আমি তরুণদের বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। কারণ তরুণরা ঝুঁকি নিতে পারে যা অন্যরা পারে না। তরুণদের ভিতরে অজেয়কে জয় করার ক্ষুধা কাজ করে। তরুণদের ভিতরের আবেগ, আনন্দ আর কষ্ট কান্না হয়ে যখন বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে তখন থেকেই সৃষ্টির যাত্রা শুরু হয়। এজন্য আমি সম্ভাবনাময় তরুণদের অনুপ্রাণিত মুখগুলো দেখে মনের গভীর থেকে বলি- জয়তু তারুণ্য। হেলাল হাফিজের জনপ্রিয় কবিতা ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’;- এর দুটি পংক্তি ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ মনে করিয়ে দেয় অমিত শক্তির দুরন্ত তরুণদের কথা। সাহিত্যের সাথে বিজ্ঞানের একটি নিবিড় সম্পর্ক আছে। কথাটা বিশ্বাস হবার মতো কিনা জানি না তবে ফেলনা নয়। তরুণদের বলবো তোমরা যদি কবিতা, গল্প কিংবা গান লিখতে পারো তবে তোমাদের চিন্তাশক্তি বাড়বে। চিন্তাশক্তি বাড়লে তোমাদের উদ্ভাবনী শক্তিও বাড়বে।
সাহিত্যিকরা চিন্তাশক্তি আর কল্পনাশক্তি দিয়ে সায়েন্স ফিকশন বা বিজ্ঞানভিত্তিক কাহিনি লিখেন। সাহিত্যের জাদুকরী শক্তি এতটাই বিস্ময়কর যার মাধ্যমে আজ যা আমাদের কাছে অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে হয়তো সেটাই তরুণদের অমিত সম্ভাবনার সৃজনশীল চিন্তাশক্তির মাধ্যমে আগামী দিন বাস্তবে পরিণত হবে। তরুণদের বলবো তোমরা যদি তোমাদের চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগাতে পারো তবে তোমার গবেষণা পৃথিবীকেই বদলে দেবে। আলবার্ট আইনস্টাইন পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি তো বড় বড় সব গবেষণা করেছেন। কিন্তু ভাবলে অবাক হতে হয়, এই বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীর কোনো ল্যাবরেটরি বা গবেষণাগার ছিল না। তাঁর সব বড় বড় আবিষ্কারের পেছনে মাত্র তিনটি জিনিস ছিল। এর দুটি হলো কাগজ, কলম আর সবচেয়ে বড়টি ছিল তাঁর চিন্তাশক্তি। সায়েন্স ফিকশনের কথা বলছিলাম, কাল্পনিক বিজ্ঞানভিত্তিক সাহিত্য। ফরাসি লেখক জুল ভার্নের টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি নামের সায়েন্স ফিকশন বইটি মার্কিন নৌবাহিনীর স্থপতি সাইমন লেককে এমনভাবে প্রেরণা যোগালো যে তিনি প্রথম ডুবোজাহাজ আবিষ্কার করে ফেললেন। ভার্নের ক্লিপার অব দ্য ক্লাউডস বইটি ইগর সিকোরস্কিকে এতটাই আকৃষ্ট করলো যে তিনি সেখানকার কল্পনা শক্তিকে চিন্তাশক্তিতে রূপান্তরিত করে আধুনিক হেলিকপ্টার উদ্ভাবন করে বসলেন।
আধুনিক মুঠোফোনের অগ্রদূত মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মটোরোলার গবেষণা পরিচালক মার্টিন কুপার মনে করেন, ১৯৭০-এর দশকে আধুনিক মুঠোফোন উদ্ভাবনের নেপথ্যে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে মার্কিন টেলিভিশন সিরিজ ও চলচ্চিত্র স্টার ট্র্যাক-এ প্রদর্শিত যন্ত্র ‘কমিউনিকেটর’। যুক্তরাষ্ট্রের সিংগুলারিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-প্রতিষ্ঠাতা পিটার ডায়াম্যান্ডিস বলেন, উড়ন্ত মোটরগাড়ি (ফ্লাইং কার) আসছে। আর অসুস্থতা শনাক্তকারী যন্ত্র ‘ট্রাইকোডার’ শিগগিরই মানুষের হাতের নাগালে চলে আসবে। সিলিকন ভ্যালির অনেক ধারণা সায়েন্স ফিকশন থেকে নিয়ে অনেক গবেষক কাজ করে যাচ্ছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় গুগল এক্স ল্যাবের গবেষকেরা গুগল গ্লাস ও ফ্লাইং কার নিয়ে তাদের গবেষণা চালাচ্ছেন। আর মঙ্গলগ্রহে মানুষের বসতি স্থাপনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা শুরু করেছে এলন মাস্কের স্পেস এক্স। প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ে বিনিয়োগকারী জন টেইসম ধারণা করেন, সায়েন্স ফিকশনের প্রেরণায় খুব কম প্রযুক্তিপণ্যই উদ্ভাবন করা হয়েছে। তবে নতুন প্রযুক্তির ভবিষ্যত্ সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরি করে দিতে সামর্থ্য হয়েছে এ ধরনের সাহিত্যকর্ম। কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রযুক্তিবিদ জিম ওয়াল্ডোর বিপরীত মনোভাব পোষণ করে বলেন, কোনো উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে সায়েন্স ফিকশনের কখনও প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল না। তবে নিজ উদ্ভাবনের সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে নানামুখী ধারণা যাচাই করতে তিনি কল্পবিজ্ঞানের সহায়তা নিয়েছেন। অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইমাজিনেশনের গবেষকরা হায়ারোগ্লিফ নামের একটি গবেষণা প্রকল্প শুরু করেছেন। এতে মানুষের সামর্থ্য ও ভবিষ্যত্ নিয়ে যৌথভাবে বিশ্লেষণমুখী কাজ করছেন বিজ্ঞানী ও কল্পবিজ্ঞানের লেখকেরা। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক এড ফিন বলেন, ভবিষ্যতে মানুষকে আরও সৃজনশীল ও আরও উচ্চাভিলাষী করে সম্ভাবনার দিককে পরিপূর্ণভাবে উন্মোচন করাই তাদের লক্ষ্য।
তরুণদের বলবো তোমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে ভালো মানের জার্নালগুলো রয়েছে সেগুলো পড়তে হবে। এগুলো পড়লে তুমি জানতে পারবে বিজ্ঞান চর্চা আর গবেষণা কোন দিকে এগুচ্ছে। নেচার, সাইন্স আর সেল এর মতো জার্নালের মৌলিক গবেষণার আর্টিকেলগুলো পড়লে তোমার চিন্তা শক্তি তোমাকে বিজ্ঞানের অসম্ভবকে সম্ভব করার মনোবল যোগাবে। তোমার মধ্যে সুপ্ত ও ঘুমন্ত একজন বিজ্ঞানীকে জাগিয়ে তুলবে। তোমাকে বিজ্ঞান চর্চা আর গবেষণায় অনুপ্রেরণা যোগাবে। গবেষণাপত্র খুব উচুমানের জার্নালে প্রকাশ করা এতো সহজ নয়। বার বার বিভিন্ন জার্নালে গবেষণাপত্র পাঠিয়ে প্রত্যাখ্যাত হতে পারো। কিন্তু এতে হতাশ হলে চলবে না। বরং তোমার গবেষণার সীমাবদ্ধতা নিয়ে যত বেশি আলোচনা হবে ততো বেশি তুমি সেই সীমাবদ্ধতাগুলো জেনে গবেষণাকে সফল করে তুলতে পারবে। চিকিত্সা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার (১৯৫৩) পান জার্মান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ চিকিত্সক ও প্রাণরসায়নবিদ হ্যান্স অ্যাডলফ ক্রেবস। তিনি ইউরিয়া চক্র এবং সাইট্রিক এসিড চক্র আবিষ্কার করেন। তার নামে সাইট্রিক চক্রের নামকরণ করা হয় ‘ক্রেবস সার্কেল’। ক্রেবসকে এই গবেষণাপত্রটি প্রথমবার প্রকাশের ক্ষেত্রে অপারগতা জানিয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়কি ‘নেচার’ চিঠি পাঠিয়ে ছিল এবং পরেরবারের জন্য চেষ্টা করতে বলেছিল। তিনি এতে ভেঙে না পড়ে চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন বলেই নোবেল পুরস্কার তার ভাগ্যে জুটেছিল। তরুণদেরও এই ধরনের ইতিবাচক মনোভাব থাকতে হবে।