ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। ঘুমটা ভাঙল যান্ত্রিক মহিলা কণ্ঠের সতর্কবাণীতে। আমি দালিয়ান বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছি সেয়াঙগামী ফ্লাইটের। সেই ভোরবেলায় উঠেছি তাই ঘুম পেয়ে গেছিল। ঘুম ভাঙল একটা দুঃসংবাদে। সেয়াঙগামী ফ্লাইট খারাপ আবহাওয়ার জন্য তিন ঘণ্টা লেট। আমার আশেপাশে যে সব চীনা লোক বসেছিল, তারা বার্তাটা শোনা মাত্রই নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে এদিক ওদিক ছড়িয়ে গেল। পড়ে থাকলাম আমি একা। কি আর করি বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিলাম আমার দুরবস্তার কথা।
এই তিন ঘণ্টা কি করে কাটাবো ভাবছি, হঠাৎ মনে পড়ে গেল আরে ওয়ান সুণ থাং যে একটা বই দিয়েছিল পড়ার জন্য। তাড়াতাড়ি কেবিন ব্যাগটা খুলে বইটা বের করলাম। বেশ পুরানো বই। নাম 'সু ছি-র কবিতা সমগ্র'। আশেপাশে কেউ নেই, তাই সামনের সিটটার উপর পা তুলে একটু আরাম করে বসে শুরু করলাম পড়া। মুগ্ধ হয়ে গেলাম। পড়া শেষ হতে দেখলাম এক নিমেষে দেড় ঘণ্টা কেটে গেছে।
শুধু কবিতা পড়ে মন ভরল না। এই অসামান্য কবিতাগুলো যিনি লিখেছেন তাঁর সম্পর্কে কিছু না জানলে কিরকম যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। এখনও আরও দেড় ঘণ্টা দেরী ফ্লাইটের। চট করে উঠে পড়লাম। সামনের কফি সপটায় গিয়ে একটা ক্যাপেচিনোর অর্ডার দিয়ে ল্যাপটপটা অন করলাম। বিমানবন্দরের ওয়াই-ফাই কানেক্ট করে স্কাইপিতে ফোন লাগালাম ওয়ান সুণ থাং-কে। বার দুই বাজার পর ওপাশ থেকে ওয়ান সুণ থাং-এর গলা শোনা গেল। কোন রকম ভনিতা না করে সোজা টপিকে চলে গেলাম। ওয়ান সুণ থাংও দেখলাম সু ছি-র নাম শুনে কোন অপ্রাসঙ্গিক কথা না বলে সরাসরি বলতে শুরু করল, চীন দেশের বিখ্যাত কবি ও চিত্রকর সু ছি-র গল্প।
সু ছি সং যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ও চিত্রকর ছিলেন। ১০৩৭ সালের ৮ই জানুয়ারী ওমেই পর্বতের পার্শ্ববর্তী শহর মেইসানে (আজকের সিচুয়ান) তিনি জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। ওনার পিতা, সু জুন, আর ওনার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দুজনেই সাহিত্য জগতের সাথে জড়িত ছিল। এই পরিবারে জন্মের ফলে ছেলেবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি বিশেষ ঝোঁক ছিল সু ছি-র। ছবি আঁকতেও তিনি ভীষণ ভালো বাসতেন। এই সাহিত্য চর্চা আর ছবি আঁকার মধ্যে দিয়ে কেটেছিল তাঁর শৈশব। তারপর, দীর্ঘ কুড়ি বছর তিনি তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন পদে চাকুরীরত ছিলেন। ১০৬৯ সালে ওয়ান আনশী বিভিন্ন আইন পূর্ণগঠন করা শুরু করলে, সু ছি এই পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। সেই সময় তিনি সিমা গুয়াঙ-এর বিপ্লবী দলের সাথেও যুক্ত ছিলেন কিছুদিন। সু ছি-র লেখা রাজনৈতিক কবিতা ওয়াং আনশী ও তাঁর দলবলের কুনজরে পড়ে যায়। যার ফলে, ১০৭৯ সালে ওনাকে গ্রেপ্তার করে ওয়াং আনশী। সেই বছরই ‘টেরেস ক্রো পোয়েট্রি ট্রায়াল’-এ দোষী সব্যস্ত হওয়ায় আজীবনের জন্য নির্বাসিত করা হয় সু ছি-কে।একবার, ওয়াং আনশীর লবণ একাধিকার আইন পুনর্গঠনের ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে লবণ পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠেছিল। সেই বিষয়ে এই কবিতাটি রচনা করেছিলেন সু ছি। কোন নাম দেননি কবিতার।
বৃদ্ধ লোকটি কুঁজো হয়ে গেছে,
শরতের পাহাড়ি ফল বেশ মিষ্টি,
বয়স যে তার স্বাদ চেনার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে,
তা নয়,
গত তিন মাস সে লবণ খেতে পায় নি।
১১০০ সালে তৎকালীন সম্রাটের হস্তক্ষেপে আদালত সু ছি-র শাস্তি ক্ষমা করে আর সেই সঙ্গে ওনাকে আবার চাকরিতে নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু চাকরীতে যোগ দিতে যাওয়ার পথে ১১০১ সালের ২৪সে আগস্ট ওনার মৃত্যু হয় ছাঙজৌতে। ওনার বয়স হয়েছিল চৌষট্টি। ওনার মৃত্যুর পর ওনার জনপ্রিয়তা যেন হঠাৎ করে দ্বিগুণ হয়ে যায়। ওনার লেখা কবিতা, ভ্রমণ কাহিনি ও ওনার আঁকা ছবি দশ গুন দামে বিক্রি হতে থাকে। ওনার মূর্তিও স্থাপন করা হয়। সেই মূর্তি এখনও বর্তমান হুইজৌ শহরে। বলা হয়, এই হুইজৌ শহরে বসে নাকি তিনি তাঁর সেরা কবিতাগুলির একটি লিখেছিলেন। যদিও এই ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে বেশ সন্দেহ আছে। তবুও সেই কবিতাটি এখানে দিলাম।
হঠৎ লেখা
পর্বতের পূর্ব দিকে এক বসে আছে বৃদ্ধ,
আমার বরফ ভেজা চুল, উড়িয়ে দেয় বাতাস।
আমার ছেলে চিনতে পারেনি আমায়,
আমি হাঁসি: আমার চোখ সুরার বশে রক্তিম।
সু ছি তাঁর জীবৎকালে ২৭০০ টি কবিতা রচনা করেছিলেন, সঙ্গে ছিল ৮০০ খানা চিঠি। উনি সাধারণত ছি, সি আর ফু ঘরানার কবিতা লিখতেন। প্রবন্ধ লেখক ও চিত্রকর হিসাবেও বিশেষ জনপ্রিয় ছিলেন। ওনার বিখ্যাত কিছু কবিতার মধ্যে নিম্ন লিখিত কবিতাটি একটি।
তুলনা
কিসের সাথে তুলনীয় মানুষের জীবন?
বরফের মাঝে ছুটে যাওয়া
এক ঝাঁক হরিণের সাথে।
নিজের নিশান ছেড়ে যায় ফেলে আসা পথে।
সু ছি-র কবিতা চীন দেশে ভীষণ রকম জনপ্রিয় সেই আদি কাল থেকে। শুধু চীনেই নয়, জাপান ও পার্শ্ববর্তি দেশেও ছড়িয়ে আছে এই জনপ্রিয়তার রেষ। সু ছি-র কবিতাগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন আর্থার ওয়ালি। আর এই অনুবাদের জন্যই ইউরোপেও বেশ কদর আছে সু ছি-র কবিতার। ওনার বেশির ভাগ কবিতাই ছি ঘরানার ছিল যদিও ওনার ৩৫০ টা বিখ্যাত কবিতাই হল সি ঘরানার। ওনার লেখা বা চিত্রতে সবসময় সাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য আর তার জীবন্ত বর্ণনা মিশে থাকত ওতপ্রোত ভাবে। উদাহরণ স্বরূপ দুটো কবিতা দিলাম।
বর্ষা ঘন বিকেল (১)
কালো বদল যেন কালি মাখিয়েছে পর্বতে,
ভাসমান নৌকটায় বৃষ্টি ফোটার গান,
শীতল বাতাস যেন ছুটে যায় চারিদিক,
নীচের হ্রদে আমি আমি আকাশে প্রতিচ্ছবি দেখি।
বর্ষা ঘন বিকেল (২)
রেশম পোকা বুড়ো হয়,
গমও আধা হলুদ,
পাহাড়কে স্নান করায় ঘন বর্ষা।
বৃদ্ধ চাষিটা বিশ্রাম নিচ্ছে,
মেয়েটিও আর কুড়চ্ছে না ঝরা ফল,
শুধু অন্তর্যামী দেখছে, তার খেলনা পৃথিবী।
সু ছি-র লেখায় সবসময় একটা বুদ্ধিদীপ্ত রঙ্গরস থাকত। সেই সময়ের চীনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটা আজকের আমাদের দেশের মতই ছিল। ওনার কনিষ্ঠ পুত্রের জন্মের পর সু ছি-র অনুভূতি কেমন জিজ্ঞেস করায় উনি এই কবিতাটি রচনা করেছিলেন। এখান থেকে আমরা ওনার চরিত্রের এই হাস্যরস পূর্ণ দিকটা দেখতে পাই।
পৃথিবীতে নতুন শিশু এলে,
পরিবার বুদ্ধিমত্তা দেখাতে চায়।
আমি, যদিও শিক্ষিত,
তবুও নষ্ট করেছি সারাটা জীবন।
আমি চাই আমার শিশু
অশিক্ষিত হোক,
তবেই জীবনে কিছু করতে পারবে,
হয়তো, মন্ত্রীও হয়ে যেতে পারে।
জীবনের অধিক সময় সরকারি চাকরির সুত্রে ওনাকে বিভিন্ন স্থানে থাকতে হত। যার ফলে পরিবারের সাথে খুব কম সময় কাটাতে পারতেন সু ছি। ১০৭৮ সালে, হেমন্ত উৎসবের সময়, ওনার ভাই ওনার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল সুজহৌতে। এই সময় তিনি ভাইয়ের সাথে মিলনের আনন্দে নিম্ন লিখিত কবিতাটি রচনা করেছিলেন। এই কবিতায় কবির পরিবার থেকে দূরে থাকার দুঃখ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
হেমন্তের চাঁদ
সূর্যাস্তের মেঘেরা চলে গেছে দূরে, এখন বইছে শীতল বাতাস,
আকাশগঙ্গা শান্ত, আমি তাকিয়ে তারই দিকে, নিস্পলক।
এই রাতের স্নিগ্ধতা আর কতক্ষণই বা থাকবে?
জানি না, কাল কোথায় দেখব এই উজ্জ্বল চাঁদ।
নিজের লেখা সম্পর্কে সু ছি বলেছিলেন, “আমার লেখা কোটি কোটি শরতের মত। আমি যেখান থেকে ইচ্ছে সেগুলোকে মুক্ত করে দিতে পারি। মসৃণ ভূমিতে খুব সহজেই তারা এক মুহূর্তে পাড়ি দিতে পারে হাজার মাইল। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথেও সে একই রকম সচ্ছল। কোথায় তারা থামবে, সে আমিও জানি না। শুধু জানি, তারা এগিয়ে যাবে, যেখানে না থামলে নয়, সেখানেই থামবে। এর থেকে বেশি আমিও জানি না।”
শুধু কবিতা নয়, সু ছি-র লেখা আমরা বিস্তর ভাবে জানতে পারি সেই সময়কার লৌহ শিল্প সম্পর্কে। তাছাড়া, ভ্রমণ কাহিনী লিখিয়ে হিসাবেও ওনার বিপুল নামডাক। সং যুগের এক বিশাল হস্তি ছিলেন এই সু ছি। সু ছি-র লেখা সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতাটির অনুবাদ দিয়ে আজকের লেখাটা শেষ করলাম। আশা করি চীন দেশের কবি সু ছি-র জীবন কাহিনী ও কবিতা আপনাদের খারাপ লাগলো না।
সাগরের সাথে মিলন
আমি সারা রাত মাতাল হয়ে ছিলাম পর্বতের নীচে,
ঘরে ফিরি ভোরের আলোয়,
নেশাতুর চোখ নিয়ে।
ঘরে কেউ দরজা খোলেনি,
তাই সারা রাত নদীর ধারে।
চূপ করে বসে নদীর কথা শুনি,
যদি এই দেহটা অন্য কারুর হত।
ভাবী, কবে ছাড়া পাব এই জেলখানা থেকে?
গভীর রাতে, বাতাস এখনও শীতল,
একটা নৌকা নিয়ে ভেসে যাই দূরে,
জীবনের শেষ ক’টা দিন কাটাব ভেসে ভেসে,
মিলিত হবে সাগরের সাথে, একান্তে।