সুমনা কোনদিনও মা হতে পারবে না জেনেও
রবীন্দ্র তাকে বিয়ে করতে শেষমেশ রাজি হয়েছে
সুমনা'র মনে শ্রাবণের কালো মেঘের মতো প্রশ্ন জাগে! রবীন্দ্র তাকে দয়া করছে ?
নাকি নিজের প্রয়োজনে বিয়ে করতে যাচ্ছে ?
এমনি হাজারো প্রশ্ন তার মনকে বিচলিত করতে থাকে ।
সুমনা বিয়ের খবর পাওয়ার পর থেকে সে প্রতিনিয়ত দোতলার ঘরে জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়ায়।
আর দেখতে থাকে--পিচঢালা রাস্তা, হুড খোলা রিকশা, পায়ে হেঁটে চলা মানুষ, বাতাসে হেলেদুলে উঠা নারকেল গাছের ডাল, ডালে ডালে ঘষা খেয়ে কেমন খস খস আওয়াজ হয়।
সুমনা'র বিয়ে হবে আগামী মাসে এটাই তার পরিবারের জন্য সুখবর।
এই সুসংবাদে তার দাদু দুইজন ব্রাহ্মণকে কিছু উপঢৌকন দান করেন।
সুমনার ছোট বোন হাসি হাসি মুখে তার রুমে আসে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম নিজের মাথা চুলকে মৃদু স্বরে বলতে থাকে,
-- বুঝেছিস দিদি তোর লাক ভালো, জেনে বুঝে কেউ এত বড় স্যাক্রিফাইজ করে না।
সুমনা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনেমনে ভাবতে থাকে সত্যিই সৌভাগ্য আমার।
আমার বিয়ের সাথে সাথে আমি একটা মেয়েও পেয়ে যাচ্ছি তবে সে ক্লাস ফোরে পড়ে।

তবে রবীন্দ্র ও সুমনা'র মেয়ে নয়, রবীন্দ্র'র একার মেয়ে,
মানে রবীন্দ্রের প্রথম পক্ষের মেয়ে।


সুমনা'র মা খুশি তবুও মায়ের মুখের দিকে তাকালে সে
অপরাধবোধ দেখতে পায়।
  একটা সন্তান মা-এর কোলে আসার আগেই কোল খালি করার অপরাধ।
   কখনো কখনো সুমনা'র রুমে এসে তার মাথায় তেল দেওয়ার বাহানায় নিজের অপরাধ স্বীকার করেন আর কাঁপা গলায় বলেতে থাকেন "সব আমার দোষ।"
সুমনা অবশ্য কাউকে দোষ দেয় না, সব দোষ নিয়তির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে স্বস্তি খুঁজতে থাকে।

সুমনা আলমারির উপরে রাখা বার্বি ডল দেখতে থাকে, গোলাপি রঙের জামা পরা, কেমন টানাটানা গোল গোল চোখ।
ছোটবেলায় সুমনা খুব পুতুল খেলত, পুতুলের বিয়ে দিয়ে হাপুস অঝোর নয়নে কাঁদত ।
এখন কান্নাকাটি সব ভুলে গেছে !
জল যদি জমে বরফ হতে পারে কান্না জমে কঠিন কেন হবে না?






বছর চার আগেই সে কান্না কঠিন স্ফটিক হয়েছে ডাক্তার যেদিন সুমনা'র মাকে কঠিন গলায় বলেছিলেন "আপনার মেয়ের এই সর্বনাশের জন্য আপনিই দায়ী। "
ঠিক সেদিন থেকেই।
সুমনা হাজার চেষ্টা করেও কাঁদতে পারতো না!
অস্থির লাগত!
গলায় কান্না দলা পেকে বসে থাকত।
বিশাল পাথর বুকে চাপিয়ে রাখলে যেমন দম বন্ধ বন্ধ হয়ে আসে ঠিক তেমনি।

সেদিন ছিল ঝলমলে রোদেলা দিন।
কোকিল তার নিজের তালে তালে পাতার ফাঁকে আপন মনে ডেকেই যাচ্ছে।
সুমনা ডাক্তারের চেম্বারে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।
ডাক্তার ট্রান্স ভ্যাজাইনাল আলট্রাসনোগ্রামের রিপোর্ট গম্ভীর মুখে উল্টে পাল্টে দেখছেন।
সুমনা গভীর মনে কোকিলের ডাক শুনছে।
খানিক বাদেই তিনি পাওয়ার ওয়ালা চশমা খুলে টেবিলে রাখলেন ও কলম ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন " এর আগে আর কোন গাইনোকলোজিস্টের সাথে কনসাল্ট করেননি?"
সুমনা'র মা ছোট্ট করে উত্তর দেন "না"
ডাক্তার স্থির চোখে সুমনা'র দিকে তাকালেন তারপর আস্তে আস্তে বলা শুরু করলেন " ওর হয়েছে পেলভিক ইনফ্লামিটরি ডিডিজ, সহজ কথায় ডিম্বনালীতে ক্ষত। দীর্ঘদিন পিরিয়ডের প্রবলেম নিয়ে মেয়েকে বসিয়ে রেখেছেন।
পেটের যন্ত্রণা কমাতে লং টাইম খাইয়েছেন নন স্ট্রয়ডাল এন্টি ইনফ্লামিটরি ড্রাগ।
এই তীব্র ব্যথানাশক ওষুধ গুলো সাময়িক ভাবে ব্যথা কমালেও কিছু ক্ষেত্রে স্থায়ীভাবে ক্ষতি করে দেয়।
তার উপর একটা অবিবাহিত মেয়েকে ওরাল কন্ট্রাসেপটিভও দিয়েছেন পিরিয়ড নিয়মিত করতে ।
What is this?
সেটাই ওর জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
  ডিম্বনালী এখন বন্ধ হয়ে গেছে, অপারেশন ছাড়া উপায় নেই।
  ডাক্তার গলা চড়া করে বললেন " এই মাতব্বরি আপনাকে কে করতে বলেছিল বলুন তো? এই অপারেশনের পর যদি ও মা হওয়ার ক্ষমতা হারায় দয়া করে আমাদের উপর দোষ চাপাবেন না।
এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন যখন ক্ষত ছড়িয়ে গেছে ব্যাপক ভাবে।
" ডাক্তার কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে গেলেন।
লাল টকটকে গাল আর অগ্নিদৃষ্টি।
হয়ত তার ভেতরে প্রচন্ড খারাপ লাগা শুরু হয়েছে একটা ২০ বছরের তরুণীর জন্য!!
এই তরুণীরা কত স্বপ্ন দেখে!
একদিন টানা করে কাজল দিয়ে,হাতে ভারী চুড়ি,টকটকে লিপস্টিক,
বেনারসি পরে স্বামীর বাড়ি যাবে।
তারপর একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে হয়তো আলতো হাসবে, কাঁদবে,মুগ্ধ হবে।
তার পেটের উপর হাত রেখে কাউকে স্বাগত জানাবে। আচারের বয়াম নিয়ে বসবে, তারপর কোলজুড়ে একটা মোমের পুতুল আসবে, বাস্তব পুতুল, যে পুতুলের দিকে তাকালে যন্ত্রণা সব উধাও হয়ে যাবে।

আর সুমনা'র বেলায় হয়েছে উল্টো!
যন্ত্রণা যেন বটবৃক্ষের আঠার মত লেগে বসে আছে।

সুমনা'র অপারেশন হল।
অপারেশন শেষে সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে আসার পর সুমনা'র মা সুমনাকে চোখে চোখে রাখতেন।
সুমনা রুমের দরজা বন্ধ করলেই মা চেঁচিয়ে উঠতেন " দরজা দিচ্ছিস কেন? দরজা খোলা রাখবি সব সময়। "
সুমনা হেসে বলতো " ভয় পেয়ো না মা _
আমি গলায় দড়ি দিব না, মরণ অত সহজ নাকি? কত মানুষ নিজের জীবন ভালোবেসে বেঁচে আছে।
সেটাই তো উচিত।

ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখ ঘটা করে সেই রবীন্দ্র'র সাথে সুমনা'র বিয়ে হল।
ঝলমলে চুল,উচ্চতা ৪"৯ কিংবা ৫"১ হবে বোধ হয়। দেখলেই বোঝা যায় ধীর স্থির তা কিন্তু নয়,
রবীন্দ্র প্রত্যেকটা কথা বলতো মেপে মেপে।
সুমনা রবীন্দ্র-এর ঘরে ঢুকে দেখল তার আগের স্ত্রীর ছবি দেয়ালে টাঙানো।
মনে হচ্ছে জীবন্ত একটা মানুষকে শুধু শুধুমাত্র ছবির ফ্রেমে আটকে রাখা হয়েছে।
তিনি মারা গেছেন গত ছয় মাস আগে।
রবীন্দ্র ছবির সামনে দাঁড়িয়ে চশমা খুলে চোখ মুছতো।
সুমনা'র মনে মনে ভাবতো......
আহা! সম্ভবত স্ত্রীকে কথা দিয়েছিলেন " তুমি মরলেও আরেকটা বিয়ে করব না।"
পুরুষ জাতির কমন ডায়ালগ কিন্তু প্রয়োজনীয়তা প্রতিজ্ঞা ভুলিয়ে দেয় এটা বাস্তবতা।



দীপালী সুমনা'র কাছে আসেনি!
দীপালী হলো রবীন্দ্র র প্রথম পক্ষের মেয়ে।
সুমনা একবার ওর ঘরে গিয়ে রেশমের মত চুলে হাত বুলিয়ে বলেছিলো " চল মামনি তোমাকে খাইয়ে দেই।" অতটুকু মেয়ে কঠিন গলায় বলেছিল, " তুই এখান থেকে চলে যা কুত্তা।"
সুমনা চুপচাপ বসে মনকে বুঝিয়েছিলো " সব অপছন্দের নাম ঘৃণা নয়।
কিছু অপছন্দের মানে তার পছন্দের জায়গায় থাকা মানুষকে সরিয়ে সেই স্থানে সুমনা নিজেকে নিয়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে।
সুমনা নিজে ভাবতে থাকে " আমি মা হলেও  আগের মায়ের একটা সৎ যুক্ত হয়ে মায়ার বাঁধন থেকে ছোট্ট মেয়েটা আমাকে মুক্তি দিতে চাইছে।
আর সুমনা বারবার সেই বাঁধনে মাকড়সার জালের মত আটকা পড়ছে।
স্কুলে যাওয়ার সময় জুতোর ফিতে বেঁধে দিতে চাইলে সুমনা'র হাত সরিয়ে দেয়। সবজি দিয়ে ভাত খেতে বসলে ভাত নাড়াচাড়া করে। সুমনা সহজ গলায় বলে "ডিম ভাজি করে দেই বাবু?"
তবুও দীপালী কথা বলে না।
এরই মধ্যে অনেকের হাজার বার বলা হয়ে গেছে " আহারে মাইয়াডা কেমুন শুকাইয়া গেছে? নিজের মা থাকলে কি এমুন হইত? সৎ মা থাকলে কেডা ভালা থাকে?"

হয়তো দীপালী তাই ভাবে।
কোথায় ঘুরতে গেলে সে কখনো রবীন্দ্র ও সুমনা'র মাঝে তাদের দু হাত ধরে হাঁটে না।
একপাশে গিয়ে হাঁটে ওর বাবার হাত ধরে।
হয়তো ও চায় না --যে হাতে,যে দেহে,যে রক্তে ওর মা মিশে আছেন সেখানে অন্য কেউ আধিপত্য করুক।
সুমনা মাঝ রাতে কখনো কখনো ওর ঘরে যায় আর কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে চুপচাপ চলে আসে।
একটু অসুস্থতায় আমি এদিক ওদিক ছুটোছুটি করি।


জানালা গলে জ্যোৎস্না আসে সেই জ্যোৎস্নায় কিছু না পাওয়া ভাসে, আঁধার বাড়ে,আঁধারের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে হাহাকার।
মাঝে মাঝে দীপালী র পড়া বুঝিয়ে দিতে খাতা কলম নিয়ে সুমনা বসে, দীপালী আনমনা হয়ে বসে থাকে। মায়ের কথা মনে পড়ে বোধ হয়। দীপালী রবীন্দ্র ও সুমনা'র রুমে খুব একটা আসে না, হয়তো অস্বস্তি লাগে কিংবা সুমনা'কে  ঘৃণা করে বলেই আসে না।
হঠাৎ কি মনে করে একদিন রুমে এল, আর আসার আগে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল " আসব?"
সুমনা হেসে বললে " হ্যাঁ অবশ্যই। এটা তো তোমারই ঘর। "
দীপালী মাথা নিচু করে বলল " আমার একটা হোমওয়ার্ক দিয়েছে, সব ঠিক আছে কিনা তুমি দেখে দিতে পারবে?"
--- কেন পারব না? অবশ্যই পারব।
দেখি, খাতাটা দাও
খাতাটা সুমনা'র হাতে দিয়ে দীপালী চুপচাপ খাটে বসে। সুমনা ওর খাতার লেখা পড়তে থাকে, মাই মাদার প্যারাগ্রাফ, সে গোটা গোটা অক্ষরে লিখেছে " মাই মাদার'স নেম ইজ নিরূপমা। শী লাভস মি সো মাচ। আই লাভ হার অলসো।"
সুমনা ভালো করে জানে এটা ওর হোমওয়ার্কের খাতা নয়, সেটার রঙ নীল।  
সুমনা ওর মুখের দিকে তাকায়, ছোট্ট মেয়েটার চোখে ঝরঝর করে পানি ঝরছে, কী আশ্চর্য ! ছোট্ট মানুষ কাঁদবে কেন? ওরা সারাদিন খলখলিয়ে হাসবে শুধু।
সুমনা ওকে টান দিয়ে তার বুকে চেপে ধরে,আর ও সুমনা কে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদে।
" এই বোকা মেয়ে কাঁদিস কেন এমন করে? এমন করে কাঁদলে মায়ের কষ্ট হয় না? "
কী অদ্ভুত! সুমনা'র গলা দিয়ে কোন কথা বের হয় না। কত বছর পর সুমনা তার জমাট বাঁধা কান্না তরল হয়ে গড়াচ্ছে তার হিসেব নিকেশ করছে আর হিসেব মেলাতে পারছে না।
সুমনা মোমের পুতুলটাকে আরও শক্ত করে চেপে ধরে রাখে।