আমি মহাবিশ্বের এক বিস্ময়কর উল্কা ।
পাথুরে-ধাতব বস্তু যেটি গ্রহাণু ও ধূমকেতুর চূর্ণবিচূর্ণ অংশবিশেষ ।
কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে দুর্বার গতিতে ঝাঁক বেঁধে পৃথিবীর দিকে ধাবিত হই ।
বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সময় বাতাসে ঘর্ষণ ও রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে জ্বলে উঠি ।
নিজস্ব প্রভাব এবং উত্তাপের কারণে উজ্জ্বল আলোকচ্ছটা সৃষ্টি করি ।
তখন কেউ আমাকে বলে নক্ষত্র-খসা বা ছুটন্ত তারা বা উল্কাপাত ।
বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভেঙে প্রজ্জ্বলিত হওয়াকে কেউ বলে উল্কা বৃষ্টি বা উল্কা ঝড় ।
পৃথিবী, ধূমকেতু এবং মহাজাগতিক অন্যান্য উৎসের সাথে সংঘর্ষ বা বিস্ফোরণে সৃষ্ট ধ্বংসাবশেষ স্রোতকে কেউ বলে উল্কা ঝরনা ।
আবার কেউ বলে আকাশের সন্তান ।
একসময় আকাশেই জ্বলে ছাই হয়ে যাই ।
কদাচিৎ পিণ্ড আকারে পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠে আছড়ে পড়ি ।
আমাকে নিয়ে অনেক কুসংস্কার, ধর্মীয় বিশ্বাস, প্রাচীন লোককথা এবং পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে ।
সৌরজগৎ গঠনের পূর্বে বা প্রাথমিক সময়ে আমার জন্ম ।
হয়তো কোনো মহাবিস্ফোরণে ।
তবে কি আমি ভ্রুণগ্রহীয় চাকতি কিংবা ধ্বংস হওয়া গ্রহের অবশিষ্টাংশ?
৪৬০ কোটি বছর পূর্বে নীহারিকা বিস্ফোরণ থেকে এক দানবীয় আন্তঃনাক্ষত্রিক আণবিক মেঘের মহাকর্ষীয় পতনের ফলে সৌরজগতের উৎপত্তি ।
আমার আদি পূর্বপুরুষ সৌরজগৎ সৃষ্টির প্রাথমিক উপাদান বহন করে ।
এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ছায়াপথে অন্ধকারে নিমগ্ন জমাটবাঁধা ঠাণ্ডা নীহারিকার হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, প্লাসমা, বস্তুপুঞ্জ এবং ধূলিকণা মেঘের কিছু উপাদান মহাকর্ষের প্রবল টানে কেন্দ্রে ঘনীভূত হয়ে কেন্দ্রিকা তৈরি করে নক্ষত্রের জন্ম হয় ।
কোটি কোটি বছর ধরে জ্বলে-পুড়ে নিঃশেষ হয়ে নক্ষত্রটির অভ্যন্তরভাগে প্রচণ্ড অন্তস্ফোটন বা অতিনবতারা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে একসময় মৃত্যু ঘটে ।
অতিনবতারা মহাবিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী আলোক বিচ্ছুরনকারী বিস্ফোরণ এবং এ দানবীয় নাক্ষত্রিক বিস্ফোরণের সময় মহাকাশে ধ্বংসপ্রাপ্ত নক্ষত্রটি পুরো ছায়াপথের চেয়েও সর্বাধিক উজ্জ্বল হয়ে প্রচুর পরিমাণে শক্তি, তীব্র আলোক বিকিরণ, ধ্বংসাবশেষ, ভারী মৌল কণা, পি-নিউক্লিয়াস আইসোটোপ, অতি উচ্চশক্তির মহাজাগতিক তেজস্ক্রিয় রশ্মি, গ্যাস-ধূলিকণা মেঘের সৃষ্টি করে পুনর্জন্ম দেয় এক একটি নতুন প্রজন্মের নিউট্রন নক্ষত্র, পালসার নক্ষত্র, গ্রহ, শীতল নীহারিকা, কৃষ্ণগহ্বর ও আমাকে ।
কোনো এক সময় জটিল প্রক্রিয়ার মাঝে একটি নক্ষত্রের চতুর্দিকে পরিভ্রমণ করি ।
অথবা কোনো দানব গ্রহকে ঘিরে ।
আমি প্রাণ-অস্তিত্বের প্রাচীনতম কঠিন পাথর বা মহাজাগতিক বস্তু বা সৌরজাগতিক বস্তু ।
অঙ্গারময়, শিলা, কন্ড্রুল এবং ধাতু সমৃদ্ধ ।
আমার আদি পিতৃপুরুষের উপাদান সিলিকন কার্বাইড (কার্বোরান্ডাম) কণার বয়স প্রায় ৭০০ কোটি বছর ।
যেখানে পৃথিবীর বয়স ৪৫৪ কোটি বছর অতিক্রম করেছে ।
এমনকি সৌরজগতের বয়সের চেয়েও বেশি ।
আমার পিতৃপিতামহগণ এ পৃথিবীতে পতনের ফলে প্রাণের উদ্ভবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন ।
হলুদ, কমলা-হলুদ, নীলচে-সবুজ, বেগুনী, কালো এবং লাল রঙ ধারণ করে মহাজাগতিক সৌন্দর্য প্রকাশ করি ।
গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ও ধূমকেতুর কণা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মহাকাশে ধেয়ে যাই তীব্র গতিতে দোর্দণ্ড প্রতাপে ।
কখনো গ্রহ, মহাজাগতিক বস্তু এবং স্ব-জাতির সাথে আকস্মিক সংঘর্ষ ঘটে ।
ডেকে আনি ভয়ঙ্কর মহাবিপর্যয় ।
নক্ষত্র, গ্রহাণু, ধূমকেতু ছাড়াও সম্ভবত অন্য কোনো গ্রহ-উপগ্রহ থেকে উদ্ভূত হয়ে পৃথিবীতে এসে সেই গ্রহের গঠন, উৎপত্তি, বিবর্তন এবং জীবনের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিচিত্র ইঙ্গিত প্রদান করি ।
আদিম বৃহৎ গ্রহের ভ্রূণ থিয়া'র সাথে পৃথিবীর সংঘর্ষের ফলে পৃথিবী ভেঙ্গে তার টুকরো থেকেই সৃষ্টি হয় চাঁদ ।
প্রায় সাড়ে ৬ কোটি বছর পূর্বে আমার বিধ্বংসী আঘাতে ডাইনোসর জাতি পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায় ।
তবে কেউ কেউ বলেন সেই মুহূর্তে জলবায়ু পরিবর্তন ও অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে এটি ঘটেছিল ।
সুতরাং আমি আজ কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন ।
অষ্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া রাজ্যের মার্চিসন গ্রামে ২৮শে সেপ্টেম্বর ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে মার্চিসন উল্কাপিণ্ডের খণ্ডাংশ পতিত হয় ।
সৌরজগৎ গঠনের প্রাথমিক সময়ে তার আবির্ভাব ।
এ গ্রহের মানুষ দেখেছে ভয়াবহ ধ্বংসলীলার ভীবৎস রূপ ।
কখনো আমাকে গ্রহাণু বা ক্ষুদ্র বামন গ্রহও বলা হয় ।
আমি পারমাণবিক বোমার চেয়েও ভয়ানক শক্তিশালী হওয়ার কারণে বৃহদাকার গর্ত, অগ্নিকাণ্ড, উচ্চ তাপমাত্রা, ধূলিঝড় ও প্রবল অভিঘাত-তরঙ্গের সৃষ্টি করি ।
সমস্ত ধ্বংসাবশেষকে বায়ুমণ্ডলে প্রেরণ করে সূর্যরশ্মি গ্রহে আসতে বাঁধা দেই এবং সম্পূর্ণ গ্রহে এর প্রভাব ফেলি ।
সৌরজগতে অগণিত গ্রহাণুর মধ্যে সবচেয়ে বৃহত্তম ২০০১ কেএক্স৭৬ গ্রহাণুটি ছাড়াও আরো কয়েকটি বড় গ্রহাণু হচ্ছে সেরেস, ভেস্টা, প্যালাস, হাইজিয়া, ডেভিডা এবং ট্রোজান ।
গ্রহাণু বলয়ের একমাত্র বামন গ্রহ বা সেরেস ফার্দিনান্দিয়া গ্রহাণুসহ অন্যরাও সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে ।
কয়েকটি প্রকাণ্ড গ্রহাণুর চাঁদ রয়েছে ।
যদি কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়া ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টিকারী বিশাল কোনো গ্রহাণু বা আমার আগ্রাসী আঘাতে কিংবা সৌরজগতের সর্ববৃহৎ গ্যাসীয় দৈত্য বৃহস্পতি গ্রহের মহাকর্ষ বলের ক্ষিপ্র প্রভাবে পৃথিবী কক্ষচ্যুত হয়ে পড়ে তবে এর পরিণতি কি হবে, মানবজাতি টিকবে তো?
হয়তো আধুনিক বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় পৃথিবীমুখী আসন্ন দৈত্যাকার গ্রহাণু বা আমার গতিপথকে পরিবর্তন করা যেতে পারে ।
তবুও পৃথিবীবাসী শঙ্কিত!
শেষ রক্ষা হবে কি?
কারণ, আমি চরম নৃশংস ও বিনাশী ।
--------------------------------------
* তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, আন্তর্জাল ।