অনুশীলন এ প্রকাশিত
ডিসেম্বর ০৮, ২০২১
https://anushilanmag.blogspot.com/2021/12/Baul-Article-abdur-rahim.html

১৯৪৭ সাল, দেশ ভাগাভাগি এবং দুই বাংলার বুকের উপর দিয়ে বয়ে গেলো একটা কাঁটাতার। বাপ-দাদার রক্তে-মাংসে গড়া ভিটামাটির কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। দুই বাংলার মানুষও তা পারে নি। এই কাঁটাতারের দাগ নদীর বুকের উপর দিয়েও বয়ে গেছে। কিন্তু নদীর ছলাৎ ছলাৎ শব্দ যে ভাটির মানুষকে দুইহাত ধরে টানে! বলছিলাম হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কথা। তিনি সিলেটের মিরাশির বাসিন্দা ছিলেন। ভাটির গায়ক। দেশভাগের কাঁটাতারটা তারও বুকের উপর দিয়ে গেছিল। এর ব্যথাটা তার গানে অনেক প্রভাব পাওয়া যায়। হবিগঞ্জের ‘জালালী কইতর/ সুনামগঞ্জের কুরা/ সুরমা নদীর গাংচিল আমি/ শূন্যে দিলাম উড়া/ শূন্যে দিলাম উড়ারে ভাই যাইতে চান্দের চর/ ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি কৈলকাত্তার উপর/ তোমরা আমায় চিননি। এই ডানা ভেঙে-পড়ার গল্পটা তাকে সারা জীবন তাড়িত করেছে। কারণ যেখানে সে ডানা ভেঙে পড়েছে সেখানে নেই কোনো ভাটির নদী, ছিল না জলের ছলাৎছলাৎ শব্দ, মাঝিমাল্লার ভাটির সুরও ছিল না। এটা তার গানের জন্য ছিলো একটা বিশাল ক্রাইসিস, কারণ তিনি যে ছিলেন ভাটিয়ালী অঞ্চলের লোক। তবে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের অসাধারণ একটা টান ছিল ভাটিয়ালীর প্রতি, পদ্মার স্রোতের মতো। ‘আমার মন কান্দেরে পদ্মার পাড়ের লাইগা দরদি/ আমার মন কান্দে পদ্মার চরের লাইগা/ আমার সুখের গৃহ শান্তির স্বপনরে/ দরদি কে দিলো ভাঙিয়া/ আমার মন কান্দেরে পদ্মার পাড়ের লাইগা’। এইযে অজশ্র সুর, ভাটিয়ালী গান, এটা এখনো ভাটির মানুষের প্রাণ। নদী, নৌকা, মাঝি, বৈঠা, উজানের সারিগান। সারিগানটাকে মূলত উজানের গানই বলা হয়ে থাকে। যখন নদীউজানে বইতে থাকে, তখন একা বৈঠায় নৌকা চলছে না, সবাই মিলে ছপাত ছপাত তালে বৈঠা চালিয়ে গান গায় একি সুরে, তখন সেটা সারি হচ্ছে। সারিগান মানে সারিবদ্ধভাবে গীত গান। ‘সোনার বান্ধাইলা নাও/পিতলের গুড়া, পিতলের গুড়া/ও রঙ্গের গুড়া, দৌড়াইয়া যাও..।‘ মূলত কর্মোদ্যম ও শ্রম লাঘব করা সারিগানের মূল উদ্দেশ্য হলেও চিত্তবিনোদনের জন্য এ-গান গাওয়া হয়। এ গানে নরনারীর প্রেম, রাধাকৃষ্ণ, প্রশংসামূলক গান, হরগৌরী ও নিমাই বিষয়ক গান, মরমি গানসহ নানা বিষয় ঠাঁই পেয়েছে। সারাবছরই সারিগান গাওয়া হয়। নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাওর, কৃষিক্ষেত ও শ্রমিকদের কর্মস্থলে এ গান চলে। পূর্ব ও নিম্ন বঙ্গের ভাটি অঞ্চলকে সারিগানের অঞ্চল বলা হয়। আমাদের দেশে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য পারস্য থেকে সুফিরা এসেছিলেন। বলা হয়ে থাকে যে, শাহজালাল ৩৬০ আউলিয়া এবং কিছু মরমী কবি ও সাহিত্যিক নিয়ে ঘাঁটি গাড়েন সিলেটে। যার ফলে এই সিলেট অঞ্চলে লোক সঙ্গীতের একটা বিরাট প্রভাব পড়েছে। এই অঞ্চলে রয়েছে, ভাটিয়ালী গান, সারিগান, দামায় গানসহ অনেক গানের সমাহার। তবে সিলেটে আলেদা আরেকটা নাগরী আছে, লিপি আছে। এতে মূলত  শাহজালালদের  প্রভাব পরিলক্ষিত। এই লিপিটা অনেকটা আরবি লেখার মতোই, ডান দিক থেকে শুরু করে বাম দিকে এসে শেষ হয়। এইভাষায় ফকিরি বা মরমি গান লেখা হত। যেমন: বন্ধু তোর লাইগা রে/ আমার তনু জড়জড়/ মনে লয় ছাড়িয়ারে যাইতাম/ থুইয়া বাড়ি ঘর... (সৈয়দ শাহ নূর), সৈয়দ শাহনূর বিরচিত আধ্যাত্মিক গান বাংলার মরমী ভুবনকে সমৃদ্ধ করেছে। এছাড়াও সিলেটের তত্বসংগীত ও মরমী সাহিত্যে সৈয়দ শাহ নুরকে সকলের উর্ধে স্থান দেয়া হয়। বাংলা সাহিত্যের প্রাথমিক যুগে সৈয়দ শাহনুর রচনা করেন তার বিখ্যাত কিছু গ্রন্থ। যা ছিল সিলেটের স্বতন্ত্র নাগরী লিপিতে লিখা।  সৈয়দ শাহ নূর কিন্তু লালন ফকিরেরও অনেক আগের। সুয়া উড়িলো উড়িলো/ জীবেরও জীবন/ সুয়া উড়িলো রে.../ লা-মোকামে ছিলাই সুয়া/ আনন্দিত মন,/ ভবে আসি পিঞ্জিরাতে/ হইলা বন্ধন।।/ পিঞ্জিরা থাকিয়া কইরলা/প্রেমেরও সাধন,/ (হায় আল্লাহ) এখনো ছাড়িয়া যাইতে/ না লাগে বেদন.. (শীতালং ফকির)- তিনি সিলেটের একজন খ্যাতনামা মরমী সাধক কবি ও সাহিত্যিক। মানব সৃষ্টির ভেদ রহস্য উদঘাটন করে শিতালং শাহ মানুষকে বুঝাতে থাকেন মানুষ চিরসত্য, তার পরে সত্য কিছুই নয়। অর্থাৎ: আকার-সাকার মানুষ নিষ্ঠা করলে, নিরাকারে আরেক মনের মানুষ পাওয়া যায়। মানুষ খোদা থেকে জুদা নয়। শিতালং শাহ এই সত্য তাৎপর্যময় বিষয়টি তার স্বরচিত ভাব সঙ্গীতে তুলে ধরেছিলেন। লোকসঙ্গীতের মূল খেলাটি হচ্ছে শব্দ বা লিরিক্স। তারা এগানের মাধ্যমে মানুষের মাঝে বার্তা দিয়ে থাকেন। আধুনিকতা আসলে ভঙ্গী দিয়ে হয় না, ব্যক্তিকে বিষয়বস্তুতেও আধুনিক হতে হবে। একটা ব্যক্তি কতটা আধুনিক হলে নিজের সময়ে দাঁড়িয়ে থেকে কয়েকশত বছর এগিয়ে থাকার কথা গানে গানে সহজ-সাবলীলভাবে বলতে পারে। এটা বুঝতে হলে অবশ্যই লোকসঙ্গীতের কাছে যেতে হবে। ‘সিরাজ সাঁই ডেকে বলে লালনকে/ কুতর্কের দোকান সে করে না আর/ মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার/ সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার’ (লালন) অথবা  ‘আরবী ভাষায় বলে আল্লাহ/ ফারসীতে কয় খোদা তা-লা/ গড বলেছে যীশুর চেলা/ ভিন্ন দেশে ভিন্নভাবে/ আপনা আপনি ফানা হলে সে ভেদ জানা যাবে’ (লালন) অথবা ‘সর্বশাস্ত্রে শুনিতে যে পাই/ দয়াল তোমার নাকি মাতাপিতা নাই/ তবে তোমার নামকরণ কে করলে সাঁই/ বসে ভাবি তাই/ পাগল বিজয় বলে মনের কথা কই/ আমি খাঁটি ভাবের পাগল নই/ আমার গোল বেঁধেছে মনের মাঝে/ তাতেই পাগল হই/ আমার বুকে যা আয় মুখে তা কই/ কাঁটা কান চুলে ঢাকি/ আমি জানিতে চাই দয়াল তোমার/ আসল নামটি কি’ (বিজয় সরকার)। বাংলার লোকসঙ্গীতে এরূপ অনেক কথাই বাউলরা বলে গেছেন গানে গানে। নিঃসন্দেহে তারা সাহসী এবং আধুনিকতার চরম পর্যায়ে ছিলেন বলেই শত-শত বছর আগে এমন কথা বলতে পেরেছিলেন। সিলেটের আরেকজন বিখ্যাত বাউলের নাম রাধারমণ দত্ত। তার গানে এতো রস, এতো সুর, এতো আনন্দ-বিরহ-বিচ্ছেদ যে, সেটা শুধু তার গানের দিকে তাকালেই বুঝা যায়। তিনি একাধারে লোক কবি বা সাধক কবি, বৈষ্ণব বাউল, ধামালি নৃত্যের প্রবর্তক। কৃষ্ণ বিরহের আকূতি আর না-পাওয়ার ব্যথা কিংবা সব পেয়েও না-পাওয়ার কষ্ট তাকে সাধকে পরিণত করেছে। ‘ভ্রমর কইও গিয়া,/ শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে/ ভ্রমর কইয়ো গিয়া/ ভ্রমর রে, কইও কইও কইওরে ভ্রমর/ কৃষ্ণরে বুঝাইয়া, মুই রাধা মইরা যাইমু/ কৃষ্ণহারা হইয়ারে, ভ্রমর কইও গিয়া’ (রাধারমণ দত্ত) অথবা ‘আমার বন্ধু দয়াময়/তোমারে দেখিবার মনে লয়।/ তোমারে না দেখলে রাধার/ জীবন কেমনে রয় বন্ধুরে/ কদম ডালে বইসারে বন্ধু/ ভাঙ্গ কদম্বের আগা/ শিশুকালে প্রেম শিখাইয়া/ যৌবনকালে দাগা রে’ (রাধারমণ দত্ত) অথবা ‘ভাইবে রাধারমণ বলে/ পাইলাম না রে হায় রে হায়/ পাইতাম যদি প্রাণ বন্ধুরে/ রাখতাম হৃদয় পিঞ্জিরায়/ জলের ঘাটে দেইখা আইলাম/কি সুন্দর শ্যাম রাই’ (রাধারমণ দত্ত) অথবা ‘তুমি চিনিয়া মানুষের সঙ্গ লইও/ পাষাণ মন রে বুঝাইও/ যদি হয় রে কুজন, তার কাছে না যাইও মনরে/ তুমি নিদাগেতে দাগ লাগাইবার চাইও/ ভাইবে রাধারমণ কয়, শুন মন মহাশয়রে/ তুমি রসিক পাইলে রসের কথা কইও’ (রাধারমণ দত্ত)। এইযে তার দুঃখবোধ, বিরহ-বিচ্ছেদ-ভাব, এটা বাংলার খুব কম সংখ্যক বাউলের মাঝে দেখা যায়। তিনি সমাজ থেকে বিতাড়িত হওয়া এক বাউল, বৈষ্ণব বাউল- জাত-পাত থোড়াই কেয়ার করেছেন। কেউ কেউ তাকে আবার স্বভাব কবি হিসেবেও সম্বোধন করে থাকেন। তিনি গানে গানে মানুষের মাঝে বিলিয়ে গেছেন প্রেম। সিলেট অঞ্চলের অনেকের মুখেই শোনা যায় যে, রাধারমণ দত্ত ও মরমি কবি হাছন রাজার সাথে যোগাযোগ বা ভাবের একটা বন্ধন ছিল।  হাছন রাজার জন্ম সিলেটের সুনামগঞ্জে, একজন মরমী কবি ও বাউল সাধক। বিশেষজ্ঞদের মতে, দর্শনচেতনার নিরিখে হাছন রাজার নামের আগে লালন ফকিরের নামই বেশি উল্লেখযোগ্য। হাছন রাজা লালন ফকিরের মতোই প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা লাভ করেন নি। উভয়ই ছিলেন স্বশিক্ষিত। হাছন রাজা স্বভাবত সহজ-সরল সুরে আঞ্চলিক ভাষায় গান রচনা করে ফেলতেন। ‘লোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার/ কি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই মাঝার/ ভালা করি ঘর বানাইয়া, কয় দিন থাকমু আর/ আয়না দিয়া চাইয়া দেখি, পাকনা চুল আমার’ (হাছন রাজা)- এগান শোনেন নি এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম। দেশ, জাতি, ধর্ম এবং লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষের একটি ধর্ম রয়েছে, মানব ধর্ম। মানবতা সাধনার একটি রূপ মরমী সাধনা, যা হাছন রাজার গান এবং দর্শনে পাওয়া যায়। এক সময়কার প্রতাপশালী অত্যাচারী জমিদার হাছনের অন্তরে-বাহিরে ঠাঁই পায় মরমী সাধনা। ‘তুমি আমি, আমি তুমি ছাড়িয়াছি ভয়/ উন্মাদ হইয়া হাছন, নাচিয়া বেড়ায়/ হাছন রাজায় কয়, আমি কিছু নয়রে, আমি কিছু নয়/ অন্তরে বাহিরে দেখি, কেবল দয়াময়’ (হাছন রাজা)। ভেতরটা কেমন দয়ার্দ্র হলে ভয়ভীতি, হিংসা, লোভ, মোহ, চলে যায়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হাছন রাজা। সিরাজ সাঁই এর একটি কথা আছে, "যাতে জন্ম তাতেই ডুইবা মরে মানুষ"। বিষয়টা হয়তো  হাছন রাজা ধরতে পেরে ছিলেন। বাপের পুকুরে আর ডুবাডুবি না করে, দিল-দরিয়ায় ডুব দিয়ে নিজেকে খুঁজতে-খুঁজতেই তার এত দূরে আসা। আর আলোক পেয়েছিলেন বলেই তো গেঁথেছেন- ‘মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়ারে/ কান্দে হাছন রাজার মন মুনিয়ায়রে/ মায়ে বাপে বন্দি কইলা খুশির মাজারে/ লালে ধলায় হইলাম বন্দি পিঞ্জিরার ভিতরে/ কান্দে হাছন রাজার মন মুনিয়ায়রে’ (হাছন রাজা)। নিজেকে বন্দী করার কাঁদার ব্যথা ক’জনে বোঝে? মাটির পিঞ্জিরা থেকে নিজেকে মুক্ত করার ভাবনা এবং অতৃপ্তির সাধনায়, এই ভজন-সাধনের পথ ধরে নিজেকে খুঁজতে গিয়ে গানে-গানে, সুখে-দুঃখে  নিজেকেই হারিয়েছেন বাংলার বাউলরা। দুঃখ মানে কান্না নয়, দুঃখ মানে অতৃপ্তির সাধনা। এই কান্দন বা বন্দি হওয়ার কথা কিংবা নিজেকে খোঁজার কথাই গানে গানে আমরা শোনে এসেছি। যারা এইসব গানে গানে বলে গেছেন তাদের আমরা দেখিনি। যারা কাছ থেকে দেখেছে তারাও আজ নেই। কিন্তু একজন আছেন, যাকে আমরা দেখেছি। শুধুই দেখেনি, তার গান তারই মুখে গাইতে দেখেছি, তিনি বাউল আব্দুল করিম। আমরা এতদিন শুধু অন্যের মুখে গায়তে শুনেছি, ‘সিরাজ সাঁই কয় লালন কানা’, ‘সৈয়দ শাহ নূরের কান্দন নদীর কোলে বইয়্যা’, ‘ভাইবে রাধারমণ বলে’, ‘শীতালং ফকিরে বলে মনে আলাপন’ এবং ‘হাছন রাজা কয় আমি কিছু নয়’। বাউল গানে শেষের অংশে এসে খুঁজে পেতাম গীতিকারের নাম। একজন বাউল  আব্দুল করিম নিজের মুখে গাইছেন নিজের লেখা গান, তারপর শেষে এসে বলছেন: ‘তোমার প্রেমে আব্দুল করিম/ মরে যদি ভালো/ রঙ্গিলা বারই রে/ তুমি নানান রঙের খেলা খেলো’। নিজ চোখে দেখার যে আনন্দ, তা বলে বোঝানো যাবে না। আব্দুল করিম সিলেটের একজন বিখ্যাত বাউল, মরমী সাধক ও গণমানুষের শিল্পী। তিনি ছোটবেলা থেকে দুঃখ, কষ্ট, আর অভাবের মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন। তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও ভাটির নদী, নৌকা ও পরিবেশ থেকে নিয়েছেন শিক্ষার অভিজ্ঞতা, আর হয়ে উঠেছিলেন ভাটির পুরুষ। তার গান সিলেটের ভাটি অঞ্চলের মানুষকে অন্য একটা জগতে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। তার গান শুধু গান নয়, যেন একটা জীবনদর্শন। ধলগ্রাম, প্রকৃতি, কালনী নদীর ঢেউ তাকে উজ্জীবিত করেছে, প্রাণিত করেছে এবং এসবকে কেন্দ্র করেই তার গান রচনা। আর্থিক অভাব থাকলেও মনের দিক থেকে সারাজীবন তিনি ভাবেই ছিলেন। দুঃখ, কষ্ট, অভাব নিয়েই করেছেন গানের সাধনা। ‘পিতা-মাতার ছেলে সন্তান একমাত্র আমি ছিলাম/ জীবন বাঁচাবার তাগিদে প্রথম চাকরিতে গেলাম/ মাঠে থাকি গরু রাখি ঈদের দিনেও ছুটি নাই/ মনের দুঃখ কার কাছে জানাই’ (আব্দুল করিম)। তার গানে অসম্ভব একটা বিচ্ছেদ কাজ করে। বাউল করিমের কোনো কোনো গান স্রেফ বিচ্ছেদী গান। গ্রাম-গঞ্জের বিচ্ছেদ গানের আসরে তার অনেক গানই গাওয়া হয়। একটা শ্রেণির মানুষ গানগুলোকে বিচ্ছেদী গান বলেই জানে। যেমন, ‘প্রেম করলাম প্রাণবন্ধুর সনে/ যে দুঃখ পেয়েছি মনে/ আমার কেঁদে যায় দিন-রজনী/ আমারে কেউ ছুঁইয়ো না গো সজনী/ আমি কুলহারা কলঙ্কিনী’ (আব্দুল করিম), ‘বসে ভাবি নিরালায়/ আগে তো জানি না বন্দের পিরিতের জ্বালা/ হায় গো ইটের ভাটায় দিয়া কয়লা আগুন জ্বালাইছে/ কী যাদু করিয়া বন্দে মায়া লাগাইছে/ বাউল আব্দুল করিম গায় ভুলিতে পারিনা আমার মনে যারে চায়/ হায় গো কূলনাশা পিরীতের নেশায় কূলমান গেছে/ দেওয়ানা বানাইছে/ কী যাদু করিয়া বন্দে মায়া লাগাইছে’ (আব্দুল করিম)। কত বড় মাপের সাধক হলে এমন সাবলীল ভাবে নিগূঢ় বিচ্ছেদের কথা বলতে পারেন! তিনি গান গেয়ে-গেয়ে জীবন পাড়ি দিয়েছিলেন, এবং এখনও বেঁচে আছেন গানে। এজন্যই হয়তো বলেছিলেন, ‘ভাবে করিম দ্বীনহীন/ আসবে কি আর শুভদিন/ জল ছাড়া কি বাঁচিবে মীন ডুবলে কি ভাসে মরা/ আর কিছু চায়না মনে গান ছাড়া/ গান গাই আমার মনরে বুঝাই/ মন থাকে পাগলপারা’ (আব্দুল করিম)। তিনি নিজেকে দ্বীনহীন বলেই দাবি করতেন। দ্বীনহীনতার কারণে তাকে অনেকেই পছন্দ করতেন না, এখনও করেন না। সৃষ্টি আছে, সবাই যখন বলে স্রষ্টাও আছে, থাকলে থাকুক। আমাকে নিয়ে তো স্রষ্টার কোনো মাথা ব্যথা নাই। কারণ স্রষ্টা অনেক বড় ব্যাপার। আমার মত আব্দুল করিম কি করলো বা কি করলো না, এইটা দেখা ত স্রষ্টার কাজ না। এইজন্যই হয়তো বলেছিলেন, ধর্ম-কর্মের ধার ধারেনা/ গান-বাজনাতে রয় বিভোর/ হিংসাখোরগণ বলে এখন/আব্দুল করিম নেশাখোর (আব্দুল করিম)। মানুষ যারে আসমানে খোঁজে, তিনি তারে খুঁজেন নিজের ভেতর। গানগুলো তার প্রমাণ রয়েছে। যেমন, ‘তন্ত্র-মন্ত্র করে দেখি তার ভিতরে তুমি নাই/ শাস্ত্র-গ্রন্থ পড়ি যত আরও দূরে সরে যাই/ কোন সাগরে খেলতেছ লাই, ভাবতেছি তাই অন্তরে/ কেমনে চিনিব তোমারে (মুর্শিদ ধন হে)/ কেমনে চিনিব তোমারে’ (আব্দুল করিম), ‘আসা যাওয়া সার হইয়াছে নিয়তির বিধানে/ জন্ম-জ্বরা যম-যাতনা/ সব তোমার অধীনে/ প্রাণনাথ তুমি বিনে’ (আব্দুল করিম)। মানুষ মনে করেন, আব্দুল করিম একজন বাউল, সাধক, ও মরমী কবি। কিন্তু তিনি নিজেকে দাবি করতেন একজন গণমানুষের শিল্পী হিসেবে। তাঁর ভাষা: ‘তত্ত্বগান গেয়ে গেলেন যারা মরমী কবি/ আমি ধরে তুলি দেশের দুঃখ-দুর্দশার ছবি/ বিপন্ন মানুষের দাবি/ করিম চায় শান্তির বিধান/ মন মজালে ওরে বাউলা গান’ (আব্দুল করিম) অথবা ‘সুধে, ঘুষে, লিপ্ত যারা/ স্বর্গসুখে আছে তারা/ কৃষক, মজুর, মেহনতিরা উপায় নাই তাদের বেলা/ কোনো কাজে গেলে বলে ঘুষ দেলা, কী জ্বালা’ (আব্দুল করিম) এই জন্যই তাকে গণমানুষের কবি বলা হয়। মনে-প্রাণে বাউল হওয়া সত্ত্বেও তিনি গানে-গানে কৃষক, মজুর, মেহনতি মানুষের কথা বলেছেন। আমাদের গণমানুষের চেতনাকে জাগ্রত করতে তার গানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। মাটি, মানুষ, প্রকৃতি, জীবনবোধ, ধর্ম, প্রেম এবং দেশের কথাই বেশির ভাগ সময় ওঠে এসেছে তাদের এই গানে। এমনই অমূল্য গানের ভাণ্ডার বাউল গান, যার মাধ্যমে এভাবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের হৃদয় আলোকিত হয়ে চলেছে। ভক্তি থেকেই সাধনা আর সাধনা থেকেই ধ্যান-জ্ঞান। এটি বাউল সম্প্রদায়ের নিজস্ব সাধনগীত। এইগানে পদ্মের মতো ফুটে ওঠেছে সাম্য ও মানবতার বাণী। এই সিলেট অঞ্চলে রয়েছেন রাধারমণ দত্ত, হাছন রাজা, আব্দুল করিম, দূরবীন শাহ, কালা শাহ, আরকুম শাহ, সৈয়দ শাহনুর, শীতালং ফকির, এর মতো আরও অনেক দার্শনিক, বাউল, মরমী সাধক। যুগে যুগে তারা রচনা করে গেছেন/যাচ্ছেন, গেয়ে গেছেন/যাচ্ছেন লোকঐতিহ্যের অনবদ্য ফসল মরমী সঙ্গীত বা মরমীবাদী গান।