একজন বিশুদ্ধ কবির মৃত্যু হলো এ-শহরে, পুরো শহর যেন বাকরুদ্ধ, স্তম্ভিত, শোকস্তব্ধ হয়ে গেল; শহরজুড়ে কান্নার রোল পড়ে গেল।
কবির নিথর মরদেহটি সকল স্তরের মানুষের শ্রদ্ধ নিবেদনের জন্য রাখা হলে শহরের আকাশ-বাতাস এক গভীর বিষাদে ভারী হয়ে উঠল।
শেষ বিদায় বেলায় শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, চোখের জল আর ফুলে ফুলে শোভিত হলো কবির মরদেহটি।
আহ্, কী মহিমান্বিত এই মৃত্যু! কী সুন্দর এই মৃত্যু!
এ-মৃত্যু যেন ভোরের অরুণিমার মতো দ্যুতিময়, ফুলের মতো স্নিগ্ধ, শিশিরের শুভ্র-শীতল বিন্দু।
মৃত্যু, মৃত্যু, মৃত্যু।
প্রতিটা মৃত্যুই পরম সুন্দর আর স্নিগ্ধ যদি সে মৃত্যু হয় স্বভাবিক, পরিণত-জীবনকাল-অতিবাহিত একটি অর্থময় মহৎ জীবনের পর সমাপ্ত।
জীবনের শুরুতেই বা মাঝপথে যে মানুষটিকে মৃত্যু কেড়ে নিল, যার জীবনের স্বপ্ন এখনো অপূর্ণ থেকে গেল, জীবনে যার চলার পথ এখনো অনেক বাকি রইলো সেই মৃত্যু আমি চাই না, সেই মৃত্যু অনাকাঙ্খিত, অপকৃষ্ট।
এ-পৃথিবীতে মৃত্যু সকল জীবের জন্য একটি পরম আশীর্বাদ, খুব প্রয়োজনীয়।
হ্যাঁ, মৃত্যু খুব প্রয়োজনীয়।
সবকিছুরই একটি শেষ আছে, এ তাবৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অনন্ততা বলতে কিছু নেই।
যে মহাতপ্ত সূর্য এত উত্তপ্ত, সে সূর্যও একদিন শীতল হবে; হবে নিথর, নিস্তব্ধ।
প্রতিটি নদীরই জন্ম হয় একদিন সাগরে নীলিন হওয়ার জন্য।
মৃত্যু আছে বলেই পুরাতন জীবেরা বিদায় নেয়, পৃথিবীতে আসে নতুন জীবের প্রাণচাঞ্চল্য।
সারাদিন জেগে থাকার পর শরীরে একসময় ক্লান্তির ভার চলে আসে, তখন দরকার হয় ঘুমের।
একটি ঝরঝরে ঘুমের পর শরীর আবার হয় তরতাজা, নতুন শক্তিতে হয় উদ্দীপিত।
দীর্ঘ জীবনের পর যখন বার্ধক্য চলে আসে তখন এক ধরনের ক্লান্তির ভার চলে আসে; এভাবে বেঁচে থাকা আর বেঁচে থাকা কত দিন।
একদিন জীবনের সব লেনদেন শেষ হলে এলে খুব দরকার হয়ে পড়ে চিরঘুমের, চিরশান্তির; একমাত্র মৃত্যুই তখন দেয় সেই চিরশান্তির স্বর্গীয় স্পর্শ।
অনাদিকাল থেকে মৃত্যুভয় মানুষকে তাড়া করে এসেছে ছায়ার মতো।
মৃত্যুভয়কে এড়ানোর অনেক পথ আছে।
তার মধ্যে উৎকৃষ্ট পথটি হলো অর্থময়ভাবে, মহৎভাবে, ক্ষুদ্রতার গণ্ডি ছাপিয়ে বৃহৎভাবে বাঁচা, বিশুদ্ধ আনন্দ পাওয়ার জন্য বাঁচা, সার্থক মানুষ হওয়ার জন্য বাঁচা, আকাশের মতো বড় হয়ে বাঁচা, জীবনকে প্রচণ্ডভাবে ভালোবেসে নিজেকে উজাড় করে বিলিয়ে দিয়ে বাঁচা।
একবার তুমি এভাবে বাঁচতে শিখে গেলে মৃত্যুভয় উবে যাবে নিমেষে, মৃত্যুকে তখন তুমি জড়িয়ে ধরে পাবে গভীর এক পরমানন্দ।
তখন হাসতে হাসতে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে তুমি আর কাঁদবে চারপাশ; আকাশ, বাতাস, মাটি, মানুষ, নক্ষত্র।