(বি. দ্রঃ নিচে কবিতার টীকা দেয়া আছে।)

নারী

এসে একবিংশ শতাব্দীতে –
কেন হে অন্ধ নর ফেল ঠেলে নারীরে পশ্চাতে?
এক পদ বেঁধে রাখিলে খঞ্জ কতদূর হেঁটে পারে?
অর্ধ-অঙ্গ ধরণীর! – ওরা বিনে সে থুবড়ে পড়ে!
অবলা নহে ক দুর্বলা, আজ রাখিয়াছে অবদান –
কর্মক্ষেত্রে, মেধা-বুদ্ধিতে হয়ে পুরুষের সমান।
নিঃসীম নভে অসীম সাহসে মঙ্গলে ছুটে চলে,
ডুবুরী হইয়া ডুব মারিয়াছে অতল-সিন্ধু-তলে।
সেনাপতি-সাজে ব্যূহ রচিয়াছে যুদ্ধের ময়দানে,
সীসার প্রাচীর! - পরাস্ত করে ঝঞ্ঝা-আঘাত হেনে!

অন্ধের দল কহে –
বীরত্ব নাকি শুধু পুরুষের? নারীর জন্য নহে।
তিমির ফ্রান্সে মধ্যগগনে উদিত হইল বালার্ক,
শৃঙ্খল ভেঙে ধ্বজা লয়ে ছোটে জোয়ান অব দ্য আর্ক!
মেইবান্দের মালালাই ছোটে শত্রুর ব্যূহ ভেদে,
বীর মুসলিম লজ্জায় মরে ছুটিয়াছে তাঁর পথে।
উম্মে আমারা প্রাণ বাজি রেখে বাঁচায়েছে নবী-প্রাণ,
ভণ্ড নবী ও মুসাইলামারে পাঠাল জাহান্নাম!
শত সহস্র বীর পুরুষের পাহাড়-দম্ভ নাশি' -
সত্যের জয় লিখিয়াছে ইতিহাসে খাওলার অসি!
হুঙ্কারে দিল হামিদা কাঁপায়ে তৈমুর দরবার,
যুগে যুগে নারী গুণে গরিমায় ছাড়ায়ে গিয়াছে নর!

জ্ঞানী নাকি নহে? নির্বোধ ওরা? – জানো তুমি অজ্ঞান? –
মেরিকুরীর ঐ রেডিয়ামে বাঁচে নিখিল-বিশ্ব-প্রাণ!

নর তো লভেছে তৃপ্তি কেবলি নারীর পার্শ্বে শুয়ে,
মহৎমানবে জনম দিল সে নারীই বেদনা সয়ে!
ভীম, অর্জুন, গৌতম, নবী মোহাম্মদ, যিশু –
এসেছিল হয়ে ভীত-কম্পিত মাতৃক্রোড়ের শিশু,
বিশ্ব ব্যাপিয়া সত্যের আলো ছড়াল যাতনা সয়ে,
আঁধার গিয়াছে টুটিয়া, পড়েছে শয়তান-শির নুয়ে।
প্রবল চরণ-আঘাতে উহারা পাপের ধরণী কাঁপায়,
অত্যাচারীর তখত-প্রাসাদ দিয়াছে মিশায়ে ধুলায়!
পূত-পবিত্র শান্তির দূত এসব মহামানবে –
গর্ভে না নিলে বিশ্ব মরিত পাপ-পঙ্কিলে ডুবে।
গর্বে মরেছ? – অক্ষম নর! বল দেখি আজ ভেবে –
গর্ভে ধরেছ কবে বল তুমি কোন মহৎমানবে?
ধূ ধূ মরু মাঝে ইসমাঈলেরে ত্যজিয়াছে তার পিতা,
শিশু পালে একা ত্যাগের মূর্ত প্রতীক হাজেরা মাতা।
নারীই করিল 'মানুষ' পুরুষে প্রেম-মমতায় ঘিরে,
তাই নর শেখে ভালবাসিতে সে স্রষ্টার সৃষ্টিরে।
যত বড় বড় বিজয় ছিনিয়ে আনে নর অভিযানে,
সেই বিজয়ের সাহসের শিখা নারী জ্বালে তার প্রাণে!
হতাশা-ন্যুব্জ নরের জীবনে আশার আলো জ্বেলে যায়,
নারী বিনে নর বিরূপ বিশ্বে চিরকাল অসহায়।
ত্যাগ-তিতিক্ষা, প্রেম-মমতার শুধিল পুরুষ ঋণ -
যুগযুগান্ত রেখে 'নারী' গৃহ-কারায় অন্তরীণ!

অলস পুরুষ ভাবে –
দাসী-সম নারী খাটিয়া মরিবে, ওরা বসে বসে খাবে,
পা'র পর পা তুলে ওরা যায় রাজা-মহারাজা বনে,
ভাবে – “মোহরানা দিয়ে চাকরানী আনিয়াছি ঘরে কিনে।“
ক্লান্ত-শ্রান্ত রাসূল আমার মার খেয়ে পথেঘাটে –
ফিরে এসে দেখে বিবি আয়েশায় মরে পাকঘরে খেটে।
ঘরকন্নার কাজ করে নবী, আয়েশারে পাশে লয়ে,
এরা বোধহয় খোদার রাসূলে ভেবে বসে আছে 'মেয়ে'!

অন্ধকারের যুগে -
পুরুষ-যমের রচা কারাগারে নারীরা মরিত ভুগে!
সত্যের যুগ, সাম্যের যুগ, পীড়িতের যুগ আজি -
নারী রবে না ক' পুরুষের দাসী - উঠিছে ডঙ্কা বাজি!
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী এই যুগে কারাগারে,
পঁচিয়া মরিবে অদূর ভবিষ্যতে সে কারায় নরে!

                                   জেনো সে কালের ক্রোধ -
জুলুম করিলে সে জুলুম এসে নেবে নেবে প্রতিশোধ!

বন্ধু! একটা গল্প বলি! –
তারাভরা রাতে বেহেশত হতে পড়িছে জ্যোৎস্না গলি'!
“জোরে দৌড়ায় কেবা?” – নবী বলে প্রিয়া আয়েশারে ডেকে,
আয়েশারে ফেলে পশ্চাতে, নবী ছোটে বাতাসের বেগে।
পরদিন শোনো বন্ধু! যে নবী রোকনারে দেয় ফেলে –
নাচিতে নাচিতে আয়েশায় কিনা তাঁরে ফেলে ছুটে চলে।
দৌড় শেষে নবী ফিরিয়া আসিয়া আয়েশার হাত ধরে,
পবিত্র চোখে ঝরনার সম ভালবাসা পড়ে ঝরে।
পতির কণ্ঠ জড়ায়ে ধরিল আয়েশা গভীর প্রেমে,
ভাস্কর-ক্রোড়ে বসিল চন্দ্র ঊর্ধ্ব হইতে নেমে!
কোল আলোকিত করে কহে চাঁদ, কিরণ ছড়িয়ে হেসে –
“বুঝেছি কেন গো দৌড়াওনি ক' গতরাত্রের জোশে!
তুমি ভালবাসো মোরে প্রিয়তম! তাই জেতানোর তরে –
দৌড়াওনি ক', তব পবিত্র কদম ফেলেছ ধীরে!”
এমন রোমান্স দেখায়েছে কোন প্রিয়, প্রেয়সীরে, বল্?
আজিকার যুগে কাপলেরা চেনে শরীর, অর্থবল!
আজ চেয়ে দেখি মর্ডার্ণ ঐ মোল্লারা পথ চলে –
আগে আগে, নারী পশ্চাতে, - হায়! ওরা তো দাসীর দলে!
যেই দেশে নারী বন্দিনী হয়ে পুরুষের দাসী রয়,
সেই দেশে পুরুষ ভীরু কাপুরষ, সদা লাঞ্ছিত হয়।
অভিশপ্ত এ পৃথিবী আজিও শৌর্য-শক্তিহীন,
শোধ করেনি সে আত্মত্যাগী ও সেবিকা নারীর ঋণ।
নারীর মহিমা-ত্যাগে যেই জাতি করেছে অসম্মান,
তকদিরে সেই জাতির জুটেছে অশেষ অকল্যাণ!
সাম্য-শান্তি চিরকল্যাণী নারীর প্রেমের টানে -
স্বর্গের পথ বেয়ে পাপে-ভরা ধরায় আসে গো নেমে!
আজো এ ধরায় নারীর প্রেমে পাখি গাহে, ফুল ফোটে,
সালাম করিতে তাঁর মহিমায় নিতি রবি-শশী ওঠে!

এইবার! এই বেলা ওঠ নারী, বিদ্রোহিণীর রূপে!
কাঁপাইয়া তোল ভূলোক, দ্যুলোক গর্জিয়া ভীম রবে!
দাসত্বের ঐ শৃঙ্খল ভেঙে আয় রে এবার রণে,
পুরুষ-অসুরে মেরে কেটে ফেল দেবী দুর্গার বাণে!
কণ্ঠে পেঁচায়ে ফাঁস দেয় তোরে পরনের ওড়না খুলে,
বাসুকির নাগপাশে মার্! – বেঁধে ফাঁস পশুদের গলে!
মুক্তি-ডঙ্কা বাজে দিকে দিকে - সুদিন আসিছে ফিরে,
নারী র'বে না'ক বন্দিনী আর পুরুষের কারাগারে।
বন্দী হল সে প্রকৃতির রাণী যেদিন গৃহকোণে,
সেইদিন হতে বিশ্বভুবনে আঁধার আসিল নেমে।
তামাম মানবজাতির ভাগ্যে পাপ-কলঙ্ক লাগে,
পাপ-সিন্ধুর অতলে বিশ্ব মরে যাতনায় ভুগে!
ভেঙে ফেল আজ পুরুষ যমের যমপুরী লাথি মেরে,
শৃঙ্খল ভেঙে আলোর বন্যা বহাও বিশ্বজুড়ে!


নিদ্রা ভেঙেছে নারী!
রুখিবে বুকের খুনে বিশ্বের তামাম অত্যাচারী!
নব প্রভাতের অরুণ উদিবে ঐ খুনে আজ রাঙি,
নিখিল বিশ্বে আনিবে এবার সাম্য-শান্তি-বাণী!

(বি.দ্র.

টীকাঃ

*) “আঁধার ফ্রান্সে মধ্যগগনে উদিত……….জোয়ান অব দ্য আর্ক”-
জোয়ান অব আর্ক। জন্ম ৬ই জানুয়ারি ১৪১২ সাল।
পরাধীন ফ্রান্সের মুক্তিদাত্রী বীরকন্যা এবং রূপকথাতুল্য নেত্রী।
জোয়ান অব আর্ক ছিলেন এক দরিদ্র কৃষক পরিবারের কন্যা। জোয়ান যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন ফ্রান্স ইংরেজদের শাসনাধীন ছিল। ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম হেনরির পুত্র ষষ্ঠ হেনরি ফ্রান্সের বৈধ রাজা ৭ম চার্লসকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উৎখাত করলে ফ্রান্সের রাজা পালিয়ে যান।
জোয়ান লেখাপড়া জানতেন না। কথিত আছে মাত্র ১৩ বছর বয়সে মাঠে ভেড়ার পাল চরাবার সময়ে তিনি দৈববাণী শুনতে পান যে তাকে মাতৃভূমির স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার ও ফ্রান্সের প্রকৃত রাজা রাজাকে ক্ষমতায় পুনর্বহাল করার জন্য প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে।
এরপর জোয়ান অনেক চেষ্টা করে ফ্রান্সের পলাতক রাজা সপ্তম চার্লসের সাথে দেখা করেন এবং দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য নিজের জীবনবাজি রেখে সংগ্রাম করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। রাজা প্রথম দিকে রাজি না হলেও জোয়ানের দৃঢ়তা দেখে তাঁর সৈন্যসামন্তের পরামর্শ অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত রাজি হন।
এরপর জোয়ান প্রায় চার হাজার সৈন্য নিয়ে ১৪২৯ সালের ২৮শে এপ্রিল  অবরুদ্ধ নগরী অরলেয়াঁয় প্রবেশ করেন। এরপর একের পর এক অঞ্চল তাঁর পদানত হতে থাকে। জুন মাসে অধিকার করেন রীঈঁ নগরী।
ইংরেজরা তাঁর একের পর এক দুঃসাহসী আক্রমণের সামনে টিকতে না পেরে এক পর্যায়ে ফ্রান্স ছেড়ে চলে যায়। অবসান ঘটে শতবর্ষ ব্যাপী যুদ্ধের।
ফ্রান্সের স্বাধীনতার পর ইংরেজরা জোয়ানকে জব্দ করার ফন্দি আঁটতে থাকে। জোয়ান তখন ক্যাস্পিয়ান শহরের বহির্ভাগে অবশিষ্ট ইংরেজ সৈন্য হটাতে ব্যস্ত। এসময়ে ফ্রান্সের রাজনৈতিক দল বার্গেন্ডি কর্মীরা বিশ্বাসঘাতকতা করে জোয়ানকে আটক করে ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়। এরপর এক ইংরেজ পাদ্রীর অধীনে তাঁর বিচারকার্য চলে। বিচারে পাদ্রী জোয়ানের কর্মকাণ্ডকে ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে ডাইনি সাব্যস্ত করে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দেন। এই নির্দেশানুসারে ১৪৩১ খ্রিস্টাব্দে জোয়ানকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।

*) মেইবান্দের মালালাই ছোটে………তার পথে –
মালালাই আফগানিস্তানের এক জাতীয় বীরাঙ্গনার নাম। আফগানিস্তানে ব্রিটিশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
সময়টা ১৮৮০ সন। কান্দাহারে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আফগান মুজাহিদদের তীব্র সংগ্রাম চলছে।
দরিদ্র মেষপালকের মেয়ে ছিলেন মালালাই। তিনি তখন কিশোরী। ব্রিটিশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে হাজার হাজার আফগানের সঙ্গে তার বাবা এবং হবু স্বামী দুজনই লড়াই করছিলেন।  
আহত যোদ্ধাদের সেবা এবং লড়াইরত যোদ্ধাদের পানি সরবরাহ করতে অন্য নারীদের সাথে মালালাইও গ্রাম থেকে যুদ্ধের ময়দানে ছুটে যান। মালালাই দেখলেন তার পক্ষের লোকজন হেরে যাচ্ছে। ঝাণ্ডাবাহককে পড়ে যেতে দেখে তিনি ছুটে গেলেন। মাথার সাদা ঘোমটা খুলে ঝাণ্ডার মত উঁচু করে অগ্রগামী সেনাদলের সামনে চলে এলেন।
চিৎকার করে বলে উঠলেন – “তরুণ সাথীরা! মেইবান্দের এই রণক্ষেত্রে যদি তোমরা শহিদ না হও, আল্লার কসম! ধরে নাও কেউ তোমাদের লজ্জা ও অপমানের দৃষ্টান্ত হিসেবে বাঁচিয়ে দিচ্ছে।“
কিছুক্ষণের মধ্যেই শত্রুপক্ষের গুলিতে মালালাই নিহত হন। কিন্তু মৃত্যুর আগে তাঁর দেয়া বক্তব্য এবং অসীম সাহসিকতা প্রায় হেরে যাওয়া সেনাদের আবার শত্রুপক্ষের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা দেয়। তারা বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর পুরো একটি ব্রিগেড ধ্বংস করে দেয়। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ইতিহাসে এটা ছিল ঘোরতর পরাজয়।
ওই বিজয়ে আফগানরা এতটাই গর্বিত হয়েছিল যে সর্বশেষ আফগান বাদশাহ কাবুলের প্রাণকেন্দ্রে মেইবান্দ বিজয়ের স্মারক ভাস্কর্য স্থাপন করেছিলেন।

*) “উম্মে আমারা প্রাণবাজি……..পাঠাল জাহান্নাম” –
উহুদের যুদ্ধে যখন মুসলমানেরা বিজয় অর্জিত হয়েছে ভেবে নবীজির নির্দেশ অমান্য করে নিজ নিজ স্থান ত্যাগ করে গণিমতের মাল কুড়ানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তখন কাফেররা এসে অতর্কিতে মুসলমানদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঠিক ঐ সময়ে আল্লার রাসূলকে রক্ষার জন্য উম্মে আমারা ঢাল হয়ে কাফেরদের সামনে এসে দাঁড়ান। প্রাণবাজি রেখে আল্লার রাসূলকে রক্ষা করেন।
যুদ্ধ শেষে মুসলমানদের বিজয় অর্জনের পর উম্মে আমারাকে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায়। সাহাবারা সেবা-শুশ্রূষা করে তার জ্ঞান ফেরান। জ্ঞান ফেরার পর তাঁর মুখে সর্বপ্রথম যে কথাটি উচ্চারিত হয় তা হল –“রাসূল(স) জীবিত আছেন তো?
আল্লাহর রাসূল ওহুদের যুদ্ধে তার শৌর্যবীর্যে মুগ্ধ হয়ে উপাধি দিয়েছিলেন 'খাতুনে উহুদ' বা উহুদের নারী।
এই উম্মে আমারা পরবর্তীতে রাসূল (স) এর মৃত্যুর পর ভণ্ড নবীর দাবিদার মুসাইলামাতুল কাজ্জাবকে হত্যায় সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।

*) খাওলা - খাওলাহ বিনতে আল-আজওয়ার ছিলেন মুহাম্মদ সাঃ এর সময়কার একজন প্রসিদ্ধ নারী এবং একজন সামরিক নেত্রী। তাকে ইতিহাসের অন্যতম সেরা যোদ্ধা হিসেবে বর্ণনা করা হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে বিরোধীপক্ষ তাকে খালিদ বিন ওয়ালিদ এর সাথে তুলনা করতো। তিনি জিরার বিন আল-আযওয়ারের বোন ছিলেন যিনি রাশিদুন সেনাবাহিনীর সৈন্য ও কমান্ডার ছিলেন। খাওলাহ তার ভাইয়ের সাথে অনেক যুদ্ধে পাশাপাশি যুদ্ধ করেছেন। এরমধ্যে আছে ৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দে বাইজানটাইন সম্রাটের বিপক্ষে সংঘটিত ইয়ারমুকের যুদ্ধ। যুদ্ধের চতুর্থ দিনে খাওলাহ একদল নারীকে নিয়ে বাইজান্টাইন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রধান কমান্ডারকে পরাস্ত করেন।
তার সাহসিকতা প্রথম প্রকাশিত হয় ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত দামাস্কাস দখলের যুদ্ধ সানিতা আল-উকাবের যুদ্ধে। তার ভাই জিরার এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তিনি বাইজানটাইনদের হাতে আহত অবস্থায় বন্দী হন। খালিদ ইবনে ওয়ালিদ তার বাহিনী নিয়ে তাকে উদ্ধার করতে বের হন৷ খাওলাহ তাদের সঙ্গী হন। সে একাই বাইজান্টাইনদের সম্মুখ বাহিনীর দিকে একাই ছুটে যান। তার বর্ম এবং আরবীয় ঢিলেঢালা পোষাকের কারণে তাকে কেউ নারী হিসেবে চিনতে পারেনি। খালিদ তার পরিচয় জিজ্ঞেস করার পরে জানা যায়। আদনাজিনের যুদ্ধে খাওলাহ আহত সৈনিকদের শুশ্রূষা করার উদ্দেশ্যে মুসলিম বাহিনীর পক্ষ নেয়।
বাইজান্টাইনদের হাতে জিরার বন্দী হওয়ার পরে খাওলাহ যোদ্ধার বর্ম, অস্ত্র নিয়ে একটা ঘোটকীর পিঠে নিজেকে সবুজ শালে মুড়ে নেন। সে বাইজানটাইন সৈন্যদের উপরে ঝাপিয়ে পড়ে। মুসলিম সৈন্যদের অনেকে খাওলাহকে খালিদ ভেবে ভুল করে। মুসলিম বাহিনীর হাতে বাইজানটাইন বাহিনী পরাস্থ হয়। রক্তাক্ত অবস্থায় খালিদ খাওলাহকে খুজে পায়। খালিদ খাওলাহকে মুখের আবরণ সরাতে বলেন। কয়েকবার বিরোধিতা করে খাওলাহ শেষ পর্যন্ত তার পরিচয় দেয়। খালিদ তার বাহিনীকে পলায়নরত বাইজানটাইন বাহিনীকে আক্রমনের আদেশ দেন। খাওলাহ সেই বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। তারা বন্দীদের মুক্ত করেন। রাশিদুন সেনাবাহিনীর একজন অধিনায়ক শুরাহবিল ইবনে হাসসানা তার সম্পর্কে বলেনঃ

“ এই যোদ্ধা খালিদ বিন ওয়ালিদের মতো লড়ছিলো কিন্তু আমি নিশ্চিত সে খালিদ না। ”

অন্য এক যুদ্ধে খাওলাহ তার ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যাওয়ায় বন্দী হন। তাকে নারী বন্দীদের সাথে সেনা ছাউনিতে নিয়ে যাওয়া হয়। খাওলাহকে দলপতির তাবুতে নিয়ে যাওয়া হয়। দলপতি যখন তাকে ধর্ষণের উপক্রম করে তখন খাওলাহ অন্য বন্দীদের উদ্বুদ্ধ করেন। তারা তাবুর খুটি উপড়ে তাই দিয়ে বাইজানটাইন সৈন্যদের আক্রমণ করে। আল ওয়াকিদির মতে, তারা ত্রিশজন বাইজানটাইন সেনাকে হত্যা করে। খাওলাহ একাই পাঁচ জনকে হত্যা করে।

*) “হুঙ্কারে দিল হামিদা কাঁপায়ে তৈমুর দরবার” –
১৩৮০ সন। তাইমুর লং এর দুর্ধর্ষ তাতার বাহিনী ধ্বংসের বিষাণ বাজিয়ে এগিয়ে চলেছে সামনে। তুর্কী সুলতান বায়েজিদ সে তাতার বাহিনীর ঘূর্ণিঝড়কে সিংহ বিক্রমে বাধা দান করলেন। তুরষ্কের রণক্ষেত্রে রক্তের নদী বইল। কিন্তু সুলতান অবশেষে পরাজয় বরণ করলেন। অনেক তুর্কী সৈন্য ও সেনানায়ক বন্দী হল। নিষ্ঠুর তাইমুর তাদের নির্বিচারে প্রাণদণ্ড দিতে লাগলেন। একজন তরুন সেনানী রূখে দাঁড়াল এই অবিচারের বিরুদ্ধে। সে তাইমুরের সাক্ষাত প্রার্থনা করল। শিকলে বেঁধে সে বন্দীকে তাইমুর সমীপে আনা হল। বিশ্বজয়ী তাইমুরের সামনে গর্বোন্নত শিরে দাঁড়িয়ে সে তরুন সৈনিক বলল, “সম্রাট তাইমুর, আপনি অন্যায়ভাবে সুলতান বায়েজিদকে আক্রমণ করে হাজার হাজার আল্লাহর বান্দাকে হত্যা করেছেন, মুসলমানা হয়ে আপনি ইসলামের অনুগত সেবকদের হত্যা করছেন। বিশ্ব জয়ের অন্যায় ও গর্বিত দাবির জন্যেই শুধু এসব অন্যায় ও গর্হিত কাজ করছেন। কিন্তু মনে রাখবেন আপনাকেও একদিন সকল রাজার রাজা আল্লাহর সামনে হাজির হতে হবে, তখন এসব কাজের কি জওয়াবদিহি আপনি করবেন?”
তরুণ সৈনিকের এ কথা শুনে বিমূঢ় গোটা দরবার। এভাবে পৃথিবীর কেউ যে তাইমুরের সামনে কথা বলতে পারে, আল্লাহর রাজ্যে যে এমন লোকও আছে, দরবার আজই যেন তা বুঝল, বুঝে সন্ত্রস্ত হলো। ভাবল তারা, না জানি এই তরুণের ভাগ্যে কি উৎপীড়ণ আছে।
তরুণ বন্দী মুহূর্তের জন্য একটু থেমেছিল। তারপর মন্ত্রমুগ্ধ দরবারের সামনে এক ঝটকায় মাথার শিরস্ত্রাণ খুলে ফেলল। একরাশ সুন্দর কেশগুচ্ছ প্রকাশ হয়ে পড়ল- সুন্দর মসৃন একরাশ নারীকেশ। বিশ্ব জয়ী তাইমুরও এবার বিস্মিত। বন্দিনী আবার বলতে লাগল, “চেয়ে দেখুন, আমি একজন অন্তঃপুরবাসিনী নারী। বতু অন্যায়-অবিচারের প্রতিরোধের জন্য অস্ত্র হাতে ধরতে হয়েছে, রক্তের নদীতে সাঁতার কাটতে হয়ে। আপনি আপাততঃ জয়ী হয়েছেন, কিন্তু মনে রাখবেন, যে জাতি এ ধরণের মানসিকতায় উজ্জীবিত, তাকে পদানত রাখা যায় না, ধ্বংস করা যায় না।”
বিশ্বজয়ী তাইমুরের শির নুইয়ে পড়ল। তিনি মুক্তি দিলেন বায়েজিদ তনয়া হামিদা বানুকে। হামিদা বানুর অনলবর্ষী উক্তি এবং তাঁর সাথে তাইমুরের পরিচয় তাইমুরের জীবনে আনল অভূতপূর্ব পরিবর্তন। ধ্বংসের হাত তাঁর জাতি গড়ার কাজে ব্রতী হলো।

*) “মেরিকুরীর ঐ রেডিয়ামে বাঁচে নিখিল বিশ্ব প্রাণ” –
বিজ্ঞানী মেরিকুরী। রেডিয়াম আবিষ্কারক। ক্যান্সার কোষ ধ্বংসে রেডিয়াম ব্যবহৃত হয়।

*) ভীম, অর্জুন – মহাভারতোক্ত বীর। কুন্তির পুত্র। এরা ছিল পাঁচ ভাই- ভীম, অর্জুন, যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব। এরা মহাভারতে পঞ্চপাণ্ডব বলে খ্যাত।
এদের পিতা ছিলেন রাজা পাণ্ডুর। পাণ্ডুর মৃত্যুর পর এদের চাচাত ভাই কৌরবরা তাদেরকে অন্যায়ভাবে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করে। পরবর্তীতে তাদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যার চেষ্টা করলে কুরুক্ষেত্রে পঞ্চপাণ্ডব ও কৈরবদের মধ্যে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পঞ্চপাণ্ডবরা জয়লাভ করেন।

*) গৌতম- বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ।

*) যীশু- খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক যিশুখ্রিস্ট।

*) রোকনা- আরবের বিখ্যাত রোকনা পালোয়ান।
নবী করিম (স) যখন মক্কায় দ্বীনের দাওয়াতের কাজ শুরু করেছেন, তখন আরবের এই বিখ্যাত পালোয়ান একদিন রাসূল (স)-কে এসে বলে যে আজ পর্যন্ত তাকে কেউ কুস্তিতে হারাতে পারেনি। এখন যদি মহানবী (স) যদি তাকে কুস্তিতে হারাতে পারেন, তবেই সে তাকে দ্বীনের নবী হিসেনে স্বীকার করে নেবে। এবং কালেমা পড়ে মুসলমান হবে।
নবী (স) রাজী হলেন।
কুস্তি শুরু হল।
পরপর তিনবার রোকনাকে মাটিতে ফেলে রাসূল(স) পরাজিত করলেন।
রোকনা পালোয়ান হতভম্ব৷
তার মত অপরাজেয় কুস্তিগিরকে কিনা মুহাম্মাদের মত শীর্ণকায় মানুষ পরাজিত করল!
বিস্ময়ের সীমা রইল না তার।
অতঃপর নবী করিম (স) তাকে শর্তের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে দ্বীনের দাওয়াত দিলেন।
কিন্তু রোকনা পালোয়ানের অহংবোধে লাগিল।
সে বুঝতে পারল মুহাম্মদ (স) সত্য নবী।
কিন্তু সে তার অহংকারের কারণে শেষপর্যন্ত সত্য দ্বীনের দাওয়াত গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাল।
ইসলামের সুশীতল ছায়া থেকে চিরতরে বঞ্চিত হল হতভাগা রোকনা পালোয়ান।

*) “পরদিন শোনো বন্ধু! যে নবী রোকনারে দেয় ফেলে” –
এই উক্তিতে রাসূল (স) এর শক্তিমত্তার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।

*) “ভাস্কর-ক্রোড়ে বসিল চন্দ্র ঊর্ধ্ব হইতে নেমে!
কোল আলোকিত করে কহে চাঁদ, কিরণ ছড়িয়ে হেসে” –
এখানে ভাস্কর হচ্ছেন রাসূল (স)। আর চন্দ্র হচ্ছেন হযরত আয়েশা (রা)।
কেননা রাসূল (স) ছিলেন দ্বীনের সূর্য। আর তাঁর স্ত্রীরা ছিলেন সেই সূর্যের আলোয় আলোকিত চাঁদ।

*) রাবণ – হিন্দু পুরণোক্ত রাক্ষসরাজ 'রাবণ', যাকে রাম পরাজিত করেন।
এখানে রাবণের সেনা বলতে নারী নির্যাতনকারীদেরকে বুঝানো হয়েছে।

*) বাসুকি – পুরাণোক্ত নাগরাজ (সর্পরাজ), যার নাগপাশ অত্যন্ত দৃঢ় বলে পুরাণে কথিত আছে। কথিত আছে, সমুদ্রমন্থনকালে নাগরাজ বাসুকিকে দেবতারা মন্থন-রজ্জুরূপে ব্যবহার করেন।)