গত রবিবার লোয়াঙ থেকে ফেরার পর ওয়ান সুণ থাং এর সাথে আর দেখা হয় নি। কাল শরীরটা একটু খারাপ ছিল, তাই অফিসে যাইনি। কিছুদিন বেশ গরম ছিল এখানে, তার মধ্যে রবিবার রাতের বৃষ্টি। একটু ঠাণ্ডা লেগে গেছে। যাই হোক, সকাল থেকে শুয়ে বসে সময় আর কাটতেই চাইছিল না। বাইরে যে একটু ঘুরে আসব তার উপায় নেই। গা হাত পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে ঘুম দিলাম একটা। ঘুম ভাঙল কলিং বেলের শব্দে। কোনরকমে উঠে দরজা খুলে দেখি ওয়ান সুণ থাং দাড়িয়ে আছে।
“কি বন্ধু, শরীর খারাপ শুনলাম? এখন ঠিক আছো তো?” ঘরে ঢুকে জুতো খুলতে খুলতে প্রশ্ন করল ওয়ান সুণ থাং ।
“ওই আছি এক রকম।”
“আমি ভাবলাম, সারাদিন একা আছো, একটু সঙ্গ দি তোমায়। ডিস্টার্ব করলাম না তো?” একটু হেসেই বলল ও।
“মোটেই না। আমি বরং ভীষণ বোরই হচ্ছিলাম। ভালো হয়েছে তুমি এসে গেছো। বসো।’
ফ্রিজ থেকে পেপসির বোতলটা বের করে তাতে একটা সশব্দে চুমুক দিল ওয়ান সুণ থাং। বলল, “তোমার শরীরটা ভালো করারা ক্ষমতা নেই আমার, তবে তোমার মনটা ভালো করে দিতে পারি।” এই বলে ওর কাঁধের ঝোলা থেকে একটা পাতলা বই আমার হাতে দিল। বইটার উপরে চিনে ভাষায় লেখা ‘দু মু-র সেরা কবিতা।’
“দু মু? নামটা পড়েছি তোমার দেওয়া একটা বইয়ে। একটা কবিতাও ছিল তাতে। কিন্তু ডিটেলে জানি না,” বইটা নেড়ে চেড়ে দেখতে দেখতে বললাম।
সোফায় আরাম করে বসে আমেজ করে একটা সিগারেট ধরাল ওয়ান সুণ থাং। তারপর শুরু হল চীন দেশের কবি দু মু-র গল্প।
দু মু চীন দেশের ট্যাং সাম্রাজ্যের একজন প্রধান কবি ছিলেন। উনি বিখ্যাত ছিলেন ওনার গীতময় ভাষা ও ভাববিলাসী কবিতার জন্য। চীনা কবিতার স্বর্ণ যুগের নামী কবিদের মাঝে দু মু বিচরণ করেন। দু ফু, লি বাই-এর মত মহান কবিদের সাথে ওনাকে একই আসনে বসানো হয় চীনা সাহিত্যে।
৮০৩ খ্রিষ্টাব্দে জীয়ান শহরের এক ধনি পরিবারে ওনার জন্ম। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে “সাহিত্যের অগ্রগতি অধিসংস্থা”-র সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। সারা জীবনে, উনি ট্যাং সাম্রাজ্যের বহু স্থানে ঘুরেছেন ও বসবাস করেছেন। এই বিভিন্ন স্থান ঘোরা নিয়ে উনি বহু কবিতা রচনা করেছিলেন। একবার, সরকারি কাজে সাংসিনে যাওয়ার পথে নিম্ন লিখিত কবিতাটি রচনা করেছিলেন।
সিংসানে প্রবেশ
আমি হাজার মাইল মেঘ পেরিয়ে আজ সিংসানে এলাম।
ছোট সেতুটার নীচে, নীল নদীটা বয়ে চলে।
পাথুরে নদীর শব্দ বৃদ্ধ লোকের কানেও পৌছে যায়।
কিন্তু আমার এখন সেই শব্দ শোণার সময় নেই।
জীবনে নানা জায়গায় ঘোরার অভিজ্ঞতা তার বিভিন্ন কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে। উনি কাজের জন্য যেসব জায়গায় যেতেন, তার প্রায় অধিকাংশই পাহাড়ি। এই পাহাড়ি পথ ওনাকে ভীষণ ব্যকুল করে দিত। এই পথ চলা নিয়ে ওনার বহু কবিতা আছে। একটি অনুবাদ করছি।
পাহাড়ি পথে চলা
অনেক দূরে ওই সাদা পাহাড়টার গা বেয়ে, পাথুরে পথটা এঁকে বেঁকে উঠে যাচ্ছে,
ঘন মেঘের মাঝে একটা গ্রাম, কিছু মানুষ তাদের ঘরের উষ্ণ আলিঙ্গনে,
আমি আমার বাহনটা থামাই, বিকেলেই ঝরা আলোয় দেখি গাছের সারি,
ফুলগুলো সব লালচে, ঠিক যেন শরতের বাগান।
শেষ বয়সে উনি হু ঝৌ রাজ্যের রাষ্ট্রপালের পদে নিযুক্ত হন। ৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে শারীরিক অসুস্থতার কারণে ইহলোক ত্যাগ করেন।
প্রাচীন চীনা গদ্য কবিতায় দক্ষ ছিলেন দু মু। ওনার কবিতায় বিরহ, প্রকৃতি আর ঐতিহাসিক ঘটনা বারবার ফিরে ফিরে আসে। আকর্ষণীয় রচনাশৈলী, চলিত ভাষার ব্যবহার দু মু-র লেখা সাধারণ মানুষের অনেক কাছে এনে দিয়েছিল। একটা উদাহরণ দিলাম।
একা বসে
জানলার বাইরে, বরফ মিশ্রিত পবন বয়ে চলেছে,
আমি ভীতরে বসে সুরার একটি পাত্র নিয়ে।
ঠিক যেমন বৃষ্টিতে ছোট একটা নৌকা,
ঘুমন্ত অবস্থায় ভেসে চলে উত্তাল নদীর বুকে।
চীন দেশে কুইং মিং অথবা পবিত্র আলোর উৎসব নামক একটি উৎসব হয়। এই দিনে ওখানকার মানুষ মৃত আত্মীয়দের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে তাদের কবরে ফুল দিয়ে। এই উৎসবটি নিয়ে দু মু-র এক অনবদ্য লেখা আছে। অনেকের মতে এটি ওনার সেরা কবিতা।
পবিত্র আলোর উৎসব
পবিত্র আলোর উৎসবের দিনে বর্ষা কুণ্ডলী পাকায় মাথার উপর।
পথের পর্যটকটার হৃদয় ভেঙে যায় সেই দৃশ্যে।
শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করে, “কাছাকাছি কোন চটী আছে?”
রাখাল বালকটা অঙ্গুলি নির্দেশে দেখিয়ে দেয় সেই ফুলেল গ্রামটার দিকে।
‘শরতের বিকেল’ নামে ওনার আরেকটি বিখ্যাত কবিতা আছে। কবিতাটা একজন নারীকে নিয়ে লেখা যে ভীষণ একাকীত্বে ভুগছে। গরমকাল শেষ হয়ে গেছে তাই তার হাত পাখাটা এখন বেকার। এই বিষয়ে অসাধারণ একটি কবিতা ‘শরতের বিকেল।’ নীচে অনুবাদটা দিলাম।
শরতের বিকেল
রূপালী মোমবাতি, শরতের শেষ আলো, রঙিন পর্দা,
ছোট্ট পাখাটা হাতে নিয়ে জোনাকি উড়ায় আপন মনে।
প্রাসাদের সিঁড়িতে, রাত্রি যেন বরফের মত শীতল,
সেখানে বসে, সে রাতের তারার মাঝে কাকে যেন খুঁজে চলে।
দু মু-র কবিতায় প্রেম একটা বড় ভূমিকা নিয়েছে সবসময়। তার লেখা বহু প্রেমের কবিতা আজও চীন দেশে বিখ্যাত। শুধু চীন দেশে নয়, দু মু-র প্রেমের কবিতা দেশ কালের গণ্ডি পেরিয়েছে। ১৯৬৮ সালে পিঙ্ক ফ্লোয়েড নামক রক ব্যান্ডটি তার একটি কবিতার লাইন ধার করে ‘Set the Controls for the Heart of the Sun’ নামক গানটি রচনা করে। দু মু-র একটি প্রেমের কবিতার অনুবাদ দিয়ে আজকের লেখাটা শেষ করছি।
দূরে থাকার বেদনা
অনেক অনুভূতি, তবুও মনে হয় কিছুই নেই,
আমি আমার মোমবাতির পিছনে লুকাই, হাসতে ভুলেছি অনেকদিন।
মোমবাতিরও হৃদয় আছে, সেও দূরে থাকতে চায় না প্রিয় জনের থেকে,
সারারাত জেগে দুঃখ করে সে, ভোরে এক ফোঁটা অশ্রু জমে তার চোখে।
আসা করি দু মু-র জীবনী ও কবিতা আপনাদের খারাপ লাগল না। আমি আবার ফিরে আসব চীন দেশের অন্য কোন কবির গল্প নিয়ে। ভালো থাকবেন সবাই।