একটা নিখোঁজ সংবাদ ছিল,
পত্রিকার তের নাম্বার পাতায়,
বাড়ি থেকে স্কুল যাবার জন্য,
কিশোরী মেয়েটি সেই যে ব্যাগ কাঁধে
না খেয়ে বেরিয়েছিল, আর ঘরে ফেরেনি।
এলাকা জুড়ে খোঁজা হল,
আত্মীয়, বন্ধু কিংবা কল্পিত প্রেমিক;
কারো বাড়ি যায়নি কিশোরী,
কারো কাছে নেই তাঁর খবর।
তবে কোথায় গেল!
আস্ত একটা মেয়ে তো
দিনের আলোয় তন্ত্র-মন্ত্র বলে
হারিয়ে যেতে পারে না!
পাড়া জুড়ে আলোচনা,
মুখ থেকে মুখে, চিন্তায়, মনে,
কত রং মিশিয়ে কেবল তাঁর নিখোঁজের ব্যবচ্ছেদ।
এই তো দুসপ্তাহ আগের কথা,
কিশোরীকে ও পাড়ার চুড়িওয়ালার সাথে,
কথা বলতে দেখেছিল আক্কাস ব্যাপারী,
উচ্চস্বরে হাসতে শুনেছিল শুকুর আলী খান।
সব শুনে প্রশাবের বেগ সামলাতে না পারা
তাইজাল মোল্লা,
ভরা রাস্তার পাশে শিশ্নদন্ড বের করে
বেলি ফুলকে মুত্র জলে ভেজাতে ভেজাতে বলেছিল,
'খোলা চুলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পরপুরুষের সাথে হাসাহাসি, ফস্টিনস্টি-
ওয়াক থু; গেল, সব গেল - মেয়েটি নষ্টা।'
মুঠোফোনে দেশি-বিদেশি,
নানান ঢঙের, রঙের, মানুষের, পশুর,
নীল চিত্র জমা করা শ্রী তাপস চক্রবর্তী
চোখ কপালে তুলে বলেছিল,
'মেয়েটি বেশ্যা, এ পাড়ায় এসব চলবে না।'
সদ্য ঘুষের কড়কড়ে নোট পকেটে পুড়ে,
রাজপথে একদলা থুথু ফেলে প্রতিবাদ করে ক্রিস্টোফার আবেল বলেছিল,
'মেয়েটি দুঃশ্চরিত্রা,
আমার কাছে আরো প্রমাণ আছে।'
জঙ্গলের আনাচে কানাচে লুকিয়ে,
মেয়েদের গোসল করতে দেখা,
কিংবা সুযোগ পেলেই তাঁদের বুক খামচে ধরা আবদাল সরদার বলেছিল,
'জামার পাশ দিয়ে মেয়েটির অন্তর্বাসের ফিতা দেখা যেত, এসব কিসের আলামত? মেয়েটি সুনিশ্চিত পতিতা।'
কিশোরীর খোঁজ মেলে আরও তিনদিন পর...
এবার সরাসরি এক লাফে,
খবরটি ছাপা হল পত্রিকার প্রথম পাতার,
মোটা লাল কালিতে।
গড়াই নদীর ধারে তাকে যখন পাওয়া গেল,
চেনা দায়।
সারাগায়ে জলন্ত সিগারেট চেপে ধরা ফোসকার দাগ।
খামচে ধরে কারা যেন,
তুলে নিয়েছিল একগোছা চুল,
বাম বুকে তাও ক্ষতবিক্ষত, ছেড়া স্তনটুকু ছিল,
ডান বুকে ছিল না সেটাও।
এ ঘটনার পর-
পাড়া থেকে দেশের মানুষ দু দলে ভাগ হয়ে গেল,
স্ব স্ব ঘোষিত সত্য দল বনাম সত্য দল।
প্রথম সত্য দল:
সংখ্যায় নগন্য; উত্থাপন করেছিলেন চার দফা দাবী।
বিচার চেয়েছিলেন সরকারের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে।
অথচ তাঁদের অধিকাংশই জানতেন না,
কিংবা অনেকে জানলেও মানতেন না,
সরকার মানে তিনি নিজেও,
রাষ্ট্র তাঁকেও খাওয়ায়,
ঠিক যেমন খাওয়ায় খুনিকে, ধর্ষিতাকে, পতিতাকে কিংবা ধর্ষককে।
মোমবাতি জ্বালিয়েছিল তাঁদের কেউ কেউ,
আঁধার কাটেনি।
ধপ করে জ্বলে উঠে ফের নিভে গিয়েছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের চাপে, দ্বিতীয় সত্যদলের হুঙ্কারে।
মনকে এই বলে বুঝিয়েছিল-
কিশোরী তো আমার বোন নয়, মা নয়, আত্মীয় বা রক্তের কেউ নয়।
তাহলে কেন এ শক্তির অপচয়!
দ্বিতীয় সত্যদল:
সংখ্যায় আগাছার মত বেড়ে উঠেছিল,
এখানে, ওখানে, সেখানে যত্রতত্র।
জিবাণুর মত তারা অগণিত, অসংখ্য।
কুকুরের মত একসাথে ঘেউ ঘেউ করে উঠতো সময়ে, অসময়ে...
সে কী শব্দ, সে কী চিৎকার, খিস্তি খেউর,
'এসব কী পোশাক কিশোরীর,
হিজাব পরে নাই, পর্দা করে নাই,
ঠিক পথে চলে নাই, মেয়ে হয়ে স্কুল!
সে তো তেঁতুল,... ঘেউ ঘেউ ঘেউ!!'
এভাবেই দিন গেল,
এক থেকে দুই,
দুই থেকে তিন,
তিন থেকে চার, পাঁচ, ছয়...
পত্রিকার পাতাও উর্ধ্বক্রমে বদলাতে বদলাতে
কিশোরীকে নিয়ে একদিন
লেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেললো রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ।
বন্ধ হয়ে গেল আলোচনা,
সবাই ভুলে গেল কিশোরীর নাম।
তারপর কিছুদিন পর,
আরেকটা নিখোঁজ সংবাদ ছাপা হল,
পত্রিকার সেই তের নাম্বার পাতায়...
এবারের কিশোরীকে আপনি চিনবেন,
এবারের কিশোরীকে আপনি জানবেন,
তার বাবার নামের সাথে,
আপনার বাবার নামটা যে শতভাগ মেলে!!!