আমার চীনা বন্ধু ওয়ান সুং থানের পাল্লায় পড়ে চীনা কবিতা সম্বন্ধে বেশ অনেক কিছুই পড়ে নিয়েছি। আপনাদের কাছে জানলাম যে এই দেশের কবিতা নিয়ে আপনাদেরও বেশ ইন্টারেস্ট আছে। তা ছাড়া, চীন দেশের কবিতার বাংলায় অনুবাদ আছে বলে জানা নেই। আমার অনুবাদগুলো যে খুব একটা খারাপ হচ্ছে না, সেটা আমি আপনাদের মন্তব্য থেকে বুঝেছি। আপনাদের অনেকেই বলেছেন চীন দেশের কবিতা নিয়ে বই-এর কথা। এই ব্যাপারে আমার খুব একটা সাহস না হলেও আমার পরিবারের ভীষণ ইচ্ছে এই বই ছাপানোর। তাই অনেকটা তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী শুরু করলাম ১০০ টি চীনা কবিতা অনুবাদের কাজ। দিন দুয়েক আগে দুটো অনুবাদ কবিতা পোস্ট করেছিলাম। আজ করলাম আরও তিন। আজ আবার কবিতার সাথে সেই কবিতা লেখার ইতিহাসটাও জুড়ে দিলাম।
আর একটা ব্যাপারে আপনাদের একটু সাহায্যের প্রয়োজন। যদি বইটা সম্ভব হয়, তাহলে সেটাতে কি দিলে বেশি ভালো হবে? শুধু কবিতার অনুবাদ না অনুবাদের সাথে আজকের লেখাটার মত ইতিহাস বা ছোট্ট করে কবি পরিচিতি। আশা করছি আপনারা নিজেদের মতামতটা জানাবেন। আর হ্যাঁ, আমার লেখা পড়ার জন্য আর আমার পাশে থাকার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।
প্রথম কবিতা :
লূ ফেন জেন
সেই সিল্কের পোশাক এখন নিশ্চুপ।
রঙিন গালিচাটায় ধুলো জমে যায়।
ফাঁকা ঘরটা শুধুই শীতল বাতাসের যাতায়াত।
ঝরে পড়া পাতাগুলো, দরজার কোনে স্তূপাক্রিত।
সবাই অপেক্ষায় আছে তোমার।
কি করে আমি এই ব্যথিত হৃদয়কে বোঝাই?
উপরি উক্ত কবিতাটি হান সাম্রাজ্যের ষষ্ঠসম্রাট, উয় তি (১৫৭-৮৮ খ্রিষ্ট পূর্ব) তাঁর প্রিয় উপরানি, লূ ফেন জেনের মৃত্যুর পর রচনা করেছিলেন।উয় তি ওনাকে এতই ভালোবাসতেন যে লূ ফেন জেনের চলে যাওয়ার শোক বরদাস্ত করতে পারেন নি। সারা চীনে লোক পাঠালেন কোন ওঝাকে খুঁজে আনতে যে লূ ফেন জেনের আত্মার সাথে ওনার যোগাযোগ করাতে পারে। কথিত আছে, বহু চেষ্টার পর এক ওঝা নাকি পর্দায় লূ ফেন জেনের ছায়াটা উয় তি-কে দেখাতে পেরেছিলেন। তাই দেখে সম্রাট কেঁদে বলেছিলেন,
এটা কি সত্যি, না ভ্রম?
আমি একদৃষ্টে চেয়ে থাকি।
হাল্কা বাতাসে পোশাক উড়ছে তোমার,
শুধু ছায়া,
শুধু ছায়া হয়ে আছো।
দ্বিতীয় কবিতা :
নিম্ন লিখিত কবিতাটি ছো ওয়েন-চুন এর লেখা। ছো ওয়েন-চুন এক ধনী পরিবারের কন্যা ছিলেন। ওনার পিতার আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সসু-মা শিয়াঙ-জু নামক এক যুবক কবির গান শুনে তিনি তাকে ভালোবেসে ফেলেন। বিবাহে পরিবারের মত না থাকায় তিনি সসু-মা শিয়াঙ-জু-র সাথে পালিয়ে যান। এই ঘটনার বেশ কিছু বছর পরে সসু-মা শিয়াঙ-জু কবি হিসাবে খুব বিখ্যাত হয়ে যান। অর্থের লোভে সসু-মা শিয়াঙ-জু তার নিজের লেখা কবিতা অন্যকে বিক্রি করতে থাকেন। একটি উপপত্নী পাওয়ার আশায় বিভিন্ন নারীকে নানা রকম উপহার দিতে শুরু করেন। ভালোবাসার মানুষের এ হেন আচরণে ছো ওয়েন-চুন ভীষণ ব্যথিত হয়ে এই কবিতাটি রচনা করেন।
পর্বত চুড়ার গান
আমার প্রেম পবিত্র,
যেমন পর্বত শিখরের বরফ;
চাঁদের মত শুভ্র
মেঘেদের মাঝে –
তারা আমায় বলছে
তোমার ভাবনা দ্বিগুণ:
সেটাকেই ভাগ করতে
এসেছি আমি।
আজ আমরা হাতে হাত রেখে
সূরা পান করব।
কালকে আবার দূরে চলে যাবে
নদীর ধার ঘেঁসে:
তুমি চলে যাবে
নদীর ধার দিয়ে,
যেখানে নদী দু ভাগ
হয়ে গেছে।
আমি এখানেই বসে
দুঃখ করে যাবো।
যেমন বিবাহ কালে
কাঁদে কোন নারী,
মনের মত পুরুষ
না পেলে।
চেয়েছিলাম, তুমি আমায় ভালোবাসবে,
ততদিন,
যখন আমার চুলগুলো সাদা ধবধবে।
তৃতীয় কবিতা :
চীরেকের কথা
আলতুন (৪৮৬-৫৬৬ খ্রিষ্টাব্দ) একজন রাশিয়ান যোদ্ধা ছিলেন যিনি রাজা কাও হূয়াণ-এর সৈনিকদের ‘হান’ কায়দায় যুদ্ধ শেখাতেন। আলতুন চীনা ভাষা লিখতে বা পড়তে জানতেন না। ‘ইও ফু কুয়াঙ তি’ নামক গ্রন্থতে এই গল্পটি পাওয়া যায়: কাও হূয়াণ, ছাও রাজ্যের রাজা পি-কে আক্রমণ করেন। কিন্তু অল্প সময়ের যুদ্ধেই তিনি প্রায় অর্ধেক সৈন্য হারিয়ে ফেলেন। এই দুঃখে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে, পি রাজা তাকে একটি চিঠি পাঠান। চিঠিতে লেখা ছিল,
কাও হূয়াণ, যে ইঁদুরের মত পলায়ন করে।
কি সাহসে রাজা পি কে আক্রমণ কর?
তরবারির একটা কোপ পড়তেই
আবার গর্তে ঢূকে গেল কাও হূয়াণ।
এই চিঠি দেখে কাও হূয়াণ-এর সেনাপতিরা ভীষণ লজ্জিত হলেণ, কাও হূয়াণ আলতুনকে কিছু শোনাতে বলেন তার দেশ সম্পর্কে। তখন আলতুন এই কবিতাটি বলেন।
চীরেক নদী,
আঁধার ঘন পর্বতের পাদদেশে,
আকাশ সেখানে তাঁবুর ছাদ,
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে গেছে।
আকাশ কালো, ভীষণ কালো,
পথটাও বিপদ সংকুল,
ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে ভীষণ বেগে।
তবুও,
ভেড়াগুলো এগিয়ে যাচ্ছে,
ওদের ক্লান্তি নেই,
ওদের ভয় নেই।