সাম্প্রতিক দশকে, চীন দেশে কবিতা অনেকবার মৃত্যু বরন করেছে আর এখনো মৃতপ্রায় বলেই বিবেচনা করা হয়। বিস্ময়কর ব্যপার হল, যখনই কোন রাজনৈতিক দুর্যোগ উপস্থিত হয়েছে, তখনই এই দেশে কবিতা বারবার পুনর জীবন লাভ করেছে। এই কথা সত্যি ১৯১৯ এবং ১৯৭৯ দুই ক্ষেত্রেই। আর এই উভয় ক্ষেত্রেই প্রভাব ছিল একটি ভারতীয় কবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। চীন সাহিত্যে তার প্রাভাব আজ এত বছর পরেও লক্ষ্যনীয়।
চীন দেশের ক্লাসিক্যাল কবিতা সেই সময়কার সনাতন চীনা সমাজের সঙ্গে তুলনীয়, সেই সমাজের নিয়ম আর বাধ্যবাধকতার সঙ্গে। কবিতায় কোন মুক্ত চরণ ছিল না, যেমন মানুষেরও কোন পৃথক স্বাধীনতা ছিল না ১৯১১-এর বিপ্লব-এর আগে। কবিতায় তখন ছিল পূর্বপুরুষ আর সম্রাট-এর আইন মানার কথা। এই ধারাটা ভাঙতে শুরু করে বিপ্লব শুরুর সাথে সাথে। বিপ্লবের পরে যখন চীনা সমাজ আস্তে আস্তে বদলাতে লাগলো, তখন দরকার পড়ল সাহিত্যকে নতুন দিশা দেওয়ার। সেই সময়ের চীনা কবিতায় ইউরোপীয় কবিদের ভীষণ প্রভাব দেখা যায়। সঙ্গে দেখা যায় জাপানী ও ভারতীয় কবিদের প্রভাবও। ভারতীয় কবিদের মধ্যে প্রধানত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখার প্রভাব বিস্তর সেই সময়ের চীনা কবিতায়।
১৯৪৯ সালের আগেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় সব লেখাই চীনা ভাষায় অনুবাদ হয়ে গিয়েছিল। বিখ্যাত চীনা কবি বাই দাও-এর লেখায় রবি ঠাকুরের ছাপ প্রবল। ২০০৭ সালে তিনি একজন সাংবাদিককে বলেছিলেন যে তার লেখা অধিকাংশই বাংলা থেকে অনুবাদ করা। চীন দেশে রবীন্দ্রনাথের এই জনপ্রিয়তার বেশ কিছু কারন ছিল। প্রধান কারন ছিল তাঁর কবিতার অনুবাদক। রবি ঠাকুরের কবিতা যারা চীনা ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন, তারা নিজারাই ছিলেন সেই সময়ের চীন দেশের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। তাঁরা শুধু রবীন্দ্রনাথের লেখাই অনুবাদ করেননি, তাঁরা চেয়েছিলেন চীনা সাহিত্যকে সেই একই ধারায় ফেলতে। অনুবাদ সাহিত্যে এটিকে ভাষা পরিবর্তন বলে। সেই সময়ের বহু চীনা কবি ছিলেন যাকে আমরা শুধুই অনুবাদিত রবীন্দ্রনাথ বলতে পারি। আজ প্রধানত যার কথা বলব, তাঁকেও সেই দলে ফেলা যায়।
রবীন্দ্রনাথের চীনা অনুবাদকদের মধ্যে প্রধান ছিলেন একজন মহিলা কবি, বিং জিন। ৯ সেপ্টেম্বর ১৯১৯ থেকে বিং জিন নিজেকে রবীন্দ্রনাথের লেখার অনুরূপতায় তৈরি করেন। যদিও ১৯১৯ থেকেই রবীন্দ্রনাথের প্রভাব তাঁর উপর ছিল, তবুও রবীন্দ্রনাথের লেখা তিনি প্রথম অনুবাদ করেন ১৯৩৬ সালে, তাঁর প্রথম ভারত ভ্রমণের পর। তিনি ঠিক কবে প্রথম রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ পড়েন তা নিয়ে দ্বিমত আছে। তিনি হয়ত ১৯১৯ এ প্রথম পড়েন। আবার এও হতে পারে যে তিনি তাঁর গুরু ঝেঙ ঝেনদুও-র রবিন্দ্র অনুবাদ অনেক আগেই পড়ে ফেলেছিলেন। ১৯৪৯ এর আগেই, রবীন্দ্রনাথের লেখা বহু গুনি অনুবাদকের মাধ্যমে চীন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল।
বিং জিন যদিও তাঁর জীবৎকালে দুটোই মাত্র কব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন ১৯২৯ সালে, তবুও চীনা সাহিত্যে তাঁর প্রভাব অনেক বেশি। তাঁর লেখা শুরুর কথা তিনি লিখেছেন তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘Stars’ এর সম্পাদকীয়তে। ১৯২১ সালের ১ম সেপ্টেম্বর তিনি লিখেছেন, “১৯১৯ সালের শীতে আমি আর আমার ভাই বিং জং চুল্লীর পাশে বসে রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ ‘Stray Birds’ পড়ছিলাম। আমার ভাই আমাকে বলেছিল, ‘তুমিও তো মনের কথাগুলো এই ভাবে লিখতে পারো।’ সেই থেকে আমার লেখা শুরু।”
১৯৩৩ সালে, বিং জিন ওনার গ্রন্থ Collected Poems-এর সম্পাদকীয়তে বলেন,
“আমি কবিতা ঠিক বুঝি না; কবিতা আমাকে ভীত করে আর আমি লেখার চেষ্টাও করি না। আমার মনে হয় কবিতার ভাব থাকে কবিতার ভীতরে, তাঁর লেখার কায়দায় নয়...... আমি যখন ‘Stars’ লিখি, আমি তখনই বলে দিয়েছি যে আমি রবীন্দ্রনাথের ‘Stray Birds’ পড়ে তাঁর মত করে আমার ভাবনাগুলো লেখার চেষ্টা করেছি।” রবীন্দ্রনাথের ‘কণিকা’ কাব্যগ্রন্থের অনুবাদের নাম হল ‘Stray Birds’।
এখান থেকে দুটো জিনিষ পরিষ্কার হয়। বিং জিন রবীন্দ্রনাথের লেখা থেকে নিজেকে ব্যক্ত করার একটা পথ পেয়েছিলেন। একটা ধারা পেয়েছিলেন – ছোট করে, সহজ ভাষায় লেখার। ওনার কবিতার প্রথম লাইনে আমরা একটা সাধারন ঘটনা পাই, আর শেষে পাই সেই ঘটনার সাথে জড়িত একটা সুন্দর ছবি। তাছাড়া, রবি ঠাকুরের কবিতার মধ্যে দিয়ে, বিং জিন নিজের অস্তিত্ব খুজে পেয়েছিলেন। ১৯১৯ সালে, যখন সবে সাম্রাজ্যবাদের মৃত্যু হচ্ছে, তখন চীনা সাহিত্যে নতুন আলো প্রবেশ করে নি। বিং জিনের লেখায় তিনি তারা (Stars) –কে নতুনের সংকেত হিসাবে ব্যবহার করেন। তাঁর চোখে তারা ছিল মহাকাশে হারিয়ে যাওয়া একক সত্ত্বা। বিং জিনের ভাষায় ‘Stray Birds’ মানে হল রাস্তা হারিয়ে ফেলা পাখি।
বিং জিনের কবিতা খুবই সরল ভাষায় লেখা।, সাধারণ ঘটনাকে নিয়ে। চীনা সাহিত্যের সমালোচকদের মতে, বিং জিনের এই মানুষের সাথে মহাবিশ্বের যে ভালবাসা, প্রকৃতি প্রেম সবটাই রবি ঠাকুরের লেখা থেকে অনুপ্রাণিত। এই বিষয়ে আরও একজন চীনা কবি জু ঝিমোর কথা আগেই লিখেছি। বিং জিনের লেখা ‘Stars’ কাব্যগ্রন্থের ১২ নম্বর কবিতাটি উদাহরণ স্বরূপ দিলাম।
“শোন মানুষগণ,
চল একে অপরকে ভালবাসি।
আমরা সবাই যাত্রা পথের বন্ধু,
আমাদের গন্তব্যও এক।”
সমসাময়িক চীনা সাহিত্যে এটা একটা অস্বাভাবিক কবিতা। সেই সময় চীনে বিভিন্ন রাজনৈতিক টানাপোড়েন চলছে। সাম্রাজ্যবাদের সাথে গণতন্ত্র, জাপানের সাথে ঠাণ্ডা রাজনীতি, গৃহযুদ্ধ ইত্যাদির মধ্যে বিং জিনের দেশের গণ্ডির বাইরে গিয়ে ‘আমরা’ শব্দটি লেখাটা হয়তো রবীন্দ্রনাথেরই প্রভাব। তাঁর লেখায় বারবার উঠে এসেছে রবীন্দ্রনাথের জীবন দর্শন।
১৯৫৪ সালে তিনি একটি লেখায় রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে বলেন,
“Stray Birds is a collection of short pieces of few words and phrases but filled with poetic feeling, artistic insight and philosophical understanding. It struck a chord in me. It occurred to me that the jottings in the margins of my notebooks could also be brought together and set in order. As I collected them I chose those which were particularly poetic, those which were particularly resonant and suggestive, and put them in sequence. . . . If Tagore’s Stray Birds was a collection of poetry, then wasn’t my ‘Maze of Stars’ also?”
এটাকে আর অনুবাদ করে দিলাম না। কবি বিং জিনের কথা, বিং জিনের ভাষায়। এই লেখাটা শেষ করছি বিং জিনের একটি কবিতা দিয়ে। ‘Stars’ কাব্যগ্রন্থের ১৪ নম্বর কবিতা। এখানে তিনি প্রকৃতিকে তাঁর লেখার অনুপ্রেরণা বলেছেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও দর্শনেও প্রকৃতি বিরাজমান।
প্রকৃতি আমাকে ডেকে বলল,
“কলম তোল,
আমার সাগরে ডুবিয়ে নাও তাকে;
মানুষের হৃদয় শুকিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।”
* * *
মূল লেখাটি ‘ASIAN AND AFRICAN STUDIES’ এর একটা পেপার থেকে পাওয়া। লেখক উল্ফগ্যাং কুবিন। আরও কিছু পেপার ও বই ঘেঁটে এটা লিখলাম। আপনাদের ভালো লাগলে জানাবেন। আমার লেখা পড়ার জন্য ধন্যবাদ।