চীন দেশের কবিদের নিয়ে যত পড়ছি, তত জানতে পারছি চীন দেশের কবিতার অদ্ভুত ইতিহাস। প্রায় পঞ্চাশ জন কবির লেখা পড়া হয়ে গেছে এর মধ্যে। অনুবাদও হয়েছে প্রায় পঞ্চাশ। কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, এখানে বেশির ভাগ কবিতাই চার কিংবা পাঁচ লাইনের। চীনে কবিতার বিভিন্ন রুপ সম্পর্কে বলতে হলে আগে বলতে হবে কোন সময়ে লেখা হয়েছে এই কবিতা। আজ তাই নিয়েই একটু বলি।
চীন দেশের কবিতা প্রধানত তিনটে যুগে ভাগ করা যায়, আদি যুগ যেখানে বিশেষত সোজা ভাষা ও মানের লোকগান; ক্লাসিক্যাল যুগ (সময়কাল হান যুগ থেকে কুইন যুগ) যখন বিভিন্ন ঘরানার কবিতা লেখা হয় আর মডার্ন যুগ (পশ্চিমী কায়দার মুক্ত কবিতা)।

আদিম যুগ:

সি লিং অথবা 'সংগীতের বই' হল এই যুগের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এখানে যেমন অভিজাত কবিতা আছে তেমন আছে সাধারণ গ্রাম্য কবিতাও। এই সব গ্রাম্য কবিতাগুলোর সাধারণত কোন লোকসংগীত থেকেই উৎপত্তি।
আর একটি কাব্যগ্রন্থ হল চু চি অথবা চু-এর গান। এটি আগেরটার থেকে অনেক উন্নততর। এখানের কবিতাগুলো আরও অনেক বেশি শ্রুতি মধুর আর অর্থবাহী। প্রধানত কু ইয়ান (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৪০-২৭৮) আর ওনার ছাত্র সং ইয়ু -র লেখাই আছে এই গ্রন্থে।

ক্লাসিক্যাল যুগ:

হান যুগে (খ্রিষ্টপূর্ব ২০৬-২২০ খ্রিষ্টাব্দ) এই চু ঘরানার কবিতা থেকে উৎপত্তি হয় ফু ঘরানার কবিতার। এই ফু কবিতায় প্রথম আর শেষ স্তবক গদ্য কবিতা আর বাকি স্তবকগুলো ছন্দের। এই কবিতা বেশির ভাগই প্রশ্ন উত্তর আকারে লেখা হত। এগুলকে অনেক সময় কাব্যিক গদ্য বলা হত।

হান সাম্রাজ্যের শেষ দিকে, সি লিং আকারে য়ুই ফু ঘরানার কবিতার জন্ম। ফু কবিতার সব বিশেষত্বই ছিল এই লেখায় আর তার সাথে ছিল সি লিং -এর আকারে সেই লোকসংগীত-এর কথা। এই ঘরানার বিখ্যাত কবি ছিলেন লি বাই।
দ্বিতীয় শতকে এই য়ুই ফু কবিতা পরিবর্তন হতে থাকে। জন্ম হয় ছি ঘরানার, যা মডার্ন যুগের আগে পর্যন্ত চীনা কবিতায় স্থায়ী ছিল।  এই ছি কবিতা পাঁচ অথবা সাত লাইনের হত আর দুটো স্তবকের। পাঁচ লাইনের কবিতায় শেষ তিন লাইন একটি স্তবক আর প্রথম দুই লাইন আর একটা। সাত লাইনের কবিতায় প্রথম পাঁচ লাইন একটা স্তবক আর শেষ তিন লাইন একটি। এই ছি কবিতাও আবার দু রকমের, গু ছি (মানে পুরানো) আর জিন্তি ছি (কঠিন ভাষার নিয়মানুসার কবিতা)। এই ঘরানার বিখ্যাত কবি হলেন দু ফু (জিন্তি ছি) আর লি বাই (গু ছি)।  
ট্যাং সাম্রাজ্যের শেষের দিকে আবার সি ঘরানার কবিতা বিশেষ বিখ্যাত হয়। সং সাম্রাজ্যের সময় এই ঘরানার লেখা শুধু আবেগ আর ভালোবাসায় সীমিত থাকে না। বিভিন্ন কবির বিভিন্ন বিষয়ে কবিতা লেখা শুরু করেন।
এই সি ঘরানার কবিতার জনপ্রিয়তা বাড়ার সাথে সান গু নামে মুক্ত স্তবকের এক ধরনের কবিতার উৎপত্তি ঘটে। এই সান গু ঘরানার কবিতা বিভিন্ন নাটকে গান হিসাবে ব্যবহৃত হত।
সং সাম্রাজ্যের পতনের পর, ছি ঘরানার কবিতা আবার জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই ধরনের কবিতা মডার্ন যুগ পর্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। যদিও বিভিন্ন কারনে ট্যাং যুগের কবিতাকেই স্বর্ণ যুগের কবিতা বলা হয়। প্রথমত, এই যুগের কবিদের কবিতা পড়ে ভবিষ্যতের কবিরা এতই উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন যে পুরানো কবিতা অনুসরণ করতে গিয়ে অনেকেই তা অনুকরণ করে বসে। দ্বিতীয়ত, ট্যাং যুগের পরের কবিদের কবিতা বাস্তব সম্মত হলেও অনেক ক্ষেত্রে তা শ্লীলতার গণ্ডি পেরিয়ে যেত। সেই সময় চীনে এই ধরনের কবিতার জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। তৃতীয়ত, ধীরে ধীরে চীন দেশের জনসংখ্যা বাড়ার সাথে কবির সংখ্যাও বাড়তে থাকে, সঙ্গে বাড়তে থাকে কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা, যার বেশির ভাগই নিম্ন মানের। আর সব থেকে জরুরি কারন হল, এই সময় নাটক,প্রবন্ধের আর উপন্যাসের জন্ম, যা কবিতার জনপ্রিয়তা বেশ অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছিল।

মডার্ন যুগ:

এই যুগে কোন বিশেষ ঘরানার কবিতা লেখা হয় নি, সবই মুক্ত কবিতা। কবিতার ভাষায় বিপ্লব আসে ৪ ঠা মে-এর বিপ্লবের পর। বিংশ শতাব্দীর কবিরা যেমন জু ঝিমো, গুও মোরুও ইত্যাদি পশ্চিমের কবিতার স্টাইলের কবিতা লেখা শুরু করেন।

নাহ, চীনে কবিতা নিয়ে বেশ খানিকটা বলে ফেললাম। আশা করি বোর হননি। নীচে আরও তিনটে কবিতার অনুবাদ দিলাম। কেমন লাগলো জানাবেন।

সপ্তম কবিতা:
                                 তোমার গান
                                      সু ছি

দশটা বছর! আমরা দুজন কত দূরেই না আছি।
আমি মনে করতে চাই না,
কিন্তু তোমায় ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।
কবরটাও হাজার মাইল দূরে,
কত কথা আছে বলার মত।
যদি কোনদিন দেখাও হয় তোমার সাথে,
তুমি আমায় চিনতে পারবে না।
আমার মুখ ভর্তি ধুলো,
আর বরফে জমে যাওয়া চুল।

গত রাতের স্বপ্নে, আমি তোমার কাছে ছিলাম।
জানলার পাশে, সেই ছোট্ট ঘরটায়
তুমি চুপ করে বসে আছ আয়নার সম্মুখে।
আমার দিকে ফিরে তাকালে শুধু,
দেখলাম, তোমার নয়নে অশ্রুধারা।
আর কত কাল এই ভগ্ন হৃদয়ে বাঁচবো?
চাঁদের আলোয় উজ্জ্বল সেই কবর,
উজ্জ্বল, সেই পাইন গাছের সারি।



উপরি উক্ত কবিতাটি ১০৭৫ সালে নিজের মৃত স্ত্রীর স্মরণে লিখেছিলেন কবি সু ছি। ১০৫৪ সালে তিনি ওয়াঙ ফু-র সহিত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহের এগারো বৎসর পর, ১০৬৫ সালে ওয়াঙ ফু-র মৃত্যু হয়। সু ছি তাঁর  স্ত্রীর মৃতদেহ সিচুয়ানে নিয়ে গিয়ে কবর দিলেন। সমাধিরে চারি ধারে, তিনি পাইন গাছ পুঁতে দেন। এই কবিতাটিতে তিনি তাঁর মৃত স্ত্রীর প্রতি তাঁর ভালোবাসা জ্ঞাপন করেছেন।




অষ্টম কবিতা:

                             বুনো হাঁসের সমাধি
                              ইউইয়ান হাউএন

কত লোককেই না জিজ্ঞেস করেছি, ভালবাসাটা কি?
দুটো প্রাণকে যা এক করে দেয় জীবন আর মৃত্যুতে?
ঐ যে পাখি দুটো উড়ে যাচ্ছে,
তাদের বৃদ্ধ ডানা একসাথে দেখেছে কত শীত, কত গ্রীষ্ম,
ভীষণ আনন্দে।
তবুও ভালোবাসা ধরা পড়ে গেল ফাঁদে
কিছু ভেবেছিল হয়তো।
কার জন্য যেন চেয়ে থাকি আকাশের ঐ ছায়াটার দিকে
হাজার মাইল জোড়া কালো মেঘ
আর পাহাড়ের সাদা বরফ কুচো?
ফেন নদীটির ধারে জনমানব নেই আজ,
তারা সব ফিরে গেছে। শুধু পড়ে আছে পোড়া কাঠ আর ধোঁয়া।
পাহাড়ি আত্মাটাও চুপ।
তার কান্নাও যেন নিঃশব্দে।
ওই পাখি দুটো আর ফিরবে না আকাশে কোনদিন,
এই ভাবেই পড়ে থাকবে বছরের পর বছর,
শীতের পর শীত। অপেক্ষায় থাকবে
সেই সব কবিদের, যারা ছুটে আসবে
শুধু, এই পাখির সমাধি দেখার লোভে।



ইউইয়ান হাউএন (১১৯০-১২৫৭) ‘জুরছেন জিন’ সাম্রাজ্যের সব থেকে নামী কবি ছিলেন। উত্তর চীনের জিনঝউ-এ ওনার জন্ম। একবার তিনি বিংঝউ যাচ্ছিলেন পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিলেন। পথে একজন পক্ষী শিকারি ওনাকে একটি গল্প বলেন। সেই শিকারি একবার এক জোড়া হাঁসের একটিকে বন্দী করে মেরে ফেলেন। সেই হাঁসটার সাথিটি নাকি তাকে খুঁজে খুঁজে জলে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। এই মর্মভেদী গল্পটি কবিকে বিশেষ ভাবে নাড়া দেয়। উনি সেই দুটো হাঁসে সমাধি বানান ফেন নদীর ধারে আর সেটার নাম দেন "বুনো হাঁসের সমাধি"। তারপর তিনি এই কবিতাটি রচনা করে সেই হাঁস দুটোর অসামান্য ভালোবাসাকে উৎসর্গ করেন।


নবম কবিতা:


                            অবিনশ্বর দোয়েলের সেতু
                                    কুইন গুয়ান

মেঘেরা ভিড় করেছে রাতের আকাশে,
তারাগুলো যেন আজ নিষ্প্রাণ।
আকাশগঙ্গা পেরিয়ে রাখাল ছেলেটা আজ
দেখা পাবে তার প্রিয়ার।
পৃথিবীতে যা কিছু আছে নশ্বর,
সবটাই বিলীন হয়ে যাবে তাদের মিলনে।
ভালোবাসা বয়ে যাবে নদীর মত
কাল থেকে শুধু স্বপ্নেই দেখা পাবে তারা।
কিভাবে তাদের ভালোবাসা টিকে গেল সহস্র শতাব্দী ধরে?
কিভাবে শুধু একটি দিনের আশায় বেঁচে থেকে বছরের পর বছর?

কবিতাটি সং সাম্রাজ্যের বিখ্যাত কবি কুইন গুয়ানের (১০৪৯-১১০০) লেখা। উনি সুমেনের সেরা চারজন পণ্ডিতের একজন ছিলেন। উনার লেখা সুক্ষ্ম ও  সংক্ষিপ্ত ছিল। উনি বিশেষত প্রেমের কবিতাই লিখেছেন। চীনা উপকথার একটি গল্পকে নিয়ে লেখা এই কবিতাটি। নিউল্যাং নামক এক রাখাল ভালোবেসে ফেলেছিল ঝিনু নামক এক জোলানিকে। কিন্তু স্বর্গের রানি অভিশাপ দিয়ে তাদের আকাশগঙ্গার দুই পাশে পাঠীয়ে দিয়েছিলেন। তারা শুধু বছরে একটি বার দেখা করতে পারবে যখন দোয়েল পাখিরা নিজেদের শরীর দিয়ে একটি সেতু বানিয়ে দেবে। চীন দেশের এই অমর প্রেম কাহিনীকে কবি তুলে এনেছেন তার কবিতায়।