যেদিন চলে যাব, সেদিনও কি গাঁয়ের আকাশ থাকবে এমনই নীল?
নাকি রোদের মায়া মেখে সন্ধ্যা নামবে ধীর লয়ে?
মাঠের আল ধরে চলোচলি করবে পরিচিত ছায়ারা,
আমার উঠোনে বাতাস দোলাবে শেষ বিকেলের কুয়াশা।

ঘরের দাওয়ায় পড়ে থাকবে পুরনো জোড়া স্যান্ডেল,
যেন ক্লান্ত দুই চোখ, ঘুমের অপেক্ষায়—
চৌকাঠের কোণে ঠেস দিয়ে রাখা লাঠিটা বোবা দাঁড়িয়ে,
আর কুঁজো হয়ে থাকা চেয়ারে পড়ে থাকবে
এক ফালি বিস্মৃত দুপুরের আদর।

আমার নাম মুছে যাবে প্রথম আজানের আগেই,
যে নামে ডাকত মা, যে নামে চিঠি লিখত কেউ,
সেই নাম বাতাসে মিলিয়ে গিয়ে আমাকে দেবে নতুন পরিচয়—
আমি হব ‘লাশ’, কেউ বলবে ‘মুগদার’,
আমি আর ‘আমি’ থাকব না, নাম হয়ে যাবে নিঃসঙ্গ স্মৃতি।

হাটের চায়ের দোকানে ধোঁয়ার ভিড়ে কেউ বলবে,
"লোকটা বড় ভালো আছিল, কারো সাথে কোনো ফ্যাসাদ আছিল না,”
আরেকজন ঢক ঢক করে চা খেয়ে বলবে,
“হ, বড় নিরীহ মানুষ আছিল, কারো ক্ষতি করে নাই কক্ষণো।”
তারপর দোকানের বেঞ্চিতে পড়বে একচিলতে নীরবতা,
একটু যেন ভারী হবে বাতাসের ভার।

মসজিদের মাইকে ধীর কণ্ঠে মুয়াজ্জিন জানাবে শোক সংবাদ—
"আজ অমুক ব্যক্তির জানাজার নামাজ
বাদ মাগরিব তার নিজ গৃহে অনুষ্ঠিত হইবে,
সকলকে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করা হইল।”
তখন গাঁয়ের বাতাস কেমন যেন থমকে যাবে,
দরজায় কপাটে আঙুল ছুঁইয়ে থমকে দাঁড়াবে কিছু মুখ।

বাঁশ কাটার শব্দ হবে, শুকনো খেজুর পাতার ঘ্রাণ ছড়াবে বাতাসে,
ছোটরা দাঁড়িয়ে দেখবে দূর থেকে,
কেউবা দাওয়ায় বসে নিঃশব্দে মুখ ঢাকবে আঁচলে।
কবর খোড়ার ফাঁকে কেউ বেছে নেবে তিন গজ কাফনের কাপড়,
একজোড়া হাত তন্ময় হয়ে গুনবে লাশ ধোয়ার পানির মাপে,
আর আমি পড়ে থাকব এক কোণে,
সবাই ব্যস্ত, কিন্তু আমার আর কোনো তাড়া নেই।

আমার গোসল হবে ধীরে, সযত্নে, পবিত্রতার পরশে,
শীতল পানির স্পর্শে শেষবারের মতো কেঁপে উঠবে নিথর দেহ।
আতর-লোবান মেখে, সাদা কাফনে মুড়িয়ে
আমাকে সাজিয়ে তোলা হবে বিদায়ের জন্য।
ইমাম সাহেব আল্লাহু আকবর ধ্বনি তুলবেন,
সারির পর সারি মানুষ দাঁড়াবে কাতারে,
নীরব মুখে জানাজার নামাজে শরীক হবে সবাই।
তারপর ধীর পায়ে আমাকে নেওয়া হবে আমার স্থায়ী ঠিকানায়,
সতর্ক হাতে নামিয়ে দেওয়া হবে নরম মাটির বুকে,
ধীরে ধীরে লোক কমবে, শব্দ মিশে যাবে বাতাসে,
আর মাটি দিয়ে সুন্দর করে ঢেকে দেওয়া হবে আমার ঠিকানা।

আমি শুইয়ে থাকব, আর পৃথিবী এগিয়ে যাবে,
বিকেলে হয়তো কেউ গরু আনবে মাঠ থেকে,
রাতে কোনো রান্নাঘরে হাঁড়িতে ফুটবে ডাল,
শিশুরা পড়বে পাড়ার মক্তবে,
আর আমার নাম, আমার গল্প,
ধীরে ধীরে মিশে যাবে বাতাসে,
মাটির স্তরে স্তরে,
চিরকালীন নীরবতায়।