🎁 আলোচ্য সূচী:
১. কবি কে?
২. ভালো সাহিত্য মন্দ সাহিত্যের মাপকাঠি
৩. নতুন কবি বনাম ছন্দ
৪. উন্নততর কবি হতে চাইলে
৫. কবি কেমন হবেন?
৬. সাহিত্য আসলে কী?
৭. তবে কি বাংলা ভাষা মরে যাবে?
৮. শিক্ষিত সাহিত্যিক
৯. লেখার মানোন্নয়ন চান?
১০. ভবিষ্যত পৃথিবীর সাহিত্য
১১. রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার নিয়ম এবং
বিঃদ্রঃ― সকলেই অদ্বিতীয় এবং সবার দেখার দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা এজন্যই সাহিত্য এত সুন্দর এবং ব্যাপক স্বাদের। এই বইটি কোনো নিয়ম নয়, কারোর ওপর কোনো মতবাদ চাপিয়েও দিতে চাইনা। এই বইটির একমাত্র উদ্দেশ্য সকলের লেখা আরও উন্নত হোক নিজের নিজের মৌলিকতা বজায় রেখে― সেজন্য কিছু জিনিস জানার খুব দরকার। সকলেই নিজের নিজের সংবিধান নিজের মতো করে বানাবেন― এই লেখা এবং বড়ো বড়ো সাহিত্যিকদের সাক্ষাৎকার শুনে সবাই নিজের নিজের লেখার ধরণ অনুয়ায়ী নিজের মতো করে এই লেখাটিকে সংশোধন করে নিজের জন্য রাখবেন। প্রতিটি সাহিত্যিকের লাইফস্টাইল ও লেখা আরও সুন্দর তথা আনন্দময় হোক এবং সকল পাঠকদের জীবন সুসমৃদ্ধ হয়ে উঠুক এই আশা করে এই খসড়া সংবিধান রচনা। এটি তরুণ সাহিত্যিকদের উদ্দেশ্যে লেখা। আসুন ঈশ্বরপ্রদত্ত শক্তিকে প্রয়োগ করে স্বর্গের চেয়েও সুন্দর এক পৃথিবী গড়ে তুলি। এই লেখার যদি আর কোনো উদ্দেশ্য থাকে তবে তা হল― প্রতি দশ বছরে যেন কমপক্ষে একজন ভারতীয় কবি নোবেল পুরস্কার পান। প্রতিটি বই সকলে নতুন নতুন ধারায় ও স্বাদে লিখুন― কবিরা যে স্বাধীন সেটা বুঝিয়ে দিতে এবং কবিরা যাতে মরার স্বাধীনতার হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারেন সেজন্যই এই দুঃসাহসিক প্রয়াস।।
📓✒️ কবি কে?
কবি জীবনানন্দ দাস বলেছেন “সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি"! এখন প্রশ্ন― কবি কে? এককথায় বলতে হলে বলব― যাদের দেখার চোখ আলাদা তারাই কবি, বাকি যারা নিজেদের কবি ভাবেন তারা হলেন ঘোড়ার ডিম! যারা দেখতে পান না তারা অন্ধ নন, তারা হলেন হতভাগ্য; বরং যারা পৃথিবী ও জীবনকে ঠিক আগের দিনের মতো দেখেন তারাই অন্ধ। আপনার দৃষ্টি উন্নত করুন এবং অদৃশ্যকে দেখুন। ভাষা, ছন্দ ইত্যাদি সেকেন্ডারি। প্রথম হল, "অন্তর্দৃষ্টি" আর দ্বিতীয় হল, "হৃদয়বিস্তারি আবেগ"― এই দুটিই কবিতার প্রধান ও প্রাথমিক কথা।
ভাষার (পড়ুন শব্দের) গুরুত্ব কতটুকু? ঠিক ততটুকু যতটুকু প্রয়োজন নিজের আবেগ ও অনুভূতিকে অন্যের হৃদয়ে সংক্রমণ করতে। কবির কাজ ভাব প্রকাশ নয়, কবির কাজ ভাবের সংক্রমণ! "সংক্রমণ" বললেও ঠিক ঠিক বলা হয় না― সঠিকভাবে বললে হয় একাধিক হৃদয়ের মাঝে নিহীত একত্বের আবিষ্কার! কবির কাজ হৃদয় ছোঁয়া নয়, কবির কাজ হৃদয়ে হৃদয় জোড়া। আবেগের materialization করাতেই শব্দের প্রয়োজন― ঠিক যেভাবে ইঁট ইঞ্জিনিয়ারের ব্লুপ্রিন্টকে বাড়িতে পরিণত করে। আর একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে ভাষা যেন কাব্যিক হয়― কবিতার জায়গায় ছন্দবদ্ধ প্রবন্ধ যেন না হয়ে যায়।
ছন্দের গুরুত্ব কতটা? ছন্দ যেন বাড়ি তৈরির সিমেন্ট! শব্দকে খাঁচে খাঁচে বসাতে সাহায্য করে। বই পড়ে ছন্দ না শিখে ইউটিউব ও ফেসবুকে উপস্থিত পেশাদার আবৃত্তিকারদের আবৃত্তি নিয়মিত শুনলেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছন্দ আসবে।
কবিতার মূল কাজটি করে অন্তর্দৃষ্টি! এ যেন ইঞ্জিনিয়ার! আবেগ হল ব্লুপ্রিন্ট বা ডিজাইন-ড্রয়িং। সুসজ্জিত শব্দ হল ইঁট আর স্বতঃস্ফূর্ত ছন্দ হল সিমেন্ট! শব্দ চয়ন আর ছন্দবদ্ধ করা এগুলো চাইলেই যে কেউ করতে পারে― সহজেই শেখা যায়। কবির ছোটো বড়ো নির্ধারিত হয় প্রথম দুটিতে। চিন্তনের গভীরতা আর হৃদয়ের বিশালতা― এই দুটি উন্নত করাই কবির প্রধান কাজ। এগুলোতে মন না দেওয়াতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে বাংলা ভাষায় আর কেউ নোবেল পাননি আর এগুলো উন্নত না হলে কেউ পাবেনও না। অন্তর্দৃষ্টিই কবি। ডুব দাও! এটাই যথেষ্ট।
কবির আরও উচ্চ সংজ্ঞা: চিন্তাভাবনা করে করে যখন আমাদের কবিতা লিখতে হয়― সেইরকম লক্ষ লক্ষ কবিতা লিখলেও আমরা তখনও আসল কবি নই― তখন অব্দি আমরা আমাদের মনকে কবি হওয়ার যোগ্য বানাচ্ছি মাত্র। যখন আমাদের আর চেষ্টা করে কবিতা লিখতে বা ভাবতে হয় না― যখন অনন্ত কবিতার স্রোতের মালিক হই আমরা― তখন মনকে যেকোনো সময় যেকোনো বিষয় দিলে সে তৎক্ষণাৎ উৎকৃষ্ট কবিতা রচনা করে। আসলে মন তখন রচনা করে না, মন তখন সদাপ্রবাহমান কবিতার স্রোত থেকে একটি সঠিক কবিতা ধরে নেয়― যেন কোনো এক অদৃশ্য লাইব্রেরির থেকে সঠিক কবিতাটি মন আবৃত্তি করে আর হাত তা লেখে। যেমন― রেডিও তরঙ্গ সবজায়গায় সবসময় প্রবাহিত, কিন্তু যার বেতারযন্ত্র নেই, তিনি সেই তরঙ্গ ধরতে পারেন না। এই চেষ্টা করাটাই সাধনা আর স্রোতের দরজা খোলাটাই সিদ্ধি। তবুও দুইধরণের কবিকেই কবি বলা যায়।
📓✒️ ভালো সাহিত্য মন্দ সাহিত্যের মাপকাঠি
সাহিত্য একটা শিল্প―আর্ট, যার ভালো লাগে তাঁর ভালো লাগে। একজন শিল্পী কোন বাধা মানতে বাধ্য নয়। পূর্ণ স্বাধীনতা না থাকলে আর্ট উন্নতি করে না, সাথে সাথে পূর্ণ স্বাধীনতা পাওয়ার এক পাওয়ারফুল মাধ্যমও হল আর্ট। একজন শিল্পী অবশ্যই বিপরীতধর্মী মতামত শুনবেন কিন্তু তিনি তা মানতে বাধ্য নন। যে শিল্পী অন্তরাত্মা বা খাঁটি প্রকৃতি কিংবা মানবতার যত কাছাকাছি তিনি তত বড়ো।
শিল্পী নিজে যদি তাঁর কৃত শিল্প দেখে আশ্চর্য হন, হকচকিয়ে যান, হতবাক হন বা বিস্ময়াবিভূত হয়ে যান তবেই সেই শিল্প একাধারে অভিনব ও অসাধারণ। এমন ঘটনা শিল্পী এবং শিল্প উভয়ের জন্যই গৌরবজনক। যে শিল্পীর জীবনে এমন ঘটনা যতবেশি ঘটে সেই শিল্পী তত বড়ো মাপের। বিস্মিত, মুগ্ধ ও সন্তুষ্ট― শিল্পীর মনের অবস্থার বিচারে আর্ট এই তিনপ্রকারের। বাকি আর কোনোকিছুই আর্ট নয়, সেসব নির্দ্বিধায় আবর্জনা স্তুপে ফেলার যোগ্য। তবে এই বিচার কে করবে? স্বয়ং শিল্পী বিচার করবেন; অন্য কারোর এ বিচারের অধিকার নেই। তাঁর কৃত শিল্পকলার বিচারের সময় শিল্পীকে নিজের প্রতি পুরোপুরি সৎ হতে হবে।
আর একরকম ভাবে সাহিত্য তথা সব ধরনের আর্টের বিচার করা যায়― "হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া অথবা জীবন পাল্টানো আর্ট" এই প্যারামিটারের বিচারে। এখানে "অথবা" শব্দটি খুব গুরুত্বপূর্ণ! সব হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া কাব্য বা আর্ট জীবন পাল্টানো আর্ট নাও হতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়― কোনো কবির কবিতা একহাজার জনের ভালো লাগলো কিন্তু সেই একহাজার জনের মধ্যে মাত্র একজনের জীবনে তা প্রভাব ফেলল, অন্যদিকে অন্য কবির কবিতা মাত্র কুড়িজন পড়ল কিন্তু তা দুইজনের জীবনে প্রভাব ফেলল! তাই কোনো কলা অনেক লোকের ভালো লাগে তার অর্থ সবসময় এটা নয় যে সেই আর্টটি উৎকৃষ্ট। সর্বোচ্চ স্তরের উৎকৃষ্ট আর্ট হল সেটাই যেটা পাঠক-শ্রোতা-দর্শকের হৃদয়ও ছুঁয়ে যাবে আবার তার চিন্তাভাবনার পরিবর্তনও ঘটাবে। এটা বিচারের দায়িত্ব পাঠক-শ্রোতা-দর্শকদের, তবে সবার একই আর্ট উৎকৃষ্ট নাও মনে হতে পারে।
তবে কি সাধারণ ভাবে আর্টের বিচার করা যায় না? যায়। শিল্পী আবেগের রঙ আর বিবেকের তুলি দিয়ে বিষয়কে আঁকেন। যে শিল্পী চাইলেই পাঠক-শ্রোতা-দর্শকদের হাসাতে কাঁদাতে বা ভাবাতে পারেন তিনিই শিল্পী হিসেবে শ্রেষ্ঠ। যে শিল্পীর জীবনে এমন ঘটনা যতবেশি ঘটে সেই শিল্পী তত বড়ো মাপের। আর যে আর্ট পাঠক-শ্রোতা-দর্শকের মনকে সম্পূর্ণরূপে কেড়ে নিয়ে উক্ত আর্টেই পূর্ণ মনোযোগ দিতে বাধ্য করায় তাই শ্রেষ্ঠ। আর সর্বশ্রেষ্ঠ তিনি বা সেটাই যিনি বা যেটা জনমানসে তথা সমাজের সংস্কৃতিতে ব্যপক প্রভাব ফেলেন। তবে এতেও সঠিক বিচার হল না― কারণ কিছু আর্ট চিরন্তন আর কিছু সাময়িক কালের জন্য সৃষ্টি। সুতরাং এই দুইশ্রেণীর মধ্যে কোনো তুলনা হতে পারে না।
যদিও আর্টসের বিচার সম্ভব তবুও আর্টস বিচারের বিষয় নয়, আর্টস অনুভবের ও উপভোগের বিষয়। শিল্পীর সাথে সাথে পাঠক-শ্রোতা-দর্শকদের মধ্যেও শিল্পীসত্তা বর্তমান। শিল্পীর মতে যে শিল্প শ্রেষ্ঠ একজন শিল্পীর আদর্শ সেটাই হওয়া উচিত, এবং তার শিল্পকর্মকে নিজের মতো করে তত ভালো করার দিকে ক্রমশ এগিয়ে যাওয়া উচিত। আবার পাঠক-শ্রোতা-দর্শকের মতে যা শ্রেষ্ঠ বা তাঁর চাহিদা যা তিনি তাই গ্রহণ করবেন। এতে উভয়েরই মঙ্গল। তবে সময়ের সাথে সাথে মনের বিকাশ হয়, তখন উভয়েরই আদর্শের পরিবর্তন হতে পারে, আর এটাই তো শিল্প-শিল্পী-গ্রহীতা উভয়কেই উৎকৃষ্ট থেকে উৎকৃষ্টতর করে।।
📓✒️ নতুন কবি বনাম ছন্দ
নতুন যারা কবিতা লিখছো বা লিখতে চাও, তাদের বলছি:
তোমরা ছন্দ নিয়ে মোটেও চিন্তা করবে না। যা আসছে লিখে ফেলো। যেভাবে আসছে লিখে ফেলো। লেখার স্বাভাবিকতাকে নষ্ট হতে দিওনা।
মন যদি দিতেই হয় তবে ভাবনার অভিনবত্ব, বিষয়ের গভীরতা আর উচ্চতর সত্য খোঁজায় মন দাও। ছন্দ নিয়ে বৃথা মাথা বকিও না। এখন ছন্দ নিয়ে বেশি মাথা ঘামালে ছন্দটা রপ্ত করতে পারলেও কবিতা লেখার স্বাভাবিকতাটা ছেড়ে চলে যাবে, কবিতা আসবেই না যেন। মনে রেখো, এটা প্রথম পর্যায়, তাই আবারও বলছি ছন্দের ভয় মন থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেলো। তোমার মনে হয়তোবা খটকা লাগবে ছন্দ হচ্ছে না, কবিতা হচ্ছে তো? কিছুদিন পর দেখবে যা লিখছো তাতেই অটোমেটিক ছন্দ হয়ে যাচ্ছে, নতুন ধরনের ছন্দ জন্ম নিচ্ছে। তখন দেখবে অন্যেরা এমনকি বিখ্যাত কবিরাও আবার তোমার ছন্দে লেখার চেষ্টা করবে! আসলে ছন্দের জন্য কবিতা নয় বরং কবিতার জন্য ছন্দ! আর তুমি ছন্দ লিখতে বসছো না, কবিতা লিখতে বসছো।
মহেন্দ্র সিং ধোনিকে দেখো, লোকটার নিজস্ব একটা স্টাইল আছে। সবাই কপিবুক ক্রিকেট খেলে, কিন্তু উনি কাউকে কপি করেন না। আর এখন উল্টে অন্যেরা উনাকে কপি করার চেষ্টা করেন। হ্যাঁ অবশ্যই রাহুল দ্রাবিড় ভালো টেকনিক্যাল ব্যাটস্ম্যান। কিন্তু খেলাটাই লক্ষ্য, স্টাইলটা নয়।যেভাবেই চার মারুন চার চারই, ছয় ছয়ই! সুর দিতে জানলে যেকোনো শব্দই যেমন গান হয়ে যায়, তেমনি আবৃত্তি করতে পারলে যে কোন লেখাই কবিতা হয়ে ওঠে, তাতে তা পদ্য, গদ্য বা নাটক যাইহোক। তবে শুধু একদুটো শব্দ পরিবর্তন বা এদিক ওদিক করতে হবে, এই যা!
ছন্দ, ছন্দ, তবে ছন্দ কোথায় গেল? আরে দাদা দিদিরা, ছন্দ পরে হবে। আগে কবিতা হোক। আগে অপরিশোধিত তেল খনি থেকে তুলে আনুন, তারপর না হয় পরিশোধন করে ডিজেল,কেরোসিন বানানো যাবে, first step first.
নতুনরা, তোমরা কি তবুও ছন্দ নিয়ে ভয়ে আছো? তোমরা কি ভাবছো ছন্দের কোনো বিকল্প আছে কিনা? আমি বলব "আছে", ছন্দের বিকল্প আছে এবং তা হল "আবেগ"! আবেগ দিয়ে কবিতার ছন্দজনিত দূর্বলতা দূর করা যায়। আবেগ দিয়ে ছন্দকে জয় করা যায়। আবেগ নিজে নিজেই ছন্দ তৈরি করে দেয়। স্বতস্ফূর্ত আবেগই ছন্দ। কবিতা সর্বদাই ছন্দের ওপর মাস্টারি করবে― ছন্দতো বাচনভঙ্গি মাত্র!
কিছুদিন লেখালেখির পর অন্য আধুনিক কবিদের লেখালেখি পড়া শুরু করো। পড়ো, আরো একটু পড়ো। দেখবে তারও কিছুদিন পর তোমার মধ্যে ছন্দের একটা স্বতস্ফূর্ত বোধ সৃষ্টি হয়েছে। তোমাকে কিন্তু তার জন্য কষ্ট করতে হল না, ছন্দও শিখতে হল না, কিন্তু কাজের কাজ হয়ে গেল। বেশ সহজ না? ব্যাকরণের বই পড়ে ছন্দ না শিখে ইউটিউব ও ফেসবুকে উপস্থিত পেশাদার আবৃত্তিকারদের আবৃত্তি নিয়মিত শুনলেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছন্দ আসবে। এটা হল দ্বিতীয় ধাপ। এখন দেখবে তোমার কবিতা ছন্দযুক্ত হয়ে একটা অন্যরকম মাত্রা পাচ্ছে।
তৃতীয় তথা শেষ ধাপ, ছন্দের পারে চলে যাওয়া। পুরোপুরি ছন্দকে জয় করে নেওয়া। এটা অনেক অনেক লেখার পর হয় (বয়সের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই)। তখন ছন্দের কথা ভাবার কোনো দরকারই পড়বে না। তখন তুমিই রাজা, যা লিখবে তাই ছন্দ।
প্রথম ও তৃতীয় ধাপ দেখতে কিন্তু একই, কিন্তু দুটোর মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য। দু'ধরনের কবির কবিতা পড়লেই বুঝতে পারবে সেকথা। সে যাইহোক এখন মাথায় একটা কথাই রেখো, first step first.
ছন্দ নিয়ে experiment করো। কবি সুকান্ত একবার আক্ষেপ করেছিলেন আমরা ছন্দ নিয়ে নতুন কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করিনা বলে! তোমরা তরুণ প্রজন্ম, তোমরাই নতুনের দূত, আমার বিশ্বাস তোমরা পারবে! এক হয় নির্মাণ, আর এক হয় সৃষ্টি; তোমরা সৃষ্টিতে মন দাও। আমার আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছা জেনো।
📓✒️ উন্নততর কবি হতে চাইলে
(১) কবিতা শুধুমাত্র সৃষ্টির জন্য নয়, সৃষ্টির মাধ্যমে নিজের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য। আত্মোন্নতিই মানব জীবনের লক্ষ্য। প্রথম প্রথম ব্যক্তিগত জীবন আর কাব্যজীবন পৃথক হওয়া দরকার, যখন যাকে সময় দেবেন তখন তাকেই; নইলে চিন্তার চোটে মাথা পাগল হবার জোগাড় হয়। এটা কিছুদিন অভ্যাসের পর নিজের থেকেই জীবনের priority মতো মন কাজ করে। কবিতা লিখতে লিখতেই আত্মমন্থন হয়, যা গভীরের জ্ঞানকে বাইরে আনে আর আত্মবিকাশ ঘটায়। লক্ষ্য করলে দেখা যায় বড়ো বড়ো কবিদের ব্যক্তিত্ব খুব শক্তিশালী এবং তাদের মাথাও সুস্থ, যেমন-- রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শঙ্খ ঘোষ, মাইকেল মধুসূদন, বাল্মীকি, ব্যাসদেব, সেক্সপিয়র প্রমুখ। যাদের মনের বা চিন্তার ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই তারা বড়ো হতে পারেন না। অপরিণতরা নাম বা পয়সার জন্য লেখেন, প্রথম প্রথম এটা ঠিক আছে কিন্তু ধীরে ধীরে এর বাইরে আসতে হবে, না হলে প্রতিভার বিকাশ হবে না, আর উচ্চস্তরের কবিতাও আসবে না; শুধুমাত্র কয়েকজন অবুঝ পাবলিকের মনভোলানো দাস হয়ে কবি রয়ে যাবেন। কবিদের শুধুমাত্র কবিতায় ফোকাস করা উচিত, কবিতা ভালো লিখলে-- না চাইলেও খ্যাতি ও টাকা আসবে। তবে একটা বাস্তব কথা, শুধুমাত্র কবিতা লিখে আজকের যুগে সংসার চালানো যায় না, আর তাই অন্যের দেখে নিজের "লেভেল" ও "standard" ছোট না করাই ভালো। নিজের কবিতাকে বেড়া দিতে হবে, যত্ন করতে হবে। কবিতার ভাবে ও কথায় বেড়া দেওয়ার মাধ্যমে প্রকারান্তরে কবি নিজের thought process-এ বেড়া দেন, যা অজান্তেই কবির আত্মবিকাশ ঘটায়।
(২) আবার অনেক কবি বলেন, তারা নাকি নিজেদের জন্য লিখেন। খুব খুব ভালো কথা। কিন্তু তা যখন প্রকাশ করা হয় বা পোস্ট করা হয় তখন তা আর কবির একার থাকে না। তাই দায়িত্বজ্ঞানহীন লেখা পোস্ট করার আগে তাদের চিন্তা করা উচিত। তলে তলে প্রশংসা চাওয়া আর ওপরে ওপরে বড়ো বড়ো কথা বলা! আপনার প্রকাশিত কবিতা পড়ে কারোর যদি কিছু লাভ নাই হল, শুধু বেচারা পাঠকের সময়নষ্ট হল আর আপনার সামান্য কিছু আয় হল তো এসব কবিতা প্রকাশ করা একপ্রকার বৃথা। ভগবানের যেমন তৃতীয় নেত্র আছে তেমনি সমাজেরও তৃতীয় নেত্র আছে, আর কবিই হলেন সমাজের তৃতীয় নেত্র। তাই ভালোভাবে দেখা উচিত যেন তৃতীয় নেত্রের অপপ্রয়োগ না হয়। তাই কবিতা শুধুমাত্র সৃষ্টির জন্য নয়, সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের প্রগতিতে যোগদান করার জন্য। অবশ্যই কবির মনখুলে হৃদয়ের কথা বলার অধিকার আছে কিন্তু তা যেন মানবতাকে আঘাত দিয়ে না হয়। মানুষের গভীর বিশ্বাসে আঘাত করার অধিকারও কবির আছে তবে বন্দুক ধরার আগে কবিকে বাঁদর থেকে মানুষ হতে হবে এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হয়ে কাজ করতে হবে। আবার যারা ভয় করেন তারা বড়ো কবি হতে পারেন না। সমাজের বাজের প্রতিবাদ করতে না পারলে কিসের কবি?
(৩) কবিতা আনন্দের জন্য, সৃষ্টির মাধ্যমে আনন্দ উপভোগ ও বিতরণ করার জন্য। হাজার হোক কবিতা একপ্রকার আর্ট। তাই তা আর্টয়ের মতোই হওয়া উচিত। যা তা লিখলেই আর্ট হয়না। মানছি একতাল কাদামাটিও আর্ট কিন্তু যখন তার প্রয়োগ সঠিক জায়গায় কিংবা সঠিকভাবে হয় কেবল তখনই।
(৪) কবিতা নির্মাণের জন্য নয়, কবিতা সৃষ্টির জন্য। একক্ষেত্রে সৃষ্টি সৃষ্টিরই জন্য, তখন যখন কবি পথ প্রদর্শন করেন। নতুন দিশা দেখান। দিশা শুধুমাত্র নতুন হলেই হয়না, তা সঠিক হওয়াও বাঞ্ছনীয়। বাস্তব জীবনের উদাহরণ দিয়ে জিনিসটা বোঝা যাক, যেমন ধরুন ফুলের বদলে কেউ পুঁটিমাছের মালা গেঁথেছে, এটা সৃষ্টি না সৃষ্টিছাড়া? পা দিয়ে খাবার হওয়া খুবই নতুন জিনিস কিন্তু এটা কে কি সৃষ্টি বলা যায় নাকি অপসৃষ্টি?
🏋️ অতিরিক্ত কিছু টিপস:
a. আধুনিক বিখ্যাত দেশি ও বিদেশি কবিদের লেখা পড়ুন।
b. নিজের কবিতা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করুন।
c. কবিদের সাক্ষাৎকার দেখুন, শুনুন ও পড়ুন।
d. একাধিক পাবলিক ওয়েবসাইট, ফেসবুক ও অ্যাপে লিখুন ও অন্যদের লেখা পড়ুন। "কুয়োর ব্যাঙ" হলে আমাদের চলবে না। একজায়গায় অনেক দিন থাকতে থাকতে আমাদের উন্নতির ইচ্ছা কমে যায় এবং পরিবেশের বাকিদের সাথে আমরা সম্পৃক্ত হয়ে যাই। তাই কেবল একটি ওয়েবসাইটে না লিখে অন্য জায়গাতেও লিখুন এবং অন্যদের কবিতাও পড়ুন।
e. মাঝেমধ্যে কবি সম্মেলনে যোগদান করুন।
f. নোবেলজয়ী কবিদের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কারণ হিসেবে নোবেল কমিটি কী কী বলেছেন তা লিখে রাখুন এক জায়গায়।
📓✒️ কবি কেমন হবেন?
সকলের লেখা এবং ব্যাক্তিত্ব নিজের নিজের আলোকে উজ্জ্বল থাকবে। সবাই ইউনিক থাকুন। তবুও এখানে একটি জেনারেল আইডিয়া দেওয়ার চেষ্টা করছি।
কবিতা লেখিয়ে ও কবির মধ্যে অনেক অনেক পার্থক্য। কবিকে প্রতিটি মূহুর্তে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয় এমনকি নিজের আবেককেও ভেংচি কাটতে হয় কখনো কখনো, নিজের চরিত্রকে শুদ্ধ রাখতে হয় সর্বদা। এও ঠিক ছিল, কিন্তু এক একটা সত্যের জন্য নিজেকে মনে মনে কেটে টুকরো টুকরো করতে হয়, মনে জমে থাকা সব সংস্কারকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে হয়, লোকে যা বিশ্বাস করে সেটাকেও বিবেক করে দেখতে হয়, এমনকি অনেক অনেক কবিতা লেখা হয়ে গেলেও কখনো কখনো উর্ধ্বতর সত্যের খাতিরে সেগুলোকে কেটে ফেলতে হয়।
একজন সত্যিকারের কবির কোনোপ্রকার রাজনৈতিক দল বা কোনোধরনের কোনোপ্রকার মতবাদেরই দাস হওয়া উচিত নয়,যে মুক্ত নয় সত্য তার কাছে ধরা দেয় না। যারা কোনোপ্রকার রাজনৈতিক দলের দাস তারা বড়ো কবি হতে পারলেও কবি হিসেবে বড় হতে পারেন না। কবির দায়িত্ব অনেক,তাকে সর্বদা সত্য, মানবিকতা ও আশার প্রতীক হতে হয়। একজন শিক্ষকের যা দায়িত্ব,একজন কবির দায়িত্ব তার চেয়ে শত শত গুন বেশি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে হয়,যে প্রতিবাদে ভয় পায় সে কবি নয়।
যারা সস্তায় প্রশংসা আসা করেন তারা কবি হতে পারেন না। লোকে যা শুনতে চায় তা শোনানো কবির কর্ম নয়, বরং লোকের কী শোনা উচিত তাই শোনানো তার কাজ,এইজন্যই কবিরা পথপ্রদর্শক।একজন কবি তার প্রিয়জনকে পর্যন্ত পুরোপুরি সময় দিতে পারেন না, এতটাই কষ্টকর তার জীবন।
প্রায় সবসময় মাথায় লক্ষ কোটি কোটি চিন্তা ঘুরপাক খায়, একজন কবির পক্ষে সবচেয়ে কঠিন কাজ হল নিজের মাথা আর মনটাকে সুস্থ রাখা। এজন্য কিছু উপায় নেওয়া যেতে পারে:
১. লেখার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় করতে হবে। অন্য সময় লেখালেখি নয়। অন্য সময়ে কোনো ভালো লেখা মনে এলে একটি বা দুটি শব্দ (key words) লিখে রেখে নিজের কাজ করতে হবে― লেখার টাইমে key words দেখে আবার মনে পড়বে লেখাটা, তখন লিখতে হবে।
২. পরিমিত ঘুম, পুষ্টিকর খাবার, মাঝেমধ্যে একাকী ভ্রমণ ইত্যাদি দরকার।
৩. ঘুম থেকে উঠে প্রথম দেড়ঘন্টা কেবল self care এর জন্য দিতে হবে। প্রথম দেড় ঘন্টায় ফোন টাচও করা চলবে না। আধ ঘন্টা হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়ম, আধঘণ্টা পড়াশোনা (সাহিত্য ও নিউজের বাইরের) এবং আধঘণ্টা ধ্যান― এই দেড়ঘন্টা কেবলমাত্র নিজের জন্য রাখতে হবে।
৪. নিজের values, নিজের চরিত্রের strength, নিজের জীবনের লক্ষ্য এবং বিভিন্ন মনীষীর 25-30 টা মহান বাণীর একটি লিস্ট খাতায় লিখতে হবে। নিয়মিত সেগুলো পড়তে হবে এবং মানতে হবে।
৫. এযুগে কবিতা লিখে পেট চলে না, তাই সংসার চালানোর জন্য অন্য একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
যারা সত্যিকারের কবি হয় তারা একজীবনে অনেক অনেক লোকের জীবনে বাঁচতে পারে, এটা হয়।
📓✒️ সাহিত্য আসলে কী?
ভাব আর কল্পনার যোগ হল সাহিত্য; শব্দের অলংকার হল তার নববধূর সাজ। শব্দ বা ভাষা নয়, ভাবে (তত্ত্বে) ও কল্পনায় আমাদের মন দিতে হবে। তত্ত্বরূপ সিমেন্টকে আবেগময় শব্দরূপ জলে গুলে কল্পনার ইঁটের খাঁজে খাঁজে বসাতে পারাই সাহিত্য।
আগে আদিম মানুষরা ঈশারায় কথা বলতেন অর্থাৎ ভাবপ্রকাশ করতেন। তখন ভাষার আবিষ্কার হয়নি। আবার আমরা দেখি যে বাচ্চারা কথা না বললেও মা ঠিক বুঝতে পারে সন্তানের ভাব।
আজও কথা না বলেও বডি ল্যঙ্গুয়েজ এবং ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন দ্বারা আমরা সবসময় কমিউনিকেট করে চলি। তাই শব্দ ছাড়াও সাহিত্য সম্ভব― প্রকৃতি সবসময় গভীর ও মিষ্টি সঙ্গীত গেয়ে চলেছে― আমরা সমসময় তা ধরতে পারি না।
সাহিত্যকে কাগজ-কলম বা টাইপিং কিংবা মুখের আবৃত্তি বা গল্প হতে হবে― এমন দিব্যি কে দিয়েছে? যারা বোবা-অন্ধ-কালা তারা কি সাহিত্যের রসাস্বাদনের অধিকারী নন? আবেগানুভূতি আর জ্ঞানের অপূর্ব মিশ্রণই সাহিত্য। ভাষা অবশ্যই ভাবের বাহন। একদম সত্যি কথা। কিন্তু ভাবের কেবলমাত্র একটিই বাহন কি? আগেকার দিনের চ্যার্লি চ্যাপলিলেন সিনেমা এবং এখনকার মিস্টার বিনের কার্টুন― এগুলোও সাহিত্য― এখানে কথার দরকার হয়নি। এখনকার উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বা সাধারণ বাদ্য যন্ত্র বাজানো তথা ইন্সট্রুমেন্টাল মিউজিকেও কিন্তু কোনো শব্দ বা ভাষা নেই― তবুও তা আমাদের আনন্দিত ও একাগ্র করে। ইউটিউবে বা ইন্টারনেটে সার্চ করলেই sign language poetry বা deaf poetry দেখতে পাওয়া যাবে― শব্দ ছাড়া ঈশারার মাধ্যমে প্রকাশিত কবিতা। নৃত্য গান নামক সাহিত্যের ঈশারা রূপ। অনেক সময় গান ছাড়াও আমরা আনন্দে নেচে উঠি, এক্ষেত্রে ভাব অর্থাৎ সাহিত্য ভাষা ছাড়াই সরাসরি নৃত্যরূপে প্রকাশিত।
প্রতিটি আবেগ বা অনুভূতি দিয়ে যেমন এক একটি সাহিত্য লেখা যায়, তেমনি প্রতিটি আবেগ বা অনুভূতিও এক একটি বা অনেকগুলি সাহিত্য। আমরা যে দুশ্চিন্তা করি, খুশি হই বা কাঁদি― এগুলোর প্রতিটিই সাহিত্য― হয়তো অনেক উচ্চমাত্রার বা গোছানো নয়। তাই আমরা ধরতে পারি না কারণ আমরা ততবেশি ক্রিয়েটিভ নই। এগুলোকেই কাজে লাগিয়ে এগুলোর ছাঁচে ভাষাকে ফেলে উচ্চমানের বা সর্বোচ্চ স্তরের বা উৎকৃষ্ট সাহিত্য লেখা হয়।
📓✒️ তবে কি বাংলা ভাষা মরে যাবে?
"...আছে কোন এমন ভাষা/এমন দুঃখ ক্লান্তিনাশা..." অথচ, আজ অবস্থা এরকম যে যদি আপনি শুদ্ধ বাংলায় কথা বলেন তবে আপনার পাশের বাঙালি ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলাটি তা বুঝতে পারবেন না। আজ মাঝারি ও বড়ো শহরগুলোর "আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসেনা"-র অবস্থা! তবে গ্রামবাংলার মানুষজন বাংলাতেই কথা বলেন।
ভাষার ক্ষেত্রে গভীরতম সত্যটা হল, ভাষার ব্যবহার অর্থপূর্ণ ভাব প্রকাশের জন্য। ভাবপ্রকাশ যে বাংলাতেই করতে হবে এমন কোনো দিব্যি দেওয়া নেই। থাকলে আজকের এই এত সুন্দর বাংলাভাষা পেতামও না, আমাদের পূর্বপুরুষদের মাতৃভাষা খটমট সংস্কৃত বা আদিম হিজিবিজি বাংলা বা খুব জোর বাংলা সাধুভাষাতেই আমরা আটকে থাকতাম। সময়ের সাথে ভাষা বা মাতৃভাষা বদলাবে, এই বদলানো আমরা মানি বা নাই মানি চলতেই থাকবে। আর আমরা সবাই জানি যে, যে ভাষা অন্য ভাষার শব্দাবলী বেশি গ্রহণ করতে পারে সেই ভাষাই বেশি সমৃদ্ধ ও সতেজ! কিন্তু আমরা বাঙালীরা বিতর্ক সভায় আবেগের বশে এটা মানতে চাই না।
পেশার খাতিরে মানুষ বিভিন্ন জায়গায় যায়, এটা ভাষার বিবর্তনের অন্যতম কারণ। আমি বাঙালি মানে আমি হিন্দিভাষী বা ইংরেজিভাষীর সাথে বাংলাতে কথা বলবো এমনটাতো হতে পারে না, তাহলে ব্যবসার ক্ষতি হবে বা চাকরি যাবে। আর আমার কথা(পড়ুন ভাষা) যদি কেউ বুঝতেই না পারলো তবে কথা বলাটা নিরর্থক। আর একটা কথা আমাদের মাথায় রাখতে হবে, মানুষের প্রথম তিনটি দরকারি জিনিস হল, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান; ভাষা রক্ষা করা নয়। যে রাজ্যের(পশ্চিমবঙ্গের) প্রায় পঁচাত্তর শতাংশ মানুষের মাসিক আয় পাঁচ হাজার টাকার নীচে তারা নিজের পরিবারের অন্ন যোগাবে নাকি রবিঠাকুরের গান গাইবে? বাংলাদেশের অবস্থা এর থেকে ভালো কিন্তু তারাও গরীব দেশ, তবে যেহেতু ওইদেশের ভাষা বাংলাই তাই অন্য ভাষায় তাদের কথা বলতে হয়না। নইলে জীবন ও জীবিকার দায়ে তাদেরকেও হিন্দি বা অন্য কোনো ভাষা বলতে হতো।
এবার পড়াশোনায় আসা যাক। যদি বাংলা মাধ্যমের স্কুলে ভালো পড়াশোনা না হয় তবে আমি আমার সন্তানের ভবিষ্যত কেন অন্ধকারে ফেলব? বাস্তবের দাম আবেগের চেয়ে বেশি। কবি বলেছেন, "রূঢ় বাস্তবের দিতে হবে খাঁটি দাম!" আপনার সন্তানের ভবিষ্যত কি আপনি আবেগে ভাসা কয়েকজন বাঙালির হাতে ছেড়ে দিতে চান?
দেশ যেমন সবার কিন্তু দেশটাকে রক্ষার দায়িত্ব সৈনিকদের হাতে ন্যস্ত। তেমনি ভাষাটাও সবার আর ভাষার সৈনিক ওই ভাষায় চালিত টিভি, রেডিও আর ওই ভাষার সাহিত্যিকদের হাতে। সাহিত্যিকের চেয়ে টিভি চ্যানেল ও রেডিও চ্যানেল বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী সৈনিক আজকের যুগে। সাহিত্য ক'জন পড়ে? আর টিভি ক'জন দেখে? এটা থেকেই এর প্রমাণ হয়। তার ওপর ইউটিউব আর ফেসবুকের খিঁচুড়ি ভাষা খুব দ্রুতই প্রভাব বিস্তার করছে আজকাল।
তবে কি বাংলা ভাষা মরে যাবে? উত্তরটা "হ্যাঁ" যদি...
১/ যদি আপনি চান সব বাঙালি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বাংলা জানা ও বাংলায় দক্ষ বাঙালি হোক।
২/ যদি আপনি চান সবাই পরিবারের অন্নের কথা না ভেবে ভাষার কথা ভাবুক।
৩/ যদি আপনি চান পিতামাতা সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে না পড়াক।
৪/ আর যদি আপনি চান বাংলা ভাষা অন্য ভাষার শব্দ গ্রহণ করা বন্ধ করুক। তাহলে সংস্কৃতের মতো বাংলার অবস্থা হবে।
যদি বাঙালিরা এগুলো চান তাহলে জেনে রাখুন "বাংলা" বাঁচবে না, বাঁচতে পারে না। এই জায়গাটাই আমাদের বুঝতে হবে। ওপরের যুক্তিগুলো বাংলা ভাষার শত্রু নয়, বরং ভাষাটাকে গতিশীল রাখতে সাহায্য করে ও ভাষাটাকে দিশা দেয়। কোনো নদীর লক্ষ্য সাগর হওয়া উচিত, সোজা পথে চলা নয়। বাংলা নিয়ে ভাবার সময় এই কথাটা অবশ্যই আমাদের মাথায় রাখতে হবে। এগোলোকে এড়িয়ে চলতে চাইলে বা এগুলোকে শত্রু ভাবলে ভাষাটাকে রক্ষা করার পথে ভুল পথে চালিত হতে হয়। এড়িয়ে চলা নয় এগুলোর সাহায্য নিয়েই রক্ষা করতে হবে বাংলা ভাষাকে।
তবে ভাষাটাকে রক্ষা করা যায় কিভাবে এবং কোন সুপারম্যান তা করবেন? এ যেন "বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে?" গোছের প্রশ্ন। সে যাইহোক, সরাসরি কাজের কথায় আসা যাক:
১/ যেহেতু এটা মাতৃভাষার প্রশ্ন সেহেতু পিতামাতা বিশেষত মাতাকে দায়িত্ব নিতে হবে। ছেলেমেয়েদের বাংলা মাধ্যমে নাই পড়ানো হোক, ক্ষতি নেই, যেন ছেলেমেয়েদের বাংলাটা সেখানো হয়। ইংরেজি বলতে পারলে বুদ্ধি বা সম্মান বেড়ে যায় না বরং কেবল একটা অতিরিক্ত ভাষায় ভাবপ্রকাশ করা যায় মাত্র। যাতে বাংলা বলতে, পড়তে ও লিখতে পারে সেটা তাদের দেখা উচিত। বাঙালিদের বাড়িতে বাংলায় কথা বলাই শোভা পায়।
২/ সরকারের উচিত বাংলা মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করা। এজন্য শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। তাই ঘুস নিয়ে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ সর্বপ্রথম বন্ধ করা আবশ্যক।
২.ক/ উচ্চমাধ্যমিকের বাংলা ভাষার প্রকল্পটা যেন কেবল "হাতেলেখা শিল্প" না হয়ে যায়, এটা দেখতে হবে।
২.খ/ দু'চারটে নোটস মুখস্থ করে যেন কোনো বাংলা সাহিত্যের অনার্সের বিদ্যার্থী পাশ করতে না পারে এটা নিশ্চিত করতে হবে। যেন তাদের বিশ্লেষনী ক্ষমতা, সৃজনশীলতা ও ভাষায় দক্ষতা অর্জন হয় সেটা মাথায় রাখতে হবে। সিলেবাস ও পরীক্ষা সেইমতো হবে।
৩/ বড়োবড়ো কবিদের ও সাহিত্যিকদের ফেসবুকে ও ইউটিউবে আসা উচিত ও লেখা প্রকাশ করা উচিত। ভাষাটাকে সুস্থ রাখতে এটা দরকার।
৪/ যদি আমরা চাই যত কম সংখ্যক সম্ভব বাঙালি হিন্দি কথা বলুক এবং যদি আমরা চাই অন্যান্য ভাষাভাষীরাও বাংলা বলুক তবে আমাদের সরকারকে রাজ্যে শিল্প ও কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। এটাই একমাত্র রাস্তা।
৫/ অশুদ্ধ বা ভাঙাচোরা বাংলায় বলা সকল প্রকার সকল বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করতে হবে। টিভি ও রেডিওর সকল অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ও খবর পাঠকদের শুদ্ধ বাংলায় বলা নিশ্চিত করতে হবে। সিনেমা ও সিরিয়ালেও গল্পের প্রয়োজনের অতিরিক্ত যেন বাংলা ভাষার বিকৃতি না ঘটানো হয় সেটা দেখতে হবে। গায়কদের বাংলার উচ্চারণ সঠিক হওয়া আবশ্যক।
৬/ স্কুলে, কলেজে আলোচনা সভা, বিতর্ক সভা, নিয়মিত ম্যাগাজিন ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হবে।
৭/ সব কথা বাংলায় নাই বলি, অসুবিধা নেই, কিন্তু আমরা বাঙালিরা যতটুকু বাংলা বলবো ততটুকু যেন ঠিকমতো বাংলা বলি এটা মাথায় রেখেই কথা আমাদের বলা উচিত।
এরকম আরো অনেক ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
বাংলা ভাষাকে ভুলে কেউ থাকতে পারেন না। প্রবাসী বাঙালিরাও বাংলার চর্চা চালিয়ে যান। আশার কথা শহরের বাঙালিরাও আজ নতুন করে বাংলা ভাষাকে নিয়ে অনেক বেশি সচেতন। বাংলায় খবর, সিনেমা, গান, ই-বুক ও বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তাঁরা মাতৃভাষাকে ভালোবাসেন। তারা ফেসবুকে বাংলায় কমেন্ট করতে ভালোবাসেন। তারা হোয়াটস্যাপে বাংলায় হাসির চুটকি বিনিময় করেন।
ভারতের "বন্দেমাতরম্" ও "জনগণমন" দুটি রাস্ট্রীয় সঙ্গীতই বাংলা ভাষায় বিরচিত। ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীত একজন বাঙালি কবির রচিত, এটা খুবই গৌরবের। যে ভাষার সাহিত্য এশিয়ায় প্রথম নোবেল নিয়ে আসে সেই ভাষা মরতে পারে না। পৃথিবীতে বিভিন্ন রকম যুদ্ধ হয়েছে, কিন্তু ভাষার জন্য কেমন একবারই যুদ্ধ হয়েছে এবং এটা আমাদের বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য। যে ভাষার জন্য দেশভাগ হতে পারে সেই ভাষা মরতে পারে না। যে ভাষার জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষিত হতে পারে সেই ভাষা মরতে পারে না। যে ভাষা সাম্প্রতিক অতীতে ইউনেস্কো দ্বারা বিশ্বের মধুরতম ভাষার স্বীকৃতি পায় সেই ভাষা মরতে পারে না। যতদিন গ্রামবাংলার একজনও মানুষ বেঁচে থাকবেন, যতদিন বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে এবং যতদিন শহরের মানুষ বাংলা ভাষা নিয়ে তর্ক বিতর্ক করবেন ততদিন বাংলা বেঁচে থাকবে। যদি কেউ বলে এই মিষ্টি ভাষা মরে যাবে, তবে হয় সে ইচ্ছা করে ভুল বলছে কিংবা সে পাগল।
📓✒️ শিক্ষিত সাহিত্যিক
সাহিত্যিকদের হাত ও চোখকে শিক্ষিত করতে আলাদা আলাদা মাধ্যম থাকতে হবে। সাহিত্যিকদের শিক্ষিত ও স্বতঃস্ফূর্ত দুটোই হতে হবে― সর্বোপরি নিজস্বতা বজায় রাখতে হবে।
কল্পনা করুন গিটারের মতো একটি বাদ্যযন্ত্র যার থাকবে চারটি তার। যে তারগুলোর একপ্রান্ত বাঁধা থাকবে―
১. আপনার প্রিয় সাহিত্যিকদের রচনা
২. নোবেলজয়ী আধুনিক সাহিত্যিকদের সাহিত্য
৩. অস্কারজয়ী সিনেমা
৪. একেবারে আজকের যুগে লিখিত উৎকৃষ্ট সাহিত্য
― এই চারটি থামে এবং অপর প্রান্ত বাঁধা থাকবে নিম্নলিখিত থামগুলিতে:
১. স্বামীজির বাণী ও রচনাবলী
২. নেতাজির বাণী ও রচনাবলী
৩. ডঃ কালামের বক্তৃতা ও রচনাবলী
৪. কবিগুরুর রচনাবলী
ভারতকে ঠিক ঠিক জানতে এবং জীবন সম্পর্কে নিজের চোখ খুলতে আদর্শ সন্ন্যাসী, আদর্শ রাজনেতা, আদর্শ বৈজ্ঞানিক ও আদর্শ কবির চিন্তাভাবনার সাথে পরিচিত হওয়া খুবই দরকার। কবিরাই সমাজ সৃষ্টি করেন তাই তাদের দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের শিক্ষিত করতে হবে বৈকি!
এই বাদ্যযন্ত্রের তারগুলো হল― গান, কবিতা, গল্প ও উপন্যাস। বর্তমান পৃথিবী এই বাদ্যযন্ত্রের শত শত এক্সপার্ট বাদকের প্রার্থনায় তপস্যামগ্ন। আসুন "সাধারণ মানুষের আবেগের ছাঁচে" অপার্থিব সুর তুলি। আমাদের সাহিত্য শেখার, ভালোবাসতে শেখার ও জ্ঞান শেখার আলাদা আলাদা সোর্স থাকতে হবে।
📓✒️ লেখার মানোন্নয়ন চান?
নিজের লেখার স্ট্যান্ডার্ড বাড়াতে চান? তাহলে দু'টি প্রশ্ন আছে:
১/ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে কোনো দশটি বইয়ের নাম বলুন? না থাক, বলতে হবে না। কেবল মনে মনে ভাবুন। পাঁচটিই ভাবুন। পারলেন?
২/ আজ পর্যন্ত আপনার "পড়া" সকল কবির সকল কবিতাগুলির মধ্যে আপনার মতে শ্রেষ্ঠ কুড়িটি কবিতা কী কী?
এবার ওপরের প্রশ্নগুলো কেন করলাম বলা যাক। আমরা বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবির দশটি বইয়ের নাম বলতে পারি না। তবুও আমরা সাধারণ মানুষ বা পাঠক নই। আমরা এমন এক প্রজাতি যারা নিজেদের কবি বলতে চাই। আমরাই নাম পর্যন্ত বলতে পারি না, পড়া তো দূরের কথা! তাহলে ভাবুন, সাধারণ মানুষ তো রবীন্দ্রনাথ পড়েনই না। তাহলে আমার আপনার লেখা পড়বে কে? আমাদের কয়টি লেখার ভবিষ্যতে মূল্য থাকবে? তাই কোয়ান্টিটি নয়, কোয়ালিটিতে মন দেওয়াই বুদ্ধিমানের কি। বাল্মীকি একটি বই লিখে, হোমার দু'টি বই লিখে ফেমাস হয়ে গেলেন। আর আমরা হাজার হাজার লেখার নামে স্তুপীকৃত আবর্জনা সৃষ্টি করছি― আমাদের বেশিরভাগেরই তাই অবস্থা। সকলকে সম্মান জানিয়েও একথা বলতে আমি বাধ্য কারণ সত্য এটাই। আমি বাংলাকে আর সাহিত্যকে ভালোবাসি তাই তার ভবিষ্যত ও তার সম্পদ আরও মহান হোক― এটাই চাই।
দ্বিতীয় প্রশ্নটির উদ্দেশ্য হল― নিজের নিজের তৈরি একটা স্ট্যান্ডার্ড বা একটা মডেল কবিতা না থাকলে কার সঙ্গে তুলনা করে বোঝা যাবে যে কবিতাটি কতটা ভালো হয়েছে। এটা নিজেকে করতে হবে। এটা দুইভাবে করা যেতে পারে। প্রথম, নিজের পড়া সর্বশ্রেষ্ঠ কুড়িটি কবিতা এক জায়গায় লিখে কয়েক দিন বারবার পড়তে হবে। তারপর কুড়িটির মধ্য থেকে দশটিকে বেছে নিতে হবে― খুব খুব কঠিন কাজ― মনে হবে কাকে ছেড়ে কাকে রাখি! তারপর ওই দশটি কবিতার লেভেলে স্থান পাবে কিনা এইভাবে নিজের লেখা কবিতাগুলির বিচার করতে হবে। দ্বিতীয় উপায়, (আগের উপায় ভালো না লাগলে) প্রতিটি কবিতা লেখার পর তার সাথে তার ঠিক আগে নিজের লেখা শেষ পাঁচটি কবিতার তুলনা করতে হবে। যদি গুণগত মানে এই লেখাটি আগের পাঁচটির যে কোনো একটি থেকে ভালো হয় তবেই রাখব নাহলে ছিঁড়ে ফেলব― এই অ্যাটিটিউড থাকতে হবে। পরের লেখার ক্ষেত্রেও একই নিয়ম, তখন শেষ পাঁচটি কবিতা আলাদা হবে। তাই এভাবেই লেখার মানোন্নয়ন হবে। এই নিয়মদুটি আমার বানানো। আপনারা নিজের মতো নিয়ম বানাতে পারেন। আমি দ্বিতীয় নিয়মটি ফলো করি।
নিজের কথা বলতে হলে বলব― আমার লেখা প্রায় একশো কুড়িটির বেশি কবিতাকে আমি নষ্ট করেছি― কারণ তা আমার নির্ধারিত মানে দাঁড়ায় নি। সাহিত্যে ২০১৬ সালে নোবেলজয়ী গায়ককবি বব ডিলানও এইভাবে খারাপ লেখাগুলো নষ্ট করে দিতেন। আমি পাঠকের প্রশংসার চেয়ে পাঠকের সময়কে বেশি মূল্য দিই; অন্যের সময় নষ্ট করার কী অধিকার আমার আছে? মাসে একশোটা আবর্জনা লেখার থেকে পাঁচটি ভালো কবিতা লেখা অনেক ভালো। আমি নিজেকে এটাই বলি। আপনি নিজেকে নিজে কী বলেন?
লেখার সাথে সাথে মনের দিক দিয়ে লেখকের উন্নতি না হলে লেখার জীবনদর্শনের দিক দিয়েও তার পরের লেখাগুলির উন্নতি হবে না। সেই লেখকই ধন্য যিনি লেখালেখিকে আপন আধ্যাত্মিক উত্তোরণের সাধনা ভাবেন এবং সাথে সাথে লেখালেখিতে আনন্দ পান।
📓✒️ ভবিষ্যত পৃথিবীর সাহিত্য
বেদ-উপনিষদ-শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা এগুলোকে আধার করে পুরাণ সহ রামায়ণ ও মহাভারত রচিত হয়। ঠিক তেমনি এখন সময় এসেছে ঠাকুর-মা-স্বামীজির ভাব ও বাণীকে আধার করে কিছু লেখার। এখন কিন্তু পুরাণ স্টাইলে কিছু লিখলে চলবে না। হলিউড সিনেমার কল্পবিজ্ঞানের গল্পের ছাঁচে ঠাকুর-মা-স্বামীজির বাণীকে ঢালতে হবে এবং সাথে খেয়াল রাখতে হবে ভারতের সাধারণ জনতা চাওয়াটা কোথায়! দেশের ও বিশ্বের সংস্কৃতিকে বাঁচাতে গেলে এটা করতেই হবে। এখন সিনেমা-সিরিয়াল-সিরিজ মানেই অশালীন ভাষা প্রয়োগ, ষাঁড়ের মতো যার তার সাথে যৌনতা, পারিবারিক কলহের দৃশ্য আর বাইরে হিংসাবৃত্তি― আগেকার যুগে নাটক-সিনেমা আদি তৈরি হত জীবন দেখে আর আজ সমাজ ও জীবন তৈরি হয় এইসব থেকে ইনপুট নিয়ে। এমনকি নিউজ চ্যানেলগুলি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ঝগড়ার মাধ্যমে এনটারটেনমেন্ট ও ফেক নিউজের মাধ্যম হয়ে গেছে। এই অবস্থায় একটা নতুন কিছু দরকার। আজ দরকার এমন লেখকের যিনি ঝাড়ুদার হতে পারবেন― "first connect, then correct"― প্রথমে সাধারণ জনতার আবেগের স্তরে নামতে হবে, তারা যেমন চায় তেমনি ভাবে গল্পের শুরু করে প্রতিটি গল্প (উপন্যাস, কবিতা ইত্যাদিও) আকর্ষণীয় ফ্লো-এর মাধ্যমে চিরন্তন সত্যের স্তরের জীবনে নিয়ে যেতে হবে। পতনের নীচে নেমে সাহিত্যের থিম বা বিষয়কে নিয়ে উপরে উঠতে হবে― তবেই না ক্রিয়েটিভিটি!
সমাজ তৈরি করেন সাহিত্যিক-শিক্ষক-বৈজ্ঞানিকরা; মা-বাবারা এনাদের থেকেই শিখেন। দুর্ভাগ্যজনক এটাই যে, আজকাল টাকা দিয়ে বা টাকা কামানোর জন্য ডিজিটাল পর্দার নিম্ন-মধ্য রুচির অভিনেতা ও পলিটিক্যাল নেতাদের অতিরিক্ত প্রচার ও বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। যা বারবার দেখার ফলে মানুষের সাবকনসিয়াস মাইন্ডে এই প্রভাব পড়ে যে, এইসব নিম্নরুচির (বেশিরভাগই তাই) প্রাণীগুলিই আমাদের রোলমডেল― কারণ ফোন খুললেই নোটিফিকেশনে, নিউজে এবং social media-তে নিজের বা ফ্যানের দ্বারা উনাদের অবিরত আনাগোনা! কোথায় গীতার রোলমডেল আর কোথায় আমাদের অলিখিত রোলমডেল! আজ মানুষ greatness-এর চেয়ে glamour-কে বেশি গুরুত্ব দেন― এই বিষয়টি বাদ দিয়ে জোর করে নীতিকথা শেখানো মূর্খতা― এটাকে নিয়েই সাহিত্য রচনা করতে হবে। সাধারণ মানুষের আবেগকে নিয়ে উৎকৃষ্ট সাহিত্য রচনা করতে হবে― যা purpose-led and future-forward হবে। সাহিত্য দ্বারাই অনুপ্রাণিত হয়ে নতুন জীবন গঠনের মাধ্যমে সাধারণের মধ্য থেকে লোকাল রোলমডেল তৈরি হবে। আমাদের সর্বগ্রাসী ও নতুন সাহিত্যের জোয়ার আনতে হবে।
কল্পবিজ্ঞানের গল্পই কেন? প্রথমত, পুরাণের মতো গল্প চলবে না এযুগে। দ্বিতীয়ত, লাস্ট ও ভায়োলেন্সের বাইরে সাহিত্যে মানুষ যেটা ভালোবাসে তা হল ফ্যান্টাসি― ভূত-এলিয়ান-রোবট-জাদু-পক্ষীরাজ ইত্যাদি― এমনকি মানুষ লাস্ট-ভায়োলেন্সের গল্পের থেকেও এগুলোকে বেশি ভালোবাসে। ঠিক এই জায়গাটিকে ধরেই ঠাকুর-মা-স্বামীজির বাণীকে জীবন্ত করে তুলতে হবে― এভাবেই নতুন সমাজ গড়ে উঠবে। তৃতীয়ত, বিশ্ব উত্তোরোত্তর বিজ্ঞান কেন্দ্রীক হচ্ছে। এইসব কারণের জন্যই কল্পবিজ্ঞানের গল্প। স্বামীজি ভারতের বেদান্ত ও পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান-এর সমন্বয় বিষয়ে একটি বই লেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। আধুনিক বিজ্ঞান যে বেদান্তের একটি সিঁড়ি বা গণিতের ভাষায় সাবসেট মাত্র― এইটি ভালো করে ব্যাখা করতে হবে― না হলে আধুনিক মানুষ ধর্মে বিশ্বাস করবে কেন? মানুষের কি দোষ? এইরকম প্রবন্ধের বই লিখতে হবে এবং কল্পবিজ্ঞানের গল্পও লিখতে হবে। দর্শন বা বিজ্ঞান বলে কিছু হয় না― যা হয় তা হল চিরন্তন সত্য― আর্ট, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি হল এই এক সত্যেরই বিভিন্নরূপে প্রকাশ। আধুনিক বিজ্ঞানের উৎকৃষ্ট রূপ হল জ্ঞানযোগ (অদ্বৈত বেদান্ত) আর আর্টের উৎকৃষ্ট রূপ হল ভক্তিযোগ!
পাশ্চাত্যের কল্পবিজ্ঞানের গল্প হল জাস্ট আজগুবি গল্প― চিরন্তন সত্যহীন। এই জায়গাতেই আমাদের আধুনিক সাহিত্যিকদের কাজ করতে হবে। সাহিত্যিকদের হতে হবে প্রখর পর্যবেক্ষণ শক্তি সম্পন্ন, আধুনিক বিজ্ঞান জানা, টেড টকস্-গুগল টকস্ ফলো করে মর্ডান থিঙ্কিং জানা, ঠাকুর-মা-স্বামীজির ভাবে বাঁচা এবং অনন্ত হৃদয়ের অধিকারী। তাকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শ্রেষ্ঠ আধুনিক সাহিত্য ও আধুনিক সিনেমার অভিজ্ঞতা সম্পন্নও হতে হবে। তাকে নিজের ক্রিয়েটিভিটিকে সর্বোত্তম স্তরে নিয়ে যেতে হবে। মাথায় রাখতে হবে, অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ঘেঁটে ADD Syndrome অর্জন করা সাধারণ মানুষ দীর্ঘ লেখা পড়তে চান না। ইউটিউব খুললেই সাধারণ মানুষের আবেগটা কোথায় তা জানা যায়। তার সাথে আধুনিক জনপ্রিয় লেখকদের লেখা পড়ে তাদের জনপ্রিয়তার secret কী এটি বেশ বুঝতে হবে, তারপর ঠাকুর-মা-স্বামীজির বাণীকে সেই আবেগের ছাঁচে ফেলে তাঁদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি উৎকৃষ্ট সাহিত্য রচনা করতে হবে।
বিশ্বমাতা আজ শত শত সাহিত্যিক বলী চান― সাধারণ মানুষ নয় সাহিত্যিকের বলী― নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করে, এমনকি ভারতরত্ন-নোবেলের লোভকে হেলায় ত্যাগ করে কোমর বেঁধে আমাদের মৌলিক লেখালেখিতে লেগে পড়তে হবে। আমাদের আউটপুট জনপ্রিয়তা অর্জন নয়, আমাদের আউটপুট হোক চিরন্তন সত্যকে মানুষের মনের ছাঁচে ফেলে সহজ করে উপস্থাপন করে জীবন পরিবর্তন এবং স্বামীজির ভাবে বিশ্ব গঠন। বিশ্ব সাহিত্যের খোলনলচে বদলে দিতে হবে। বিশ্ব সাহিত্যে বিপ্লব আনতে হবে― আর তা আসবে এই ভারত থেকেই। সিনেমা সিরিয়াল বাপ বাপ বলে নিজেকে অটোমেটিক বদলে নেবে― ভবিষ্যত পৃথিবীতে নপুংসক লেখকদের কোনো স্থান নেই। অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন হও বৎস, অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন হও।
ঠাকুর-মা-স্বামীজির কথা লেখব কেন? কোনো দরকার নেই যদি আপনি এরচেয়ে উচ্চ চিরন্তন সত্য নিজের অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা আবিষ্কার করতে পারেন। লেখককে নিজের মৌলিকতা বজায় রাখা উচিত। লেখকের উচিত নয় কোনোপ্রকার কোনো ইজম্-এর দাস হওয়া। ঠাকুর-মা-স্বামীজি কোনো প্রকার ইজমের দাস ছিলেন না, তারা নিরপেক্ষও ছিলেন না, তারা ছিলেন ভালো-মন্দ-নিরপেক্ষ সবকিছুর উর্ধ্বে এবং ছিলেন সর্বোচ্চ নিঃস্বার্থপর― তাই সত্য তাদের নিকট ধরা দিয়েছিল― সেজন্যই তাদের বাণীকে প্রকাশ করতে বলা। যুগাবতারকে (নতুনভাবে কথিত চিরন্তন সত্যকে) প্রচার করতে শত শত যুগ কবির দরকার।
নতুন ধরনের সাহিত্যের features কী কী হবে? Basics এমনটা হলে ভালো হয়:
কবিতা:
১. অভিনব উপস্থাপন
২. গুনগুনানো মুগ্ধতা
৩. চিরন্তনের অন্বেষণ
কবিতায় নিজের আবেগ অনুভূতির লিখে তার বিস্তার ঘটিয়ে বৃহত্তর জনজীবনের আবেগের সাথে তাকে মেলাতে হবে তারপর তাকে আধ্যাত্মিক অ্যাঙ্গেলে অথবা চিরন্তন সত্যের সাথে মেলাতে হবে। যেমন রিলেশনশিপ ব্রেকআপের কান্না সংক্রান্ত কবিতা বিচ্ছেদের কান্না কাঁদতে কাঁদতে তাকে অভুক্ত শিশুদের ও বস্তিবাসীদের দুঃখের সহিত মেলাতে হবে এবং পরবর্তীতে তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়ে আত্মবিকাশ হন না বা আত্মজ্ঞান লাভ হল না বলে কান্না― তীব্র আবেগের সহিত এই স্তরে আনতে হবে। তবে কবিতা। তোমার লেখা "যেকোনো একটা" কবিতা যদি কেউ পড়েন তবে তাঁর যেন জীবন বদলে যায়!
সবকিছুরই চাকা ঘোরে। মানুষ যখন এখনকার কালের লেখালেখিতে বিরক্ত হবে তখন সে কী পড়বে?
গল্প-উপন্যাস:
১. রোমাঞ্চকর কাহিনী
২. আকর্ষণীয় সংলাপ
৩. অভিনব উপস্থাপন
৪. মনোমুগ্ধকর বর্ণনা
৫. চিরন্তনের অন্বেষণ (২০-২৫% credit for this feature)
দরকারে নোবেলজয়ী সাহিত্যিকদের নোবেল পুরস্কার জয়ের কারণ হিসেবে নোবেল কমিটি কী কী বলেছেন তা একটি খাতায় পরপর লিখে রাখলে বোঝা যায় উৎকৃষ্ট সাহিত্যের গুণাবলী কী কী!
ভক্তিগীতি ভালোই আছে। তবে আরও নতুন ধরনের ভক্তিগীতি লিখতে হবে। অন্তর্নিহিত দেবত্বের জাগরণ বিষয়ক প্রেরণাদায়ক ভক্তিগীতি। অদ্বৈত বেদান্ত ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব মেলবন্ধনের শোভাস্বরূপ কবিতা-গান ইত্যাদি।
শিশু সাহিত্য কেমন হবে?
ঈশোপের গল্প, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নীতিকথা এবং উপেন্দ্রকিশোর-সুকুমারের রসাস্বাদন― এই দুইয়ের সমন্বয় ঘটাতে হবে। একা একা এই দুইপ্রকার সাহিত্যের একটিও ঠিক ঠিক যুগোপযোগী আর নয়। কথা বলা গাছ, পাখি, পশুর সাথে রোবট, এলিয়েন ইত্যাদিও থাকবে। ইংরেজি মোরাল স্টোরি এবং আধুনিক আনন্দদায়ক কার্টুনের সমন্বয় ঘটাতে হবে। স্বামীজি একবার দুঃখ করে বলেছিলেন, সকল দেশের সকল শিশুকে শেখানো হয় চুরি করা ভালো নয়; কিন্তু চুরি করা কেন ভালো নয় তা শেখানো হয় না। আর তাছাড়া বড়োরা বলে এক আর করে এক― আর শিশু যা দেখে তাই শেখে। শিশু সাহিত্যকে এমন আনন্দদায়ক ও অজান্তেই উচ্চস্তরের তত্ত্ব শেখার মাধ্যম বানাতে হবে যাতে তারা বড়ো হলে এখনকার সিরিয়ার-সিনেমাকে বেকার স্বাদের মনে হয়! মিছরির পানা যে পান করেছে তার কাছে চিটে গুড়ের সরবত যেমন তেমনটি মনে হয়। গীতাও বলেন―"Deveop a higher taste to discard the lower one"― তবেই নীচুস্তরের সিনেমা-সিরিয়াল জগত থেকে বিদায় নেবে। কারণ শিশুরাই তো যুবক হন! উৎকৃষ্ট শিশুসাহিত্য রচনা করো আর অ্যানিম্যাশনের মাধ্যমে কার্টুন ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবকে দখল করে নাও দেখি― শিশুরা পড়ার চেয়ে কার্টুন দেখতেই ভালোবাসে। দুর্দান্ত সব আকর্ষণীয় আনন্দদায়ক গল্পের মাধ্যমে স্বামীজির বাণীগুলোকে ম্যানিফেস্ট করো দেখি। শিশুদের ভেতর আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করো― তার ফোকাসকে শরীর থেকে মনে নিয়ে এসো― তার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ হোক আত্মবিকাশের দিকে অগ্রগমন। ADD Syndrome, hacking, fake news, শিশুনির্যাতন অপরাধ ইত্যাদিকে রূপকথার বা কল্পবিজ্ঞানের গল্পের মাধ্যমে উপস্থাপিত করে শিশুদের সচেতন করো। কার কতো মাথার দম একটু খাটাও তো দেখি! শিশুদের মনটাকে খুলে প্রকৃতি প্রেমিক করে তাকে অনন্তে মুক্ত করে না দিতে পারলে এবং এই করতে গিয়ে তাকে আনন্দ বিতরণ না করতে পারলে কিসের শিশু সাহিত্য?
অ্যাডভেঞ্চারের সাথে স্বামীজির জীবনদর্শন― তবেই না কিশোর সাহিত্য! মহাবিশ্বের বিষ্ময়কর ঘটনা, ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, আশ্চর্য জীবজগত এবং সাথে স্বামীজির বাণী― সবকিছু স্বামীজির বাণীকে গল্পের মাধ্যমে ব্যক্ত করবে। সাধারণ মানুষের জীবন সংগ্রাম নিয়েও ভিন্ন স্বাদের অনেক ক্লাসিক সাহিত্য লেখা যায়!
কেবল একশত জন সাহিত্যিক এইভাবে লিখলে বিশ বছরে এই বিশ্ব স্বর্গের চেয়েও সুন্দর হয়ে উঠবে। আগামী পঞ্চাশ বছর আমাদের এমন সব সাহিত্য রচনা করতে হবে যেন পরমধাম হতে রবীন্দ্রনাথ-শেক্সপিয়র তা পড়ে বলেন "আহা! এমনটা যদি লিখতে পারতাম তবে বেশ হতো!"
📓✒️ রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার নিয়ম এবং
বেশিরভাগ রবীন্দ্রসঙ্গীতে "আমি" ও "তুমি"-র সম্পর্ক আছে। এই জিনিসটি যদি আমরা ঠিকঠিক বুঝতে পারি তবে আমাদের কবিতা ও গান লেখার দৃষ্টিভঙ্গিটাই পাল্টে যাবে। তখন একই বিষয়কে নিয়ে আমরা একাধিক কবিতা লিখতে পারব এবং প্রতিটিই হবে উচ্চ থেকে উচ্চতর লেভেলের ভাবের। আসুন রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা কেমন কেমন ভাবে যেতে পারে তা নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
(১) প্রথম ধাপে, রবীন্দ্রসঙ্গীতের "আমি"-র জায়গায় নিজেকে এবং "তুমি"-র জায়গায় নিজের প্রেমিক বা প্রেমিকাকে ভেবে গানগুলো শোনা যাক। যেমন "আমি তোমার বিরহে রহিব বিলিন...", "মাঝেমাঝে তব দেখা পাই...", "তুমি কোন কাননের ফুল...", "তুমি রবে নিরবে হৃদয়ে মম...", "দাড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে...", "আমার ভেতর বাহিরে অন্তর অন্তরে আছো তুমি হৃদয়জুড়ে...", "ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে..." ইত্যাদি ইত্যাদি গানগুলো। শুনুন কেমন ফিলিংস লাগছে দেখুন।
(২) দ্বিতীয় ধাপে, রবীন্দ্রসঙ্গীতের "আমি"-র জায়গায় নিজেকে এবং "তুমি"-র জায়গায় আপনি যাকে খুব খুব শ্রদ্ধা করেন তাকে রাখতে হবে। তাতে তিনি আপনার পিতামাতা বা শিক্ষক বা অন্য কোনো ভালো মানুষ হতে পারেন। এই মনোভাব রেখে গানগুলো শোনা যাক।
(৩) তৃতীয় ধাপে, রবীন্দ্রসঙ্গীতের "আমি"-র জায়গায় নিজেকে এবং "তুমি"-র জায়গায় আপনি আজ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মহান ব্যাক্তির সঙ্গ করেছেন তাকে বা যে মহান ব্যক্তির সঙ্গলাভ হলে নিজেকে তৃপ্ত ও ধন্য ভাবতেন তাকে কিংবা আপনার প্রিয় মহাপুরুষদের যাদের মা-বাবার চেয়েও বেশি শ্রদ্ধা করেন তাদের রেখে এবং সেই মনোভাব নিয়ে গানগুলো শুনুন।
(৪) এই ধাপে উভয়ক্ষেত্রেই নিজেকে রাখতে হবে। "আমি"-র জায়গায় বর্তমানের নিজেকে এবং "তুমি"-র জায়গায় নিজের সর্বোত্তম সংস্করণ বা যতো মহান আপনি নিজে হতে পারেন আপনার সেই অবস্থাকে বা নিজের অতীতের নিজের মহোত্তর ও আনন্দতর অবস্থার উদাহরণকে রেখে গানগুলো শুনুন।
(৫) এই ধাপে ভাবুন আপনি ঈশ্বরকে গান শোনাচ্ছেন। আপনার সামনে ঈশ্বর বসে আছেন। এক্ষেত্রে ঈশ্বরই তুমি।
(৬) এক্ষেত্রে ঈশ্বর আপনার সামনে বসে নেই তিনি আছেন আপনার মনের গভীরে― অন্তদৃষ্টি সহায়ে নিজের ভেতরকার সত্তাকে গান শোনান।
(৭) এইক্ষেত্রেও ভেতরকার সত্তাকে গান শোনাচ্ছেন ভাবতে হবে তবে তা কেবলমাত্র আনন্দ পাওয়া হবে না― এক্ষেত্রে প্রধান বিষয় হল "ব্যাকুলতা"! প্রতিটি শব্দের মধ্যে আবেগ ও মহত্তমকে পাবার ব্যাকুলতা থাকবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে আবেগ নিয়ে লিখেছেন তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি ব্যাকুলতা নিয়ে কথা ও সুরের মাঝে ডুবে গিয়ে কেবলমাত্র ভেতরের সত্তাকে স্মরণ করে তাকে পাবার তীব্র আকুতি নিয়ে তাকে গান শোনাচ্চি― এই মনোভাব নিতে হবে। আরও আরও গভীরে গেলে আমিটাও তুমি তুমিটাও তুমি― যেন এমন লাগবে।
এক দিনে সাতটিভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান শোনা সম্ভব নয়। এক মাস করে করে এগোন। প্রতিটির জন্য একমাস করে করে দিন। সাত মাস পরে দেখুন আপনার নিজের লেখালেখি অটোমেটিক উন্নত হয়ে গেছে।
এই হচ্ছে প্রেম ও বিরহের গান বা কবিতা বিভিন্ন লেভেলের জন্যই সমান সত্য ও সমান প্রাসঙ্গিক― কেউ ঈশ্বরের জায়গায় প্রকৃতির সুন্দরতা ধরলেও প্রাসঙ্গিক। আর আমাদের কবিতা ও গান? আমরা কি প্রেমের কবিতা লিখি নাকি? আমরা তো সেক্সের বা সেক্সকেন্দ্রীক কবিতা ও গান লিখি― সিনেমার গানও! আমরা কি বিরহের কবিতা লিখি নাকি? আমরা তো পাঠক বা দর্শককে তার করুণ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে দিতে চাই না, তার আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করি না উল্টে তার ভবিষ্যতকে নষ্ট করে দিয়ে তাকে দুঃখের কাব্যরূপী মদ খাইয়ে তার প্রশংসা পেতে চাই বা সিনেমা বানিয়ে টাকা কামাতে চাই― পাঠকের ভবিষ্যত বা দেশের অর্থনীতি আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়! আমাদের লজ্জা লাগা উচিত। দেহের কবিতা আর যাই হোক তা প্রেমের কবিতা নয়, আত্মধ্বংসের কবিতা আর যাইহোক তা বিরহের কবিতা নয়। যে বিরহে মানুষ উন্নত হয় তাই বিরহের কবিতা― কৃষ্ণের বিরহে রাধার "হা কৃষ্ণ" করতে করতে কৃষ্ণের মতো উন্নতমনা হয়ে যাওয়া, রাধাদেবীর অহংকার নাশ হয়― এটা তার উদাহরণ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য কাব্যরচনায় নয়, একমাত্র পার্থক্য উনি মনের যে লেভেলে বাস করতেন সর্বদা বা বেশিরভাগ সময় অর্থাৎ যেটা উনার মনের স্বাভাবিক লেভেল সেটা উচ্চ। আমরাও মানুষ হিসেবে আমাদের মনকে সেই উচ্চ লেভেলে নিয়ে গিয়ে সেখানেই আমাদের "কমফোর্ট জোন" বানাতে পারি― তবেই আমরা সেই উচ্চ লেভেলের লাখ লাখ কবিতা লিখতে পারব। এটা অভ্যাস দ্বারা ও অপ্রয়োজনীয় জিনিস চিন্তা বর্জন দ্বারা― এককথায় বাঁচার কেন্দ্রবিন্দুটিতে ভালো জায়গায় সিফ্ট করে করা যায়।
আমাদের প্রতিটি আবেগ, প্রতিটি চিন্তাভাবনা― তাতে কেউ কবি হন বা না হোন― সবকিছুই নিজের আবেগকে আরও সংস্কৃত করার জন্য, বহিঃজগতের সুন্দরতা দেখার বা খোঁজার মাধ্যমে মনকে সুশোভিত চিন্তায় সুসজ্জিত করার জন্য এবং গভীর সত্যের মাধ্যমে নিজেকে উন্নত করার জন্য। আলটিমেট লক্ষ্য নিজের পূর্ণ বিকাশতম অবস্থা কিংবা নিজের সর্বোত্তম বা শুদ্ধতম অবস্থায় অবস্থান করতে থাকা। এই এক লক্ষ্য নিয়ে বাঁচুন আর কবিতাও লিখুন।
দুর্দমনীয় গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। নিজেকে জয়ের বা উন্নত করার আনন্দ এবং নিজেকে আবিষ্কারের প্রেরণাই কাব্যিক ভাষাতে আপনার লেখার মধ্যে ঝরে পড়ুক। যখন আমাদের মন কাঁচের মতো স্বচ্ছ হবে তখনই ভেতরের সুন্দরতম আনন্দতম জ্ঞানস্বরূপ সত্তা স্বতই প্রকাশিত হবে।
বাংলা "কবি" শব্দটি এসেছে সংস্কৃত "কবি" শব্দ থেকে। যার অর্থ ক্রান্তদর্শী― যিনি মোবাইলে সিনেমা দেখার মতো অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতকে অনুভব করতে পারেন তিনিই কবি। ছন্দবদ্ধ লাইন যে কেউ লিখতে পারেন। প্রবন্ধ বা সাধারণ কথাকে ছন্দবদ্ধ করলেই কি কবিতা হয়? যিনি উচ্চতর সত্যের খাতিরে নিজের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতাটিকেও কাটতে পারেন তিনিই কবি।
প্রিয় কবি, আপনি যদি নিজের সৃজনশীলতায় খুশি হন তবে আপনি চিরকাল সুখী হবেন, তবে আপনার সুখ যদি অন্যের প্রশংসার উপর নির্ভর করে তবে আপনি কখনই সত্যই খুশি হতে পারবেন না। আপনার কাজের উপর ফোকাস করুন, পাঠকদের কাজের উপর নয়। আর অন্যান্য লেখকদের সাথে প্রতিযোগিতা করবেন না। ভাবুন, পৃথিবীতে যদি কেবল একজন শিল্পী বা কেবল একজন বিজ্ঞানী বা কেবল একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী বা মুক্তিযোদ্ধা থাকতেন তবে আমরা কি খুশি হতাম?
What you have felt and what you have become are more important than how many poetry you have written. Because not your fan but you alone are responsible for how and who you are! Write for happiness, fight for humanity and enjoy freedom. অন্যকে নীতিশিক্ষা দেওয়ার জন্য আপনার জন্ম হয়নি, কিন্তু নিজেকে উন্নত করার জন্য এবং নিজের আইডিয়ালকে নিজের জীবনে প্রয়োগ করার জন্য। আপনার আইডিয়া কেউ মানবে না, কিন্তু একজন মানতে পারতো, সেটা আপনি নিজে। আপনি কী নিজের লেখাকে সুন্দর মানেন না? আপনি কী মানেন না যে তা কমপক্ষে একজন মানুক? সেই একজনটাই আপনি নিজে।
রূপক কবিতা কী? রূপক হল তত্ত্বকে রূপ দেওয়ার নাম। এর চেয়ে নিম্নমানের সংজ্ঞা হল― কবিতার ক্ষেত্রে যা "রূপ বর্ধক" তাই রূপক― "রূপ পরিবর্তক" নয়, কথাটি "রূপ বর্ধক"। রূপক বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে।
১. কাব্যিকতা নিজেই একটা রূপক
২. তত্ত্বরূপক
৩. ভাবরূপক
৪. উপমারূপক
৫. শব্দরূপক বা বন্ধ্যারূপক
🌝 কাব্যিকতা রূপক: কাব্য কী? গল্প, নাটক, প্রবন্ধ সহ যে যে জিনিসগুলো কাব্য নয় সেগুলো বাদ দিলে যা থাকে তাই কাব্য― ব্যাক্তি বিশেষে কাব্যিকতার সংজ্ঞা আলাদা হতে পারে। তবুও ইতিবাচক দিক দিয়ে কাব্যের সংজ্ঞায় বলা যায়, কাব্য হল সেই দৃষ্টিভঙ্গি যা রসবোধ, ছন্দ ও আলংকারিক বর্ণনা সহ ক্ষুদ্রকে বৃহৎ, বৃহৎকে ক্ষুদ্র, ভয়ঙ্করকে সুন্দর, তথাকথিত সুন্দরতাকে অসার অথচ সত্যকে সত্য দেখিয়ে আত্মতৃপ্তি দেয়!
বেদের নাসদীয় সুক্তমের "...অন্ধকার দ্বারা অন্ধকার আবৃত..."; জীবনানন্দের "চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা..."; জয় গোস্বামীর "মেঘবালিকা", নজরুলের "...আমি দাবানল দাহ দাহন করিব বিশ্ব..."; কবিগুরুর "মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা মঙ্গলঘট হয়নি যে ভরা সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থ নীড়ে..."; শেক্সপিয়ারের কবিতা, বাল্মীকি রামায়ণের শ্রীরামচন্দ্রের বনবাসের পূর্বে কৈকেয়ী ও শ্রীরামচন্দ্রের সংলাপ, ব্যাসদেবের নল দময়ন্তী সংলাপ, জসীমউদ্দীনের "কবর" কবিতা ইত্যাদি হল কাব্যের বা কবিতার উদাহরণ। কাব্যিকতা নিজেই কেন রূপক? কারণ তা সাধারণ মানুষের পক্ষে সেভাবে ভাবা সম্ভব নয় বলে। কাব্যিকতা স্বয়ং রূপকের রাণী।
🌞 তত্ত্বরূপক― রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "দুই বিঘা জমি" বা আমাদের রামায়ণ, মহাভারত ও পুরান সেগুলোও রূপক গল্পের আড়ালে কবিতার মাধ্যমে তত্ত্বকে বা সত্যকে বোঝাতে চান। সেই কাহিনীগুলো কিছু সত্যি আবার কিছু বোঝাবার জন্য― কিন্তু সবকটি কাহিনীর আড়ালের তত্ত্বটি অতি উচ্চমানের সত্য। এগুলো কেন রূপক? কারণ আমরা এসব ক্ষেত্রে বোকার মতো কাহিনী নিয়েই মেতে থাকি, তলিয়ে দেখে তত্ত্বটি খুঁজে নিজের নিজের জীবনকে উন্নত করি না― এসব যেন রূপকথার গল্পের রাক্ষসের প্রাণপাখি গাছের কোটরে থাকার মতো। এই প্রকার রূপককে রূপকের রাজা বলা যায়।
🐣 ভাবরূপক: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "আমি", "তুমি" শব্দ যুক্ত প্রেম বা বিরহের গান বা কবিতাগুলো এর উদাহরণ। এগুলো রূপক কেন? কারণ তা বিভিন্ন লেভেলের মনের মানুষের কাছে বিভিন্ন প্রকার অর্থ বহন করে। যেমন প্রেমিক প্রেমিকার, আবার একই কবিতা পড়ে ভক্ত ঈশ্বরের কথা ভাববেন― এসব উৎকৃষ্ট রচনা উভয়ক্ষেত্রেই সমান প্রাসঙ্গিক। এ হল রূপক রাজ্যের তরুণ রাজপুত্র বা রাজকন্যা!
🌹উপমারূপক: "পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি"; "বেয়নেট যতো হোক ধারলো, কাস্তেটা শান দিও বন্ধু"; "...দেখগো হেথায় হাপর হাঁপায় হাতুড়ি মাগিছে ছুটি..." এবং ক্লাস টেনে পড়া বেশিরভাগ ভাবসম্প্রসারণ যেমন "কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে" ইত্যাদি হল উপমা প্রয়োগে অন্য জিনিসকে বোঝানো। এসব কবিতার রূপ বর্ধিত করে। কাব্যিকতা রূপক আর এই রূপক প্রায় একই প্রকার দেখতে। পার্থক্য সামান্যই, এক্ষেত্রে কিছু জিনিস বোঝাতে অন্য কিছুকে ব্যবহার করা হয় আর কাব্যিকতার ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেখাই হয় অন্য ভাবে। এক্ষেত্রে মানে অনেক সময় বোঝা যায় না― না বোঝা গেলে উদ্দেশ্যটাই অসফল থেকে যায় এবং রসাস্বাদনে বাধা আসে। কিন্তু সেক্ষেত্রে মানে বোঝার কোনো তাড়না থাকে না― কেবল আবেগে আবেগ মিলিয়ে অজান্তেই অন্য জগতে চলে যাওয়া! একে কাব্যিকতা রূপকের ভাই বলা যায়, অর্থাৎ এ হল তত্ত্বরূপকের শালাবাবু।
🕸️ শব্দরূপক বা বন্ধ্যারূপক: এগুলো মূর্খতা― অনাবশ্যক কঠিন কঠিন শব্দের জাল বিস্তার বা অযাচিত ও দুর্বোধ্য ছন্দবদ্ধ কথা। এগুলোতে না রস পাওয়া যায় না বোঝা যায় কোনো মানে― জোরজবরদস্তি নিজেকে আধুনিক কবি প্রমাণের জন্য, অন্যদের থেকে আলাদা প্রমাণের জন্য, নিজেকে তত্ত্বরূপক সৃষ্টিকারী প্রমাণ করতে বা নিজের দুর্বলতাকে ঢাকা দিতে এই ধরণের রূপকের আশ্রয় নেওয়া হয়। এ বন্ধ্যা। আধুনিক সহজ শব্দ প্রয়োগে এবং অভিনব উপস্থাপনে আমরা ওপরের চারটি রূপকের যত্ন নিতে পারি।
কখন লিখব কবিতা? মন অস্থির হলে কবিতা লেখা কঠিন, কিন্তু কিছুদিন চেষ্টা করলে হয়। আবার কবিতা লিখলে মন স্থির হয়― কবিতা লিখতে যে গভীর মনোযোগ লাগে সেটাই মনকে স্থির করে দেয়। আবার লেখার পরে নবসৃষ্টির accomplishment- এর জন্য সুখানুভূতিও আসে। মনের ভাব যেমন হয় তেমন ধরনের কবিতা লিখলে ব্যাপারটা আরও সহজ হয়ে যায়। যেমন কারোর ওপর রেগে থাকলে তার ওপর রাগ প্রয়োগ না করে ওই রাগটাকে একটা big picture দিয়ে জনতার সাথে অন্যায়ের প্রতিবাদমূলক কবিতা লিখুন! মুডও ভালো হয়ে যাবে আবার রাগের কারণে কারোর ক্ষতিও হবে না। দুঃখে দুঃখের আর খুশিতে খুশির কবিতা লিখলে সহজেই লেখা আসে। যখন লিখবেন না তখন দিনের পর দিন যে কোনো একটি বিষয় নিয়ে গভীর থেকে গভীরে ভাবতে থাকুন― কে বলতে পারে সেটাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম কবিতা হয়ে ঝরনা বহাবে না?
কলেজে সাহিত্যে অনার্সে নোটস্ মুখস্থ করে, এমনকি টেক্সট বই না পড়েও 70% নম্বর পাওয়া যায়― সাজেশন থেকেই প্রশ্ন আসে। মানবসম্পদ কোথায় তৈরি হচ্ছে? সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করে নিজের এবং দেশের কী লাভ হচ্ছে? টাকাগুলো এইভাবে নষ্ট করার কী মানে আছে? এই অবস্থায় তিনটি জিনিস করা যায়:
১. প্রতি সেমিস্টারে কলেজে এক বা দুজন বড়ো মাপের সাহিত্যিক এনে তারা কিভাবে লেখেন এবং তারা জীবন ও জগতকে কিভাবে দেখেন সেই বিষয়ে সেমিনার আয়োজন করতে হবে। এর সাথে বাংলা ভাষা কেন নোবেল পুরস্কার পাচ্ছে না সেটাও আলোচনা করতে হবে।
২. প্রতি কলেজের বাংলা ও ইংরেজি ডিপার্টমেন্ট মিলে প্রতি ইয়ায়ের প্রতি সেমিস্টারে সেই সময়কার নতুন লেখা ভালো ভালো সাহিত্যের অনুবাদ করবে― কপিরাইট অনুমতি নিয়ে সহ বই আকারে তা প্রকাশও করবেন।
৩. পরীক্ষায় একটি ডাইনামিক প্র্যাকটিক্যাল সাবজেক্ট থাকবে। কমপক্ষে 20% ছাত্রছাত্রীদের নিজস্ব লেখালেখি করতে হবে, করতেই হবে এবং বাকি যারা লিখতে পারবেন না তারা একেবারে আধুনিক সময়ের পাঁচটি ভালো কবিতা নিজের মতো করে চয়েস করবেন এবং সেগুলো ব্যাখা করবেন। প্রতি সেমিস্টারে এই সাবজেক্ট রাখতে হবে।
পরিশেষে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে আমাদের অনেক কবিই এত উন্নত মানের কবিতা লেখেন, যেগুলো বিদেশি লেখকরা কল্পনাও করতে পারেন না। কেবলমাত্র এগুলো অনুবাদ হয় না এবং উনারা পড়েন না বলেই আমরা নোবেল পাচ্ছি না। অনেক অনেক বিষয়ে আমরা শ্রেষ্ঠ।
সাহিত্যে অনেক সময় বিশেষ্য ও ক্রিয়ার জায়গায় বিশেষণ ব্যবহার করে ভাষাটাকে আরও তেজোদীপ্ত করা যায়। আর ভারতের জাতীয় সুর হল― বেদ। স্বামীজির থেকে আমরা এগুলো শিখতে পারি। আমাদের সংস্কৃতির প্রাণপাখিকে এবং আমাদের সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ জিনিসগুলোকে রক্ষা করে বাকি যে অজস্র আবর্জনা আছে সেগুলোকে ত্যাগ করে ভালো ভালো বিদেশি লেখা থেকে শিখে সেগুলোকে নিজেদের ভাবে করে নিজেদের মৌলিকতার অংশ নিতে হবে। মাথায় রাখতে হবে আমরা যেন না "না ঘরকা না ঘাটকা" হয়ে যাই। সাপ মারতে গিয়ে যেন না শিব মেরে বসি।
🕉️ উৎসর্গ: অনন্ত শ্রদ্ধা সহ স্বয়ং বিদ্যাদেবীকে 🙏🙏🙏