হাংরি মুভমেন্ট প্রথমে সামাজিক আন্দোলন হিসেবে আবির্ভূত হলেও ক্রমেই তা সাহিত্যিক আন্দোলনে পরিণত হয়।হাংরি বাংলা সাহিত্যের প্রথম প্রতিষ্ঠান বিরোধী আন্দোলন।এর আগে সমাজের নিচুতলার মানুষের ভাষা কবিতায় নিজস্ব ভঙ্গি নিয়ে উপস্থিত হয়নি এই অভিযোগে হাংরি জেনারেশনের কবিরা কবিতায় তাদের শব্দাস্ত্র প্রয়োগ করতে শুরু করেন।১৯৬১ সালে পাটনা থেকে একটি ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আত্মপ্রকাশ করে।পাটনায় বাংলা প্রেস পাওয়া যায়নি বলে কবিতা সম্পর্কিত লেখাটি বাধ্য হয়ে ইংরেজিতে প্রকাশ করতে হয়েছিল।প্রথমদিকে এর সাথে যুক্ত ছিলেন সমীর রায় চৌধুরী,মলয় রায় চৌধুরী ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়।পরবর্তীতে বিনয় মজুমদারের মত স্বল্পভাষী কবিও এর সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন।হাংরি মুভমেন্টকে তখন কালচারাল কাউন্টার বলে উল্লেখ করা হয়।পরবর্তীতে মলয় রায় চৌধুরী নিজেকে কালচারাল বাস্টার্ড বলে উল্লেখ করেন।এই উল্লেখে নিজেকে নিজেই গালি দেওয়ার মতো মনে হলেও বুঝতে হবে এ ধরণের উন্মুক্ত ও প্রতিঘাতী শব্দ প্রয়োগই ছিল হাংরির শক্তির উৎস।সেই সময়ের প্রতিষ্ঠিত শিল্পী সাহিত্যিকরা হাংরিকে স্বভাবতই বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করেন।বুদ্ধদেব বসু এবং আবু সয়ীদ আইয়ুবের মত কাণ্ডারীরাও একে মূল্যবোধহীন সাহিত্য আন্দোলন বলে কটাক্ষ করেছিলেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সুদূর আমেরিকা থেকে মলয় রায় চৌধুরীকে এই আন্দোলন বাদ দেওয়ার জন্য একপ্রকার শাসিয়েই চিঠি লিখেন।পরবর্তীতে অবশ্য তিনিই আদালতে মলয় রায়ের প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কবিতাটির পক্ষে রায় দিয়ে তার কারামুক্তিকে সহজ করেন।
রেলস্টেশন,স্কুল,কলেজ ইত্যাদি স্থানে হাংরি একপাতার বুলেটিন বিলি করতে শুরু করে।ঝাঁঝালো শব্দ ও অদ্ভুত চিত্রকলার জন্য অল্প সময়ের মধ্যেই হাংরির খবর সমাজের প্রান্ত থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছে যায়।এমনকি বিদেশেও এই আন্দোলনের খবর চলে যায় বাতাসের বেগে।কিন্তু অদ্ভুত সব কাণ্ডের জন্য হাংরি দ্রুত প্রশাসনের চক্ষুশূলে পরিণত হয়।হাংরির কর্মীবৃন্দ বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে কবিতা পাঠ করতে শুরু করেন।খিস্তিখেউড় ও যৌন অনুভূতিজাতক শব্দের ব্যবহারে সমাজ ও প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা প্রকাশ পাওয়ায় তাদের কবিতাপাঠ জনগণকে সহজেই আকৃষ্ট করতে থাকে।তখন কবিতা পাঠকের চারপাশে মলম বিক্রির মত জমায়েত বেঁধে যেত।একটি বইয়ের মূল্য এক লক্ষ টাকা নির্ধারণের পাশাপাশি হাংরি বিভিন্নজনের কাছে বুক রিভিউ করার নামে জুতার বাক্স পাঠাতে শুরু করে।শুধু তাই নয় প্রশাসনিক কর্তাস্থানীয় ব্যক্তিদের নানা রকম জন্তু-জানোয়ারের মুখোশ পাঠিয়ে সেখানে তারা লিখে দিতেন এবার মুখোশটা খুলে ফেলুন।স্বভাবতই এসব কর্মকাণ্ডের জন্য ও সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যিকদের ইন্ধনে হাংরির নামে চার্জশিট গঠন করা হয় এবং এই প্রথম বাংলা ভাষার ছয় কবিকে হাতে হাতকড়া পড়িয়ে কারাগারে নেওয়া হয়।পরবর্তীতে হাংরির সাথে জড়িত অনেককেই চাকরিচ্যূতও করা হয়।ফলে ভয়ে বাকিরা আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে নিজেদের পেট ও পীঠ রক্ষায় মনোযোগী হন।
সেই সময়ের সামাজিক অবস্থার কথা বিবেচনা করলে হাংরির উদ্ভব অস্বাভাবিক ছিল না।তবে খুব বড় প্লাটফর্মও তাদের ছিল না।সাহিত্যের চেয়ে মূলত আন্দোলনের দিকেই তাদের নজরটা বেশি ছিল।তাই অতিরিক্ত দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গিয়ে অদ্ভুত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মাত্র চার বছরের মধ্যেই এই আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অবসান ঘটে।আরেকটু স্থির ও সুশৃঙ্খল হতে পারলে হাংরি তার ফসল ঘরে তুলতে পারতো সন্দেহ নেই।তবু বাংলার প্রতিষ্ঠান বিরোধী ও ইশতেহার প্রণেতা সাহিত্য আন্দোলন হিসেবে হাংরি বিখ্যাত হয়ে আছে।হাংরি স্বমহিমায় নিজেকে বিকশিত করতে না পারলেও বাংলা কবিতার একটি দুর্বল অঞ্চলকে নির্দেশ করে সাহিত্যপ্রেমীদের তার প্রতি সচেতন করে তোলে এবং পরবর্তীতে অনেক কবির কবিতায় হাংরির পরোক্ষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
মলয় রায় চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট সুরেই তিরিশের কবিতার বিরোধীতা করেছেন।
বাংলা কবিতায় তিরিশের দশক নতুন মোড় ঘুরালেও,নতুন কবিতার স্বাদ দিলেও তার সমালোচনাও কম নয়।এখনও সমালোচকগণ তার রসদকে পাশ্চাত্য থেকে আমদানিকৃত বলে ঘোষণা করেন।কবিতায় সংকল্পবদ্ধ ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে,গণমানুষের কথা বলতে গিয়ে তারাও বরং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপরমহলের জীবনাভিজ্ঞতারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।তাদের কবিতাতেও উঠে আসেনি নিম্নজনের ভাষা ও জীবন।তিরিশের কেউ কেউ সমাজের নানা অসঙ্গতিকে আঘাত করলেও সেটা করেছেন তাদের উপর মহলের বিদগ্ধ ভাষায়।উপরন্তু তিরিশের দশক কবিতায় যেভাবে মিডিয়া কাভারেজ করেছে ও তীব্র তরঙ্গ তুলেছে তার ভেতর কবিতার একটি মিহি শাখার যথেষ্ট উন্নতি হলেও আরও অনেক রকমের মাটিঘেঁষা কবিতা প্রেরণার অভাবে সেইভাবে উঠে আসতে পারেনি।এমনকি নজরুল ও জসীমউদ্দীনের মত প্রান্তিক অণুরণনের কবিরাও এ সময় আলোচনার অনেকটা বাইরে চলে যান।এর আগে রবীন্দ্রযুগে রবীন্দ্রনাথ একাই বড় একটা সময় কবিতায় রাজত্ব করায়,আধুনিক যুগের প্রারম্ভে কবিতার ভাষা হয়ে উঠেছিল একান্তভাবে রাবিন্দ্রীক।তখন জনজীবনে ব্যবহৃত অনেক আরবি-ফারসি শব্দ বিপুলভাবে উপেক্ষিত হয়েছিল।নজরুল তার কবিতায় এসব শব্দ ব্যবহার করলেও সেটাকে অনেকে আতিশয্য হিসেবে দেখেছেন,স্বাভাবিক মিশ্রণের ভঙ্গি নিয়ে তা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
বাংলা কবিতার ইতিহাসের এই ব্যবধানকে ধরাটা নতুনধারার কর্তব্য বলে আমি মনে করি।শত বছরের পালা বদলে,মহামারি ও যুদ্ধ সঙ্কুল বর্তমান পৃথিবীতে নতুনধারার প্লাটফর্ম আমার কাছে হাংরির চেয়ে জোড়ালো মনে হয়েছে।সেই সাথে তাদের মাঝে স্থিরতা ও ধারাবাহিক উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।ইশতেহার প্রণীত ইতিহাস,প্রত্নতত্ত্ব,লোকাচার,লোকশব্দ ও সম্পর্কবাচক শব্দের ব্যবহার এবং চিত্রকল্পের অতিরঞ্জন কমিয়ে শিল্পের স্বাভাবিক সৌন্দর্যবোধের প্রতি সচেতনতা ইতোমধ্যেই সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।সেই সাথে নতুন শব্দ ও শব্দসমবায় তৈরির প্রতিও নতুনধারা অঙ্গীকারবদ্ধ।যদি নতুনধারা সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের ভাষা,অনুভূতি ও জীবনকে কবিতায় প্রাধান্য দিতে পারে,যদি কৃত্রিমতাকে উপেক্ষা করে রক্ত-মাংসের বস্তুনিষ্ঠতাকে গুরুত্ব দেয়,তবে এই গোষ্ঠী কবিতায় সত্যিই চিরায়ত আদর্শের নতুনধারা আনতে সক্ষম হবে বলে মনে করি।
(আজকের ১৪.১০.২২ দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত)