বিষ্ণু দে (১৯০৯-১৯৮২) বাংলা কবিতায় দ্বান্দ্বিক চেতনার কবি হিসেবে পরিচিত।একদিকে মার্ক্সবাদী সমাজচেতনা অন্যদিকে লোকঐতিহ্য,পুরাণ,প্রাচ্য-প্রতীচ্যের সমন্বয়বাদী মানসিকতায় ব্যক্তি আমির সুচারু আত্মসচেতনায় গড়ে উঠেছে তার কবিতার বীজভূমি।বিষ্ণু দে'র কবিতা বুঝতে হলে প্রথমেই বুঝতে হবে তার সময়কে।কেননা সময় ও জীবনের বাস্তবতাকেই প্রতীকময় করে তিনি উপস্থাপন করেছেন কবিতায়।প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী স্থবির সময়ের প্রতিঘাতে গড়ে উঠা মানসে তিনি কবিতার উপকরণ পান এবং কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিরিশের দশকের সূচনালগ্ন থেকে।এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ,দুর্ভিক্ষ,দেশভাগ,দেশভাগ পরবর্তী নানা আন্দোলন তিনি দেখেছেন একজন নিবিড় অনুভূতিজাত শিল্পী হিসেবে।স্বভাবতই সত্তাবিচ্ছিন্ন মানুষের এই হাহাকার,মূল্যবোধের অবক্ষয় তাকে কাঁপিয়েছে প্রবলভাবে।কিন্তু মার্ক্সবাদী মনোভাবের অংশীদার হয়েও তার কবিতা শ্লোগানধর্মী হয়নি।শব্দ,বোধ,আঙ্গিক ও বিন্যাসের এক সচেতন চর্চা লক্ষ্য করা যায় তার সমস্ত কবিতা জুড়ে।কোথাও তিনি অতি আবেগে ভেসে যান না,কোথাও পরাবাস্তবতার আড়ালে নিজেকে একদম লুকিয়ে ফেলেন না বরং এ দুইয়ের মাঝে থেকে গড়ে তোলেন নিজের অভীষ্ট কাব্যরীতি।রোমান্টিক কবিরা পৃথিবীর এই আকষ্মিক পরিবর্তনকে মানতে না পেরে বাস্তবতা থেকে মুখ ঘুরিয়ে যখন মনের একান্ত অন্তরালে ডুবে গীতিকবিতায় শান্তি খুঁজছিলেন তখন বিষ্ণু দে বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই আশাবাদী ভবিষ্যতের স্বপ্নকে কবিতায় অবয়ব দিলেন।এখানেই বাংলা কবিতায় বিষ্ণু দে'র অনন্যতা।
সমালোচকগণ বিষ্ণু দে'র কবিতায় এলিয়টীয় আত্মসচেতন ও বিচ্ছিন্ন চেতনার প্রভাব লক্ষ্য করেন।মূলত শিল্প বিপ্লোবোত্তর পুঁজিবাদী বিশ্বের বিক্ষিপ্ত ও খণ্ডিত প্রতিবেশে একজন চিন্তাশীল মানুষের আত্মসচেতন না হয়ে উপায় ছিল না।মূলত আত্মসচেতনতাই একজন আধুনিক মানুষের প্রধান লক্ষণ।তবে বিষ্ণু দে এলিয়টীয় খণ্ডিত চেতনাকে আশ্রয় করলেও তিনি অখণ্ডিত ভবিষ্যত নির্মাণে আশাবাদী।এলিয়টের যেখানে বাস্তবতার যুগযন্ত্রণা প্রকাশেই সমাপ্তি,বিষ্ণু দে'র সেখানে যুগযন্ত্রণা প্রকাশের পরেও প্রত্যাশিত দীপশিখা প্রজ্জ্বলিত।এলিয়টীয় চিন্তার ধারক হয়েও এইখানে তিনি বৃত্তভেদী।
বিষ্ণু দে'র শিক্ষা ও কর্মজীবন বর্ণাঢ্য।তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স করেন।১৯৩৫ সালে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন কলকাতার রিপন কলেজে।সেখানে সহকর্মী হিসেবে পান কবি বুদ্ধদেব বসুকে।ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় তাদের এই সাহচার্য দুজনকেই সমানভাবে সমৃদ্ধ করেছিল।বিষ্ণু দে'র কবিজীবন শুরু বুদ্ধদেব বসু ও জীবনানন্দের সমকালেই।বুদ্ধদেব বসুর প্রগতি পত্রিকায় তিনি প্রচুর কবিতা লিখেন।কল্লোল পত্রিকায় শ্যামল রায় ছদ্মনামে তার অনেক কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল।পরবর্তীকালে তিনি সুধীন্দ্রনাথের পরিচয় পত্রিকার সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন।বিষ্ণু দে'র প্রথম কবিতাগ্রন্থ উর্বশী ও আর্টেমিস প্রকাশিত হয় ১৯৩২ সালে।পরবর্তী কবিতাগ্রন্থ চোরাবালি প্রকাশিত হয় ১৯৩৭ সালে।এরপর ১৯৮০ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘকাল তার কবিতাগ্রন্থের প্রকাশ ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে।কবিতার পাশাপাশি তিনি প্রবন্ধ,ছোটগল্প ও অনুবাদ সাহিত্যেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন।তিনি ছবি আঁকতেন এবং সেই সাথে একজন চিত্রসমালোচকও ছিলেন।চিত্রশিল্পী যামিনী রায় ও রবীন্দ্রনাথের চিত্রশিল্প নিয়ে তিনি Art of Jamini Ray (১৯৪৪) ও The paintings of Rabindranath Tagore (১৯৫৮) শিরোনামে মূলব্যান গ্রন্থ রচনা করেন।চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায় এর সহযোগিতায় সাহিত্যপত্র নামে তিনি একটি রুচিশীল পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন।স্বতন্ত্রভাবে নিরুক্ত নামে একটি সাহিত্যপত্রিকাও তিনি সম্পাদনা করেন।তার নিজস্ব সমাজচেতনা ও বিপ্লবপ্রত্যাশী হওয়ায় তিনি সোভিয়েত ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশন,প্রগতি লেখক শিল্পী সংঘ,ভারতীয় গণনাট্য সংঘ ইত্যাদি সংগঠনের সাথে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন।এককথায় কবি,শিল্পী,সংগঠক,সমালোচক ও চিন্তাবিদ হিসেবে তিনি এক বিরাট যজ্ঞপুরুষ ছিলেন।
বিষ্ণু দে'র কবিতায় পুরাণের প্রচুর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।পুরাণ একটি কল্পিত কাহিনী হলেও এর সাথে সেই সময়ের মানুষের আকাঙ্খা, স্বপ্ন ও কম্পন জড়িত।বাস্তবতাকে যখন সে নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না,সবদিক থেকে নিয়ন্ত্রিত ও শোষিত জীবনে সে তখন কামনা করে দৈবিক কোন শক্তিকে।এই দৈব কল্পনা,প্রকৃতি জয়ের মানসিকতা তার ভেতর জন্ম দেয় পুরাণ ও রূপকথার।প্রাচীনকালের কঠোর রাজ্যশাসিত সমাজে তাই রূপকথা ও পুরাণের এত প্রচলন ছিল।সঙ্গত কারণেই আধুনিক নগর সভ্যতার যুগে নতুন করে আর পুরাণ সৃষ্টি না হলেও তার তির্যক ব্যবহার এখনও অর্থবহ।ঔপনিবেশিক যুগে মধ্যবিত্ত শ্রেণী যখন সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার গ্লানিতে বিকারগ্রস্ত তখন নৈরাজ্যের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ ও ভেঙে পড়া সবকিছুকে ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত করে নিজের বক্তব্যকে জোড়ালো করার জন্যই অপরিহার্য হয়ে পড়ে পুরাণের ব্যবহার।নজরুলের বিদ্রোহী কবিতাতেও একই কারণে ভারতীয় ও ইউরোপীয় মিথের এত প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।বিষ্ণু দে'র কবিতায় তাই হেডিস,ক্রেসিডা,ওফেলিয়া,মহাশ্বেতা প্রভৃতি পৌরাণিক ও কল্পিত চরিত্র উপস্থিত হয় কবিতার বর্ণ-গন্ধ অনুযায়ী নির্দিষ্ট দর্শন ও চেতনার পরিস্ফূটনে।
সব বড় কবির মতোই সহজাতভাবেই বিষু দে'র কবিতাতেও মৃত্যুচিন্তা উপস্থিত।তবে তা সরাসরি বর্ণনায় নয়,মৃত্যুচিন্তা উঠে এসেছে উপমা ও প্রতীকের ব্যবহারে।প্রকৃতি মৃত্যুকে প্রতিনিয়ত জীবনের ছন্দের অন্তর্গত করে নেয়--এটা প্রকৃতির সজীব থাকার এক দারুণ অস্ত্র।ব্যক্তিগত মৃত্যুচেতনার পরিবর্তে দেশ-কাল,সময়ের থেমে যাওয়াকে বিষ্ণু দে মৃত্যু হিসেবে নির্দেশ করেন বলে আপাতভাবে মনে হয় তার কবিতায় মৃত্যুচেতনা নেই।বিষ্ণু দে'র কবিতা পড়তে গিয়ে বোধে ধরা পড়ার আগেই শব্দ-বন্ধন ও ছন্দের পায়ে চলা পদক্ষেপের যাদুকরী ছোঁয়া অজ্ঞাতসারে আমাদের দখল করে নেয়।তার বেশিরভাগ কবিতারই সেই অর্থে একটি নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা বের করা সহজ নয়।ফলে শব্দে তিনি খুব বেশি জটিল না হয়েও কবিতার বোধ নির্মাণে জটিল।তাই বিষ্ণু দে'র কবিতার পাঠক হাঁটে-ঘাটে পাওয়া যায় না।তিমির হননকারী নিবিষ্ট পাঠকের অন্তর্জালেই একমাত্র তিনি ধরা পড়েন শৈল্পিক ভাস্বরে।তার বিখ্যাত ঘোড়সওয়ার কবিতাতেও এই বহুমাত্রিকতার অভিঘাত লক্ষ্য করা যায়।চারপাশের ঘূর্ণি জীবনের বিপরীতে একজন দীপ্ত পুরুষের প্রতিকাশ্রয়ী পদধ্বনি কামনা করেছেন তিনি এ কবিতায়।একই সাথে প্রতীকের ব্যবহারে কেউ কেউ ঘোড়সওয়ার কবিতাটিকে জৈবিক আকাঙ্খার বাহন হিসেবেও দেখেন।আবার কেউ কেউ এটাকে মনে করেন বিশুদ্ধ প্রেমের কবিতা।আধুনিক কবিতার বহুমাত্রিকতার গুণে পাঠকের মনে তার যে কোন তির্যকতাই ধরা দিতে পারে।কোন নির্দিষ্ট মাপকাঠিতে কবিতাকে ধরা দিতেই হবে তা জরুরি নয়।পাঠক তার ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী কবিতা থেকে কল্পনা ও অনুভবের সারাংশ পাবেন--এ আর মন্দ কী!
আধুনিক কবিরা বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নেই মধ্যবিত্ত স্থূল আত্মতৃপ্তিকে প্রত্যাখ্যান করে বাস্তবতার রূঢ়তার ভেতর কবিতার উপকরণ খুঁজতে থাকেন।তিরিশের কবিগোষ্ঠী আক্ষরিক অর্থে রোমান্টিক বিরোধী হলেও বুদ্ধদেব বসু ও জীবনানন্দ দাশ মূলত মধ্যবিত্তের নগরসভ্যতার কশাঘাতে ক্লান্ত মানসিকতাই তুলে ধরেছেন তাদের কবিতাকীর্তিতে।তারা দুইজন সেই অর্থে এক ভিন্নধর্মী রোমাণ্টিকই যারা প্রাণপণে মুক্তি পেতে চান সভ্যতার এই ঘাতক বন্ধন হতে।জীবনানন্দের অবসরের গান কবিতা একরকমভাবে নাগরিক জীবন থেকে দূরবর্তী আলেখ্যনগরেরই সঙ্গ প্রত্যাশী।বিষ্ণু দে এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।জীবনের দ্বন্দ্বময় বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দিয়েই তিনি তার মাঝে সমন্বয়ধর্মী চেতনার অনুসন্ধান করেছেন সময়ের একজন সচেতন ভাস্কর হিসেবে।তাই নিছক শিল্পসাধনার দুর্গে আত্মগোপন না করে তিনি কবিতাকে ব্যবহার করেছেন বাস্তবতার এক পরিণামধর্মী প্রতিমা হিসেবে।
(প্রকাশ--দৈনিক ইনকিলাব,০২.১২.২২)