ওয়ান সুন থাং বেজিং চলে যাওয়ার পর চীন দেশের কবি সিরিজটা শেষ করতে বাধ্য হলাম। কিন্তু তা বলে চীনা কবিতা সম্বন্ধে লেখা শেষ হওয়ার নয়। যে গুটিকয়েক মানুষ আমার চীন দেশের কবিতা সম্পর্কিত লেখা নিয়মিত পড়েন, তাদের জন্যই ফিরে এলাম নতুন একটা চীনা কবিতার সিরিজ 'চীন দেশের পাঁচ কবিতা' নিয়ে। এখানে থাকবে চীন দেশের একজন কবির সংক্ষিপ্ত জীবনী আর পাঁচটি কবিতার অনুবাদ। সংক্ষিপ্ত জীবনী কারন যে দশজন কবিকে আমি বাছাই করেছি, তাদের কবিতা উদ্ধার করা গেলেও, তাদের জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় নি। যাই হোক, শুরু করছি নতুন সিরিজ। আজকে তার প্রথম পর্ব দিলাম। আমাদের আজকের কবি হলেন লি চ্যাং চাও।
লি চ্যাং চাও (১০৮৪-১১৫১) চীন দেশের শ্রেষ্ঠ মহিলা কবিদের অন্যতম। ১০৮৪ সালে ঝানকিউ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ওনার জন্ম। প্রথম জীবনে কবি হিসাবে লি চ্যাং চাও-এর বেশ নাম ডাক ছিল। ১০১১ সালে ওনার বিবাহ হয় ঝাও মিংচেঙ-এর সইত। ১১২৯ সালে ওনার স্বামীর মৃত্যুর পর লি চ্যাং ভীষণ রকম ভেঙে পড়েন। ওনার শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলি এই সময় রচনা। শেষ বয়সে তিনি হংঝউ-এ বসবাস করতেন। এর বেশি ওনার জীবন সম্পর্কে বিশেষ জানা যায়নি।
যদিও সারা জীবনে কয়েক শো কবিতা রচনা করেছিলেন, তবু মাত্র আটাত্তরটি কবিতাই সংরক্ষণ করা গেছে। ওনার লেখা কাব্যগ্রন্থ 'সুয়ু জি' হারিয়ে গেছে সময়ের গহ্বরে। ওনার লেখা বেশ কিছু সি ঘরানার কবিতা উদ্ধার করা গেছে। ওনার কবিতার ভাষা সরল হলেও ভাব খুব গভীর। ওনার কবিতাকে প্রধানত দুভাগে ভাগ করা যায়, ওনার স্বামীর মৃত্যুর আগের আর পরের কবিতা। ওনার প্রথম দিকের কবিতায় আমরা পাই প্রকৃতির কথা, তার ছেলেবেলার কথা আর তার স্বামীর প্রতি ভালোবাসার কথা। পরের দিকের কবিতায় পাওয়া যায় শুধু বিরহ।
ওনার লেখা সেরা পাঁচটি কবিতার অনুবাদ দিলাম। নতুন সিরিজ কেমন লাগলো জানাবেন।
১) উৎসবের দিন
হালকা কুয়াশা আর ঘন মেঘে,
ঢেকে আছে বিষণ্ণ দিন।
সোনালী মোমবাতিটার
দীপ্ত শিখা এখন মৃতপ্রায়।
আবার সেই
উৎসবের দিন আসন্ন।
মাঝ রাতের শীতলতা
আমার পোশাক ভেদ করে
প্রবেশ করে আমার অন্তরে।
বুনো ঝোপের ধারে বসে
আমি সুরা পানে ব্যস্ত।
আমার শরীরে ছড়িয়ে যায়
সেই বুনো ফুলের সুবাস।
মুগ্ধতায় ভরে যায় আমার মন।
শুধু যখন, পশ্চিমী বাতাস উড়িয়ে নেয় আমার আঁচল,
আমি বুঝি, ওই হলুদ ফুলের থেকেও
আমি বেশি কোমল।
২) সূর্যাস্তের গান
সূর্যটা যেন তপ্ত সোনার মাঝে অস্তায়মান।
বিকেলের আকাশ মেঘাছন্ন।
কোথায় তুমি?
ঘন, শুভ্র কুয়াশায় ঢেকে যায় বনানী।
কোথা থেকে ভেসে আসে এক করুন বাঁশির সুর।
আর কটা দিনই বা বাকি?
এই সন্ধ্যেটা আরও সুখকর হতে পারত।
এখন পরিবেষ ভীষণ শান্ত।
কিন্তু এটা যে ঝড়ের আগাম বার্তা নয়
তা কে বলে দিতে পারে?
৩) সুরার আমেজ
নরম বাতাস, ক্লান্ত সূর্য - শরতের এই তো শুরু।
নতুন পোশাকে আমার অন্তরেও যেন নতুনত্বের রেশ,
তবুও ঘুম ভাঙলে একটা হালকা শীতলতা অনুভব করি।
কেশ সাজাই নতুন ফুলে,
তবু তারাও যেন নতুনের আশায়।
কোথায় আমার ঘর?
শুধু, নেশাগ্রস্থ হয়ে ভাবি।
চন্দন কাঠের বিছানায় সুবাস
কোথায় যেন হারিয়ে গেল।
পড়ে আছে শুধু, সুরার হালকা আমেজ।
৪) তোমার চলে যাওয়া
মিলিয়ে যাচ্ছে আমার শরীরে
রক্তিম পদ্মটার সুবাস।
শরত, তুমি ফিরে এসো।
শহুরে পোশাকটা ফেলে, নৌকায়
আমি ভেসে বেড়াই। সেই গ্রামে।
কে চিঠি পৌঁছে দেবে
ওই মেঘের পারে?
শুধু ফিরে আসে বুনো হাঁসটা
অজানা ভাষার কোন গান নিয়ে।
চাদের আলোয় ছড়িয়ে আছে
ফুলের উপর। জলের উপর।
যতই ছড়িয়ে যাক, তবু
একত্রিত হবে আবার সেই ক্ষনে।
একই জাতের পাখিরা সর্বদা
নিজেদের সঙ্গী খোঁজে।
আমিও তারই মত।
কত দূরেই না আছি আমরা।
এই দুঃখ কোনদিন শেষ হবে না।
কখনও জমে থাকবে আমার চোখের পাতায়,
আর,
পরমুহূর্তে ভিজিয়ে দেবে আমার হৃদয়।
৫) বার্ধক্য
বছরের পর বছর, বরফের মাঝে,
আমি কুড়িয়ে গেছি মেই ফুল;
তাদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে।
হাতের মুঠোয় ভর্তি করেছি।
আমার পোশাক ভিজে যায় তাদের স্বচ্ছ অশ্রুতে।
এই বছর, আমি ভেসে গেছি
সাগরের মাঝে,
দিগান্তের সীমায়।
আমার চুলে পাক ধরে গেছে।
বিকেলের দমকা হাওয়ার বিচার,
মেই ফুলে মুগ্ধ হতে,
আমি আর কোনদিন আসব না।