আমার কবিতা লেখা ২০১৩ সাল থেকে শুরু । কবিতার কথা যখন বলছি তখন আমার নিজের মা’র কথাটা সবার আগে মনে হয়, ওনার কাছেই বাল্যকালের শিক্ষা ও জীবনের প্রথম বাংলা সহজ পাঠ বা কবিতা পাঠ শেখা, এবং কবিগুরুর লেখা কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ী থেকে শুরু, ওনার মুখে বিভিন্ন সুরে সুর করে পাঁচালী পাঠ ইত্যাদি যেন সেই ছোট বয়সে আমাকে অভিভূত করত। যাইহোক আজকের এই আলোচনায় আমি ছন্দ নিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছি, কিছু সহজ কথা। যদিও আধুনিক কবিতায় ছন্দের অন্তমিলের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা নেই। তবুও আমি মনে করি, ছন্দের প্রয়োজন কখনো ফুরোয়নি বা ফুরোবেও না। এই নিয়ে বেশী বিতর্কে আমি যেতে চাইনা। আমি যা বলতে চাই, কবিতায় আমরা যে তুরী, দোলা বা স্পন্দের কথা বলি, তা এই ছন্দ থেকেই আসে। সেই প্রসঙ্গেই বলি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা কথা আনন্দবাজার পত্রিকার কোন এক রবিবাসরীয় পাতায় পড়েছিলাম। একবার শান্তিনিকেতনের ছাতিম তলায় শিশুদের সাথে প্রভাত কালীন মিলনের সময় একটি শিশু ওনাকে নিমপাতার রস যেটা উনি প্রতি দিন সকালে পান করতেন কাঁচের গ্লাসে (সবুজ রঙের দেখা যেত) করে আসত, সেটা সকল শিশুদের কাছে এক বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণীয় বস্তু ছিল, শিশুটি সেই রস পানের ইচ্ছা প্রকাশ করে, ততক্ষণে কবিগুরু কাঁচের গ্লাস’টি শূন্য হয়ে যায়, তাই কবিগুরু শিশুটিকে জিজ্ঞাসা করলেন তোমার নাম কি? শিশুটি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল যে তার নাম “ছবি”। সেই পরিপ্রেক্ষিতে কবিগুরু শিশুটিকে একটা কবিতা উপহার দেন।
"তোমার নাম ছবি
আর আমার নাম রবী
ছন্দে ছন্দে মিলে গেল, বেঁচে গেলেন কবি।"
কি অদ্ভুত দৃষ্টান্ত উনি দিয়ে ছিলেন শিশুদের, তার মানেই এই যে, কোনো কবিতা বা ছড়া শিশু বয়স থেকে লিখতে গেলে অবশ্যই ছন্দে লেখা উচিৎ, পড়ে জানা যায় তাতে শিশুটি প্রচণ্ড আনন্দিত হয়েছিল। ছন্দে লিখুন বা না’ই লিখুন, এটা অবশ্যই জেনে রাখা দরকার যে আমাদের আলোচনা, কেবল একটা সহজ আলোচনা মাত্র।
ছন্দের ধরণঃ
যদি ছন্দের ধরণ নিয়ে কথা বলতে হয় তা হলে বলি, বাংলা কবিতার তিন প্রকারের ছন্দ আমারা ধরে নিতে পারি, অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত । এর মধ্যে প্রথমে আমি অক্ষরবৃত্ত কে বেছে নিলাম এবং এই আসরে আমি কেবল অক্ষরবৃত্ত ছন্দ কে নিয়েই আলোচনা করব।
মাত্রাঃ
মাত্রা কি? সোজা কথাই মাত্রা মানে, পরিমাপক অর্থাৎ বস্তু মাপতে মাপি লিটারে বা মিটারে ইত্যাদি। ঠিক এই রকম ছন্দ মাপতে মাপি মাত্রাতে। কবিতার বিভিন্ন পংক্তির মধ্যে যেই যেই ধ্বনিপ্রবাহ থাকে, এবং তাকে উচ্চারন করতে যতটা সময় আমরা নিয়ে থাকি, তার উচ্চারন সময়ের ছোট একটা অংশই হল মাত্রা। সমষ্টি গত মাত্রা দিয়ে তৈরি হয় একটি পূর্ণ পংক্তি বা লাইন। এবার আসছি অক্ষরবৃত্তে
অক্ষরবৃত্ত মাত্রা গণনা :
অক্ষরবৃত্ত কী? অক্ষরবৃত্ত হোল ছন্দে যত অক্ষর বা বর্ণ আছে, ঠিক তত মাত্রা অর্থাৎ প্রতিটি অক্ষরই এখানে একটি মাত্রার মর্যাদা পায়, যেমন-
১) বাষ্প জলের প্লাবন কণা দুঃখ গানে (১৪ মাত্রা -গুণে দেখুন)
২) মেঘের জটা জড়িয়ে ধরে অশ্রু ভরে (১৪ মাত্রা)
“বাংলা অক্ষরের উপরে যে’রকম মাত্রা থাকে তাকেই মাত্রা বলা হয়। যথা, ‘ব’ অক্ষরের উপর মাত্রা দাওয়া আছে, তাই ‘ব’ অক্ষর টির একটি মাত্রা। ‘জ’ অক্ষরের উপর মাত্রা দাওয়া আছে, তাই ‘জ’ অক্ষর টির একটি মাত্রা। এখানে ‘া’,’ি’,’ী’,ু,ূ,ৃ,ে,ৈ,ো,ৌ,ঁ,ঃ এই অক্ষর গুলিকে মাত্রা বলে ধরা হয় না। আবার ‘ষ্প’ ‘প্ল’ ‘শ্রু’ ইত্যাদিতেও একটি মাত্রা। অর্থাৎ অক্ষরবৃত্ত যুক্তাক্ষরে একটি মাত্রা হয়। ‘প্লাবন’ অক্ষরবৃত্তে ৩ মাত্রা, ‘দুঃখ’ ২ মাত্রা।
স্বরবর্ণে ‘এ’ অক্ষরে, ‘ও’ অক্ষরে মাত্রা নেই। কিন্তু ‘এ’ অক্ষরে সর্বদাই এক মাত্রা ধরতে হবে, যেমন ‘এদিকে’ ৩ মাত্রা। ‘ওই’ ২ মাত্রা । ‘ও’ অক্ষরে মাত্রা নেই। তবে সকল শব্দের ‘ও’ অক্ষরে একটা মাত্রা ধরতে হয়। খুব অল্প শব্দ আছে যেমন ‘ও’ অক্ষরে শূন্য মাত্রা। ‘ওই’ ২ মাত্রা, কিন্তু ‘চাওয়া ‘পাওয়া’, ‘খাওয়া’ প্রভৃতি শব্দের শেষে ‘ওয়া’ যদি থাকে ‘ও’ কে শূন্য মাত্রা ধরা হয়। এই শব্দ গুলো ২ মাত্রা বলেই ধরা হয়।
এবার আসছি ব্যঞ্জনবর্ণে। ব্যঞ্জনবর্ণের ‘ঙ’ এবং ‘ৎ’ – এই দুইটি অক্ষরের মাত্রা ধরা হয়না। কঙ্কাল, অঙ্ক এবং অনুরূপ সব শব্দে ‘ঙ’ অক্ষরের সঙ্গে ভিন্ন অক্ষর যুক্ত হয়ে যুক্তাক্ষর হবার ফলে এই যুক্তাক্ষর কে এক মাত্রা। অর্থাৎ ‘অঙ্কন‘ ৩ মাত্রা, ‘অঙ্ক’ ২ মাত্রা।
শব্দের শেষে যদি ‘ৎ’ থাকে তবে ১ মাত্রা বলে ধরা হয়, যেমন ‘হঠাৎ’ ৩ মাত্রা। আবার ‘ৎ’ শব্দের মাঝ খানে থাকে তবে শূন্যমাত্রা ধরা হয়। যেমন ‘উৎপীড়ন’ ৪ মাত্রা। আর শব্দের শেষে ‘ঙ’ যদি থাকে তবে ‘ঙ’ অক্ষর কে সব সময় একমাত্রা ধরা হয়। যেমন- ‘রঙ’ ২ মাত্রা।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে আসলে ৪ মাত্রার চাল। প্রতিটি পর্বে বা অংশে থাকে ৪টি মাত্রা, শেষে থাকে ২ মাত্রার যেটাকে ভাঙা পর্ব বলা হয়। এক কথায় অক্ষরবৃত্তে মাত্রাসংখ্যার নিয়ম হচ্ছে ৪ এর গুণিতক +২।
নিয়ম :
৪ x ১ +২ = ৬
৪ x ২ + ২ = ১০
৪ x ৩ + ২ = ১৪
এই নিয়মে ১৮, ২২ , ২৬ , ৩০ এভাবে মাত্রাসংখ্যা সৃষ্টি ও বৃদ্ধি হতে পারে।
এবার ছয় মাত্রার পংক্তি বা লাইন কে ভেঙে দেখালে এরকম হবেঃ
জলের প্লা / বন
ধরে অশ্রু / ভরে
সেই রকম ভাবে দশ মাত্রা কে ভেঙে দেখালে এরকম হবেঃ
বাষ্প জলে / র প্লাবন / কণা
মেঘের জ / টা জড়িয়ে / ধরে
চদ্দো মাত্রা কে ভেঙে দেখালে এরকম হবেঃ
বাষ্প জলে / র প্লাবন / কণা দুঃখ / গানে
মেঘের জ / টা জড়িয়ে / ধরে অশ্রু / ভরে
ছন্দের মিল নিয়ে যেই কবিরা চিন্তা ভাবনা করছেন তাদের কাছে আমার আবেদন যথা’সম্ভব আট মাত্রার প্রথম পর্বে রাখার চেষ্টা করবেন। যদি আপনারা সনেট লিখতে চান সে’ক্ষেত্রে প্রথম পর্বে আট মাত্রা এবং শেষ পর্বে ছয় মাত্রা লেখা হলে কবিতা পাঠে সুবিধা হয়।
ছন্দ সম্পর্কে আর একটা বিশেষ কথাঃ
শব্দ শব্দে গাঁথারও একটা পদ্ধতি আছে। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, বিখ্যাত ছন্দের জাদুকর নামে বাংলা সাহিত্যে পরিচিত। তিনি একটা সহজ কথা বলেছেন– “বিজোড়ে বিজোড় গাঁথো, জোড়ে গাঁথো জোড়।“
মানে, বিজোড় শব্দের সাথে বিজোড় শব্দ এবং জোড় শব্দের সাথে জোড় শব্দ গাঁথো বা ব্যবহার কর। সে’ক্ষেত্রে পাঠকের শ্রুতি মধুর হবে।
এবার আমি আসতে চাই একটু সনেট প্রসঙ্গে। তাহলে আপনার নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পারছেন ভালো সনেটিয়া হতে গেলে অক্ষরবৃত্তের উপর একটু দখলদারীর প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি সনেট প্রসঙ্গের বর্ণনা দিচ্ছি, সেতারের একটা উদাহরণ দিয়ে উনি বলেছিলেন “সপ্ত তারের বন্ধনেই সুরের মুক্তি”, বন্ধনে মুক্তি! কি অদ্ভুত দৃষ্টান্ত উনি দিয়ে ছিলেন।
এখানেই আজকের মত দাড়ি টানছি।
হয়তো অনেক কিছু ভুলও হতে পারে। এই আসরে অনেক উচ্চমানের কবি ও লেখকবন্ধু যারা আছেন তাদের কাছে আমার অনুরোধ এই লেখাটি কোন ভুল থেকে থাকলে একান্ত নিজের মনে করে ভুল ধরিয়ে দিলে পরবর্তী সংশোধনে এই লেখাটি আরও পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। চেষ্টার কোন শেষ নেই, আমি চালিয়ে যাব, হয়তো এই ভাবেই আমাদের অনেক আশাবান নতুন কবিরা উঠে আসবে যারা ছন্দের অন্তমিলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন ও বাংলা সাহিত্যকে সেই উদ্দেশ্যে আরও উচ্চস্থানে নিয়ে যেতে চান। যদি কখন আমার এই লেখাটা কারোর কোন কাজে বা উপকারে আসে তাহলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব। ধন্যবাদ।