আদিকাল হতে বাস এ পাহাড়ে আমরা সে আদিবাসী,
পাহাড়ের কোল জন্মভূমিরে মা'র সম ভালবাসি।
কেটেছে এ কোলে কত মধুময় শৈশব-কৈশোর,
প্রাণাধিক ভালবাসি এ জন্মভূমি – এ মায়ের ক্রোড়।
হেথায় পাহাড়, নদনদী, বন-বনানী, ঝর্ণাধারা –
শৈশবের সে পাঠশালা, মাঠ – মায়াময় স্মৃতিঘেরা!
কত সে হাসি ও কান্না কিংবা সুখ-দুঃখের স্মৃতি
মিশিয়া রয়েছে আকাশে-বাতাসে; কত বন্ধন-প্রীতি –
ছড়িয়ে রয়েছে এক মা'র কোলে – মোরা তাঁর সন্তান,
মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নাহি – নাহি কোনো ব্যবধান!
ভালবাসি কত মাতৃভূমির বায়ু, তরুলতা, মাটি,
আইনের প্যাঁচ বুঝিনে, বুঝি এ মাটি সোনা হতে খাঁটি।
বুঝি এ জন্মভূমির সাথে আজন্ম নাড়ির টান,
শেষ নি:শ্বাস ফেলিব কোলে, এ মাতা সে মোদের প্রাণ!
অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে স্বাধীন করেছি দেশ-মাতায়,
জন্মভূমিতে পরিবাসী! – মানবতা মরে লজ্জায়!
ঝঞ্ঝা-তুফান, দুর্ভিক্ষ, খরা, শ্বাপদের সনে লড়ে –
যুগ যুগ ধরে আবাসযোগ্য করেছি মায়ের ক্রোড়ে।
পেরিয়ে এসেছি মোরা কত খুনে রাঙা সংগ্রামী পথ,
লঙ্ঘিতে হবে আরো দুর্গম গিরি-মরু-পর্বত!
মৃত্যুরে ভয় করি নে, মৃত্যু বন্ধু মোদের কাছে,
খুঁজে ফেরে বীর পাহাড়ীরা কোথা মৃত্যুর সুধা আছে!
স্বপ্নের আবাস, শান্তির আবাস এ পাহাড় মায়ের কোলে –
অশান্তি-আগুন কোথা হতে লেগে দাবানল সম জ্বলে!
সহসা মাতার কোল জুড়ে কারা বসিল উড়িয়া আসি' –
ভূমিদস্যুর দল 'সেটেলার দানব' সর্বনাশী!
আইন রচেছে দানবের দল নিজ স্বার্থের তরে,
রাক্ষস-সম লোভের জিহ্বা মেলে ভূমি গ্রাস করে।
কাঁপন তুলিয়া দাপিয়ে বেড়িয়ে পর্বতে পর্বতে –
শ্মশান করিছে লুটেপুটে খেয়ে পাহাড়ের সম্পদে!
শহরের বাবু পাহাড় মাতার সম্পদ করে শেষ,
ধনী-রাক্ষস রক্ত শুষিয়া মেটায় মনের খাহেশ।
রক্ত-মাংস শুষে পাহাড়ীরে করে ওরা কঙ্কাল,
দূর করে দে রে লাথি মেরে – ওরা সমাজের জঞ্জাল।
উজাড় করিয়া বনভূমি গড়ে বিলাসের আসবাব,
দেরি নাই! – ধেয়ে আসিবে সহস্র পাহাড়ীর অভিশাপ!
ধনী দানবেরা বোঝে না সেদিন কী ভীষণ খাবে মার!
পাহাড়ীর ক্রোধে সম্পদরাজি জ্বলে হবে ছারখার!
পাহাড়ে পাহাড়ে বাজিয়া উঠিছে বিদ্রোহ-রণভেরী,
ঊর্ধ্ব হইতে পড়িবে আগুন শিরে – বেশি নাই দেরি!
যুগযুগান্ত মুখ বুঁজে মোরা সয়েছি অত্যাচার,
পশুর মতন মার খেয়ে খেয়ে কালো হয়ে গেছে হাড়।
দৈত্যের দল নিশ্চিহ্ন করিতে চাহে কৌশলে মেরে,
পাহাড়ী-পাহাড়ী দ্বন্দ্ব বাঁধিয়ে স্বার্থ হাসিল করে।
শান্তিপ্রিয় পাহাড়ীর মাঝে বয়ে আনে হানাহানি,
তাড়া সব মেরে! – শুনিস নে কেহ ভুয়া শান্তির বাণী।
পশুর মতন বাঁচিতে চাহি না – জালিমেরা হুঁশিয়ার!
পথে নামিয়াছি নির্যাতিতেরা – দিতে হবে অধিকার!
যুগযুগান্ত অত্যাচারের নেবে নেবে প্রতিশোধ,
সহজ-সরল পাহাড়ী দেখেছ, দেখনি তাদের ক্রোধ!
অত্যাচারীর রক্ত পিইতে পাহাড়ী মানে না বাধা,
জালিমের খুন নির্যাতিতের তরে স্বর্গের সুধা!
যুগ যুগ ধরে জুলুম সয়েছি, সহিব না কভু আর,
পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে – হাঁকিব শেষ রণহুংকার!
কোন দানবের দল দাঁত-নখ বাগিয়ে আসবি, আয়!
গুলির সামনে বুক ঢাল করে রক্ষিব মোরা মাতায়।
ঠাসিয়া ধরিব বজ্রকঠিন হাতে জালিমের টুঁটি,
প্রাণ দেব তবু নাহি দেব কভু মা'র এককণা মাটি!
মুক্তি-ডঙ্কা বাজে দিকে দিকে শঙ্কা নাহি ক' আর,
জালিমের থাবা ভাঙিয়া আনিব ভূমিহীনের অধিকার!
পাহাড়ী-বাঙালী ভেদাভেদ ভুলে পাহাড় মায়ের ক্রোড়ে -
থাকিতে চাহ তো, বাধিব তোমায় মোরা প্রীতি-বাহুডোরে!
ভাইয়ে ভাইয়ে প্রীতির বাঁধনে থাকিতে চাহ গো যদি,
রক্ষিতে তোমা বিপদের মুখে – দেব মোরা বুক পাতি'!
কিন্তু জানিও যদি দাঁত-নখ বাগিয়ে আসো আবার,
অন্ধের মত মারিব জালিম! তোমা সাপমারা মার!
উৎখাত করিতে চাহ যদি প্রিয় মাতৃ-অঙ্ক হতে,
গরুপেটা করে চিরতরে মোরা ছুটাব ঘাড়ের ভূতে!
মান-অভিমান সহি, সহি নে ক' বাড়াবাড়ি মোরা মোটে,
তোমরা কি জান মরিবার তরে পিঁপড়ের পাখা ওঠে?
মানুষের মত বাঁচার অধিকার ফিরে নাহি পাই যদি,
পাহাড়ের বুকে অত্যাচারীর বহাব রক্ত-নদী!
করুণায় মোরা বাঁচিতে চাহি না, চাহি মোরা অধিকার,
মানুষের ভূমি – এতে নাই কোনো দানবের অংশীদার!
সুদিন আসিছে ফিরে –
পাহাড়ী-বাঙালি ভেদাভেদ র'বে না এ বাংলার ক্রোড়ে!
ফিরে পাবে পাহাড়ীরা মানুষের মত বাঁচার অধিকার,
বাংলার আকাশে শান্তির বাণী ধ্বনিবে রে অনিবার!
সকলের বুকে উঠিয়া সেদিন প্রেম-সাগরের ঢেউ –
এক মোহনায় আছাড়ি' পড়িবে – রুধিতে নারিবে কেউ!
নিখিল বিশ্ব ধর্ম, জাতি ও গোষ্ঠী নির্বিশেষে –
সেই মোহনায় মিলনের বাঁশি শুনিবে সেদিন এসে!
মানুষের মত বাঁচার অধিকার সেদিন মানুষ পাবে,
জাতি ও উপজাতির মাঝে সব ভেদাভেদ ঘুঁচে যাবে।
বিশ্ব জুড়িয়া উঠুক ধ্বনিয়া – “জয়! মানবতা জয়!”
মানুষের পরিচয় সবার আগে, তার আগে কিছু নয়।
ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী নির্বিশেষে সব ভাই ভাই,
পাহাড়ী-বাঙালী মানুষের জাতি – কোনো ভেদাভেদ নাই!