রবিবার সকাল। মনটা খুব প্রসন্ন আছে। একটু আগে মেল-এ আমার দেশে ফেরার টিকিট চলে এসেছে। এখন শুধু দিন গোনা। টিকিট পাওয়া মাত্রই ঘরে যেন একটা ব্যস্ততার আমেজ এসে গেল। খবরটা বলতেই আমার স্ত্রী বললেন, “সুটকেসটা একটু বের করে দিও, গোছানো শুরু করি আর কি।” দিন হিসেব করলে এখনও প্রায় এক মাস। বললাম, “এখনও তো অনেক দেরি। আজ তো সবে ছ’তারিখ। টিকিট তো পরের মাসের দু’ তারিখে। তাড়া কি? তোমার হাতে এখনও আছে...” কথাটা শেষ হল না। ফোন বেজে উঠল। ফোনটা কানে দিয়ে ‘হ্যালো’ বলতে ওপাশ থেকে ওয়ান সুণ থাং-এর গলা ভেসে এল। কিন্তু যা শুনলাম, তাতে দেশে ফেরার আনন্দটা কোথায় যেন উবে গেল।
ওয়ান সুণ থাং-এর বদলি হয়ে গেছে বেজিং-এ। বিশেষ প্রয়োজনে আগামী বুধবার ওকে চলে যেতে হবে। বৃহস্পতিবার জয়েনিং। আগামী তিনদিন ও অফ-ডিউটি।
দুঃসংবাদটা সংক্ষেপে দিয়ে ও বলল, “ভাই তোমার সাথে তো আর রোজ রোজ দেখা হবে না। কাল পরশু খুব ব্যস্ত থাকব। দেখা করা হয়তো সম্ভব হবে না। কিন্তু তোমার সাথে একবার দেখা করতেও খুব ইচ্ছে করছে। কি করা যায়? আসবে নাকি একবার?”
আমার স্ত্রিকে সুটকেসটা বের করে দিয়ে সোজা চলে গেলাম ওয়ান সুণ থাং-এর ফ্ল্যাটে। বেশ কিছুক্ষন কথা হল দুজনের। চীনে আসার পর থেকে এই আড়াই বছরে ওয়ান সুণ থাং-এর সাথে একটা গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। কাল থেকে তাকে আর দেখতে পাবো না এই ভেবে আমার গলার কাছটায় কি যেন একটা আটকে আছে মনে হল। কিছুক্ষন পর ও বলল, “ফোনে না হয় কথা হবে, কিন্তু তোমার চীনা কবি নিয়ে লেখার কি হবে?”
এই বিষয়টা আমার মাথাতেই আসে নি। বললাম, “কি আর হবে। তুমি থাকবে না, তোমার গল্পও থাকবে না। চীনে কবিদের নিয়ে লেখাও বন্ধ।”
“সে কি হয় বন্ধু। আমার সব প্রিয় কবিদের নিয়েই লিখেছ। তবে একজন বাদ পড়ে গেছেন। আজ সেই কবির গল্পটা তোমায় বলি। আপাতত আমার শেষ গল্প। শিরোনাম দিয়ো, ‘চীন দেশের কবি (শেষ অংশ)’। তা হলে শুরু করা যাক? আমাকে আবার একটু বেরতেও হবে। কিছু মার্কেটিং করার আছে।” এই বলে উঠে গিয়ে একখানা বেশ মোটা কার্ডবোর্ড বাঁধানো বই নিয়ে এল ওয়ান সুণ থাং। তারপর শুরু হল গল্প, চীন দেশের কবি টাও ইয়ুন মিং –এর কথা। শিরোনামে ‘শেষ অংশ’-টা ইচ্ছে করেই বাদ দিলাম। ইংরেজিতে কথাই আছে, Never Say Never.
টাও ইয়ুন মিং (৩৬৫-৪২৭) ষষ্ঠ সাম্রাজ্য যুগের বিখ্যাত কবি ছিলেন। টাও ইয়ুন মিং জীবন কাহিনী খুব সরল। উচ্চশিক্ষিত হলেও ওনার পরিবার ভীষণ গরীব ছিল। খুব কম বয়সে উনি মা কে হারান। কিছুকাল উনি সরকারি কাজে নিযুক্ত থাকার পর চাকরি ছেড়ে গ্রামে ফিরে যান আর চাষবাস করে জীবন অতিবাহিত করতে থাকেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ওনার পৈত্রিক বাড়ি আগুনে ধ্বংস হয়ে গেলে গভীর দারিদ্র নেমে আসে ওনার সংসারে। ৪২৭ খ্রিস্টাব্দে ছিয়াত্তর বছর বয়সে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। জিনঝি শহরে মিয়াঙ পর্বতে ওনার সমাধি আজও বর্তমান।
ওনার লেখা মাত্র একশো পঁচিশটা কবিতা উদ্ধার করা গেছে। এই কবিতাগুলো সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা হয় – সুরা পানের কবিতা, প্রাকৃতিক কবিতা আর বৈরাগ্যের কবিতা। ওনার লেখা বেশির ভাগ কবিতাই সিফু ঘরানার। ওনার লেখা বেশ কিছু প্রবন্ধও উদ্ধার করা গেছে। ‘টাও ইয়ুন মিং-এর কবিতা সমগ্র’ চীনা কবিতার প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ওনার লেখা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কবিদের মাধ্যমে। সরকারি চাকরী করার জন্য, তিনি বহুদিন পরিবারের থেকে দূরে থেকেছেন। চাকরীতে ইস্তফা দিয়ে ফেরার পথে এই কবিতাটি রচনা করেছিলেন।
ঘরে ফেরা
আমার নৌকাটা নদীর উপর নৃত্য করছে,
ঘূর্ণায়মান বাতাস, উড়িয়ে নিচ্ছে আমার পোশাক।
ঐ সূর্যটা আমায় পথ নির্দেশ দেয়।
সন্ধ্যে যত কাছে আসছে, আমিও উতলা হচ্ছি।
হঠাৎ আমার বাড়িটা যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে:
আমি আনন্দে ছুটতে থাকি।
দেখি,দরজার পাশে কে যেন অপেক্ষা করে।
টাও ইয়ুন মিং-কে বৈরাগ্যের কবি বলা হয়। নিম্ন লিখিত কবিতাটায়, ওনাকে বৈরাগ্যের কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেতে সাহায্য করে। কবিতাটির নাম ‘আমার গ্রামে ফেরা’।
ছেলেবেলায়, আমি বাকিদের মত ছিলাম না;
আমি পাহাড় পর্বতের প্রেমে পড়েছিলাম।
আমার দুর্ভাগ্য,
আমি হারিয়ে গেছিলাম সমতল ভূমির মাঝে,
দীর্ঘ তেরো বছর কেটে গেল এই ভাবে।
বন্দী পাখিটা, আজ ফিরে যেতে চায় পূরানো সেই গাছে।
পুকুরের মাছটা চায় সেই আদিম জলস্রোত।
আমি চাষ করি আমার ছোট্ট বাগানটায়।
সাধারণ মানুষের, সাধারণ জীবন।
আমি বাড়ি আমার মতই ছোট,
কয়েকটা ঘর মাথা গোজার মত।
পিছনে জমেছে বৃদ্ধ গাছের সারি,
দরজা ছুঁয়েছে নতুন গুল্ম ফুল।
দূরের গ্রামটা কূয়াশাছণ্ণ।
হালকা ধোঁয়াশায় আবছা বাড়িগুলো।
কোথা থেকে যেন একটা কুকুর ডেকে ওঠে,
একটা মোরগ অনেকক্ষণ ধরে কাকে যেন খুঁজছে।
শীতল বাতাস বয়ে যায়, আমার বন্ধ দরজার বাইরে।
ফাঁকা ঘরগুলো ভরে আছে অচেনা নিঃশব্দতায়।
বহুদিন বন্দী থেকে জীবনের খাঁচায়,
আজ আবার ফিরে আসছি আমার প্রিয় গ্রামে।
কিন্তু ওনার এই বৈরাগ্যের জন্ম কঠোর পরিশ্রম থেকেই। টাও-এর সারাটা জীবন কেটেছে ভীষণ দারিদ্রের মধ্যে। এমন সময়ও গেছে, যখন চাষ করার সময় বলদ না থাকায় উনি নিজে বলদের স্থানে হাল চালিয়েছেন। সঙ্গী ছিলেন ওনার স্ত্রী। এই দারিদ্রের উপর উনি বেশ কিছু কবিতাও রচনা করেছিলেন। এই নিদারুণ দারিদ্র টাও-এর বৈরাগ্য আর জীবন দর্শনের ভাবনার জন্মদাতা।
কবিতা ১
মানুষের জীবন শুধু পথ খুঁজে কেটে যায়,
তবে, খাদ্য আর বস্ত্র এই পথ খোঁজার প্রথম সিঁড়ি।
কি করে এই সামান্য জিনিষ অসামান্য হয়ে ওঠে
কিছু মানুষের কাছে? কি করে? ...
একজন চাষি সারাদিন চাষ করে;
নিদারুণ কঠোর পরিশ্রম।
এই আশায়, যে এই ভাবেই কেটে যাবে জীবন;
তাই আমার নিজে হাতে হাল চালাতেও আপত্তি নেই।
কবিতা ২
দারিদ্রের মাঝে থাকতে থাকতে আমি একা হয়ে গেছি,
কখনও কখনও আমি ভুলে যাই শীতের পর কোন ঋতু।
আমার বাগানে ছড়িয়ে আছে কত ঝরে যাওয়া পাতা।
তাই দেখে বুঝি, হেমন্ত আসন্ন।
নতুন ফুল জন্ম নিয়েছে জানালার পাশে,
আমার বাগানেও নতুন কুঁড়ির ভিড়।
আগামি বছর আসবে কিনা আমি জানি না,
তাই এই দেখেই আমি ভীষণ খুশি।
আমার পরিবারের সাথে আমি বেরিয়ে যাই
আজ সামনের পাহাড়টায় একটু ঘুরে আসব।
ওনার সমসাময়িক কবিরা দারিদ্র নিয়ে অনেক কবিতা রচনা করেছিলেন, কিন্তু টাও সেই দারিদ্রে ভরা জীবন কাটিয়েছেন। কঠোর পরিশ্রম থাকলেও, টাও-এর মতে এই চাষবাসে জীবনই ওনাকে বৈরাগ্যের অনেক কাছে এনে দিয়েছিল। এই চাষবাসই তার পরিচয়, তার জীবন।
জীবনের প্রথম দিকে, অনেক চেষ্টা করার পরেও টাও ইয়ুন মিং কে প্রচণ্ড দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন কাটাতে হয়। কোন কিছু করেই তার অবস্থার পরিবর্তন হয় না। হয়তো এই কারনেই উনি সুরাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। উনি নিজের চাষ করা ফসল থেকে সুরা প্রস্তুত করতেন। ওনার জীবনী ‘ফাইভ উইলো’ তে লেখা আছে,
“উনি সুরা পান করতে ভীষণ ভালবাসতেন, কিন্তু ওনার পরিবারের দারিদ্র্যের কারনে সেটা সম্ভব হয়ে উঠত না। তাই, ওনার বন্ধুরা মাঝে মধ্যেই ওনাকে সুরা পানের নিমন্ত্রণ পাঠাতেন।”
এই সুরা পান নিয়ে ওনার বহু কবিতা আছে। সেগুলোকে ‘সুরা পানের কবিতা’ নামক গ্রন্থে সংকলিত করা হয়েছে। এই সব কবিতায় তিনি বর্ণনা করেছেন ওনার অনুভূতির, কিছু কবিতায় লিখেছেন পান করার সঙ্গীর কথাও। কোন কোন বিশেষজ্ঞ বলেছেন এই সুরা পান নাকি টাও-এর বৈরাগ্যের সাঙ্গরূপক। টাও-এর মতে তৎকালীন দুর্নীতিগ্রস্থ নেতাদের তোষামোদ করার থেকে এই দারিদ্রতাকে সুরা বলে পান করে নেওয়া বেশি ভালো। সেই সুরা পান বিষয়ে একটা কবিতা দিলাম।
হাজার বছর ধরে পথ হারিয়েছে ওরা;
সবাই সবার অনুভূতি নিয়ে ব্যস্ত।
যদিও সুরা আছে অঢেল,
তবুও সেই সুরা পান করা যায় না।
ওনার বয়সের সাথে ওনার লেখার বয়সও বেড়েছে। কবিতার ভাষাও হয়েছে অনেক পরিণত। ওনার শেষ বয়সের কবিতাই ওনার সেরা কবিতা, এটাই বলেছেন বিভিন্ন চীনা সমালোচক। ওনার মৃত্যুর কিছুকাল আগের লেখা এই কবিতাই তার উদাহরণ।
দলছুট পাখিটা ভীষণ অপ্রস্তুত;
সারাটা বিকেল সে একা একা উড়ে বেড়িয়েছে।
একটু বিশ্রাম নেওয়ার স্থান খুঁজেছে...
শেষটায় একটা বুড়ো পাইন গাছে আশ্রয় নিয়েছে সে,
এখন তার ডানা ক্লান্ত,
নিজের ঘরে হয়তো আর কোনদিন ফেরা হবে না তার।
টাও ইয়ুন মিং কোনদিন মেনে নিতে পারেননি কনফুসিয়ানইজম। টাওইজমের কর্মা আর অমরত্বের মতবাদেও ওনার বিশ্বাস ছিল না। ওনার বহু কবিতায় উজ্জ্বল একটি চিরন্তন প্রশ্ন, প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েও কি করে জীবনের পরিকল্পনা করা যায়? ওনার জীবন দর্শন ছিল অন্য রকম। ওনার মতে পরিবার, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, একাকীত্ব আর নিজস্বতা দিয়ে খুঁজে বের করতে হয় জীবনের মানে। চীন দেশের কবিতার মতবাদও মোটামুটি তাই। ওনার বিভিন্ন কবিতায়, ‘আমার ঘর’ কথাটা মহাবিশ্বের রূপক মাত্র।
আমি মানুষের মাঝে আমার ঘর বানিয়েছি,
তবু আমার সাথে কেউ কথা বলেনি।
ভাবছ, সে কি করে হয়?
যখন হৃদয়ই একা, তখন অন্য কে আর সঙ্গ দেবে।
ঘন বনের উপর দিয়ে,
দেখি দূরের সেই পর্বতমালা।
সূর্যাস্তের রঙটা মলিন,
পাখিদের বাসায় ফেরার তাড়া।
এই অসামান্য দৃশ্য দেখে
আমি, কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলি।
সং যুগের বিখ্যাত কবি সু ছি, টাও ইয়ুন মিং-এর সম্বন্ধে বলেছেন, “আমি ওনার লেখার খুব ভক্ত। শুধু কবি হিসাবে নয় মানুষ হিসাবেও উনি ছিলেন উচ্চমানের। ওনার লেখা সহজ কিন্তু গভীর, বাস্তব কিন্তু মিষ্টি। আমার মতে সেই সময়ের অন্য কোন কবির কবিতা টাও ইয়ুন মিং-এর কবিতার ধারে কাছেও আসে না।”
টাও ইয়ুন মিং-এর লেখা একটি বিখ্যাত কবিতা দিয়ে আজকের লেখাটা শেষ করছি। আশা করি আপনাদের খারাপ লাগে নি। কেমন লাগলো জানাবেন।
দিন আর মাস একটুও অপেক্ষা করে না;
চারখানা ঋতু একে অপরের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলে।
ঠাণ্ডা হাওয়ায় দুলছে শুকনো গাছের ডাল;
ঝরা পাতায় ছেয়ে গেছে রাস্তাটা।
আমার নীতিবোধ ক্ষয়ে যায় সময়ের সাথে।
মাথার চুল আর কালো নেই:
শুভ্র আভা ছড়িয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
সামনের পথ আস্তে আস্তে সরু হয়ে যায়।
আমার ঘরে পথিকরা বিশ্রাম নেয়,
আমিও যেন একজন পথিক, বিশ্রামের পর
চলে যাব বহু দূর।
সুদূরের এই বরফ ঢাকা পাহাড়ে আমার নিজের ঘর।