সকালবেলায় বেশ ভোরেই,
মাঝ বয়েসী মহিলা ঘুম থেকে উঠে,
জানালার বাইরের সাদা পাহাড়টি
দেখে-
তখন শহর ঘুমিয়ে, যেমন তার
ভালোবাসা ঘুমিয়ে থাকে বিছানার কোন ঘেঁষে।
ভোরবেলায় পাহাড়ী জায়গায় একটু বেশীরকম শীত,
মহিলা লেপটিকে আরো ভালো করে জড়িয়ে দেয়, তার সবচেয়ে প্রিয় পাঁচ এগেরোর পুরুষটির গায়ে।
আগের চেয়ে অনেক শীর্ণ দেহ হয়েছে তার, বয়স তো হল।
এই বয়েসে ঠাণ্ডাটাও বেশী করে লাগে, আর যদি ঠাণ্ডা লাগে,
তবেই জ্বালা- সারাদিন মহিলাকে
ঘরের কিছু কাজ করতে দেবেন না,
চাইবেন সারাক্ষণ যেন মাথায়, হাত রাখে।
মিথ্যে বলা হবে, মহিলার এমন
জ্বালানো বেশ লাগে
দিনের প্রথমে চায়ে দুটো তুলসি পাতা আর একটু কুচনো আদা, মধু দিয়ে রোজ বানিয়ে দেয়।
মহিলার এমনটি করার পিছনে শুধু ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচানোই যে অভিপ্রায় তা ভাবলে,
ভুল ভাবা হবে।
ঐ ভোরের সূর্যস্নান করতে, করতে যে গান,
ভৈরব রাগের ধরেন তার প্রিয় মানুষটি,
তা শুনতে এমন চা রোজ সে বানাতে পারে।
আহাঃ যেন মনে হয় পাহাড় ঘেঁষে বাড়ির বারান্দায় ভোরের সূর্যের ছটা এসে পৌঁছে গিয়েছে।
সারাদিন দুজনে হাজার কাজ করে,
মহিলা যায় পাহাড়ের ছোট্ট বাচ্চাদের স্কুলে পড়াতে, তার প্রাণের মানুষ ল্যাপটপে বসে গল্প লেখেন।
দিনের বেলায় খাওয়ার ব্যবস্থা যদিও
করে দিয়ে যায় মহিলা,নিজের হাতের
রান্না, খাওয়ানোর আনন্দই আলাদা।
যদিও স্বল্প আহার করেন তার জীবনের
একটি মাত্র সুখ, তার মনের মত পুরুষ।
ভেঁতো বাঙালিদের মত সাতটি সব্জী সিদ্ধ আর একটু ভাত, যাতে একটু কাঁচা তেল দিয়ে
রেখে দিয়ে যায়, সে স্কুলে যাওয়ার সময়।
আর স্কুল থেকে দুপুরে ফিরলে দেখে,
মনের মত সব্জী, মাছের বাজার করে
রেখেছেন তার সংসারের প্রতি একটু,
একটু ভালোবাসায় পড়া মানুষটি।
ঐ সবকিছু দুজনে কেটে, কুটে, নুন,মশলা
হলুদ দিয়ে রান্না চাপিয়ে দেয়।
আর শান্তি মতো জানালার পাশের টেবিলে,
রেখে খায় দুজনে অসীম তৃপ্তিতে!
তারপর আসে অলস দুপুর-
কত কবিতা আর লেখা বিভিন্ন আধুনিক,
পুরোনো লেখকের।
তাতে যদি কখনো রবি ঠাকুরের স্থান হয়,
কখনো হেলাল হাফিজ সাহেবের লেখায়,
জমে মেহেফিল!
সন্ধ্যা এলে, দুজনেই চুপ করে যায়,
মহিলার অনর্গল কথা থেমে যায়-
চোখ দুজনের রোজ চকচকে হয়।
ঘরের উল্টো দিকের পশ্চিমের বারান্দায়
বসে ওরা সূর্যকে অস্ত যেতে দেখে।
আলতো ভাবে প্রতিদিন পুরুষের লম্বা আঙুল, মহিলার ছোট্ট কুঁচকানো আঙুলের মধ্যে চলে যায়!
দুজন অনেকক্ষণ ঐভাবে বসে থাকে,
পাহাড়ের গায়ে আলো জ্বলে-
দূর থেকে কাশী আর ঘন্টার আওয়াজ ভেসে আসে।
শেষে মহিলা একটি মোম জ্বালিয়ে দেয়,
তার প্রেরণাদায়ক পুরুষের পড়ার টেবিলের পাশে।
ঈশ্বরের কোন পট বা মুর্তি, ছবি, কেলেন্ডার
কিছু নেই ঐ একটি বসবার, শোবার ঘর ও একটি রান্নাঘর নিয়ে সাজানো কাঠের বাড়িটিতে।
কিন্তু আছে দুইদিকে দুটো বারান্দা আর
আছে ভর্তি বই, নতুন, পুরোনো গানের সিডি-
ঘরের আলমারি জুড়ে।
শেষে রাতের খাবার পরে, দুজনে
কাঠের বাড়ির পাশের,
ছোট্ট রাস্তা ধরে অনেকটা দূর
হাতে, হাত ধরে হাটে।
মাঝেমাঝে মহিলা থমকে দাঁড়ায়,
তার মনের মানুষ, পাহাড়ের অন্ধকারে
পিছন থেকে নিবিড় আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে।
নিশ্চুপ আলাপনে দুজনে,
শহরের ম'ল রোডের পছন্দের একটি কেফেতে, কালো কফি মহিলা, ল্যাটে পুরুষটি নিয়ে বসে-
একঘন্টা সেখানে কাটিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।
রাতের চাদর যখন পাহাড়কে জড়িয়ে ধরে,
তখন অদ্ভুত একটি আবেশ যেন শরীরকে অনুভূতিতে ভরিয়ে দেয়।
যা দুজনে বেশ অনুভব করে, একই বিছনায় শুয়ে।
ওদের সামনের জানালাটি বন্ধ থাকে-
পর্দা খোলা থেকে যায়, রাতভোর একইভাবে!
ওই জানালার পাশে যে মোমবাতি, মহিলাটি জ্বালিয়ে রাখে, প্রতিটি সন্ধ্যায় তা
একটু, একটু করে গলতে শুরু করে রাতের সাথে।
একটি সুদৃঢ় বুকে, সুডৌল বাহুপাশে,
মহিলা ঘুমে ঢোলে পড়ে।
পুরুষটি সারা রাত মহিলার চোখের পাতা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত গান শোনাতে থাকে।
গত রাত্রিতে যে গানটি ঐ বাড়ির থেকে ভেসে আসছিল তা ছিল-
"তোমায় গান শোনাব তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখ
ওগো ঘুম-ভাঙানিয়া বুকে চমক দিয়ে তাই তো ডাক'
ওগো দুখজাগানিয়া ॥ এল আঁধার ঘিরে, পাখি এল নীড়ে, তরী এল তীরে শুধু আমার হিয়া বিরাম পায় নাকো। ওগো দুখজাগানিয়া ॥"
অনেকেই শোনে এমন গান ভেসে আসে ওই পাহাড়ের বাড়ির থেকে।
কে বা কারা ছিল ওরা, জানা যায় নি।
তবে পাহাড়ের লোকেরা বলে-
"খুব ভালো ছিল ঐ দিদিমুনি ও বাবু,
বাবুর মৃত্যু হয় ঐ কাঠের বাড়িতে রাতে। ভোরবেলায় দিদিমনি ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে হারিয়ে যায় কোথায়.... আর দেখিনি কেউ দিদিমুনিকে।"
ঐ স্কুলে মহিলা নিজের নাম লিখিয়েছিলেন 'পাহাড়'!
আর একটি খবরের কাগজের এজেন্সি যেখান
থেকে কাগজ, বই, সংকলনের আসতো।
জানা গিয়েছিল পুরুষটির ছদ্মনাম,
"ভোরের সূর্য" ছিল।
==========≠==========================