কবিতায় যার নাম আনন্দ তার নাম বেদনা--প্রমথ চৌধুরী অনেকদিন আগেই এই চিরসত্য বলে গেছেন।বলা হয়ে থাকে দুঃখই সাহিত্যের জননী।পৃথিবীর বড় বড় কবিদের জীবনের দিকে তাকালে দেখা যায় যে,দুঃখ যেন তাদের শিল্পসৃষ্টির জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে।বিনয় মজুমদার যখন বলেন "লিখতে লিখতে বুঝেছি কবিতা লিখলে দুঃখ ভোলা সম্ভব।কিন্তু দুঃখ ভুলে গেলে আর কবিতা লেখা যায় না"--তখন কবিতার জন্মের ইতিহাস বুঝতে আমাদের খুব দূরে তাকাতে হয় না।এ তো গেল কবিতা সৃষ্টির পেছনে কবির ব্যক্তিগত দুঃখের অবদান।এর বাইরে তার সৃষ্টিতেও সঙ্গত কারণেই সে দুঃখের সার ফুটে ওঠে।সুখ অনেকটা উদ্বায়ী পদার্থের মতো।সত্যি বলতে দুঃখকে যতটুকু অধিকার করে তার সর্বস্ব হরণ করা যায় প্রত্যক্ষ সুখকে তার কণামাত্রও অনুভব করা যায় না।সুখের সময় মানুষ তাই নিজেকে পাতলা অনুভব করে,দুঃখেই সে ঘন সংবর্তের স্বাদ পায়।দুঃখেই সে নিজেকে সবচেয়ে গভীরভাবে অনুভব করে।মানুষ তাই দুঃখবিলাসী কেননা নিজেকে এত ওজনহীন ভাবতে তার ভাল লাগে না।ছোট দুঃখেও তাই বড় করে দুঃখ নিতে মানুষ পিছপা হয় না।তাই জনৈক মনিষী বলেছেন যে,পৃথিবীতে যে নিজেকে সবচেয়ে দুখী মনে করে সেই সবচেয়ে দুখী।

কবিদের ক্ষেত্রে দুঃখের এই অঞ্চল আরও ভিন্নমাত্রা নিয়ে উপস্থিত হয়।সাধারণ মানুষের কাছে কবিদের দুঃখের কারণ অনেক সময় অদ্ভুত মনে হতে পারে কিন্তু কবির জন্য সেটাই সত্য।কবির দুঃখের কারণ সমস্ত ইহজাগতিকতার বাইরের বিষয়ও হতে পারে।সমস্ত গ্যালাক্সিকে যিনি চেতনায় ধারণ করছেন তার কোন অংশে গ্রহ-নক্ষত্রের সংঘর্ষে কী আলোকপাত হচ্ছে তা বাইরে থেকে বোঝা সম্ভব নয়।শুধু তাই নয় চারপাশের নিতান্ত তুচ্ছ উপকরণ থেকেও কবিরা হিমালয় সমান দুঃখের সম্ভার পেতে পারেন।জীবনানন্দের 'আট বছর আগের একদিন' কবিতার নায়ক কোন নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ না হয়েও,হাড়হাভাতের গ্লানিতে তার জীবন কখনও কেঁপে না উঠলেও, অন্তর্গত রক্তের ভেতর কোন এক বিপন্ন বিস্ময়ের ক্লান্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে যখন লাশকাটা ঘরে ক্লান্তিহীন লাশের জীবন বেছে নেয় তখন কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে কবিদের দুঃখের সীমানা সম্পর্কে।

এ তো গেল কবিতা সৃষ্টির পেছনে কবির ব্যক্তিগত দুঃখচেতনার কথা।তবে সবার সৃষ্টিতে এই বোধ দুঃখের প্রকাশ হয়ে নাও আসতে পারে।সংসারে যে লোকের সারাদিন চোখের কোণে জল চিকচিক করে,হতে পারি সে-ই মঞ্চ কাঁপানো কোন কৌতুক অভিনেতা।আবার জীবনবোধে দীক্ষিত কবি কোন আনন্দের উপকরণকেও কিছুটা ভিন্নমাত্রা দিতে করে থাকেন লবণ পরিমাণ দুঃখের ব্যবহার।এখন দেখা যাক বাংলা কবিতায় দুঃখবাদের বিবর্তনের ইতিহাসের  সামান্য আলোকসম্পাত।বাংলা কবিতায় দুঃখবাদ অতি পুরাতন একটি বিষয়,প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও বহু আগে,তার সৃষ্টিলগ্ন থেকেই।চর্যাপদ থেকে শুরু করে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন,বৈষ্ণব পদাবলী,ইসলামি ভাবপুষ্ট অনুবাদ সাহিত্য--এসবে দুঃখই প্রধান।বৌদ্ধ ধর্মের সাধনসঙ্গীতের পাশাপাশি  চর্যাপদে বর্ণিত হয়েছে সেই সময়ের অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের জীবন সংগ্রাম,তাদের দুঃখ-হতাশা।যেমন-

"টালত মোর ঘর নাহি পড়বেসী।
হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী।।
বেঙ্গ সংসার বড়হিল জাঅ।
দুহিল দুধু কি বেন্টে সামায়।।"


প্রতিবেশীহীন টিলার ওপর ঘর,হাড়িতে ভাত নেই।নিত্য অতিথি আসে,আবার ব্যাঙের মত সংসার বেড়েই যাচ্ছে--এসবের মধ্য দিয়ে বাংলার চিরকালের দরিদ্র গ্রামীণ সমাজের চিত্র ফুটে ওঠে করুণভাবে।এছাড়া চণ্ডাল,ডোম,মাঝি,পতিতা নানা শ্রেণীর মানুষের জটিল জীবন ও জীবিকার চিত্র ফুটে ওঠে বেশকিছু কবিতায়।২ নং চর্যার একটি পঙক্তি--


"দিবসহি বহুড়ী কাউ হি ডর ভাই।
রাতি ভইলে কামরূ জাই।।"


দিনে যে বধূ কাকের ভয়ে ভীত,রাতে সে বাধ্য হয়ে কামরূপ চলে যায়।এখানে চরিত্রহীনতার এক গাঢ় ইঙ্গিত পাওয়া যায়।নির্মম বাস্তবতা ও গভীর এক বেদনার চিত্রকল্প ফুটে ওঠে এ পঙক্তিতে।ভুসুকুপা বর্ণিত 'অপণা মাংসেঁ হরিণা বৈরী' উক্তির মধ্য দিয়েও দুঃখবাদী দর্শনই প্রকাশিত হয় পাঠকের সামনে যেখানে নিজের মাংসের জন্যই হরিণকে সকলের শত্রু হতে হয়।যদিও চর্যাপদের এইসব স্থূল ও বাহ্যিক চিত্রকল্পের আড়ালে সহজিয়া ধর্মতান্ত্রিক সূক্ষ্ণ দর্শনই লক্ষ্য,তবু তা যে সামাজিক বাস্তবতাকে আশ্রয় করেছে তা অবশ্যই সেই সমাজের অংশ ছিল।তাই নিছক উপমা বা রূপক বলে তার প্রত্যক্ষতাকেও অগ্রাহ্য করা যায় না।


শ্রীকৃষ্ণকীর্তন থেকে শুরু করে চৈতন্য পরবর্তী পদাবলীতে কৃষ্ণের লীলার চেয়ে রাধার বিরহ অনেক বড় হয়ে ধরা দেয় পাঠক ও শ্রোতার কাছে।"আকুল শরীর মোর বেআকুল মন/বাঁশীর শবদেঁ মোর আউলাইলোঁ রান্ধন"--রাধার এই ব্যাকুল প্রত্যাশা শেষপর্যন্ত পর্যবসিত হয় কৃষ্ণবিরহের সীমাহীন দুঃখে..."বন পোড়ে আগ বড়ায়ি জগজনে জাণী/মোর মন পোড়ে যেহ্ন কুম্ভারের পণী"।


অনুবাদ সাহিত্য লাইলী- মজনু,শিরি-ফরহাদ,ইউসুফ-জুলেখা এবং কারবালার কাহিনী নিয়ে নির্মিত কাব্যগুলোয় দুঃখই প্রধান উপাদান হয়ে প্রবিষ্ট হয় পাঠক ও শ্রোতার হৃদয়ে।আধুনিক যুগে রোমান্টিক এই দুঃখবাদের সাথে যুক্ত হয়েছে আবার নাগরিক হতাশা,জীবনের প্রতি নিরাসক্তি আর মহাকালের মঞ্চে অস্তিত্ব সংকটের গভীর বেদনা।ইংরেজ বিরোধিতা,ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি নিয়ে মাঝে কিছু রাজনৈতিক ও উচ্চকণ্ঠ কবিতা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠেছিল।পশ্চিমবঙ্গে হাংরি জেনারেশন আন্দোলন,নকশাল বিদ্রোহ ইত্যাদির ফলেও আদর্শগত দ্বন্দ্বে সেখানকার কবিতায় উচ্চকণ্ঠ স্বর যুক্ত হয়েছিল।সেখানে দুঃখের রঙটা ছিল দলগত আদর্শে সিঞ্চিত।তবে দুই বাংলাতেই বর্তমানের কবিতা পর্যবসিত হয়েছে ব্যক্তিগত দুঃখবাদে।তার প্রকাশের রীতি কিছু পাল্টাচ্ছে,আবেগের তীব্রতা কমে যাচ্ছে,রূপক ও চিত্রকল্পে পরিবর্তন আসছে কিন্তু সর্বোপরি দুঃখবাদ থেকে বেরনোর কোন সম্ভাবনা দেখছি না বাংলা কবিতার।সম্ভাবনা শুধু তার আর্তনাদের ধ্বনি,সুর ও ভঙ্গী কিছু পাল্টাবার।

(প্রকাশ--দৈনিক ইনকিলাব/০৬.০১.২৩)