১)
কাব্যের প্রশংসায় কী হে কাব্য-গুণ বাড়ে ?
ভাঁড়ে মা ভবানী রাজা, নিছক প্রচারে ।
২)
বর্তমানে আবর্তমান যে জন অতীতচারী ;
মোটামুটি ভূতাবিষ্ট তাকে বলতে পারি ।
৩)
পারস্পরিক কণ্ডূয়ন মন্দ কিছু নয়
কার নখে গুপ্ত বিষ থেকে যায় সংশয় ।
৪)
তপ্ত যখন রক্ত-ধারা রসস্থ আবেগ
বৃষ্টি ঝরায় দু’চার পশলা শরতের মেঘ ।
৫)
কুঠারের কী মুরোদ ? না থাকলে বাঁট ?
বিধাতাকে দায়ী করে কাষ্ঠ আকাট ।
৬)
খেলায় লেজে, সেবক সেজে, বুঝেছি গেল বারোটা বেজে
অহো কী মহত্ব ক্রীতদাসত্ব সহাস্যে দিই হুঁকোটি সেজে ।
৭)
অহো অহো কী লীলা ! বিপরীত বিহার ...
নদী কিনা তরঙ্গ-রঙ্গে তরণীকে পার !
৮)
বাজাতে জানলে বাঁশি, না জানলে বাঁশ ;
সমাজে স্বীকৃত বাপু, হিঁজড়ের সন্ন্যাস ।
৯)
গয়ং গচ্ছ, ফুর্তি মোচ্ছব, প্রেমের ঢিবি উচ্চ উচ্চ ;
রঙিন ধান্দা বিন্দাস বান্দা, রসদে টান ঊর্দ্ধ পুচ্ছ ।
১০)
আমি বোকা, বয়স্ক খোকা, রঙের ফেরে খাচ্ছি ধোঁকা ;
ক্ষুধার্ত সাপ গিলছি ছুঁচো, চোখে পিঁচুটি, বসছে পোকা ।
১১)
কী হচ্ছে, না হচ্ছে, শুধু দেখে যাক চোখ ...
এই শর্ত যে মেনে চলে সেই ভদ্রলোক ।
১২)
বুঝলে বাড়বে বোঝা ; না বুঝলেও মুশকিল ;
বোদ্ধা সেজে গোঁজামিলে দাও না অন্ত্যমিল ।
১৩)
গল্পের গোরু গাছে, এ তো সবার জানা,-
এ গোরুর দুধে কী হয় ক্ষীর ননী ছানা ?
১৪)
পাগলকেই বলা যায় সাম্যবাদী জাত
মলে আর চন্দনে করে না তফাৎ ।
১৫)
আঁকি-বুকি টেনে দিলেই আকাঁ হয় ছবি ?
হাঁটা-পাঁঠা যে মেলায় সেই এঁজ্ঞে কবি ?
১৬)
কাব্য-খ্যাতি নিরক্ষর ভোরের কুয়াশা
পড়তে শেখেনি বাপু রোদ্দুরের ভাষা ।
১৭)
অবোদ্ধা বেশি বোঝে, বোদ্ধা বোঝে কম
আকাশে সার অসার প্রয়োগ, ফলে কী ধান-গম ?
১৮)
প্রত্নশব্দভূমি খনন, অক্লান্ত পরিশ্রম,
সরস্বতী-সভ্যতা পায় নিষ্ঠা ও সংযম ।
১৯)
ঝগড়া-ঝাঁটি করে মরে 'আসা' আর 'যাওয়া' ।
"ধেত্তেরিকা" বলে ঝঞ্ঝা হয়ে গেল হাওয়া ।
২০)
রসের কাছে শিকড় তো সাক্ষাৎ শয়তান
শোনে না সে ডালে ডালে রঙের জয়গান ।
২১)
ভাসছি হাল্কা যোগী কালকা ; তরোয়াল কার ? কিংবা ঢাল কার ?
যুদ্ধ খেলায় বিশুদ্ধ পুরুষ বেচারা বুদ্ধ স্বপ্নের মালকার ।
২২)
হল তো ঢের, হের ও ফের ; না বুঝে ঘের, টানছি জের …
রঙিন স্বপ্ন-কচু পোড়া খাই, কালকে বামের আজকে রামের ।
২৩)
টুকরো টুকরো করে কাটে যে কুঠার ;
হাত দিয়ে দেখো, তার পড়ে গেছে ধার ।
২৪)
এক জীবনে অনেক কিছুই হল দেখা, হল বোঝা
হল না শুধু পাখির চোখে শ্যাওড়া-ফলের বীজটি খোঁজা ।
২৫)
বোঝার ঝামেলা অনেক ; না বোঝাই ভালো,
বললে কথা, ধরা পড়ে, কে ভোঁতা কে ধারালো ।
২৬)
অতিবোদ্ধা না বুঝেই মুচকি মুচকি হাসে
বোকা তারাই, তারা গোনে দিনের আকাশে ।
২৭)
সব চাইতে উঁচুতে আমি, ভাবে উড়ন্ত ঘুড়ি
সুতো ও লাটাই জানে সে কার বাহাদুরী ।
২৮)
কাব্যের বাজারে, পচা মাছ বেচে যারা
তাদের হেঁড়ে গলার স্বরে সচকিত পাড়া ।
২৯)
সিঁধ কেটে কাব্য-বাড়িতে ঢোকে বোকা চোর
হাতড়ে মরে অলঙ্কার, হয়ে আসে ভোর ।
৩০)
গাছে গাছে নতুন পাতা আপনিই গজায়
অক্ষর-জ্ঞান থাকলে কী হে কাব্য লেখা যায় ?
৩১)
শত শত কবিতা পচা খড়ের গাদা
যে করে ছুঁচের খোঁজ মস্ত সে গাধা ।
৩২)
গাছে চড়তে জানি না, মগডালে চড়বই
প্রভাব-প্রতিপত্তি আছে, জোগাড় করি মই ।
৩৩)
হাটে হাঁড়ি ভেঙে গেলে, গড়িয়ে যায় জল ;
মরা মাছ পড়ে থাকে, জ্যান্ত খলবল ।
৩৪)
কেউ কিছুই বোঝে না, আরে আমিই বড় বোদ্ধা ;
মাঠে যাওয়ার দরকার কী ? তত্ত্ব-জ্ঞানেই যোদ্ধা ।
৩৫)
বুঝতে চাইলেও বোঝা যায় না, এমন লিখি পদ্য
অবোধ পাঠক কী বুঝবে ? মশাই, আমারই অবোধ্য ।
৩৬)
ভালো-মন্দ নিত্য দ্বন্দ্ব, সম্বন্ধ আপেক্ষিক
মহাশূন্যে যে দাঁড়ায় তার সামনেটা পুবদিক ।
৩৭)
সামনে হেসে হেসে কথা পিছনে গালাগাল
ছন্দ- রঙিন পোশাকে ঢাকা শব্দের কঙ্কাল ।
৩৮)
চোখ তো সব দেখে, কিন্তু দেখে না চোখের তারা ;
কোনো দেখাই পুরো হয় না যোগ্য আয়না ছাড়া ।
৩৯)
শাখা থেকে ছিঁড়ে নিলেও ফুল কিন্তু হাসে
সত্যিকারের প্রেমিক, রঙিন মৃত্যু ভালোবাসে ।
৪০)
বন্ধুর মনে ভারি দুঃখ, তাকে বোঝে না কেউ
ইচ্ছে কাদা ডোবায় তোলে নীল সাগরের ঢেউ ।
৪১)
জ্বলন্ত শিখাটি ; দায়ী প্রদীপ-তেল আর সলতে
কী আছে কী নেই ? ভেবে বোঝ, পারো কিনা জ্বলতে ।
৪২)
ব্যাকরণে মহাপণ্ডিত বিশুদ্ধবাক মোহান্তি
যে যখন যে কথাই বলে খুঁজে পান ভ্রান্তি ।
৪৩)
তাকিয়ে থাকে, দেখে না, দেখে কিন্তু শেখে না
শেখে, মানে শেখার ভাণ, কাঁচাই থাকে, পাকে না ।
৪৪)
ঝক ঝকে ধারালো দাঁত, লোহা কাটে লোহার করাত,
স-জাতে কী হত কাটাকাটি ? না থাকলে কারো হাত ।
৪৫)
হাসলে হাসি, কাসলে কাসি, ভাসালে ভাসি স্রোতে ...
মহাপ্রভুর শ্রীপুচ্ছটি ধরে টিকছি কোনোমতে ।
৪৬)
দুরারোগ্য কাব্যরোগ, দুর্বাচক যোগ-সঙ্গম
কাব্য-কলার খোসায় পা, পাঠক আলুর দম ।
৪৭)
অবস্থা খারাপ,আছি চাপে ; বকছি প্রলাপ অনুতাপে
আমি তো কাঠের তরবারি নকশাদার রঙিন খাপে ।
৪৮)
মুক্ত বিহঙ্গম, বকম বকম, প্রথম প্রথম সুস্বাগতম
খুলে পড়ল রঙিন চশমা, স্বপ্ন-কুসুম কুঁড়িতে খতম ।
৪৯)
উড়ছে টাকা, ঘুরছে চাকা, ভর্তি শাখা, ভর্তি ঝাঁকা
আজব কাণ্ড ঘটছে কত, রাজার চাল, পকেট ফাঁকা ।
৫০)
বন্দীরাম কাঁচা আম, বচন কিন্তু পাকা
জানলে কিংশুক ফোটায়, ভেরেণ্ডার শাখা ।
ঁবন্দীরাম নন্দী ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক । সেকালের মাইনর পাশ । আজ থেকে প্রায় ৪৪ বছর আগে চির বিদায় নিয়েছেন । তিনিই আমার প্রথম ছন্দগুরু । প্রিয়ংবদা দেবীর ‘প্রার্থনা’ নামে একটি কবিতা নকল করে আমি অশুদ্ধ বাংলায় ভুল ছন্দে একটি কবিতা লিখেছিলাম । তখন আমার বয়স ১০-১১ হবে । কেন লিখে ছিলাম তা জানি না । উনি তারপর থেকেই আমাকে নিয়ে পড়েন । পেনসিল দিয়ে ছোট ছোট লাইন খাতায় লিখে দিতেন । কথার সাথে কথা মেলানোর নেশা ধরিয়েছিলেন । উনি আমার ছাপা অক্ষরে কোনো কবিতা দেখে যেতে পারেননি । শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাইয়ের নামটি ছদ্মনাম হিসেবে ব্যবহার তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি ।
আমার দুই মামার মধ্যে ছোট মামাকে ‘বোকা মামা” বলেই ডাকতাম । আমার বোকা মামার মতো এমন ছড়াকার আমি কোথাও দেখিনি । না বোকামামা এক লাইনও লিখেননি । মুখে মুখে ছড়া কাটতেন । আজ আমার মনে হয় বোকা মামার ছড়াগুলো লিখে রাখলে বাংলা সাহিত্যে এক ঋদ্ধ সংযোজন হত । খেয়ালী মানুষটি বিয়ের চার বছর পর সংসার ছেড়ে চলে যান । মামা ও মামীমা কখনো এক শয্যায় শয়ন করেননি । মামীমার অপরাধ তাঁর সুন্দরী খুড়তুতো বোনকে ‘কনে দেখার সময় দেখিয়ে’ তার সঙ্গে মামার বিয়ে দেওয়া হয়েছিল । মামা অবশ্য পাত্রী দেখতে যাননি । দাদু গিয়েছিলেন । কিন্তু বিয়ের চার বছরের সংসারে মামীমার সঙ্গে বোকা মামার বেশ একটা সখা-সখী সুলভ সম্পর্ক ছিল । বোকামামা আজও যদি বেঁচে থাকেন তো ৮৫-৯০ এর কাছাকাছি বয়স হবে । বোকামামার কয়েকটি ছড়া আমার এখনো মনে আছে । একটি আপনাদের শোনাই । আমার মামীমার নাম ছিল শৈবলিনী । মামীমাকে নিয়ে ছড়া ঃ
“শোনো শোনো, শৈবলিনী
আমি তোমাকে সই বলিনি ;
দোলের মেলায় নোলোক দেব
এমন কথা কৈ বলিনি ।“
বোকামামার মতো মিল দেওয়া আমার অসাধ্য । মামার ভাগ্নে বলে হয় তো কিছুটা পারি ।