প্রাচীন এথেন্সে সক্রেটিস গুরু শিশ্য পদ্ধতির মাধ্যমে যে ব্যক্তিগত শিক্ষা পদ্ধতি চালু করেছিলেন, এরই হাজার বছর পূর্বে বৈদিক যুগে এই পদ্ধতির বিকাশ ঘটেছিল । চিত্রকলা ও লিখন উপকরণ সামগ্রি প্রচলনের প্রারম্ভিক সময়ে আর্য ঋষিগণ উদ্ভব করেছিলেন গুরুর মাধ্যমে শিক্ষা দান পদ্ধতি । এটির উদ্দেশ্য ছিল গুরু ও শিশ্যের মধ্যে একটি আদর্শ সম্পর্ক সৃষ্টি এবং পরিমিত পারিবারিক বোধের মাধ্যমে শিশ্যদের নতুন জীবন দান ।
প্রাচীন ভারতবর্ষে শিক্ষার সব দিকগুলো খুব দ্রুত উল্লেখযোগ্য ভাবে এখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল । এটা প্রকাশিত হয়েছিল একটি আলোকিত করন প্রতিষ্ঠান স্বরূপ, যা মানুষকে দিয়েছিল জীবনের সঠিক দিক নির্দেশনা । মহাভারত বর্ণনা করে, ‘ ঐ প্রকার শিক্ষার কোন গুরুত্ব নেই, যা ব্যক্তির অব্যর্থ অন্তর্দৃষ্টি এবং উন্নত চরিত্র ও আচরণের নিশ্চয়তা বিধান করে না ’ ।
কিছু কিছু উপনিষদও খুব দৃঢ়ভাবে উল্লেখ করেছে, শিক্ষার প্রাথমিক উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ স্বতন্ত্র উন্নয়নের মাধ্যমে সমাজের সেবা করা । চাঁদোগ্যা (Chandogya) উপনিষদ শিক্ষার সামাজিক নিয়ম শৃংখলার উপর জোর দিয়ে বলেছে, ‘ অসীমত্ব হচ্ছে দিব্যানন্দ এবং সামাজিক কর্তব্য পালনের মাধ্যমে শুধুমাত্র সেই ব্যক্তি দিব্যানন্দ লাভ করে’।
সমাজের শিক্ষা সম্বন্ধীয় দায়দায়িত্ব হচ্ছে, জ্ঞান দান করা এবং অন্যান্য গুণাবলীকে শিক্ষার মাধ্যমে জাগ্রত করা । একজন ব্যক্তির প্রাথমিক কর্তব্য হচ্ছে শিক্ষা সমাপ্ত করা এবং শিক্ষা পদ্ধতির বহুল বিস্তার ঘটানো, সর্বোপরি শিক্ষিত সমাজে অপ্রতিরুদ্ধ ভাবে অবস্থান করা । (prajatantum ma vyacchetsih) (পরাজাতানতুম মা বিচ্ছেৎসই) । এই পদ্ধতি ছিল জ্ঞান অর্জনের শুরু ও শেষ প্রয়াস এবং একজন আদর্শ গুরু অবশ্যই সবসময় সতর্কভাবে নিয়োজিত থাকত জ্ঞানের অগ্র সৈনিক হিসেবে ।
শিক্ষার গুরুকুল পদ্ধতিটি দাঁড়িয়েছিল সরাসরি ছাত্র-শিক্ষক ব্যক্তিগত সম্পর্কের উপর এবং এটি ব্যক্তিগত শিক্ষক পদ্ধতির উপর দারুণ ভাবে ঋণী ছিল । শিক্ষকদের অবিরত উপস্থিতি, তাদের বাস্তব জীবনযাপন পদ্ধতি এবং ছাত্রদের প্রতি অনুজ্ঞা ও আদেশাত্মক আচরণ, ছাত্রদের উন্নত চরিত্র ও আদর্শবান হিসেবে গড়ে তুলার জন্য সহায়ক ছিল ।
প্রাচীন তপোবন ধারনাকে উপেক্ষা করে গুরুকুল বিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল শহরের মূল বসতি থেকে দূরে নিভৃতে । বেনারসের শহরতলিতেও এ ধরনের পৃথক গুরুকুল গড়ে উঠেছিল । বৈদিক গুরুকুল পদ্ধতি ছিল সংস্কৃত শিক্ষার উপযুক্ত মাধ্যম । মধ্যযুগেও এটি তার গোরবোজ্জ্বল ধারা অব্যাহত রেখেছিল । এর অনুকূলে কারণ ছিল স্থানীয় প্রশাসক ও ভূস্বামীদের বিপুল বদান্যতায় ভুমির অধিকার লাভ । এ ধরনের বিদ্যালয় গুলোর কাজ ছিল সাধারণত ২০ থেকে ২৫ জন ছাত্রের তালিকা করন । শিক্ষা দানের ঘর ছিল কাদায় নির্মিত কুঠির, যার চাল তৃণ পত্রের দ্বারা ছাওয়া হত । সেখানে ব্যাকরণ, সাহিত্য (কবিতা), দর্শন এবং জ্যোতিষ শাস্ত্র শিক্ষা দেয়া হত ।
১২০৬ খৃঃ বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত রাজা লক্ষণ সেন ছিলেন নদীয়ার শাসনকর্তা । এখানে স্থাপিত নদীয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম মধ্যযুগে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল । এখানে তর্কশাস্ত্র, স্মৃতি, জ্যোতির্বিদ্যা, ব্যাকরন, কাব্য ও তন্ত্র বিষয়ে মৌলিক শিক্ষা প্রদান করা হত ।
প্রাচীন ভারতবর্ষে নালন্দা ছিল একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় । ৪০০ (খৃঃ পূঃ) অব্দে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় । এখানে ছাত্র সংখ্যা ছিল ৭৫০০ জন । শিক্ষক ছিলেন ১৫০০ জন এবং কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছিলেন ১২০০০ জন । এখানে সম্পূর্ণ বিনামুল্যে আবাসিক সুবিধা, খাবার, পোশাক ও শিক্ষা প্রদান করা হত । প্রতি ৫ জন ছাত্রের জন্য ১ জন শিক্ষক এই পদ্ধতি প্রচলিত ছিল, যা আধুনিক যুগে কল্পনাও করা যায় না।
তক্ষশীলা স্থাপিত হয়েছিল ৭০০ (খৃঃ পূঃ) অব্দে । এটি ছিল পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় । এখানে ছাত্র সংখ্যা ছিল ১০,৫০০ জন । ৬০টিরও অধিক বিষয়ের উপর শিক্ষা প্রদান করা হত । অধ্যয়নের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ছাত্ররা এখানে আগমন করত ।
প্রাচীন ভারতবর্ষের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে সব বিশ্ববিদ্যালয় বহুল পরিচিতি পেয়েছিল তার তালিকাটি ছিল এরকম-
১ . নালন্দা ২ . তক্ষশীলা ৩ . বিক্রমশীলা
৪ . জগদলা ৫ . উদ্দন্ডপুর ৬ . ভালাভি
৭ . মিথিলা ৮ . উজ্জয়িনি ৯ . নদীয়া
১০. অমরাবতী ১১. কাঞ্চি ১২. মাধুরা
এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার বিভিন্ন বিষয় ও শাখায় জ্ঞান বিতরণ করা হত । এ গুলোর মধ্যে নালন্দা-দর্শন, তক্ষশীলা-আয়ুর্বেদ, নদীয়া-তর্কশাস্ত্র, অমরাবতী-গন্ধর্ব আয়ুর্বেদ (রসায়ন শাস্ত্র), শিল্পকলা, উজ্জয়িনি-জ্যোতির্বিদ্যা, মাধুরা-ইতিহাস এবং কাঞ্চি-বেদান্ত বিষয়ের জন্য বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল । নালন্দা ও তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুখ্যাতি ছিল পৃথিবী ব্যাপী । জাপান, কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া, চীন , তিব্বত প্রভৃতি দেশের শিক্ষার্থীরা নালন্দায় অধ্যয়ন করত । তক্ষশীলার আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের উপর রোম ও চীনের ছাত্রদের আকর্ষণ ছিল অত্যন্ত প্রবল ।