‘নিসঙ্গতার এক শত বছর’ সম্ভ্রান্ত এক উপন্যাস। এ যেন স্বপ্নের মত এক মহান সৃষ্টি । কলম্বিয়ার নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সাহিত্যিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এর রচয়িতা । তাঁর প্রেম ও আকাঙ্ক্ষার মনোমুগ্ধকর গল্প ল্যাটিন আমেরিকার লক্ষ লক্ষ পাঠকের জীবন ও সাহিত্যজগতে এক ঐন্দ্রজালিক বাস্তবতা সৃষ্টি করেছিল । ২০১৪ সালের ১৭ এপ্রিল এই মহান সাহিত্যিক ৮৭ বছর বয়সে মেক্সিকো শহরের নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন । মৃত্যুর এক সপ্তাহ পূর্বে তিনি নিউমোনিয়ার চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাসায় প্রত্যাবর্তন করেছিলেন ।
সংবাদপত্রের প্রতিবেদক হিসেবে মার্কেজ কর্মজীবন শুরু করলেও মূলত তিনি ছিলেন একজন উর্বর লেখক । তাঁর অসাধারণ সাহিত্যকর্ম ’নিসঙ্গতার এক শত বছর’গ্রন্থের জন্য তিনি ১৯৮২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান । একই গ্রন্থের জন্য তিনি ১৯৭২ সালে পান রোমুলো গ্যালাওস পুরস্কার। বন্ধু ও ভক্তরা মার্কেজকে গ্যাবো নামেই চিনত । তিনি ল্যাটিন আমেরিকায় এত বেশী জনপ্রিয় ও প্রসিদ্ধ ছিলেন যে বইটি দ্রুত বেষ্টসেলারে পরিণত হয় এবং ১৯৬৭- ২০১৪ পর্যন্ত ৫ কোটি কপি বিক্রির রেকর্ড অর্জন করে। তাছাড়া এটি পৃথিবীর ২৫টি ভাষায় অনূদিত হয় । কবিতা ছাড়াও তাঁর রচনার মধ্যে আছে গল্প, প্রবন্ধ, ছোট উপন্যাস ইত্যাদি । ১৯৫০ সালে তাঁর ছোট উপন্যাস "Leaf Storm" ও "No One Writes to the Colonel" পাঠক সমাজে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল । যদিও ‘নিঃসঙ্গতার একশত বছর’ মার্কেজ এর অধিকতর জনপ্রিয় সৃষ্টি ; এ ছাড়াও তাঁর আরও কিছু ধ্রুপদী সাহিত্যকর্ম হচ্ছে- "Autumn of the Patriarch", and "Chronicle of a Death Foretold".
১৯৬০ সালের গোড়ার দিক পর্যন্ত তাঁকে উপন্যাসিকের স্বরূপ উম্মোচনে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল । কিন্তু ’নিসঙ্গতার এক শত বছর’ প্রকাশের সাথে সাথে নাটকীয় ভাবে তাঁর প্রকৃত স্বরূপ উম্মোচিত হয়ে পড়ে । এই গ্রন্থে মার্কেজ কলম্বিয়ার ক্যারিবিয়ান উপকূলের কাছাকাছি অবকাশ নগরী আরাকাতাকা এর অধীন কাল্পনিক গ্রাম ম্যাকোন্ডো এর অধিবাসী বুয়েন্ডিয়া পরিবারের সাত প্রজন্মের গল্প তুলে ধরেছেন । ক্যারিবিয়ান উপকূলের এমন একটি গ্রামে তিনি ১৯২৭ সালের ৬ মার্চ জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং নানা-নানীর তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠেছিলেন ।
মার্কেজ এর উপন্যাসে দেখা যায় মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বিবরণ ও ল্যাটিন আমেরিকার রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে অলৌকিক এবং অতিপ্রাকৃত ঘটনার অপূর্ব সম্মিলন । ভূত, মহামারীর মত অনিদ্রা, শূকরের লেজওয়ালা শিশুর জন্ম, অতি ক্ষমতাধর গ্রাম প্রধান ইত্যাদি তিনি ম্যাকোন্ডোর পটভূমিতে চিত্রিত করেছেন । তাঁর হাস্যরসাত্মক, যৌন উত্তেজক ও অন্যান্য বিয়োগান্তক রচনাবলী ৩০ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছিল এবং তা বারটি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে । তাঁর সাহিত্যকর্ম নিঃসন্দেহে ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্যভান্ডার সমৃদ্ধ করেছে একথা গুরুত্ব দিয়ে বলা যায় । সাহিত্যবোদ্ধারা বলেন হোর্হে লুইস বোর্হেস এবং হুলিও কোর্তাসারের সাথে মার্কেজও বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ল্যাটিন আমেরিকান কথাসাহিত্যিক। জনপ্রিয় এবং মহৎ লেখক হিসেবে লেভ তলস্তয়, আর্ণেস্ট হেমিংওয়ে ও চার্লস ডিকেন্স এর সঙ্গে তাঁর নাম উচ্চারিত হয়।
ঘন ঘোফ , কোঁকড়ানো চুল ও সদা হাস্যোজ্জ্বল মার্কেজ শৈশবে নানীর মুখে শুনা লোকজ গল্পগুলো থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন বিশেষ করে উপন্যাসের ক্ষেত্রে । যে গল্পগুলো ছিল অতিপ্রাকৃত এবং কল্পনা প্রসূত, অথচ মার্কেজ এর নানী স্বাভাবিকভাবে বর্ণনা করে যেতেন । ১৯৮১ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন-. "I discovered that what I had to do was believe in them myself, and write them with the same expression with which my grandmother told them: with a brick face."
মার্কেজ ছিলেন ঐন্দ্রজালিক বাস্তবতার শাহেনশাহ । উপন্যাসের শৈলী হিসাবে ঐন্দ্রজালিক বাস্তবতা তাঁর আবিস্কার নয় বটে । তবে এই শৈলীকে তিনি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছিলেন যা আর কেউ করেনি । তাঁর উপন্যাসের কাহিনী বাস্তবতার ভিতের উপর প্রোথিত । কিন্তু এই ভিতের উপর তিনি একের পর এক কল্পনার ফানুস উড়াতে থাকেন । একবার তিনি বলেছিলেন, যেদিন ইউনুচ নবী ৩০ বছর নিরুদ্দেশ থাকার পর ঘরে ফিরে স্ত্রীকে বলেছিলেন, একটি তিমি মাছ তাঁকে গিলে ফেলেছিল এবং এ কারণে তিনি নিরুদ্দেশ ছিলেন, সেদিনই কথাসাহিত্যের গোড়াপত্তন হয়েছে । তাঁর মতে পাঠক গল্প উপন্যাসে বাস্তব পরিবেশের অনুপুঙ্খ বর্ণনা খুব বেশী আশা করেনা । এ কথা অবশ্যই মানতে হবে তাঁর কল্পনা প্রবণতা পাঠককে আনন্দ দেয় । আবার তাঁর রাজনৈতিক দর্শন চেতনায় ঝড়ও তুলে । পুরাণ, জাদু ও সাধারণ অভিজ্ঞতার বৈচিত্রময় বিশ্লেষণ তাঁর রচনায় দৃষ্টিগোচর হয় । ল্যাটিন আমেরিকার বিশৃঙ্খলার সময়টিতে তাদের নীতি, আদর্শ ও বাস্তবতা উদ্বেগজনক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র । এমন কি ঐন্দ্রজালিক বাস্তবতার উপরও পড়েছিল এর প্রভাব । তাঁর উপন্যাস ও ছোটগল্পে আমরা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ স্থানের নির্দেশনা পাই, যেখানে অলৌকিকতা এবং বাস্তবতা এক বিন্দুতে মিলিত হয়েছে । তাঁর নিজস্ব কল্পজগতের সাথে প্রচলিত লোকগল্প ও ঘটনা, সাহিত্যতত্ব ও মৌলিকত্ব, সময়ের নির্ভুল চিত্রাংকন, ঘটনা ও বিষয়বস্তুর সমন্বয় আছে । নোবেল পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে সুইডিশ একাডেমি মন্তব্য করেছিলেন, তাঁর প্রতিটি নতুন গ্রন্থের প্রকাশনা বিশ্বব্যাপী নতুন ঘটনার মত । গণমানুষের সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক যোগাযোগ বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ ছিল ।
তিনি ফ্রাঞ্জ কাফকা এর কর্মের প্রশংসা করতেন এবং প্রখ্যাত ল্যাটিন আমেরিকান লেখক মেক্সিকোর জুয়ান রালফ ও আর্জেন্টিনার জর্জ লুইস বোর্জস দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন । ম্যাকোন্ডোর পরিবেশ, দুর্নীতি, অত্যধিক তাপমাত্রা-মার্কেজের এইসব সৃষ্টিশীলতা আমেরিকান লেখক উইলিয়াম ফকনারকে ভীষণ অনুপ্রাণিত করেছিল । পরবর্তীতে আরাকাতাকার উপকণ্ঠে একটি কলাবাগানের নামকরণ করা হয়েছিল ম্যাকোন্ডো । মার্কেজ তাঁর স্মৃতিকথা "Living to Tell the Tale." এ লিখেছিলেন, “ এইসব শব্দসম্ভার আমার জীবনের প্রথম দিকে মনোযোগের কেন্দ্রে চলে আসে যখন আমি পিতামহের তত্বাবধানে তৈরি হচ্ছিলাম, কিন্তু আমি যখন প্রাপ্তবয়সে উপনীত হলাম, তখন ঐসবের কাব্যিক রূপ আবিস্কার করেছিলাম ।
ল্যাটিন আমেরিকার সমসাময়িক সাহিত্যিকদের মধ্য থেকে মার্কেজ ঘোরতর ভাবে কমিউনিজম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন । কিউবার বিপ্লবের সময় তিনি সেখানে প্রচুর সময় অতিবাহিত করেন এবং সেই সময়ে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফ্রিদেল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে ঘনিস্ট বন্ধুত্ব গড়ে উঠে । ক্যাস্ট্রো একবার তাঁর বন্ধুকে লিখেছিলেন, একজন শিশুর মহত্ব ও মহাজাগতিক প্রতিভার আগামিদিনের মানুষ । ল্যাটিন আমেরিকার প্রতি অনুপ্রেরণা, সততা, ন্যায় ও সংবেদনশীলতা যা তাঁর সাহিত্যে প্রামাণ্য দলিল, তা কখনই শেকড়চুত্য হবেনা ।
কমিউনিস্ট কিউবার সরকারি সংবাদ সংস্থা নিউ ইয়র্ক শাখা স্থাপন ও নিজ বাড়িতে বামপন্থী গেরিলাদের জন্য অর্থ সংগ্রহের অভিযোগে মার্কেজকে এক দশক আমেরিকায় নিষিদ্ধ করা হয়েছিল । একবার তিনি আমেরিকার ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেছিলেন, এটি ল্যাটিন আমেরিকায় মার্কিন হস্তক্ষেপের একটি যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয় ।
একজন বাম ঘরানার বুদ্ধিজীবী হিসেবে খ্যাতি সত্ত্বেও সমালোচকরা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে, কলম্বিয়ার দীর্ঘ সংঘাতের সময় প্রায় দশ হাজার লোক নিহত হয়েছিল । মার্কেজ তাদের মধ্যে মধ্যস্থতার ভূমিকা রাখেন নি । উপরন্ত তিনি স্বদেশ ত্যাগ করে মেক্সিকোয় বসবাস করেছিলেন । সত্যিকার অর্থে তখন তাঁর প্রাণনাশের গুজব কিছু কলম্বিয়ানের কানে কানে ঘুরে বেড়াত ।
ধুমপানের প্রতি প্রবল আসক্তির কারনে ১৯৯৯ সালে তাঁর লসিকানালী ক্যান্সার ধরা পড়ে । ক্যামোথেরাপি চিকিৎসার মাধ্যমে সে যাত্রা তিনি রক্ষা পান । এই সময়ে তাঁর লেখালেখি ও ভ্রমণ সীমিত হয়ে পড়ে । ২০০২ সালে তাঁর আত্মজীবনী"Living to Tell the Tale” ১ম খন্ড প্রকাশের পর তাঁর পরিকল্পিত ২য় ও ৩য় খন্ড রচনায় আর হাত দিতে পারেন নি । ২০১২ সালের জুলাই থেকে তাঁর স্মৃতিশক্তি বিনষ্ট হতে থাকে । তাঁর সাম্প্রতিক কর্ম প্রথম দিককার উপন্যাসের মত তত সফলতা পায়নি । তাঁর এরকম একটি রচনা হচ্ছে "Love in the Time of Cholera”. এখানে তিনি তাঁর পিতার পঞ্চাশ বছরের প্রণয়লীলার গল্প বর্ণনা করেছে । মার্কেজের আরও একটি সাম্প্রতিক কাজ হচ্ছে , "Memories of My Melancholy Whores,". এটি প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে । এই স্বল্পদৈর্ঘ উপন্যাসে ৯০ বছরের এক অতিশীপর বৃদ্ধের ১৪ বছরের বালিকার প্রতি অনুরাগ কিছু কিছু পাঠকের মনে বিরক্তির উদ্রেক সৃষ্টি করেছিল । সংলাপবহুল গল্পের দিকে মার্কজের তেমন ঝোঁক দেখা যায় না । বর্ণনামূলক গল্প লিখতেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন । আর এখানে লেখকের ভূমিকা হয় সবজান্তার । দীর্ঘ ও জটিল বাক্যে তিনি অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন । মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে তিনি কাজ করেন না । তবে মানুষের আচরণ বর্ণনা করে চরিত্র রূপায়িত করেন । কখনও কখনও তাঁকে অতিশয়োক্তির আশ্রয় নিতে দেখা যায় ।
বই পড়া মার্কেজের অন্যতম নেশা । প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে তিনি প্রথমে বই পড়তেন । তারপর পড়তেন সংবাদপত্র । এরপর চার ঘণ্টা ধরে লিখতেন । কাউন্ট ড্রাকুলা ও গার্গানতুয়াগার্সিয়া ছিল তাঁর প্রিয় সাহিত্যিক চরিত্র । প্রিয় ঐতিহাসিক চরিত্র জুলিয়ো সিজার । তিনি ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে ভীষণ অপছন্দ করতেন । প্রিয় খাবারের তালিকায় ছিল ‘কানা অ লরাঞ্জ’। এটি একটি ফরাসি খাবার । যা কমলার সসে রান্না করা হাঁসের রোস্ট । হলুদ ছিল তাঁর প্রিয় রং । তিনি ঘুম থেকে উঠার পূর্বে তাঁর স্ত্রী লেখার টেবিলে একটি হলুদ গোলাপ রাখতেন ।