বাসন্তিক দুপুর, একাকী আনমনা,
বাসস্টপে দাঁড়িয়ে, বাসের অপেক্ষায় ।
চারিদিকে কর্মব্যস্ত মানুষের ছোটাছুটি
অসম প্রতিযোগিতায় বাসে যাত্রী তোলার হিড়িক। এরই মাঝে একটা বাচ্চা ছেলে,
ওই নয় কি দশ হবে।
কোন ছোট লোকের ছেলে হবে হয়তো,
অন্তত পোশাক দেখে তো তাই মনে হল।
একটা হাফপ্যান্ট, গায়ে ময়লা, ছেঁড়া গেঞ্জি।
অভাবের নামে স্বভাব দোষে দুষ্ট…
'বাবু দু টাকা দাও, কিছু খায়নি।'
কেমন বেমানান লাগছিল,
অনুভূত হচ্ছিল অস্বস্তিকর পরিস্থিতি ।
সরকারি টাকায় গড়া এই ঝাঁ চকচকে টারমিনাসে
ছোটলোকদের উৎপাত।
শিক্ষিত ভদ্র সমাজ এটা মানবে কেন ?
তখনই দূরপাল্লার বাস থেকে নামলেন এক যাত্রী,
বাকি রাখলেন না! তিনি হয়তো প্রকৃত শিক্ষিত, ভদ্র!
আত্ম সম্মান বাঁচাতে,
একটা চড় কষিয়ে দিলেন ।
ছেলেটা নিচে পড়ে,
আর হয়তো ওর মতই
কিছু ছোটলোকেরই দেওয়া,
কটা খুচরো কয়েন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ।
মায়া হলো, অদ্ভুত হলেও একটা জীবিত প্রাণ তো,
ছুটে গিয়ে ওকে উঠিয়ে, কয়েন কটা হাতে দিলাম,
'আয় আমার সাথে '
থিক্ থিকে ভিড় সরিয়ে,
যাত্রী প্রতীক্ষার শেষ বেঞ্চে বসালাম ।
'কি নাম তোর? কোথায় থাকিস?'
'রনজয় ...
পাঁচ টাকা দেবে ?'
একটু হেসে জিজ্ঞাসা করলাম
'কি হবে পাঁচ টাকায় ?'
তাড়াতাড়ি করে পকেট থেকে কিছু খুচরো
বের করে আমার হাতে দিলো ,
'গুনে দেখো এখানে পঁচিশ টাকা আছে ,
আর পাঁচ টাকা হলে,…
এক কেজি চাল নিয়ে যাবো,
দেবে পাঁচ টাকা?'
আমার মুহূর্তটায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল ।
'কে কে আছে তোর বাড়িতে?'
'আমার মা , পুচকু বোন ,
ও কিন্তু এখনো কথা বলতে পারে না ,
আর আমার বাবা,
জানো ডাক্তার বলেছে
বাবা আর বেশিদিন বাঁচবে না।'
'কি হয়েছে তোর বাবার?'
'ক্যান্সার,
ওই জন্যই তো মাকে
আর কেউ বাড়িতে কাজে ডাকে না।'
'তুই স্কুলে যাস না?'
'দাদা তুমি কি পাগল ? স্কুলে গেলে সবাই খাবে কি?'
আমি স্তব্ধ , আমি বাকরুদ্ধ ,
আমাদের মাতৃভাষা তখন শূন্য !
হাতে পাঁচ টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললাম ,
'চল্ '
সীমিত সামর্থ্য , এ পকেট ও পকেট হাতরে,
দোকান থেকে দু কেজি চাল, কিছু সবজি
আর ওর বাবার জন্য কিছু ফল কিনে…
'এই নে ধর্, আর শোন্  যে টাকাটা রইলো
ওটা জমিয়ে রাখবি।'
লক্ষ্য করলাম ওর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তখন ফ্যাকাসে !
বুঝলাম!
হাজারো দয়া,করুনার দায় তার মাথার উপর।
আমার খালি ব্যাগটা ওর হাতে দিয়ে বললাম,
'বাবু ব্যাগটা বাস অবধি পৌছে দে না।'
তাতে সে ঋণ মুক্ত হল কিনা জানিনা ,
তবে বেশ খুশী হয়েই সিট পর্যন্ত পৌঁছে দিলো।
আর পরক্ষণেই আমার গলা জড়িয়ে ধরে,
ফুঁপিয়ে উঠলো ।
তার বাঁধভাঙ্গা ভালোবাসার অশ্রুতে আমার পিঠে
তখন বন্যা।
এই প্রথম সত্যি কারের ভালোবাসা
ফিরে পাওয়ার স্বাদ পেলাম ।
'তুই আমাকেও হারমানালি ভাই '
তারপর কোন রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে
আশ্বস্ত করলাম ,
'এই জীবন যুদ্ধে হেরে গেলে হবে না ভাই,
শক্ত হাতে তোকে হাল ধরতে হবে !
শিক্ষিত , সভ্য , বর্বর পাষণ্ডের বিরুদ্ধে
তোকে জিততেই হবে।
তুই রনজয়, যুদ্ধে জেতাই তোর ধর্ম,
তুই তো সমাজের প্রকৃত স্টিলম্যান,
স্টিলম্যানরা  কখনো হারে না।'