে কথা কোন শিল্প নয়।কথাকে শিল্পরূপ দিতে গেলে হয় তাতে আনতে হয় নাটকীয়তা নয়তো বোধের গাঢ় প্রক্ষেপণ অথবা সুরের মূর্ছনা।সুরের মূর্ছনায় কথা হয়ে ওঠে গান;নাটকীয়তায় গল্প,উপন্যাস বা নাটক।কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে সুরের অভাবকে ঘুচিয়ে দিতে আনতে হয় অনেক কিছু।কিছুটা ছন্দের দোলা,কিছুটা বোধের প্রক্ষেপণ,কিছুটা আড়াল,কিছুটা আরও অনেক কিছু।আবার বিষয় অনুযায়ী এসবের মাঝে রাখতে হয় ভারসাম্য।সুতরাং কথার ভাস্কর্য নির্মাণে কবির কাজ কোনকালেই সহজ ছিল না,আজও নয়।
১১
সাহিত্যে রাজনীতি আছে,খুব কঠিনভাবেই আছে।সাহিত্যের রাজনীতি একেবারে যে খারাপ জিনিস তা নয়।মানুষ যেহেতু রাজনৈতিক প্রাণী সবজায়গায় তাকে রাজনীতি বুঝতে হয় অথবা রাজনীতির কলকাঠি হতে হয়।কিন্তু সাহিত্যের এই রাজনীতিটা হওয়া উচিত তরকারিতে লবণের মত মৃদু।সৃষ্টিশীলতা ছেড়ে ওদিকে বেশি মন দিলে বিপদ আবার একদম তা না বুঝলেও ক্ষতি।
তবে মজার বিষয় হল ফেসবুক আসার পর তা সাহিত্যের এই রাজনীতিকে বিক্ষিপ্ত করে দিয়েছে।এখন আর এর কোন কেন্দ্র নেই।এখন অনেকগুলো দল,উপদল আছে কিন্তু কেউই তারা প্রধান নয়।এটা একদিক থেকে ভাল আরেকদিক থেকে খারাপ।ভাল এজন্য যে, লেখা প্রকাশের জন্য কোন পীর ধরতে হচ্ছে না আবার খারাপ এজন্য যে, তরুণেরা অগ্রজদের পথনির্দেষ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।সাহিত্যের রাজনীতি কেন্দ্রহীন হওয়ায় আবার ভাল লিখেও কেউ সামনে আসতে পারছে না।কারণ সাহিত্যের এককেন্দ্রিক কোন মিডিয়া নেই।আগে বুদ্ধদেব বসুর 'কবিতা' পত্রিকায় লেখা ছাপা হলে তার মোটামুটি একটা কবিস্বীকৃতি জুটে যেত।কিংবা 'দেশ' পত্রিকায় লেখা ছাপা হলে তার একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হত।এখন প্রথম আলোতেও মাসের পর মাস কবিতা ছেপে লাভ নেই।
বাংলা সাহিত্যের অনেক নামকরা সাহিত্যিক আছেন যারা যতটা না প্রতিভাবান তার চেয়ে বেশি পরিচিতি পেয়েছেন বড় বড় পত্রিকার সাথে সরাসরি সংযোগ ও সাহিত্যরাজনীতির কেন্দ্রে অবস্থানের জন্য।তবে এর ব্যতিক্রমও আছে।যেমন বিনয় মজুমদার।তিনি সাহিত্যের রাজনীতিতে উপেক্ষিত হয়েও পাঠকমহলে সমাদৃত।সেটা তার অত্যন্ত গভীর কিছু কবিতার জন্য,সাহিত্যের রাজনীতি যাকে আড়াল করতে পারেনি।
বর্তমান এই পরিস্থিতি কতটা ভাল আর কতটা মন্দ হিসেব করা কঠিন।তবে চলছে যখন চলুক।অদূর ভবিষ্যতে অনেক 'সবাই রাজা'র ভেতর একজন সম্রাট হয়তো উঠে আসতেও পারে।
১২
আবৃত্তিধর্মী কবিতাকে আজকাল অতি সংবেদী কেউ কেউ তরল ও লঘু কবিতা হিসেবে গণ্য করে থাকেন।এমনকি শামসুর রাহমান ও নির্মলেন্দু গুণের বিবৃতিধর্মী কবিতাকেও তারা আক্রমণ করতে ছাড়েন না।দীর্ঘদিন কবিতার সাথে যুক্ত এমন অগ্রজকেও এধরণের পোস্ট দিতে দেখেছি।দেখে মর্মাহত হয়েছি।
বিবৃতিমূলক বা আবৃত্তিধর্মী হলেই তার কাব্যিক মান নেমে যাবে এর যুক্তি কোথায়?যেকোন শব্দ ও ভাষা মানুষের বোধে যদি প্রক্ষিপ্ত হতে পারে,ভেতরে যদি তুমুল আলোরণ তুলতে পারে অথবা মৃদু শিহরণ জাগাতে পারে--সেটাইতো কবিতা।
প্রকৃত কথা হল আবৃত্তিধর্মী কবিতায় উপরিচালাকি চলে না।সত্তার একদম তলদেশ থেকে ওঠে আসলেই কেবল তা তরঙ্গপ্রবণ আবৃত্তিধর্মী হতে পারে।আমরা তো নাগরিক বিলাসে আজ সত্তার তলা খুইয়েছি!সুতরাং ইতিহাসটা অন্য কোথাও।
তরল মানেই সহজলভ্য নয় আবার ঘন-সংবদ্ধ মানেই মূল্যবান নয়।মূল্যবান হল তারা কী বহন করে এনেছে তা।
১৩
সাহিত্যের নানা শাখার পাঠক কমলেও বর্তমানে কিন্তু কবিতার পাঠক বেড়েছে।কারণ কবিদের সংখ্যা অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে রেকর্ড ছাড়িয়েছে।আর বলাই বাহুল্য বর্তমানে কবিতার মূল পাঠক এই কবিরাই।আমাদের পাঠ্য বইয়ের কবিতাগুলো এখনও ১৯৩০ সালের সিলেবাস পার করতে পারেনি বলে বর্তমানে কবি ও নিজস্ব সাধনায় সূক্ষ্মানুভূতি সম্পন্ন গুটিকয়েক মানুষের বাইরে কবিতার পাঠক কম।
বর্তমানে উপন্যাসের পাঠক কমলেও ছোটগল্পের পাঠক এখনও আছে।স্ট্যাটাসটা লিখতে চেয়েছিলাম মূলত এই বিষয়ে যে,বর্তমানে অনেক লেখক/কবি আছেন যারা দীর্ঘদিন সাহিত্যকর্মের সাথে জড়িত থাকার পরও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে তার সৃষ্টিকর্ম মুলতবির ঘোষণা দিচ্ছেন।এর অনেক ধরণের কারণ থাকতে পারে।প্রথমত তিনি হয়তো তার চারপাশ থেকে একদমই প্রেরণা পাচ্ছেন না।দেশে প্রচারযোগ্য তেমন কোন লিটলম্যাগ বা আগের মত আত্মপ্রত্যয়ী সাহিত্যসম্পাদক নেই।আবার তিনি পয়সা খরচ করে ২০০ কপি বই বের করলে হয়তো তার ২০ কপিও বিক্রি হচ্ছে না।এভাবে ৫/১০ টা বই বের হওয়ার পর যে কারও পক্ষেই প্রেরণাহীন হওয়া সম্ভব।
ফেসবুকের এই যুগে লেখক/কবিদের মাঝে সংযোগ বাড়লেও আন্তরিকতা কিন্তু বাড়েনি।বাড়লে আমরা অন্তত আমাদের কাছের বন্ধুর বইটা কিনতাম ও তার প্রচারের দায়িত্ব নিতাম,দুই লাইন পাঠ-প্রতিক্রিয়াও দিতাম।বর্তমানে লেখক/কবিরাই যেহেতু পাঠক তাই মনের সকল কৃপণতা দূর করে আমাদের একে অপরকে প্রেরণা দেওয়া উচিত।
এক অগ্রজ আমাকে বলেছিলেন "সাহিত্যজগতে কোন বন্ধু নেই।সবই শকুন"। কথাটি শুনে মর্মাহত হয়েছিলাম।আমরা চাই একথা মিথ্যা প্রমাণিত হোক এবং কবি/লেখকেরাই পরস্পরের সবচেয়ে নিকটাত্মীয় হোক।
১৩
লেখালেখিকে খুব সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছু নেই।সিরিয়াসলি নেওয়া যেতে পারে একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ যার আশ্রয় হতে পারে এই লেখালেখি।লেখালেখিটা হল জল প্রবাহের জন্য একটা নালা বিশেষ।জলের ব্যবস্থায়নের দিকে মনোযোগ না দিয়ে শুধু তার প্রবাহের উপায় নিয়ে ব্যস্ততা শেষপর্যন্ত হতাশই করে দেবে।অপরদিকে জল যদি উপযুক্ত পরিমানে থাকে তবে তা যেকোন পথেই নদী সৃষ্টি করে গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারে।
সুতরাং ভেতরে সারাংশ আহরণ না করে সারাক্ষণ লিখতেই হবে লিখতেই হবে বলে নিজেকে শাসন করা একটা অন্যায়।লেখালেখিটা একটা আনন্দের জায়গা,নিজের উপর অত্যাচার কখনও নয়।
১৪
তিনটি কবিতাকে কম্প্রেসড করে একটা কবিতা তৈরি করলে প্রায়ই বহুমাত্রিকতা পাওয়া যায়।উত্তরাধুনিক কবিতা তো প্রায়ই প্রতিটি লাইনেই আলাদা আলাদা কবিতাসত্তা ধারণ করে।আমি এতটা পারি না।তবে বিচ্ছিন্ন তিনটি কবিতার সারাংশ একসূত্রে গেঁথে দিয়ে ভাল ফলাফল পেয়েছি।জাঙ্ক ফুডের যুগে কিছুটা কৌশলপ্রবণ না হলেও হয়তো চলে না।তবে অতি চালাকের গলায় দড়ি--কথাটাও মনে রাখা জরুরি।
১৫
বর্তমান যুগটা মারাত্মকভাবে বাজার-অর্থনীতির কবলে।আমাদের জীবনযাত্রা এখন এমনভাবে গড়ে ওঠেছে যে,একজন মানুষের মৌলিক প্রয়োজনটাই দুইদশক আগের চেয়ে প্রায় ১০ গুন বড় হয়ে গেছে।তাই এখন কোন সৃষ্টিশীল মানুষের পক্ষেই জীবনের এই দৌঁড়কে এড়িয়ে শুধু শিল্পসাধনায় মগ্ন হওয়া সম্ভব নয়।আবার এই বদ্ধ ও উন্মাদ পরিবেশে সমাজে শিল্পের উপযোগিতাও কমে গেছে।ফলে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট শিল্প সৃষ্টি করেও এখন কেউ আর তার উপর নির্ভর করে বাঁচতে পারবেন না।আপনার মৃত্যুর পর কোন উৎসুকের মাধ্যমে তার মূল্যায়ন হলেও হতে পারে,কিন্তু জীবিত অবস্থায় এ আশা দুরাশা।
তবু শিল্প-সাহিত্য ধানক্ষেতের আলে ফুটে থাকা ঘাসফুলের মত আলোরিত করুক আমাদের।বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত জুড়ে তার বিস্তার এখন আর কারও জন্যই শোভন নয়।ধানের দশটি গোছার পর রাখা যেতে পারে একটি সূর্যমুখীর বীজ।
প্রথমত মানুষ বাঁচুক,মানুষ বাঁচলে শিল্পও অন্তত জীবাশ্ম হবে না।
১৬
কবিতা তো সেই রক্তক্ষরণ যাকে কবিতা নামে ডাকলেও মেকিত্বের কালিমা লাগলো মনে করে কবি প্রায়ই দূরে সরে যান।কবিতা তো দিনযাপনের একেকটা রেখাচিত্র,গোপন সংকেত,অসংজ্ঞায়িত পরিভ্রমণ।
অথচ মেকি কতকিছুকেই রঙিন আলখেল্লা পড়িয়ে তাকে কবিতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অনেকেই ব্যতিব্যস্ত!
কবি ও কবিতার খেতাব প্রকৃত কবি কোনদিন চান না।তিনি তার যাপনক্রিয়ায় শুধু সৃষ্টির আনন্দ উপভোগ করে যান।
১৭
আয়নায় নিজের মুখ দেখিনা বহুদিন।তবে কবিতায় প্রায়ই নিজের প্রতিবিম্ব খুঁজি।পারা লাগানো আয়নায় যেমন নিজের মুখ দেখা যায়,সত্তা নিঙরানো কবিতায় পাঠক তেমনি নিজের প্রতিবিম্ব দেখে।
কোন কৌতূহলী নিপুণ দক্ষতায় কাচের পেছনে রঙ মেখে দিলেই তা আয়না হয় না,বড়জোড় কাচের দেয়াল হয়।কিছুই প্রতিফলিত করে না বলে তখন তা শুধু ব্যবধানই বাড়ায়।
১৮
কবিতার সারাংশে থাকে ব্যক্তি ও ইতিহাসের হাজার বছরের অভিজ্ঞতা।তাই কবিকে শুধু নিজের জীবন নয়,একটা তৃণের জীবনও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হয়।নিজের অভিজ্ঞতাকে চাড়িয়ে দিতে হয় ইতিহাসের নক্ষত্রে নক্ষত্রে,হতে হয় স্মৃতি ও চিহ্নের বিশ্বকোষ।
অংকের চলকের মত পুনরাবৃত্তিমূলক অভিজ্ঞতাহীন জীবন দিয়ে বছর বছর বইমেলায় কবিতার বই বের হতে পারে কিন্তু পাঠকসমাজে আলোরণ তোলা এত সহজ ব্যাপার নয়।শব্দের পারমোটেশন ও কষ্ট-কল্পনাই কবিতার শেষকথা নয়।
১৯
মানুষ আসলে পৃথিবীতে শুকিয়ে মরার জন্যই জন্মায়।জন্মের পর থেকেই সমাজ ও পরিপার্শ্ব তার অধিকার হরণ করতে শুরু করে।একটা সময় পরে প্রকৃতিও এই কাজে অংশগ্রহণ করে,তখন পৃথিবীর সমস্ত সম্পদের যোগান দিয়েও তার ক্ষয় রোধ করা যায় না।আশা ও স্বপ্নের টানাপোড়েনের মাঝে এই আমিত্বের সংকটই তাকে প্রতিনিয়ত বিভ্রান্ত করে।সময় ও প্রকৃতির কাছে মানুষ আসলে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।তবু শিশিরবিন্দুর মতো সূর্যতাপে শুকিয়ে যাওয়ার আগে মানুষকে বেঁচে থাকার প্রাণান্তকর সংগ্রাম চালিয়েই যেতে হয়।
যারা নিজেদের এই ক্ষয়ে যাওয়াকে প্রতিনিয়ত উপলব্ধি করেন পৃথিবীতে তারাই সবচেয়ে অসুখী।সফলতা-বিফলতার বাইরে আরও এক বিপন্ন বিষ্ময়ের ক্লান্তি থেকে কিছুতেই তারা মুক্তি পান না।
২০
একজন গুণী মানুষ বলেছেন "এখন আসলে হয়েছে অভাবের অভাব"। তিনি রবীন্দ্রনাথের উপর একজন গবেষক,নাম সুধীর চক্রবর্তী।এখন চাইলেই একই রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিভিন্ন শিল্পীর নানা ভঙ্গিমায় গাওয়া রেকর্ডগুলো ইউটিউব থেকে নিমেষেই দেখা যায়।অথচ তার যৌবনে তিনি সপ্তাহের একটি দিনে কোন এক মুদিদোকানের রেডিওতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটা অনুষ্ঠান শুনতেন।সঙ্কোচে বলতে পারতেন না বলে নির্দিষ্ট সময়ে তার উপস্থিতির কারণ টের পেয়ে মুদিদোকানী নিজেই সেই চ্যানেলটি ছেড়ে দিতেন।তিনি যা শুনতেন এরপর সারা সপ্তাহ তা নিয়ে ভাবতেন ও চর্চা করতেন।এভাবে নানাভাবে চলতে থাকে তার রবীন্দ্রচর্চা।সুযোগের এত অপ্রাচুর্যের ভেতরও তার যেটা ছিল তার নাম নিবিড়তা ও একান্ত সাধনা।তাই তিনি 'সুধীর চক্রবর্তী' হতে পেরেছেন।
আজ এই যুগে আমাদের হাতের কাছের এত প্রাপ্তিকেও আমরা ব্যবহার করতে পারছি না কারণ কোন প্রাপ্তিই আমাদের ভেতরকে আলোড়িত করছে না।ভেতরে নেবার মত অবসর,নিবিড়তা কিছুই আর আমাদের নেই।ফলে সকল প্রাপ্তি আমাদের পোশাকের উপর দিয়েই বৃষ্টির ফোটার মত বয়ে যাচ্ছে।কিছুই আমাদের দেহ ও মনকে পরিপুষ্ট করছে না।ফলে চারদিকে এত বারুদ থাকা সত্ত্বেও আমরা জ্বলে উঠতে পারছি না বা কোন গোপন নদীর মতোও বয়ে যেতে পারছি না।
২১
গান গাইতে এসে কেউ যদি বলে তাল-লয় কিছুই মানি না তাহলে যে বিপর্যয় ঘটবে,একই বিপর্যয় ঘটবে কবিতার ক্ষেত্রেও কেউ যদি বলে ছন্দ মানি না।ছন্দ শুধু তো ঐ স্বরবৃত্ত,মাত্রাবৃত্ত আর অক্ষরবৃত্তের নির্দিষ্ট কাঠামো নয়।বাক্যের পদক্ষেপেরও একটা ছন্দ আছে।আধুনিক কবিতায় এর বোধ থাকাটা অত্যন্ত জরুরি।সাধারণ পাঠে সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক ছন্দ নাও পাওয়া যেতে পারে কিন্তু কবির যে ছন্দজ্ঞান আছে তা নিশ্চিত বোঝা যাবে।এই স্তরে আসতে প্রাতিষ্ঠানিক ছন্দে আগে দক্ষ হতে হবে।এছাড়া কোন বিকল্প পথ নেই।
২২
গান ও ছবি আঁকার মত কবিতা লেখা কারও কাছে শেখা যায় না।হয়তো কিছু কলাকৌশল পাঠ নেওয়া যায় মাত্র।কবিতায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার বিদ্যা কবির একান্ত নিজস্ব।তাই কবিতায় পরিশ্রম করতে হয় আরও বেশি।নিজের কাছে প্রতিনিয়ত দীক্ষা নিতে হয় নিজেকেই।বোধ ও মননের প্রত্যেকটি গুহায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় অতন্দ্র প্রহরীর মতো।আর নিজের সাথে চালিয়ে যেতে হয় সার্বক্ষণিক আলাপচরিতা।তবেই আকাশে বিদ্যুৎ চমকানোর মত কখনও কখনও কবিতা ধরা দেয়।
২৩
ইমরান খানকে মোঘল ও ব্রিটিশ আমলে নির্মিত একটি কুখ্যাত কারাগারের নির্জন সেলে রাখা হয়েছে।মাঝে মাঝে মনে হয় এরকম নির্জন সেলে বসবাস একটি শৈল্পিক ব্যাপার।মানিয়ে নিতে পারলে নীরবতার হাজার ঝর্ণাধারার সন্ধান পাওয়া অসম্ভব নয়।
যাই হোক,আমাদের কবিদের হাজতবাসের ঘটনা এখন চোখেই পড়ে না।কবিরা সভ্যতার সাথে খাপে খাপে মিলে গিয়ে কেমন যেন প্রতিবাদহীন নান্দনিক গোবেচারা টাইপের হয়ে গেছে।অথচ তারা যে প্রতিনিয়ত একটি বৃহৎ কারাগারে বাস করছে তার খবরই নেই।রুটি ও মাংসের আহ্লাদ তাদের দৃষ্টিকে আজ অন্ধ করে রেখেছে।তাই আমাদের কবিতায় এখন হিমোগ্লোবিনের এত অভাব।
২৪
"সুন্দরের প্রতিটি দরজা থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আমি নিজের ভেতরের সৌন্দর্য আবিষ্কারে নিয়োজিত হয়েছিলাম।
তারপর সকল সৌন্দর্য আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল।"
২৫
শুধু সাহিত্যে নয়,ভারতীয় সঙ্গীতেও আর্য ও অনার্য মিশ্রণ অত্যন্ত প্রকট।বিশ্লেষকগণ বলেন যে,পনেরো শতকের মধ্যে ভারতীয় সঙ্গীত চীন ও জাপানে অত্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে।একইসাথে ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজনৈতিক সংস্পর্শে আসায় ভারতীয় সঙ্গীত মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়া থেকেও উপাদান গ্রহণ করে ঋদ্ধ হয়।স্বাভাবিকভাবে মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গীতেও তা নিজস্ব উপাদান প্রবেশ করায়।
প্রাচীন ভারতে ধর্ম প্রকৃতি নির্ভর হওয়ায় তার সুর অত্যন্ত সুরেলা।কারণ তখন ধর্মানুষ্ঠানেই গানের প্রচলন ছিল বেশি।তাছাড়া সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ প্রকাশেও গানের ব্যবহার হত।তবে তা ছিল অল্প স্বরের (এক--চার স্বর)।আর্যদের আগমনের পরেই ভারতীয় সঙ্গীতে সাতস্বর বিকশিত হয়।
আমরা পৃথিবীর নানা দেশের গান শুনলেও ভারতীয় সঙ্গীত কেন আমাদের এত মুগ্ধ করে তার কারণ এটাই।এতে রয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সুরের মিশ্রণ।কারণ এত সভ্যতা ও সংস্কৃতির মিশ্রণ আর কোন দেশে ঘটেনি।
২৬
যখন থেকেই প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস পড়েছি আর্য জাতির (ভাষাগোষ্ঠী) আগমনকে আমার কাছে একটি অতিরঞ্জিত বিষয় মনে হয়েছে।কিন্তু তখন এ বিষয়ে বিস্তর জানা না থাকায় সেই বিরোধের সপক্ষে কোন ব্যাখ্যা ছিল না আমার কাছে।প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতিতে আর্যজাতির ভূমিকা থাকলেও সেটাই প্রধান স্রোত নয়।যা কিছু উন্নত তার সবই পশ্চিম থেকে আসা-এই বাণীকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ পশ্চিমকেন্দ্রিক করে সমস্ত পৃথিবীর ইতিহাস সাজিয়েছেন।
সময় এসেছে এখন আমাদের নিজস্ব ইতিহাসকে আবিষ্কার করার।সেজন্য ভারত,পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে একযোগে কাজ করা উচিত বলে মনে করি।সিন্ধু সভ্যতা ও ওয়ারী বটেশ্বর হতে পারে আমাদের ইতিহাসের প্রাচীন সূত্র সন্ধানের উৎসমুখ।
২৭
ইতিহাসে আগ্রহী ব্যক্তি কখনও ক্ষুদ্র বিষয়ে মত্ত হয় না,বর্তমানের অনেক ক্ষয় ও আবর্তনকে সে নির্লিপ্তভাবে বিবেচনা করতে পারে।ফলে ইতিহাসচেতনা তার ব্যক্তিজীবনকেও সংগ্রামী ও ভয়হীন করে এবং তার ভেতর যেকোন ধরণের পরিণতি মেনে নেওয়ার যোগ্যতা তৈরি হয়।একইভাবে যেকোন শিল্পমাধ্যমেও ইতিহাসের বিরাট প্রভাব থাকে।কোন ঘটনা ও বিষয়কে সার্বজনীন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে ইতিহাসের জ্ঞান অত্যন্ত জরুরি।
সাহিত্যের পাশাপাশি ইতিহাস তাই আমার অত্যন্ত প্রিয় বিষয়।সাহিত্যের আফিম ঘোরগ্রস্ত করে ফেলার পর ইতিহাসের ঘোড়ার খুড়ের আঘাত অত্যন্ত উপাদেয়।
২৮
বুটেক্সের প্রথম বর্ষে পড়ি তখন।তখন মনে হত লেখালেখির জন্য ঢাকায় থাকা জরুরি,তাই মেকানিক্যাল বিষয়াদি প্রিয় হওয়া সত্ত্বেও চুয়েটে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বাদ দিয়ে বুটেক্সে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া।আবার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার গোপন বাসনা ছিল বলে ঢাবিতে ফিজিক্সে চান্স পেয়েও পড়া হল না।প্রথম বর্ষে ঠিকানা হল চল্লিশ জনের এক বিশাল গণরুম। বন্ধুরা যখন গণরুমে বিকেলে একসাথে ঘুমাত আমি প্রায়ই ঘুম বাদ দিয়ে তেজগাঁও থেকে শাহবাগে যেতাম।উদ্দেশ্য পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়াশুনা করা।
একদিন প্রথম আলো পত্রিকায় দেখলাম বাংলা একাডেমি থেকে নতুন লেখকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।কিছু লেখা সাথে নিয়ে গেলাম সেখানে।ঢুকলাম একদম মহাপরিচালকের রুমে।গিয়ে দেখি আমার মতোন অপেক্ষায় আছেন অনেকেই।কিন্তু আবেদন জমা দেওয়া গেল না।তার কারণ জাতীয় দৈনিক বা কোন লিটলম্যাগে প্রকাশিত অন্তত ১০ টি লেখা জমা দিতে হবে।তার মানে তারা লেখা যাচাই এর কাজটি করবেন না।তখন মাত্র ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি,ঢাকায় নতুন এসেছি,কোন লেখাই প্রকাশ হয়নি কোথাও।তাই বাধ্য হয়ে একাডেমি থেকে চলে আসি।
টিএসসি চত্বরে এসে মনে হল যে,এত কষ্ট করে এলাম আর লেখাগুলো সাথে নিয়েই ফিরে যেতে হচ্ছে!ব্যাপারটি ভাল লাগলো না।তাই আবার ফেরত এলাম মহাপরিচালকের রুমে।তিনি তো অবাক আমি আবার এসেছি দেখে!তখন বললাম--অনেক দূর থেকে এসেছি,আপনি আমার লেখাগুলো অন্তত পড়ে দেখলে খুশি হব।একজন ২০ বছরের তরুণ লেখকের আবেগ বুঝতে পেরে তিনি লেখাটি নিয়েছিলেন সযত্নে।তবে পড়েছিলেন কিনা সে আর জানার উপায় নেই।
তাই একাডেমি কর্তৃক কর্মশালা পাওয়ার আশা বাদ দিয়ে নতুন উদ্যমে সাহিত্য বিষয়ক নিবন্ধ পড়া শুরু করি এবং পরের বছরই নানা জনের কাছে টাকা ধার করে একুশে বইমেলা থেকে প্রথম বই প্রকাশ করি।
হয়তো সবারই এমন আবেগ থাকে লেখা নিয়ে এক সময়।বাস্তবতার কঠিন নিয়মে সেই আবেগকে লালন করা হয়তো সহজ হয় না।তবু শব্দের কাছে শেষ আশ্রয় খোঁজা ছাড়া কারও কারও উপায়ও থাকে না।
২৯
বর্তমান ভার্চুয়াল যুগে সাহিত্য রাজনীতিতে সৌন্দর্য একটি মোক্ষম অস্ত্রে পরিণত হয়েছে।নানা অঙ্গ-ভঙ্গির ও রঙ-বেরঙের ছবি ও রিল প্রকাশ করে সম্পাদক/সম্পাদিকা ও চানাচুর পাঠকদের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকার এ এক দারুণ উপায়।এভাবে ভাল বইও বিক্রি হয়।মহাকালে স্থান পাওয়া যাবে কিনা সেটা পরের ব্যাপার,তবে তারা সাময়িক সুবিধা পাচ্ছেন।
আজকাল গানের সাথে মিউজিক ভিডিও ছাড়া যেমন তা চলে না না,সাহিত্যের সাথে নিজেও মডেল হয়ে যাওয়া তেমনি এক অদ্ভুত ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
৩০
দুই ধরনের কবি আছেন।একদল বাইরের বিষয়কে খুব কাব্যময় করে প্রকাশ করেন।শামসুর রাহমান,রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ,সৈয়দ শামসুল হক প্রমুখ আছেন এই দলে।আরেক দল অন্তর্গত বিষয়কে খুব মিহি সুতোয় বুনন করেন নান্দনিক চিত্রকল্পে।জীবনানন্দ,আল মাহমুদ,বিনয় মজুমদার প্রমুখ এই দলের অন্তর্গত।যুগের চাহিদায় দ্বিতীয় দলের ধারাই বয়ে চলছে বর্তমান কবিতার স্রোতে।তবে প্রথম ধারাতেও যে কেউ লিখতে পারেন।কবিতা কবিতা হলেই হয়,তার প্রকাশ ও তরঙ্গ যেমনই হোক।
৩১
বিজ্ঞানের অগ্রগতি শিল্পের সকল শাখাকে অন্তরালবর্তী করে দিয়েছে।হাতের মুঠোয় এত উপকরণ এনেছে যে শিল্পরস নেওয়ার মত মানুষ হাতে গুনেও পাওয়া যায় না।সাহিত্য তো দূরের কথা এমনকি গান শোনারও যথেষ্ট সময় আর মানুষের নেই।অদূর ভবিষ্যতে AI দিয়ে এত সহজে গান কম্পোজ করা যাবে যে প্রকৃত প্রতিভা আর সামনেই আসতে পারবে না।ভোগবাদী মানুষের চরিত্র বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে আরও প্রকট হচ্ছে।
৩৩
দুঃখের ভেতর এত গভীরতা থাকে যে,সেখানে ডুব দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে গাঢ় সৌন্দর্যকে অনুভব করা যায়...।তবে দুঃখের এই সৌন্দর্য অবিরতভাবে গ্রহণ করা শিল্পীর জন্য নিপুণ অভিজ্ঞতা হলেও ব্যক্তি মানুষের জন্য তার আলিঙ্গন সহ্য করা কঠিন।
৩৪
অনেকেই প্রশ্ন করেন বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ পরবর্তী ধারায় কেউ তাকে অতিক্রম করেছে কিনা।অনেকেই আবার এই প্রশ্নকেই অবান্তর মনে করেন।তাদের ভাষ্য হল-জীবনানন্দ বাংলা কবিতার পাঠকদের কিছু ব্যতিক্রমী স্বাদ দিয়েছেন,কবিতার আলাদা ভুবন নির্মাণ করেছেন,তাকে অতিক্রমের কিছু নেই।
এখানে অতিক্রম মানে জীবনানন্দীয় ধারারই এক্সটেনশন নয়।একটি পথে চলতে চলতে বড় আলোয় চোখ ঝলসে যাওয়ার পর পরবর্তী ধাপে তার চেয়েও বড় আলো না এলে চোখ আর অভিভূত হয় না।সেই হিসেবে জীবনানন্দ পরবর্তী কবিতায় আল মাহমুদ,বিনয় মজুমদার,সুনীল,শামসুর প্রমুখ কবিগণ যথেষ্ট আলো ছড়ালেও তা জীবনানন্দের চেয়ে গভীর ব্যাপ্তি নিয়ে অগ্রসর হয়নি।তারাও ভিন্ন ভিন্ন কবিতার স্বাদ দিয়েছেন,কেউ কেউ আঙ্গিকগত নিরীক্ষায় বরং অনেক এগিয়ে গেছেন।কিন্তু জীবনানন্দের পরিচয় অন্য জায়গায়।একই সাথে তিনি আঙ্গিক,শব্দ চেতনা ইত্যাদিতে যেমন সার্থক,কবিতার গভীরে বোধ স্থাপন করায় তেমনি অপ্রতিরোধ্য।এখানেই জীবনানন্দের কবিতার মূল শক্তি যাকে কেউ আজও অতিক্রম করতে পারেনি।
সুতরাং বাংলা কবিতার আলোচনায় প্রশ্নটি অবান্তর নয়।
৩৫
সিকদার আমিনুল হকের টানাগদ্য অসাধারণ।তার এসব লেখা পড়লে মনে হয় তিনি বাংলা কবিতার শুধু অন্যতম কবি নন,একজন শ্রেষ্ঠ কবি।বোধকে অতলে নিয়ে গিয়ে অভিভূত করে দেওয়ার মত অসংখ্য উপাদান রয়েছে তার টানাগদ্য গুলোতে।পড়তে পড়তে শুধু তলিয়েই যেতে হয় নিজের ভেতর।
তার অন্যান্য কবিতাও নিবিড়।শহুরে স্তব্ধতা ও কৌমার্য্য অথচ গ্রামীণ নীরবতা সেখানে।
যদি প্রকৃত পাঠকসমাজ গড়ে ওঠে,সিকদার আমিনুল হকের পাঠকপ্রিয়তা দিনে দিনে বাড়বে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
৩৬
বিসিএস নিয়ে আমার কিছু বলার আছে।এই দেশের কথিত মধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী সন্তানেরা অনেক চড়াই উৎরাই পাড় করে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায়।তারপর তারা নানা রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা,সেশনজট ইত্যাদির ফলে নির্দিষ্ট মেয়াদের গ্র্যাজুয়েট কোর্স শেষ করে অন্তত ২ বছর লেট করে।তারপর আবার মাস্টার্স করতে লেগে যায় আরও দেড় থেকে দুই বছর।মাস্টার্স পাশ একজন মানুষের বয়স ২৬-২৭ হওয়াই স্বাভাবিক।মাঝে পারিবারিক বা ব্যক্তিগত কারণে তাকে যদি কয়েক বছর শিক্ষা বিরতি দিতে হয় তবে তো কথাই নেই।
অনার্স মাস্টার্স করার পর পরিবার যখন তার দিকে তাকিয়ে আছে টাকা আয়ের একটি উৎস হিসেবে সে নিজেকে প্রমাণ করুক এবং তার প্রিয় বান্ধবীটির যখন বিয়ের জন্য প্রতিষ্ঠিত ছেলেদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব আসছে তখন তাকে বসতে হয় বিসিএস এর পিড়িতে।তার সিলেবাসের বহর দেখলে অবাক হতে হয়।ক্লাশ ফাইভ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত আর্টস ও সাইন্সের যত বিষয় আছে--ইতিহাস,ভূগোল থেকে শুরু করে বিজ্ঞান এমনকি আন্তর্জাতিক রাজনীতি সব।একজন মানুষের এসব বিষয় জানা অবশ্যই জরুরি।কিন্তু একজন শিক্ষার্থী যার গত ২৬ বছর কেটে গেছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাতেই তার পক্ষে বাকি ৩-৪ বছরে কি এই সিলেবাস কাভার করা সম্ভব?এটাতো অনার্স-মাস্টার্সের চেয়েও বড় এক সিলেবাস।
হ্যা এটা হয়তো সম্ভব গুটি কয়েকজনের পক্ষে।দার্শনিক গ্রামসির কালচারাল হেজিমনি নামে একটি তত্ত্ব আছে যা ব্যাখ্যা করে যে,সমাজ আপনার উপর এমনভাবে আধিপত্য করবে ও আপনাকে শোষণ করবে যে আপনি সেটাকে পজিটিভলি দেখবেন।ধরুন একশো জন মানুষকে বলা হল একটা ২০ মাইলের ম্যারাথন দৌঁড়ে যে পাঁচজন প্রথম হবে তাদের গোল্ড মেডেল,থাকার জন্য বাড়ি ও জীবিকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।তখন প্রতিযোগিতা শেষে হেরে যাওয়া ৯৫ জনের কাছে মনে হবে তারা তো প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেনি তাই এই হতভাগ্য পরিণতির জন্য তারাই দায়ী।অথচ ঘটনা অন্য জায়গায়।উর্ধ্বতন লোকদের আসলে ১০০ জনের ব্যবস্থা করার ইচ্ছে বা উপায় নেই,সেই ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় অর্থ তারা হয়তো গ্রাস করে ফেলেছেন।তারা হিসেব করে দেখেছেন ১০০ জনকে ডাল-ভাত খাওয়ানোর চেয়ে ৫ জনকে পোলাও-মাংস খাইয়ে বাকি সবাইকে প্রতিযোগিতার নামে চুপ করিয়ে রাখা এবং এটাকে ভাগ্যের পরিহাস হিসেবে তাদের মেনে নিতে বাধ্য করানোই সহজ।
এভাবে সমাজের বিস্তীর্ণ একটি অংশের উপর শোষণ ও নিপীড়ন করা হয়।সমস্ত জীবন শোষিত হয়েও অনেকেই তা শুধু তার নিয়তি ভেবেই একটা জীবন পাড় করে দেয়।এটাই কালচারাল হেজিমনি বা সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ।বিসিএস এর একটা উদাহরণ মাত্র।এরকম আরও অসংখ্য সূত্র দ্বারা তৃতীয় বিশ্বের মানুষেরা আবদ্ধ।
৩৭
নিজের ভেতর ডুব দিয়ে গভীরের পলিমাটি আহরণ ছাড়া কবিতা হয় না।এখন তো বেশিরভাগের চোখ উপরের দিকে,নয়তো পাশের দিকে।তাই পলিমাটির অভাবজনিত খরা চলছে বাংলা কবিতায়।
৩৮
কবির কবিত্বই তার আততায়ী
৩৯
বর্তমান যুগটা মূলত বিজ্ঞানের দাপটের যুগ।ফলে শিল্প-সাহিত্য এই শতাব্দীতে মানুষকে দলগতভাবে আলোড়িত করবে না।কেননা বইয়ে মুখ গুজে গল্প-কবিতা পড়ার চেয়ে অনলাইনে রোমাঞ্চকর ভিডিও দেখা সাধারণের কাছে বেশি উপভোগ্য।
তবু কিছু মানুষ থাকবে যারা আলোর চেয়ে অন্ধকারে নিজেদের অস্তিত্ব অধিক অনুভব করে,এগিয়ে যাওয়ার চেয়ে সমগ্র দৃশ্য দেখার লোভে পিছিয়ে যাওয়া ভালোবাসে,কিছু মানুষ থাকবে যাদের মৌলিক কিছু অনুভূতি বিজ্ঞানের রোবট বা ইট-পাথরের মানুষের সাথে শেয়ার করতে না পেরে শব্দের গায়ে হাতুড়ি পেটাবে--তাদের জন্যই চিরকালের শিল্প-সাহিত্য। সভ্যতা মানুষকে সব দিলেও এমন কিছু দিতে পারে না যার জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মত মানুষকেও প্রতিষ্ঠা ছেড়ে শেষ জীবনে সাঁওতালদের সাথে বাঁচতে হয়।
চরমভাবে জয়ী হওয়ার চেয়ে পরাজয় যাদের প্রিয়,অশ্রু ও দীর্ঘশ্বাসের সৌন্দর্য বিজ্ঞানের ঝলকানিতে যারা ভুলে যাবে না--তাদের জন্য শেষ আশ্রয় হিসেবে রয়ে যাবে কবিতা ও গান।শিল্প হল আগুনের তপোবন,আগুনের মানুষ না হয়ে সেখানে বেশিদিন টিকে থাকা যায় না,পুড়ে যেতে হয়।
৪০
আমার কাছে নানা সময়েই মনে হয়েছে বাংলাদেশে কিশোর অপরাধের একটি প্রধান কারণ জৈবিক বিষয়ে শিক্ষার অভাব।সেই বয়সে বেশিরভাগ কিশোর বিষয়টি নিয়ে অসহায়ত্ব ও অনিরাপত্তা বোধ করতে থাকে।এর ফলে সে সমাজের সবকিছুর প্রতিই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে,অভিভাবকদের সাথে খারাপ আচরণ করে ও নানা অপরাধে যোগ দেয়।
বর্তমানে বেশিরভাগ কিশোর বড়দের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে না।কারণ তাদের চোখ অপরাধী।কারণ তাদের হাতে আছে ইন্টারনেট কানেকশনসহ স্মার্টফোন।আর এই বয়সে এটা কোন প্রলয়ংকরী ব্যাপার ঘটাতে পারে তা আমরা জানি।ফলে এক ঘুমহীন লাল চোখের পলাতক ও আচমকা নৃশংস উত্তরাধিকারী আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
এদেশে মেধার অপচয়ের অন্যতম কারণও একই বিষয়।আমরা সত্যকে স্বীকার করতে লজ্জা পাই কিন্তু গোপনে মিথ্যের সাথে আপোষ করতে আমাদের লজ্জা নেই।আমরা পাহাড় সমান অপরাধকে সহজ করি আর সমাধানের পথে পাথর সমান বাধা দেখলেই মুখ ফিরিয়ে নেই।আমরা অবদমনকে প্রশ্রয় দেই, তাই গোপন পথে আগ্নেয়গিরির মত তা হঠাৎ আমাদের গ্রাস করে।
সত্যে আমাদের এত লজ্জা বলে মিথ্যা আমাদের গালে একদিন তীব্র থাপ্পড় দিতে ভুল করে না।তবু আমরা মিথ্যে সত্যের চাদরেই ওম নিতে ভালোবাসি।কারণ ব্যক্তিগত বিম্বিত আয়নায়ও আমরা প্রতারক।
৪১
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে Cold War চলাকালীন সময় তৃতীয় বিশ্বের সদ্য স্বাধীন দেশগুলো কোন দলে অংশ না নিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন গড়ে তোলে।কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল যে,যেকোন একপক্ষে যোগ দিলে তাদের ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে না।তারা বুঝেছিল যে,শক্তিতে দুর্বল হওয়ায় বিপরীতপক্ষ তখন আসল শত্রু বাদ দিয়ে তাদের দিকেই চড়াও হবে আগে।বর্তমানে ইউক্রেন যার প্রমাণ।
পুজিবাদ ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বিরোধ বহু পুরনো।বর্তমানে বিশ্বে Cold War এর চেয়েও খারাপ অবস্থা বিরাজ করছে।একদিকে চীন-রাশিয়া-ইরান অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র,ইইউ,অস্ট্রেলিয়া-জাপান।এদের সাথে আরও অনেক সাঙ্গপাঙ্গ আছে।চীন ও রাশিয়ার অর্থনীতি এখন পুরোপুরি সমাজতান্ত্রিক না হলেও তা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের থেকে আলাদা ও প্রতিদ্বন্দ্বী।
বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ।এদেশের পররাষ্ট্রনীতি এতদিন ছিল কোন বড় শক্তির সাথেই বিরোধে না গিয়ে সতর্ক অবস্থানে থাকা।কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশ বিশেষ কারণে স্পষ্টভাবে চীন-রাশিয়া ব্লকে অংশ নিয়েছে।অথচ তার রপ্তানি বাণিজ্য শতকরা ৯০% ইউরোপ ও আমেরিকা নির্ভর।সত্যি বলতে বাংলাদেশে কোন দল ক্ষমতায় আসে তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এত মাথা ব্যথা নেই।কিন্তু যেকোন দুর্বল রাষ্ট্রও তার বিরোধী পক্ষে অবস্থান নিলে তারা তার বিরুদ্ধে খুব শক্ত অবস্থান নেয়।এর আগে ভিয়েতনাম ও কিউবা যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র তার প্রমাণ দিয়েছে।
বর্তমান মাল্টিট্যালেন্ট প্রশাসনের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে হাতে রেখে ক্ষমতায় থাকা অসম্ভব ছিল বলে আমার মনে হয় না।তবু তারা খুব জোড়েসোরেই তাদের প্রধান অর্থনৈতিক পার্টনারদের সাথে শত্রুতা তৈরি করেছে।আর যোগ দিয়েছে এমন এক ব্লকে যেখানে আমাদের রপ্তানি তো নেইই আছে বরং বিরাট বাণিজ্য ঘাটতি।সেই সাথে চীন ও ভারত বরং টেক্সটাইল সেক্টরে আমাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।এখন ইউক্রেনের মত এই বদ্বীপ যদি একটি ত্রিমাত্রিক আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রত্যক্ষ শিকারে পরিণত হয় তবে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।
কথায় আছে গরীবের বন্ধু কেউ হয় না।তাই তখন চীন,রাশিয়া,ভারত কেউ আমাদের বাঁচাতে আসবে না।হয়তো কিছু মামুলি বিবৃতি দিয়ে তারা তাদের কর্তব্য পালন করবে এবং এদেশীয় শিল্প ধ্বংসের বিনিময়ে তারা বাড়তি অর্ডার পাওয়ার আনন্দে মাতোয়ারা থাকবে।
৪২
অনেকদিন আগে পড়েছিলাম,সভ্যতা পুরুষকে দাস বানিয়ে রাখতে চায় আর নারীকে রক্ষিতা করে রাখতে চায়।আজ তার সত্য রূপ দেখছি।
শিক্ষার নামে সভ্যতা নিরুপায় দাস তৈরি করে।Ethics ও Law এর চাতুর্যপূর্ণ ব্যবহারে নিজের ক্ষমতা ও ভোগ্যবস্তুকে কুক্ষিগত করে।
খাদ্য পিরামিডের মত সভ্যতার প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পর্যায়ে একটি শকুন অবস্থান করে।যদিও তাকে দেখে খুব মানবিক,ভদ্র ও নিরামিষভোজী মনে হয়।
৪৩
কবিতা আত্মগোপনের এক দারুণ টনিক।চারপাশের রোদ-ঝড় থেকে যেমন বাঁচায় তেমনি নিজের ভেতরে এক ব্যক্তিগত সাম্রাজ্যও তৈরি করে।ফুল কিংবা অশ্রু দুইই সেখানে সমান মর্যাদা পায়।বাইরের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি সেখানে নিতান্ত তুচ্ছ এক ব্যাপার।