“চীনের কবিতার স্বর্ণ যুগ কোনটাকে বলে জানো?” কফির কাপে একটা সশব্দে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করল ওয়ান সুণ থাং।
আজকে রবিবার, তাই সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ আমি চলে এসেছি, জিন হুই রোডে আমার বন্ধু ওয়ান সুণ থাং-এর তেতলার ফ্ল্যাটা-টায়। অন্যদিন এদিক ওদিকের কথা বলে কবিতার প্রসঙ্গে আসে, কিন্তু আজকে একেবারে বসতে না বসতেই।
“মধ্য ট্যাং যুগ,” বলে একটা সিগারেট ধরালাম।
ওয়ান সুণ থাং-এর মুখটা খুশিতে প্রসন্ন হয়ে উঠল।
আমি কফির কাপটা হাতে নিয়ে বললাম, “চীন দেশের কবিতা নিয়ে যখন একটু আধটু চর্চা করছি, তখন এটা না জানাটা অপরাধ না?”
“তা তো বটেই, তা তো বটেই। তা লি বা-র নাম শুনেছ?”
বললাম, “নাম শুনেছি। তবে ওইটুকুই। তুমিই বলেছিলে একদিন।”
“নিশ্চয়ই বলে থাকবো। আমার প্রিয় কবিদের মধ্যে একজন লি বা।”
এই বলে বার তিনেকের চেষ্টায় সিগারেট ধরাল ওয়ান সুণ থাং। তার পর যা বলল আমি তাই লিখছি।
লি বা চীনা কবিদের মধ্যে বিশেষ নামী। ৭০১ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। উনি এক হাজারের উপরে কবিতা রচনা করেছিলেন যার মধ্যে বেশ কিছু আজও চীনের বিভিন্ন স্কুলে পড়ানো হয়। বন্ধুত্ব, প্রকৃতি প্রেম, একাকীত্ব নিয়েই ওনার বেশীর ভাগ কবিতা। একটা উদাহরণ দিলাম।
শরতের বাতাস
শরতের আকাশ পরিষ্কার,
শরতের চাঁদও উজ্জ্বল,
ঝরে পড়া পাতা ছড়িয়ে আছে যত্রতত্র।
পাখিরা আবার নতুন করে বাসা বাঁধবে।
আমারা একে অপরের কথা ভাবি, জানি না কবে দেখা হবে?
তাই, এই রাতে, এই ক্ষনে আমার চিন্তাগুলো ভারাক্রান্ত।
লি বা ওনার ভাবনায় সর্বদাই মগ্ন থাকতেন। শোনা যায় উনি নাকি স্বভাব কবি ছিলেন। একবার, লি বা এক পূর্ণিমা রাতে নৌকা ভ্রমণে বের হয়ে ছিলেন। সেখানে বসেই একটি কবিতা রচনা করেন। আর মাতাল বলেও ওনার বেশ সুনাম ছিল। উনি কবিতায় এতই বিভোর ছিলেন, যে নদীর জলে চাঁদের প্রতিবিম্ব দেখে সেটাকে ধরতে যান। আর সেই চাঁদ ধরতে গিয়ে, উনি নাকি প্রায় ডুবেই যাচ্ছিলেন। ওয়ান সুণ থাং অনেক খুঁজে, আমাকে সেই নৌকায় লেখা কবিতাটাও শোনালো।
শান্ত রাতের ভাবনা
আমার বিছানার উপর, চাঁদটা উজ্জ্বল,
মনে হয় যেন মেঝেতে বরফ পড়ে,
মাথা তুলে আমি উজ্জ্বল চাঁদটাকে দেখি,
তারপর,
মাথা নামিয়ে আমার জন্মভূমির কথা ভাবি।
সেই সময়ের লেখা আরও একটা কবিতা অনুবাদ করছি। শরৎকাল ওনার ভীষণ প্রিয় সময় ছিল। তাই ওনার বিভিন্ন কবিতায় সেটা বারবার ফিরে এসেছে।
পাথরের সিঁড়ির কথা
পাথরের সিঁড়িতে সাদা শিশির জমেছে,
আর এই শেষ না হওয়া রাতে আমার ভাবনাগুলোতেও।
কিন্তু এখন আমি মসৃণ পরদাটা সরিয়ে
শরতের চাঁদটার দিকে তাকিয়ে থাকবো নিস্পলক।
লি বা-র কবিতায় আমরা সেই সময়ের দুটো ভিন্ন দিক দেখতে পাই। ওনার প্রথম জীবনের কবিতায় একটা স্নিগ্ধতা ছিল। সেই সময়টাও ছিল শান্তির। কিন্তু ওনার কবিতাও পরিবর্তন হয় যখন আন লূ সাং-এর বিপ্লব শুরু হয়। যুদ্ধ আর দুর্ভিক্ষের মাঝে লি বা-র কবিতাও যেন পালটে গেল। সেই সময় দাড়িয়ে, উনি ওনার জীবনের সবচেয়ে বিখ্যাত কাব্যটি রচনা করে।
এক শরতের দিনে আমি মাতাল হয়ে চলি
এই পৃথিবীতে জীবন, একটি মস্ত স্বপ্ন,
আমি কোনরকম ভাবেই এটিকে নষ্ট হতে দেব না।
লোকে বলে, আমি নাকি সারাদিনই মাতাল,
আমার দরজার পাশে পড়ে থাকি।
যখন নেশা কাটে, আমার বাগানের দিকে দেখি,
একটি পাখি, ফুলেদের মাঝে একাই গান গাইছে।
আমি ভাবি, আজকে কি বৃষ্টি হয়েছে?
শরতের বাতাস সেই পাখীটিকে বলে যাচ্ছে,
তোমার গানে মুগ্ধ হয়ে দেখো আমিও গাইছি,
আমি আবার আমার গেলাস ভরে নিলাম সুরায়,
পাগলের মতো গাইতে গাইতে আমি চাঁদ ওঠার আপেক্ষা করি,
আমি গান শেষ হওয়ার আগেই আমি আবার সংজ্ঞা হারাই।