বাংলা কবিতায় বৈষ্ণব পদাবলীর একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।মধ্যযুগের প্রথম নিদর্শন 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' এর ভাষাভঙ্গির প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মৈমনসিংহ গীতিকার 'মহুয়া' নামক পালায়।যদিও মহুয়া পালার বিষয় সম্পূর্ণ রক্তমাংসের মানুষের প্রেমকাহিনীকে অবলম্বন করেছে,তবে কাহিনী বর্ণনার প্রক্রিয়ায় তাতে 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' এর বর্ণনাভঙ্গি প্রাধান্য পেয়েছে।হয়তো বৈষ্ণব পদাবলী সুর সহযোগে বিভিন্ন স্থানে গীত হত বলে তার বর্ণানা পদ্ধতি কবিদের মনে অবচেতন বা চেতনে স্থান করে নেয়।মৈমনসিংহ গীতিকার পালাগুলো আখ্যান নির্ভর হওয়ায় রাধা--কৃষ্ণের প্রেম বর্ণনার আখ্যান পদ্ধতিকে তা সহজেই অনুসরণ করে।
গবেষকগণের মতে সংস্কৃত ভাষায় রচিত কবি জয়দেব এর 'গীতগোবিন্দম' এর কোমল ভাষারীতির প্রভাবে মিথিলার কবি বিদ্যাপতি ব্রজবুলি ভাষায় বৈষ্ণব পদাবলী রচনা করেন।ব্রজবুলি হল বাংলা,হিন্দি,অসমীয় প্রভৃতি ভাষার মিশ্রণে এক শ্রুতিমধুর কাব্যভাষা।আগের দিনে বৈষ্ণব পদাবলী নানা অঞ্চলে সাধকদের দ্বারা গাওয়া হত বলে মিথিলার কবি বিদ্যাপতি বাংলার মানুষ না হয়েও বাংলাতেও তার পদাবলী ছড়িয়ে পড়ে।বলা হয়ে থাকে জয়দেব ও বিদ্যাপতির কাব্যসাধনায় অনুপ্রাণিত হয়ে বড়ু চণ্ডীদাস "শ্রীকৃষ্ণকীর্তন" রচনা করেন।কিন্তু তার কাহিনী ও ভাষায় রাধা-কৃষ্ণের শাস্ত্রগত আদর্শকে মানা হয়নি বলে চৈতন্য ও চৈতন্য পরবর্তী যুগের বৈষ্ণব কবিতায় 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' অচর্চিত হয়ে পড়ে,যার কারণে অন্তরালবর্তী হয়ে উনিশ শতকে এসে তা আবার আবিষ্কৃত হয়।চৈতন্য পরবর্তী যুগে অবশ্য কাহিনী বর্ণনার চেয়ে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম বর্ণনার ভেতর দিয়ে আধ্যাত্মিক মিলানাকাঙ্খাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে যেখানে আধুনিক গীতি কবিতার লক্ষণ দেখা যায়।
বৈষ্ণব কবিতার প্রভাব মধ্যযুগে শেষ হলেও আধুনিক যুগেও তার ভাষারীতি প্রভাব ফেলেছে।বৈষ্ণব কবিতায় অনুপ্রাণিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ কিশোর বয়সে 'ভানুসিংহের পদাবলী' রচনা করেন যা গান হিসেবে এখনও বিখ্যাত।তার একটি হল 'শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা" যা বহুল প্রচারিত ও অত্যন্ত শ্রুতিমধুর।এই বৈষ্ণব কবিতার প্রেরণাই কি পরবর্তীতে রাধা-কৃষ্ণের আধ্যাত্ম লীলার নামায়ন থেকে বেরিয়ে এসে পরিণত বয়সে তাকে ব্যক্তি আমি'র সাথে মহা আমি'র প্রতি ভক্তি ও প্রেম আকাঙ্খায় পর্যবসিত 'গীতাঞ্জলি' সৃষ্টিতে বাধ্য করেনি?ব্যক্তিগতভাবে আমার তাই মনে হয়েছে।অবশ্য ভাবগত দিক থেকে 'গীতাঞ্জলি'তে উপনিষদেরও গভীর প্রভাব দেখা যায়।
রবীন্দ্রনাথের আগে মাইকেলও বৈষ্ণব পদাবলীর অনুকরণে 'ব্রজাঙ্গনা' কাব্য রচনা করেন।সেখানে তার ভাষা অন্যান্য কাব্যের ভাষার চেয়ে অনেক সহজ।এমনকি কবিতার শেষে তিনি বৈষ্ণব পদাবলীর কবিদের মত ভণিতাও ব্যবহার করেছেন।রবীন্দ্রনাথের পর নজরুল বৈষ্ণব পদালীর প্রভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে কবিতা রচনা না করলেও শ্যামাসঙ্গীত রচনা করেছেন।এখনও ধর্ম নির্বিশেষে সবার কাছে তা আনন্দের সামগ্রী।কবিতায় প্রেমের যে আকুতি বৈষ্ণব পদাবলীতে দেখা যায় তা রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের প্রেমের কবিতায় যথেষ্ট প্রভাব ফেলে।রবীন্দ্রনাথে ভাব অত্যন্ত গভীর হওয়ায় এই আকুলতা মিহি রূপে প্রকাশ পেলেও নজরুলের কবিতায় প্রেমের আকুলতা অত্যন্ত তীব্র ও দানাদার হয়ে ধরা পড়ে।
তিরিশ ও তার পরবর্তী কবিতায় পাশ্চাত্যের দীপ্র প্রভাবে বৈষ্ণব কবিতার প্রত্যক্ষ প্রভাব তিরোহিত হয়ে যায়।তবে সরাসরি কাহিনী বর্ণনা বা বিশ্বাসের বাহন হয়ে না এলেও মিথ হিসেবে কবিতার নানা চিত্রকল্প ও উপমায় তা ব্যবহৃত হতে থাকে।মিথ হিসেবে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম-উপাখ্যানের খণ্ডিত নানা অংশ,চরিত্র ও স্থানের নাম বর্তমানের কবিতাতেও নানাভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে।
(সংক্ষিপ্ত)
প্রকাশ--দৈনিক ইত্তেফাক ০৪.১১.২২