আল্লার নামে ভাসায়েছি তরী উত্তাল সিন্ধুতে,
মোহাম্মদ! – সে কাণ্ডারী, হাল ধরিয়াছে নিজ হাতে।
আবুবকর, ওমর, আলী, উসমান – এই তরণীর দাঁড়ী,
ভয় নাই! – শত ঝঞ্ঝা-তুফানে ডুবিবে না আশা-তরী!
উন্মাতাল এ সিন্ধু মোদের পাড়ি দিতে হবে আজ,
আঁধার আকাশে মেঘ-গর্জন – ঘন ঘন পড়ে বাজ!
সিন্ধুর জল টলমল, কভু তরঙ্গ ফুঁসে উঠে,
পাহাড়ের সম দানব সর্বনাশী ঢেউ এসে ছুটে –
আছড়ে পড়েছে তরীতে, যাত্রী কাঁপে ভয়ে, নিরাশায়,
আঁধার আকাশ চিরে ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকায়!
ফুঁসে ওঠে সিন্ধু, কাঁপে থরথর আমাদেরি আশা-তরী,
হে নবযুগ-অভিযাত্রীরা! – বুকে ওঠে ভয় সঞ্চরি'?
ভয় পেয়ো না'ক, নির্ভীক যারা, তারা চির-অক্ষয়,
মৃত্যুরে প্রাণ ভিখ দিয়ে ওরা মৃত্যুরে করে জয়!
মৃত্যু ওদের পরম মিত্র, ঘুম ক্ষণিকের তরে,
জেগে উঠে শত নির্জীব প্রাণে তারুণ্য সঞ্চারে!
হে নবযুগের অভিযাত্রী! – যদি কাঁপো থরথর করি',
অশান্ত যদি হও তবে আরো চঞ্চল হবে তরী।
ভয় পেয়ো না'ক, নিরাশ হয়ো না, আল্লা মোদের প্রভু,
তাঁর 'পরে যে বা ভরসা রেখেছে, - ছেড়ে যান না'ক কভু!
উন্মত্ত এ সিন্ধুতে তরী পার করিবার ভার –
তাঁর হাতে, যদি চান, পার হব দুস্তর পারাবার!
ডুবে যদি মরি মাতাল সাগরে, - সেও তাঁর ইচ্ছায়,
প্রাণ নিয়ে স্থান দেবে খোদা শহিদী মর্যাদায়!
প্রাণ যদি নিতে চান, তবে কেন বাধা দেব মোরা তাঁর?
আল্লার প্রাণ আল্লারে দাও! – এ তো তাঁর অধিকার।
বেঁচে যদি পাড়ি দিতে পারি, তবে তাঁর ইচ্ছায় গাজী,
মুসলিম সেই! আল্লার 'পরে সর্বদা রয় রাজি!
তাঁর ফয়সালা সর্বদা মানে, তারে 'বিশ্বাসী' কয়,
অসন্তুষ্ট হয় কিঞ্চিৎ, সে তো মুসলিম নয়!
যাহারা মুমিন, 'বিশ্বাসী' – যদি তাঁর পরিক্ষা আসে,
হাসিমুখে মেনে লয়, প্রয়োজনে প্রাণ দান করে হেসে!
লোভনীয় নহে ইহাদের কাছে দুনিয়াবী নেয়ামত,
শহীদ হয়ে তবু চাহে না'ক ওরা বেহেশতী সম্পদ!
প্রাণ দিয়ে ওরা বেহেশতে গিয়ে ফিরিতে চাহে আবার,
অমৃত-সম শহিদী পেয়ালা পি'তে চায় বারবার!
বাঁচি কি বা মরি, জানিও মোদের সাথী শুধু আল্লাই,
তাঁহার সঙ্গ পেয়েছে যে জন, তার চাওয়া-পাওয়া নাই!
মোদের লক্ষ্য চির-পূর্ণতা, নিত্য সঙ্গ তাঁর,
তাঁহার আদেশে তাই মোরা দাঁড় টেনে যাই বারবার!
ভয় পেয়ো না’ক অভিযাত্রীরা! দেখাইয়া তিনি ভয় –
জানিতে চাহেন বিশ্বাস কত? – ঈমান কি জয়ী হয়?
মুসিবতে ফেলে দেখিতে চাহেন, ঈমানের জোর কত?
আল্লাহ যারে যত ভালবাসে, বিপদে ফেলেন তত!
কঠিন বিপদে ফেলিয়া কঠিন পরিক্ষা করে তিনি,
সত্য-ঈমান যার বুকে, সে তো হাসিমুখে লয় মানি।
ভয় যার মনে, জীবনের রণে নিতি ঘটে পরাজয়,
নির্ভীক যারা, যুদ্ধে মরেও হয় তাহাদের জয়!
শহিদ হয়ে ওরা চেতনা জাগায় শত নির্জীব প্রাণে,
ওদের প্রেরণা পেয়ে সবে জালিমের শিরে আঘাত হানে।
পরপারে তারে নিয়ামত-ভাণ্ডার খুলে দেন খোদায়,
জ্বীন, ফেরেশতা, নবী, সাহাবীরা জ্বলে মরে ঈর্ষায়!
খোদার পরিক্ষা এলে শঙ্কায় কাঁপে, যারা পায় ভয়,
জীবনযুদ্ধে পরাজিত, ভয় ইহাদের করে ক্ষয়!
নির্ভীক বীর, দুনিয়ার বুকে মরে শুধু একবার,
কাপুরুষ যারা, দুর্বল-মন – মরে ওরা বারবার!
আল্লার ‘পরে বিশ্বাস রাখো, স্থির করো মন,
বিশ্বাসীদের রক্ষক তিনি! – আসুক প্রভঞ্জন,-
আসুক তুফান-ঝঞ্ঝা, আসুক ঘূর্ণি সর্বনাশী!
সাইক্লোন আসুক, - আল্লা রক্ষা করিবেন তরী, আসি'।
বিশ্বাসীদের কোনো ভয় নাই! ভীত তো 'কাফের' হয়,
শহিদী মৃত্যু লভিতে পারিলে মুমিনের হয় জয়!
পালিয়ে কেউ কি বাঁচিতে পেরেছে মৃত্যুর হাত হতে?
মরিতে হয় তো, শহিদী মৃত্যু মরিব খোদার পথে!
পর্বত-ঢেউ ভেঙে চলে তরী, সম্মুখে গতি তার,
আল্লার শক্তিতে পার হব উত্তাল পারাবার।
ভয় নাই! ওরে ভয় নাই! আছে আল্লার রহমত,
আমাদের গতি রুখিতে পারে না শত শত মুসিবত!
মৃত্যু এসেও এতটুকু শ্লথ করিতে পারে না গতি,
শয়তান-থাবা ভেঙে ছুটে চলে যারা সত্যের সাথী!
ওকি! দানবের মত কালো ঢেউ আঘাত হানে বারেবারে,
মাস্তুলে বাধা কলেমার পাল আঘাতে গিয়াছে ছিঁড়ে।
ক্ষিপ্র হস্তে হাল ঘোরাতেছে আমাদেরি কাণ্ডারী,
ওমরের বুকে ভয় জাগে, বুঝি ডুবে গেল আশাতরী!
ভেঙেছে ভয়াল ঢেউয়ের আঘাতে উসমানের হাতে দাঁড়,
নির্ভীক আলী হেসে বলে তবু – “পার হব পারাবার!”
নবিজীর পানে চাহিয়া চমকে উঠিল আবুবাকার,
হাল ধরে বসে আছে নবী – নিশ্চিন্ত, নির্বিকার!
দুর্বল, ভীরু যাত্রীদল! – কি কাঁপন জেগেছে বুকে?
আল্লার দেয়া শক্তিতে সব বাধা, ভয় দেব রুখে।
দেখ! চেয়ে দেখ! আমাদেরি নবী প্রশান্ত মুখে বসে,
সবর করে যে, তার তরে আল্লার সাহায্য আসে।
দৈত্যের মত কালো ঢেউ ভেঙে ছুটে চলে আশা-তরী,
সিন্ধুর পাড়ে পৌঁছাবার আর নাই দেরী! নাই দেরী!
শোনো! বিশ্বের অবিশ্বাসী! –
শত বিপদেও ভীত হয় না'ক আল্লাতে বিশ্বাসী!
টলে নাহি পড়ে শত আঘাতেও, যদি মুসিবত আসে –
বন্ধুর মত বুকে টেনে নেয় পরিক্ষা ভেবে, হেসে!
মৃত্যুর সাথে দোস্তি ওদের, নাহি মরণের ভয়,
মরণেরে ওরা প্রিয়তমা ভেবে বক্ষে জড়ায়ে লয়!
ওরা চাহে না'ক দুনিয়াবী খ্যাতি, সম্পদ দুনিয়ার,
উহাদের তরে পরপারে রয় বিপুল পুরষ্কার!
চাহে না’ক পার্থিব কল্যাণ, চাহে বেহেশত-ধাম,
ওরা জানে পরপারে খোদা রাখিয়াছে চির-কল্যাণ।
দুনিয়াবী যশ-খ্যাতি, সম্পদ – ওতো ক্ষণিকের তরে,
চির-কল্যাণ, চির-খ্যাতি – মুমিনের জোটে পরপারে! -
শত দুর্যোগে পড়ে না'ক নুয়ে, যাত্রীরা আজ তাই –
মুক্তির পানে ছুটে চলে, বুকে শঙ্কার কণা নাই!
সিন্ধুর পাড়ে মুক্তির রবি উঠেছে দিগন্ত ফুঁড়ি',
শত মুসিবত পার হয়ে তীরে ভিড়িয়াছে আশা-তরী!
(প্রভঞ্জন – ঝড়)