আমি জন্ম নিয়েছিলাম এক বর্ষার রাতে,
কালো মেঘের ডাকে, বিজলির আঘাতে।
তখন আকাশ ছিলো বিদ্রোহী উন্মাদ,
পাহাড়ের বুকে বেজেছিলো সাগরের রাগ।
আমার জন্মক্ষণে বাতাস গেয়ে উঠেছিলো গান,
ধুলো-মাটির বাঁশরী বাজতো রক্তিম সন্ধান।
আমি গড়িয়ে পড়েছিলাম শৈলশিরা চিরে,
ভাঙা ঢেউয়ের বুকে প্রথম ছন্দ তুলে।
কেউ আমাকে বলেছিলো— ‘তুই তো তৃষ্ণার জল’,
কেউ বলেছিলো— ‘তুই গৃহহারা নদীর কোল’।
কিন্তু আমি জানতাম, আমি কেবলই এক ভবঘুরে,
যার নেই কোনো ঘর, নেই কোনো নোঙর টেনে ধরা পুরে।
আমার বুকের ভিতর ছিলো ঢেউয়ের নেশা,
আমার চিবুকে ছিলো এক বিষণ্ণ দেশের ছবি আঁকা কেশা।
আমি ছুটতে চেয়েছিলাম, আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম,
স্বপ্নের স্রোতে হারিয়ে যেতে উদাসীন হয়েছিলাম।
আমাকে বুকে টেনেছিলো সবুজ ধানের মাঠ,
কৃষকের কষ্টে বোনা মাটির ব্যথিত হ্রদ।
আমাকে ডেকেছিলো ঘাসফুলের সুবাস,
জলতরঙ্গের সুরে বেজেছিলো কান্নার আভাস।
আমি কুয়াশা ছুঁয়ে গিয়েছিলাম নদীর বাঁকে বাঁকে,
রোদন-মাখা আকাশে মিশেছিলো তন্দ্রাহারা রাকে।
আমার ঢেউয়ে ভেসেছিলো কত জোছনার রাত,
কত অভিমানী ভালোবাসা হারিয়ে গিয়েছিলো স্রোতের পাত।
আমি ছিলাম এক স্বপ্নবিলাসী ভবঘুরে জল,
যার কোনো গন্তব্য নেই, শুধু ছুটে চলার দোল।
আমি জানতাম না, কবে আমি বিশ্রাম নেবো,
কোন ঘাটে এসে একদিন বালুচরে ঘুমিয়ে যাবো।
আমি ছুটেছি রাতের আধারে, বিসর্জিত চাঁদের আলোয়,
নক্ষত্ররা কেবলই ছিলো নির্বাক সাক্ষী আমার যাত্রার ঢেউয়ে ভাসিয়ে।
আমি ডেকেছি বাতাসকে, বলেছি— "বল তো আমার ঠিকানা কোথায়?"
বাতাস হেসে বলেছে— "তুই কি কোনোদিন থামতে চেয়েছিস, হায়?"
আমি থামিনি, আমি থামতে পারিনি, আমার স্রোত ছিলো অবিরাম,
আমার বুকে ছিলো ভাঙনের শব্দ, চোখে ছিলো জলরঙের নাম।
আমি দেখেছি কৃষকের কপালে ঘামের রেখা,
আমি শুনেছি বালিকার মুখে প্রথম প্রেমের দেখা।
কেউ এসে আমার জলে ভিজিয়েছে শৈশবের স্মৃতি,
কেউ কেঁদেছে আমার জলে, শ্মশানের প্রদীপ নিভিয়ে।
আমি বুঝিনি, আমি শুধু বয়ে গেছি— স্বপ্ন আর বাস্তবতার দ্বন্দ্ব বুকে,
একদিকে প্রেমের গান, অন্যদিকে মৃত্যুর শোক জড়িয়ে ছিলো আমার ঢুকে।
একদিন এক ভবঘুরে এসেছিলো, ফেলে দেওয়া এক ছেঁড়া পালক,
সে আমায় বলেছিলো— "তোর মতো আমিও পথে পথে একাকী পথিক!"
তার চোখে ছিলো বৃষ্টির ঝাপসা জল, হাতে ছিলো বাউলির একতারা,
সে আমায় গান শুনিয়েছিলো, নদীর ভিতর জন্ম নিয়েছিলো ঢেউয়ের কারা।
"তুই কি জানিস, স্বপ্ন বড় নিষ্ঠুর!"— সে বলেছিলো আকাশের পানে,
"যে স্বপ্ন কাঁধে নিয়ে চলে, সে-ই একদিন পড়ে যায় ধুলোর টানে।"
আমি শুনেছিলাম, আমি দেখেছিলাম, আমি বুঝতে পারিনি,
আমি তখনও বিশ্বাস করতাম, স্বপ্নেরা একদিন ধরা দেবে নিশ্চয়ই!
তবু আমি বয়ে গেছি, তবু আমি ছুটেছি, ভবঘুরের গান হৃদয়ে,
তবু আমি জেনেছি, আমার স্রোত কখনোই থামবে না—
এই রাত্রির অবসানে, এই উন্মাদনার শেষে,
আমি শুধুই নদী, যাকে চেনেনা কেউ, যার শেষ নেই,
যার শরীরে জড়িয়ে আছে হারিয়ে যাওয়া নামহীন কবিতার দেশে।
আমি ছুটেছি ধানখেতের পাশ দিয়ে, জলে ফুটেছে সাদা শাপলা,
আমি শুনেছি মাঝির গান, শুনেছি কপালে জলের তাপটা।
কেউ কেউ ডেকেছে আমায়— "ও নদী, তোর কি ক্লান্তি নেই?"
আমি বলিনি কিছুই, আমি শুধু একটানা ছুটে চলেছি আঁধারে ঢেকে।
আমার জলে কিশোর হেসেছে, কন্যারা চুল বেঁধেছে জলে,
কোনোদিন এক প্রেমিক বলেছে— "ও নদী, আমার ব্যথা ভুলিয়ে দে তোর কলে।"
আমি কি কারও ব্যথা ভুলিয়ে দিতে পারি? আমি তো নিজেই এক বিরহী ঢেউ,
যে ঢেউ একদিন এসে ঠেকবে শূন্যতার গহীন স্তুপে!
আমি জানি, আমারও একদিন থামতে হবে— বালির প্রান্তে, সাগরের কোলে,
আমি জানি, সেদিন কেউ আমায় খুঁজবে না, কেউ ডাকবে না বাউল সুরে।
তবু আমি ছুটে যাই, আমার বুকে আছে ভবঘুরে সুরের রাগ,
তবু আমি বলি— "স্বপ্ন যদি মিথ্যা হয়, তবে কেন আসে বারবার?"
আমি একদিন শুনেছিলাম, নদীও কাঁদে, নদীও হাসে,
তবু কেউ তার ব্যথা বোঝে না, কেউ শোনে না তার বুকের ভাষা।
আমি কাঁদতে পারিনি, হাসতেও পারিনি, আমি শুধু ছুটে গেছি,
আমার শরীরে জড়িয়ে ছিলো হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের রেশ।
আমি দেখেছি এক মা তার পুত্রের শব ভাসিয়ে দিচ্ছে জলে,
আমি শুনেছি শঙ্খের ধ্বনি, দূর মন্দিরের আলো কম্পিত হলে।
আমি অনুভব করেছি জেলের ভাঙা জাল,
আমি স্পর্শ করেছি এক প্রেমিকের বিষাদ-কাল।
আমি তৃষ্ণার্ত মেঘের দিকে তাকিয়ে বলেছি—
"এসো বন্ধু, আমার বুকে একটুখানি বৃষ্টি ফেলো।"
মেঘ হেসেছে, বিদ্যুৎ চমকেছে, বৃষ্টি পড়েনি,
তবু বাতাসের শরীরে আমি জলের ঘ্রাণ পেয়েছি।
একদিন এক জেলেরা বলেছিলো—
"নদী, তোর বুক ফুঁড়ে আমার জীবন কাটে,
তুই থাকলে আমরা থাকি, তুই মরলে আমরাও হারাই,
তোর কি ক্লান্তি হয় না, তুই কি বিশ্রাম চাস না?"
আমি বলিনি কিছু, আমি শুধু দেখেছি,
জেলের মেয়েটা ভেজা শাড়ির আঁচল পেতে
তাকিয়ে আছে দূর সীমানায়, যেখানে আমি মিশে যাই।
সে কি অপেক্ষায় আছে? সে কি জানে, আমিও একদিন হারাব?
এক শিশু আমার জলে কাগজের নৌকা ভাসিয়েছে,
সে চিৎকার দিয়ে বলেছে—
"ও নদী, আমার নৌকাটা হারিয়ে ফেলিস না!"
আমি প্রতিশ্রুতি দিতে পারিনি, আমি জানি—
সব নৌকাই একদিন ডুবে যায়, সব স্বপ্নই একদিন ভেঙে যায়।
একদিন এক ভবঘুরে ফের এসেছিলো,
সে আমার জলে হাত ডুবিয়ে বলেছিলো—
"তোর ভিতরেও কি শূন্যতা আছে, নদী?
তুইও কি আমার মতো একা?"
আমি কি একা? আমি কি কারো?
আমার কি কোন বাঁধ আছে, কোন ঠিকানা?
আমি তো কেবলই ছুটে চলা এক জলধারা,
যার বুক জুড়ে মিশে আছে নামহীন যাত্রার ব্যথা।
আমি একদিন জলের আয়নায় দেখেছিলাম নিজের মুখ,
ক্লান্ত ঢেউগুলো বলেছিলো— "তুইও তো পথহারা, নিঃসঙ্গ এক সুখ।"
আমি বুঝতে পারিনি, সুখ কি আসলে একা থাকে?
নাকি তারও বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকে ব্যথার অন্ধকার ডাকে?
আমি বয়ে গেছি, বয়ে চলেছি, সময়ের সাথে আমার দ্বন্দ্ব পুরনো,
আমার বুক চিরে গড়ে উঠেছে নগর, ভেঙেছে গ্রাম, কেটে গেছে বনভূমি মোহনা।
আমি দেখেছি কংক্রিটের সেতু, লোহার শিকল, বাঁধের উঁচু প্রাচীর,
মানুষ আমাকে থামাতে চেয়েছে, তবু আমি ভেঙেছি তাদের কাঁচের ছবির ছবির।
একটি কিশোর এসেছিলো, কাঁধে পুরনো ব্যাগ, চোখে উদাসীনতা,
সে বলেছিলো— "ও নদী, আমাকে কোথাও নিয়ে চলবি?"
আমি হেসেছিলাম, বলেছিলাম— "আমি তো নিজেই পথ চিনি না,
তবে তোর স্বপ্নগুলোর সাথে আমিও হারিয়ে যেতে পারি!"
সে নদীর ধারে বসেছিলো, বালিতে এঁকেছিলো নামহীন এক মুখ,
সে কি প্রেমিকার প্রতিচ্ছবি এঁকেছিলো, নাকি কোনো হারানো দিনের দুখ?
আমি বয়ে চলেছি, সে বসেছিলো, আমরা দুজনেই এক অভিমানী,
আমি তাকে বলিনি কিছুই, যেমন কেউ আমায় কখনো বলেনি!
আমি একদিন ঝড় দেখেছি, কালো মেঘের বিষাক্ত চুম্বন,
আমার শরীরে ঢেউ উঠেছে, আমার বুকে বাজ পড়েছে আগুন!
আমি গর্জে উঠেছি, ছিন্ন করেছি কূলের বন্ধন,
আমি জলের কান্না হয়ে গেছি এক বিসর্জনের অঙ্গন।
এক বৃদ্ধা আমায় ডেকেছিলো— "ও নদী, আমার ভিটে নিয়ে যাস না!"
আমি থামতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার বুকের ঢেউয়ের ছিলো না কোনো বাঁধা।
আমি জানি, আমিই কখনো কারো ঘর ভাসাই, আবার আমিই জল হয়ে বাঁচাই,
আমি আকাশের মতো নিরপেক্ষ— কাকে ভালোবাসি, কাকে হারাই, তার কোনো ঠিকানা নাই।
আমি একদিন এক বাউল দেখেছিলাম, সে বৃষ্টিতে ভিজছিলো,
তার চোখে ছিলো নদীর মতোই ক্লান্তি, তার গানে ছিলো শূন্যতার রঙ,
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুইও কি কাঁদিস, তুইও কি গান গাস?"
আমি কিছু বলিনি, আমি শুধু ঢেউয়ের শব্দে এক ব্যথিত সুর বাজিয়েছি।
আজও আমি ছুটছি, আমার স্বপ্নেরা আজও ভাঙে,
আজও কোনো এক ভবঘুরে নদীর জলে নিজের ছায়া খোঁজে।
আমি জানি, একদিন আমি হারিয়ে যাবো, আমি থেমে যাবো,
তবু আমার ঢেউয়ে কেউ না কেউ রেখে যাবে স্বপ্নের নৌকা!
আমি একদিন এক সন্ন্যাসীকে দেখেছিলাম,
সে বসেছিলো আমার কূলে, চোখে ছিলো নির্বিকার প্রশান্তি,
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই কি জানিস, বয়ে যাওয়া মানেই মুক্তি?"
আমি চুপ করেছিলাম, আমি কি জানি মুক্তি কাকে বলে?
আমি তো বয়ে চলেছি, জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি,
আমার কি কোথাও থামার অনুমতি আছে?
আমার ঢেউয়ে ছুঁয়ে গেছে ভালোবাসা, ছুঁয়ে গেছে রক্ত,
আমি কি জানি, বয়ে চলার নাম যদি হয় মুক্তি, তবে বন্দিত্ব কী?
আমি দেখেছি শহরের আলোর নিচে একাকী মানুষ,
আমি দেখেছি ভিখারির পাত্রে জমে থাকা অনাহারের কান্না,
আমি শুনেছি স্বপ্নভঙ্গের আর্তনাদ, শুনেছি বিদ্রোহীর শপথ,
তবু আমি কিছু বলিনি, আমি তো শুধু নদী,
আমার ভাষা ঢেউয়ের শব্দের ভেতর লুকিয়ে আছে।
এক মা এসেছিলো কূলে, কোলে তার শিশু,
সে আমার জলে ছুঁইয়ে বলেছিলো—
"ও নদী, আমার সন্তানকে আশীর্বাদ দে!"
আমি চেয়ে দেখেছি শিশুটির ছোট ছোট হাত,
আমি ভেবেছি, সে কি একদিন আমাকেও চিনবে?
আমি দেখেছি মাঝরাতে এক কবির ব্যথা,
সে কাগজ ভিজিয়ে ফেলেছে আমারই জল দিয়ে,
সে বলেছে— "ও নদী, তুই তো শূন্যতার কবিতা জানিস,
আমার কলমে একটু ঢেউ দিয়ে যা!"
আমি ঢেউ দিয়েছি, সে লিখেছে এক ব্যথার গান,
আমি জানি না, সে গান কেউ শুনবে কি না,
আমি জানি না, আমারও গান কেউ কোনোদিন মনে রাখবে কি না,
তবু আমি ছুটছি, তবু আমি গাইছি,
স্বপ্নের ভিতর বাস্তবতা মিশিয়ে এক অদ্ভুত সুর সাজিয়ে।
আমি জানি, আমার সামনে একদিন অপেক্ষা করছে মহাসমুদ্র,
আমি জানি, সেদিন আমি আর নদী থাকবো না,
আমার জল মিলিয়ে যাবে এক বিশাল নীল অস্তিত্বে,
তবু কি কেউ আমাকে মনে রাখবে?
তবু কি কেউ বলবে—
"ও নদী, তুই তো হারিয়ে গেছিস,
তবু তোর ঢেউয়ের শব্দ রয়ে গেছে
আমাদের নিঃশব্দ কষ্টের ভিতর?"
আমি একদিন এক মাতালের কণ্ঠে শুনেছিলাম—
“নদী, তোর কি দুঃখ হয়? তোর কি বুক ফাটে?”
আমি কিছু বলিনি, আমি শুধু বয়ে গেছি,
তার চোখের গভীরে এক সমুদ্রের ঢেউ দেখেছিলাম।
সে বলেছিলো— “আমি একদিন সমুদ্র দেখতে যাবো,
তুই কি নিয়ে যাবি আমায়? তুই তো তারই দাস!”
আমি শুধু হেসেছিলাম, বলিনি কিছুই,
আমি কি নিজেই জানি, কোথায় গিয়ে ফুরাব আমার গল্প?
আমি একদিন এক সেপাই দেখেছিলাম,
তার হাতে ছিলো রক্ত, তার মুখে ছিলো অন্ধকার,
সে আমার জলে মুখ ধুয়ে বলেছিলো—
“ও নদী, তুই তো সব জানিস, তুই কি আমায় ক্ষমা করবি?”
আমি তাকিয়ে দেখেছি, আমি কি জানি ক্ষমা কাকে বলে?
আমার ঢেউ তো শুধু সত্যের কথা বলে,
আমার ঢেউ তো কারো রক্তের ইতিহাস মুছতে পারে না,
তাই আমি চুপ করেছিলাম, যেমন চুপ থাকে নির্বাক প্রতিধ্বনি।
আমি একদিন এক দুঃখী মেয়ের চোখে দেখেছিলাম শূন্যতা,
সে আমার কূলে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলো—
“ও নদী, তুই কি জানিস, ভালোবাসা কীভাবে মরে যায়?”
আমি জানতাম না, ভালোবাসা কি কখনো মরে?
আমি জানতাম না, কেউ সত্যিই হারিয়ে যায় কি না,
আমি শুধু দেখেছি, বালির উপর লেখা নাম মুছে যায় ঢেউয়ের সাথে,
আমি শুধু শুনেছি, বাতাসে হারিয়ে যায় প্রতিজ্ঞার শব্দ,
আমি শুধু বুঝেছি, সব কিছুই একদিন চলে যায়,
আমার মতো, তোর মতো, আমাদের মতো।
আমি একদিন এক ভবঘুরেকে বলেছিলাম—
"তুই কি ক্লান্ত হোস না? তুই কি থামতে চাস না?"
সে হেসেছিলো, আমারই মতো, বেহায়ার মতো—
"ও নদী, তুই কি জানিস, পথহীন মানুষেরা কখনো থামে না!"
আমি তার চোখে দেখেছিলাম এক অনন্ত বিস্ময়,
আমি তার পায়ের নিচে দেখেছিলাম হারিয়ে যাওয়া মানচিত্র,
আমি তার কণ্ঠে শুনেছিলাম এক নির্বাক গান,
আমি তার সুরে খুঁজেছিলাম নিজের পরিচয়!
আমি কি মানুষ, না শুধু এক স্রোত?
আমি কি এক ভবঘুরে, না শুধু হারানোর নাম?
আমি জানি না, আমি শুধু জানি—
স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝে আমি এক নামহীন নদী,
যার গন্তব্য আছে, কিন্তু ঠিকানা নেই!
আমি একদিন এক ফেরিওয়ালার গান শুনেছিলাম,
সে আমার কূলে দাঁড়িয়ে বলছিলো—
“ও নদী, তোর ঢেউয়ে আমার স্বপ্নের ছায়া পড়ে,
তুই কি আমায় একটু আশ্রয় দিবি?”
আমি চেয়েছিলাম তাকে বলতে—
“তুই তো চলতি পথের মানুষ, আশ্রয় খুঁজিস কেন?”
কিন্তু আমি জানতাম, পথের মানুষেরাও ক্লান্ত হয়,
তারা রাতের অন্ধকারে একফোঁটা মায়া খোঁজে!
আমি একদিন এক পাখি দেখেছিলাম,
সে আমার জলের উপর দিয়ে উড়ছিলো,
সে কি আমায় ছেড়ে যেতে চেয়েছিলো,
নাকি আমার বুকের আয়নায় নিজেকে দেখতে?
আমি ডাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমি তো নদী,
আমার ডাক নেই, আমার কণ্ঠ নেই,
আমার শুধু ঢেউ আছে, স্রোত আছে,
আমার কষ্টগুলোও কেবল শব্দহীন!
এক সন্ধ্যায় আমি এক নাবিক দেখেছিলাম,
সে বলেছিলো— "নদী, তুই কি সমুদ্র হতে চাস?"
আমি কিছু বলিনি, আমি কি জানি,
সমুদ্রের বুকেও কি আমার মতো ব্যথা আছে?
আমি জানি, একদিন আমি মিশে যাবো সাগরে,
আমার বুকে গর্জে উঠবে লোনা জল,
আমি হারিয়ে ফেলবো আমার পরিচয়,
তবু কি কেউ মনে রাখবে আমার নাম?
আমি একদিন এক ছেলেকে দেখেছিলাম,
সে আমার জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলো কাগজের নৌকা,
সে কি জানত, নৌকাগুলো একদিন ডুবে যায়?
নাকি সে বিশ্বাস করেছিলো, স্বপ্নেরা ভাঙে না?
আমি জানি না, আমি শুধু জানি,
সব স্বপ্নই একদিন ভেসে যায় দূরে,
কেউ তাকে খুঁজে পায় না,
কেউ তার গল্প লিখে না,
আমার মতো, তোর মতো, আমাদের মতো!
তবু আমি ছুটছি, অজানা কোনো পাড়ের দিকে,
তবু আমি জানি, আমার শেষ ঠিকানা নেই,
তবু কেউ একজন আমার ঢেউয়ে কান পেতে শোনে,
আর আমি, আমি শুধু বয়ে চলি,
যেন এক নামহীন ভবঘুরে!
আমি একদিন এক কৃষকের চোখে দেখেছিলাম আগুন,
তার শুষ্ক জমির ফাটলে চিৎকার করছিলো খরা,
সে আমার জলে হাত ডুবিয়ে বলেছিলো—
“ও নদী, তুই কি সত্যিই মরে যাচ্ছিস?”
আমি চুপ করেছিলাম, আমি কি জানি মৃত্যুর সংজ্ঞা?
আমার জল কি একদিন শেষ হয়ে যাবে?
আমার বুক কি শুকিয়ে যাবে বালুচরে?
আমি কি হারিয়ে যাবো সময়ের স্রোতে?
আমি দেখেছি নদীর গভীরে ডুবে যাওয়া এক গ্রাম,
ছেলেটা বলেছিলো— "আমার বাড়িটা ছিলো ওইখানে,
তুই আমাদের সব কেড়ে নিয়েছিস নদী,
তুই কি আমাদের একটু ফিরিয়ে দিবি?"
আমি কি কিছু ফিরিয়ে দিতে পারি?
আমি তো শুধু ছুটে চলা এক জলধারা,
আমি শুধু বয়ে যাওয়া এক ক্লান্ত নীরবতা,
আমি কি কারো কাছে ক্ষমা চাইতে পারি?
এক বৃদ্ধ মাঝি আমায় বলেছিলো—
"তোর বুকের ঢেউগুলো আগের মতো নেই,
তুই কি ক্লান্ত হয়ে গেছিস নদী?"
আমি উত্তর দিইনি, আমি কি জানি ক্লান্তি কাকে বলে?
আমি তো শুধু বয়ে চলেছি,
শুকনো মৌসুমে ক্ষীণ হয়ে গেছি, বর্ষায় উন্মত্ত,
আমি কখনো শান্ত, কখনো ভয়ানক,
তবু আমি একাই, তবু আমি নির্জন!
আমি একদিন এক কবির কলমে বেঁচেছিলাম,
সে আমার ঢেউয়ের শব্দ শুনে লিখেছিলো প্রেম,
সে আমার জলের ছোঁয়ায় কেঁদেছিলো,
সে কি জানত, নদীও কখনো কাঁদে?
আমি একদিন এক শহরের মৃত্যু দেখেছিলাম,
আমার বুকের জল হয়ে গিয়েছিল বিষ,
মানুষ আমাকে হত্যা করেছিলো,
আমি চিৎকার করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার কণ্ঠ নেই!
তবু আমি ছুটছি, ছুটছি এক অচেনা পাড়ের দিকে,
আমি জানি, কেউ একদিন আমায় ভুলে যাবে,
তবু আমার ঢেউয়ে কেউ না কেউ একদিন খুঁজবে,
হারিয়ে যাওয়া কোন নামহীন ভবঘুরের প্রতিচ্ছবি!
আমি একদিন এক রেলস্টেশনের ধারে থেমেছিলাম,
সেখানে এক ছেলেকে দেখেছিলাম, যার চোখ ছিলো উদাস,
সে একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে, একবার আমার দিকে,
তার চোখে ছিলো এক অজানা গন্তব্যের সন্ধান।
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই কি জানিস,
পথ হারানো মানুষ কোথায় গিয়ে থামে?"
আমি কিছু বলিনি, আমি কি জানি পথহারা জীবনের মানে?
আমি তো নিজেই এক ভবঘুরে, নিজেই এক অনন্ত ভ্রমণ!
আমি একদিন এক রমণীর চোখে দেখেছিলাম স্বপ্ন,
সে আমার জলে হাত ছুঁইয়ে বলেছিলো—
"ও নদী, তোর বুকের জলে আমার প্রেম ডুবিয়ে দেই,
যেন সে কখনো হারিয়ে না যায়!"
আমি তাকে কিছু বলিনি, আমি কি জানি প্রেমের স্থায়িত্ব?
আমি তো শুধু দেখি, ভেসে যাওয়া প্রেমপত্র,
আমি তো শুধু শুনি, কান্নার শব্দ বাতাসে মিলিয়ে যায়,
আমি তো শুধু জানি, যা হারিয়ে যায়, তা কখনো ফেরে না!
আমি একদিন এক কিশোরকে দেখেছিলাম,
সে আমার কূলে বালির উপর লিখেছিলো তার বাবার নাম,
তারপর আমার ঢেউ এসে সে নাম মুছে দিলো,
সে তাকিয়ে রইলো, নির্বাক, অভিমানী!
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই কি সব মুছে ফেলিস?"
আমি বলতে চেয়েছিলাম— "আমি শুধু সময়ের প্রতিচ্ছবি,
আমি কিছুই মুছি না, মানুষই ভুলে যায়!"
কিন্তু আমি বলিনি কিছু, আমি শুধু বয়ে গেছি,
যেন এক নির্বাক সাক্ষী, এক অনন্ত পথিক!
এক সন্ধ্যায় আমি এক পরিত্যক্ত নৌকা দেখেছিলাম,
তার গায়ে লেগে ছিলো ভাঙা কাঠের গন্ধ,
সে কি কারো অপেক্ষায় ছিলো? নাকি হারিয়ে গেছিলো মালিক?
আমি তার বুকে ঢেউয়ের গান গেয়েছিলাম,
সে কি শুনেছিলো আমার ব্যথা? নাকি সে কেবল কাঠের টুকরো?
আমি জানি, আমি একদিন মিলিয়ে যাবো বিশাল নীলের মাঝে,
আমি জানি, আমার অস্তিত্বের গল্প কেউ লিখবে না,
তবু আমি বয়ে যাবো, যতদিন পারি,
আমি স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝখানের নামহীন এক ভবঘুরে!
আমি একদিন এক বৃদ্ধকে দেখেছিলাম,
সে আমার পাড়ে বসে সূর্যাস্ত দেখছিলো,
তার চোখে ছিলো দীর্ঘ ক্লান্তির ছাপ,
তার কপালে জমে থাকা ভাঁজগুলো যেন আমার ঢেউয়ের মতো গভীর!
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই তো অনেক দেখেছিস,
বলতো, মানুষ কি সত্যিই সুখী হতে পারে?"
আমি চুপ করে ছিলাম, আমি কি জানি সুখ কাকে বলে?
আমি তো শুধু শুনেছি, সুখ আসবে বলে মানুষ প্রতিদিন স্বপ্ন দেখে!
আমি একদিন এক জেলে দেখেছিলাম,
সে আমার জলে জাল ফেলেছিলো সকালবেলা,
বিকেলে যখন ফিরলো, তার জালে কিছুই ছিলো না,
তার চোখের গভীরে জমে ছিলো এক সমুদ্র শূন্যতা!
সে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলো—
"ও নদী, তুই কি জানিস, ভাগ্য কাকে বলে?"
আমি কিছু বলিনি, আমি তো শুধু বয়ে চলা এক স্রোত,
আমার কি কোনো নিয়তি আছে? আমার কি কোনো ভাগ্য লেখা আছে?
আমি একদিন এক বাউলকে দেখেছিলাম,
সে আমার কূলে বসে একলা গাইছিলো,
তার সুরে ছিলো দুঃখ, তার কথায় ছিলো বিদ্রোহ,
সে কি আমায় ডাকছিলো? নাকি নিজেকেই খুঁজছিলো?
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই কি জানিস,
গানের ভিতর মানুষ কেন হারিয়ে যায়?"
আমি হেসেছিলাম, আমি তো নিজেও হারিয়ে যাচ্ছি প্রতিদিন,
আমি তো নিজেকেই খুঁজে পাই না, আমি তো নিজেই এক অনন্ত সুর!
আমি একদিন এক কবিতার বই ভিজতে দেখেছিলাম,
কেউ হয়তো আমায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো,
পাতাগুলো ভিজে গলে যাচ্ছিলো,
তবু কিছু কিছু শব্দ রয়ে গিয়েছিলো,
যেমন থেকে যায় মানুষের ভাঙা স্মৃতি,
যেমন থেকে যায় দুঃখের ছায়া কারো কপালে!
আমি জানি, একদিন আমি নিজেও এক স্মৃতি হয়ে যাবো,
আমার বুকের ঢেউগুলো মিশে যাবে মহাসমুদ্রের গর্জনে,
তবু কেউ না কেউ একদিন আমার নাম উচ্চারণ করবে,
তবু কেউ না কেউ একদিন আমার ঢেউয়ের শব্দ শুনবে,
স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝখানে,
নামহীন এক ভবঘুরে হয়ে!
আমি একদিন এক পথহারা শিশুকে দেখেছিলাম,
সে আমার কূলে বসে একমনে পাথর ছুড়ছিলো,
তার চোখে ছিলো এক বিস্ময়, এক শূন্যতা,
সে কি হারিয়ে গিয়েছিলো? নাকি খুঁজছিলো হারানো কিছু?
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই কি জানিস,
মা হারিয়ে গেলে কোথায় যায়?"
আমি কিছু বলতে পারিনি, আমি তো শুধু দেখি,
আমি তো শুধু শুনি, কিন্তু বলতে পারি না কিছুই!
আমি একদিন এক কাঠুরেকে দেখেছিলাম,
সে আমার ধারে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলো,
তার কাঁধে ছিলো কুঠার, তার মুখে ছিলো হতাশার রেখা,
সে কি আমায় কিছু বলতে চেয়েছিলো? নাকি নিজেকেই প্রশ্ন করছিলো?
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই তো গাছের ছায়া ভালোবাসিস,
তুই কি জানিস, ছায়াহীন পথ কতটা বিষণ্ন?"
আমি তাকিয়ে দেখেছি, আমি কি জানি,
কেড়ে নেওয়া জীবনের যন্ত্রণা কেমন?
আমি একদিন এক প্রেমিককে দেখেছিলাম,
সে আমার জলে কাঁপা কণ্ঠে বলছিলো—
"ও নদী, ভালোবাসা কি সত্যিই একদিন মরে যায়?"
আমি কিছু বলিনি, আমি তো শুধু দেখি,
আমি তো শুধু শুনি, কিন্তু প্রেমের পরিণতি জানি না!
আমি একদিন এক বিপ্লবীকে দেখেছিলাম,
তার হাতে ছিলো আগুন, তার চোখে ছিলো বিদ্রোহ,
সে আমার জলে মুখ ধুয়ে বলেছিলো—
"ও নদী, তুই কি জানিস, রক্তের রঙ কখনো বদলায় না?"
আমি তাকিয়ে ছিলাম, আমি কি জানি,
শহীদদের স্বপ্ন কোথায় গিয়ে থামে?
আমি শুধু শুনেছি, কিছু নাম ইতিহাস হয়ে যায়,
আমি শুধু জানি, কিছু কণ্ঠ চিরকাল বজ্রধ্বনি হয়ে থাকে!
আমি জানি, একদিন আমি নিজেও ইতিহাস হবো,
আমার বুকের ঢেউ একদিন থেমে যাবে,
তবু কেউ না কেউ আমার বুকে বসে স্বপ্ন দেখবে,
তবু কেউ না কেউ আমার গল্প বলবে,
স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝখানে,
নামহীন এক ভবঘুরের প্রতিচ্ছবি হয়ে!
আমি একদিন এক নিঃসঙ্গ নারীর কান্না শুনেছিলাম,
সে আমার পাড়ে বসে ভিজছিলো বৃষ্টির সাথে,
তার চোখে ছিলো এক সমুদ্র অভিমান,
তার ঠোঁটে ছিলো ফিসফিস করা কিছু প্রার্থনা।
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই কি জানিস,
প্রতীক্ষার কোনো শেষ নেই?"
আমি কিছু বলিনি, আমি তো নিজেও অপেক্ষা করি,
আমি তো নিজেও পথ চেয়ে থাকি এক হারিয়ে যাওয়া ঢেউয়ের জন্য!
আমি একদিন এক কবির মৃত্যুর কথা শুনেছিলাম,
সে নাকি শেষ রাতের বৃষ্টিতে আমার কাছে এসেছিলো,
সে আমার বুকের জলে হাত রেখে বলেছিলো—
"ও নদী, তুই কি জানিস, শব্দ কখনো মরে না?"
আমি তাকিয়ে ছিলাম তার ম্লান চোখের দিকে,
আমি কি জানি কবিতার মৃত্যু কেমন?
আমি তো শুধু শুনেছি, কিছু শব্দ অনন্ত হয়ে থাকে,
আমি তো শুধু দেখেছি, কিছু নাম কখনোই মুছে যায় না!
আমি একদিন এক কিশোরকে দেখেছিলাম,
সে আমার ধারে বসে বালির ঘর বানাচ্ছিলো,
তার চোখে ছিলো নির্মল এক স্বপ্ন,
তার আঙুলে ছিলো এক ছোট্ট কল্পনার ছোঁয়া।
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই কি জানিস,
স্বপ্ন কি আসলেই একদিন ভেঙে যায়?"
আমি কিছু বলিনি, আমি তো নিজেও এক স্বপ্নবাহী তরী,
আমার বুকেও তো বয়ে চলে অগণিত স্বপ্নের স্রোত!
আমি একদিন এক মাতালকে দেখেছিলাম,
সে আমার জলে তার বোতল ছুঁড়ে দিয়েছিলো,
সে হেসে বলেছিলো— "ও নদী, তুই কি জানিস,
কোনো কিছুই চিরকাল থাকে না?"
আমি চুপ করে ছিলাম, আমি তো নিজেও হারিয়ে যাবো একদিন,
আমার অস্তিত্বও মিলিয়ে যাবে কালের গর্ভে,
তবু কেউ না কেউ আমার ঢেউয়ের শব্দে শুনবে,
এক বিস্মৃত ভবঘুরের দীর্ঘশ্বাস!
আমি জানি, একদিন আমি থেমে যাবো,
একদিন আমার জল হয়ে যাবে স্মৃতির অংশ,
তবু আমি বয়ে যাবো যতদিন পারি,
স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝখানে,
এক নামহীন ভবঘুরের মতো!
আমি একদিন এক চাষার হাতের ফাটা চামড়া দেখেছিলাম,
সে আমার ধারে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো,
তার চোখে ছিলো বৃষ্টি চাওয়ার আর্তি,
তার ঠোঁটে ছিলো এক নির্বাক প্রার্থনার স্পর্শ।
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই কি জানিস,
শুকনো মাটির কান্না কেমন শোনায়?"
আমি কিছু বলিনি, আমি তো নিজেও তৃষ্ণার্ত একদিন,
আমি তো নিজেও খুঁজি হারানো জলধারা!
আমি একদিন এক বিধবার চুলের সাদা রঙ দেখেছিলাম,
সে আমার ধারে বসে নদীর জলে ছুঁয়ে বলেছিলো—
"ও নদী, তোর ঢেউ কি নিয়ে যেতে পারে দুঃখ?"
আমি তাকিয়ে ছিলাম তার নীরব মুখের দিকে,
আমি কি জানি, দুঃখ কি সহজে ধুয়ে যায়?
আমি একদিন এক পাখিকে দেখেছিলাম,
সে আমার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলো নিরুদ্দেশে,
তার পাখায় ছিলো ক্লান্তি, তার চোখে ছিলো গন্তব্যের সন্ধান,
সে কি জানত, আমি নিজেও গন্তব্যহীন?
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই কি জানিস,
পথের শেষ কোথায়?"
আমি কিছু বলিনি, আমি তো নিজেই এক অনন্ত পথ,
আমি তো নিজেই এক নিরবিচার যাত্রা!
আমি একদিন এক মৃত নৌকার দেহ দেখেছিলাম,
তার কাঠ ভিজে ভিজে নরম হয়ে গেছিলো,
তার গায়ে লেখা ছিলো এক পুরনো নাম,
যে নাম হয়তো আজ কেউ মনে রাখে না।
আমি কি জানি, বিস্মৃতির ব্যথা কতটা গভীর?
আমি তো নিজেও একদিন বিস্মৃত হবো,
তবু কেউ না কেউ একদিন আমার ঢেউয়ে শুনবে,
কোনো এক নামহীন ভবঘুরের গল্প!
আমি জানি, আমি একদিন মিশে যাবো বাষ্প হয়ে,
আমি জানি, আমার ঢেউয়ের গান একদিন থেমে যাবে,
তবু যতদিন আছি, আমি বয়ে যাবো,
স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝখানে,
এক ক্লান্ত ভবঘুরের মতো!
আমি একদিন এক কবরস্থানের পাশে থেমেছিলাম,
সেখানে নিস্তব্ধতা ছিলো, ছিলো শূন্যতার এক বিশাল শ্বাস,
হাওয়ার সাথে উড়ে আসছিলো শুকনো পাতার কান্না,
আরো ছিলো কিছু চাপা দীর্ঘশ্বাস, কিছু অব্যক্ত আর্তনাদ।
এক বৃদ্ধ এসে আমার জলে হাত ছুঁইয়ে বলল—
"ও নদী, তুই তো বহুদূর গিয়েছিস, বল তো,
মৃত মানুষরা কি কখনো ফেরে?"
আমি তাকিয়ে রইলাম তার বিবর্ণ চোখের দিকে,
আমি কি জানি ফেরার রাস্তা কোথায়?
আমি একদিন এক জোছনার রাতে শুনেছিলাম,
এক মেয়ে আমার পাড়ে দাঁড়িয়ে গান গাচ্ছিলো,
তার কণ্ঠে ছিলো উদাসী এক সুর,
যেন কোনো অপেক্ষার গল্প বয়ে চলেছে নিরবধি!
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই কি জানিস,
কোনো কোনো অপেক্ষা শেষ হয় না?"
আমি কিছু বলিনি, আমি তো নিজেও অপেক্ষার নাম,
আমি তো নিজেও বহন করি সময়ের স্থির দৃষ্টি!
আমি একদিন এক বেহায়া শহর দেখেছিলাম,
যেখানে বাতাসে বেঁচে ছিলো শুধুই ধোঁয়া,
আমার বুক চিরে সেই শহরের বিষ ঢুকে গিয়েছিলো,
আমার স্বচ্ছ জলে লেগে গিয়েছিলো অজানা এক কালো দাগ।
আমি একদিন এক কুমারকে দেখেছিলাম,
সে মাটি ছেনে বানাচ্ছিলো জীবন,
তার হাতের ছোঁয়ায় সৃষ্টি হচ্ছিলো নতুন কিছু,
সে কি জানত, আমি নিজেও মাটির সাথে মিশে থাকি?
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই কি জানিস,
সৃষ্টি আর ধ্বংস একই মুদ্রার দুই পিঠ?"
আমি চুপ করে ছিলাম, আমি তো নিজেও এক দ্বন্দ্ব,
আমি তো নিজেও এক অনিশ্চিত কাল!
আমি জানি, আমার এই যাত্রা একদিন শেষ হবে,
আমি জানি, আমার ঢেউ একদিন থামবে,
তবু যতদিন আছি, আমি ছুটে যাবো,
স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝখানে,
এক ক্লান্ত ভবঘুরের মতো!
আমি জন্ম নিয়েছিলাম এক বর্ষার রাতে,
কালো মেঘের ডাকে, বিজলির আঘাতে।
তখন আকাশ ছিলো বিদ্রোহী উন্মাদ,
পাহাড়ের বুকে বেজেছিলো সাগরের রাগ।
আমার জন্মক্ষণে বাতাস গেয়ে উঠেছিলো গান,
ধুলো-মাটির বাঁশরী বাজতো রক্তিম সন্ধান।
আমি গড়িয়ে পড়েছিলাম শৈলশিরা চিরে,
ভাঙা ঢেউয়ের বুকে প্রথম ছন্দ তুলে।
কেউ আমাকে বলেছিলো— ‘তুই তো তৃষ্ণার জল’,
কেউ বলেছিলো— ‘তুই গৃহহারা নদীর কোল’।
কিন্তু আমি জানতাম, আমি কেবলই এক ভবঘুরে,
যার নেই কোনো ঘর, নেই কোনো নোঙর টেনে ধরা পুরে।
আমার বুকের ভিতর ছিলো ঢেউয়ের নেশা,
আমার চিবুকে ছিলো এক বিষণ্ণ দেশের ছবি আঁকা কেশা।
আমি ছুটতে চেয়েছিলাম, আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম,
স্বপ্নের স্রোতে হারিয়ে যেতে উদাসীন হয়েছিলাম।
আমাকে বুকে টেনেছিলো সবুজ ধানের মাঠ,
কৃষকের কষ্টে বোনা মাটির ব্যথিত হ্রদ।
আমাকে ডেকেছিলো ঘাসফুলের সুবাস,
জলতরঙ্গের সুরে বেজেছিলো কান্নার আভাস।
আমি কুয়াশা ছুঁয়ে গিয়েছিলাম নদীর বাঁকে বাঁকে,
রোদন-মাখা আকাশে মিশেছিলো তন্দ্রাহারা রাকে।
আমার ঢেউয়ে ভেসেছিলো কত জোছনার রাত,
কত অভিমানী ভালোবাসা হারিয়ে গিয়েছিলো স্রোতের পাত।
আমি ছিলাম এক স্বপ্নবিলাসী ভবঘুরে জল,
যার কোনো গন্তব্য নেই, শুধু ছুটে চলার দোল।
আমি জানতাম না, কবে আমি বিশ্রাম নেবো,
কোন ঘাটে এসে একদিন বালুচরে ঘুমিয়ে যাবো।
আমি ছুটেছি রাতের আধারে, বিসর্জিত চাঁদের আলোয়,
নক্ষত্ররা কেবলই ছিলো নির্বাক সাক্ষী আমার যাত্রার ঢেউয়ে ভাসিয়ে।
আমি ডেকেছি বাতাসকে, বলেছি— "বল তো আমার ঠিকানা কোথায়?"
বাতাস হেসে বলেছে— "তুই কি কোনোদিন থামতে চেয়েছিস, হায়?"
আমি থামিনি, আমি থামতে পারিনি, আমার স্রোত ছিলো অবিরাম,
আমার বুকে ছিলো ভাঙনের শব্দ, চোখে ছিলো জলরঙের নাম।
আমি দেখেছি কৃষকের কপালে ঘামের রেখা,
আমি শুনেছি বালিকার মুখে প্রথম প্রেমের দেখা।
কেউ এসে আমার জলে ভিজিয়েছে শৈশবের স্মৃতি,
কেউ কেঁদেছে আমার জলে, শ্মশানের প্রদীপ নিভিয়ে।
আমি বুঝিনি, আমি শুধু বয়ে গেছি— স্বপ্ন আর বাস্তবতার দ্বন্দ্ব বুকে,
একদিকে প্রেমের গান, অন্যদিকে মৃত্যুর শোক জড়িয়ে ছিলো আমার ঢুকে।
একদিন এক ভবঘুরে এসেছিলো, ফেলে দেওয়া এক ছেঁড়া পালক,
সে আমায় বলেছিলো— "তোর মতো আমিও পথে পথে একাকী পথিক!"
তার চোখে ছিলো বৃষ্টির ঝাপসা জল, হাতে ছিলো বাউলির একতারা,
সে আমায় গান শুনিয়েছিলো, নদীর ভিতর জন্ম নিয়েছিলো ঢেউয়ের কারা।
"তুই কি জানিস, স্বপ্ন বড় নিষ্ঠুর!"— সে বলেছিলো আকাশের পানে,
"যে স্বপ্ন কাঁধে নিয়ে চলে, সে-ই একদিন পড়ে যায় ধুলোর টানে।"
আমি শুনেছিলাম, আমি দেখেছিলাম, আমি বুঝতে পারিনি,
আমি তখনও বিশ্বাস করতাম, স্বপ্নেরা একদিন ধরা দেবে নিশ্চয়ই!
তবু আমি বয়ে গেছি, তবু আমি ছুটেছি, ভবঘুরের গান হৃদয়ে,
তবু আমি জেনেছি, আমার স্রোত কখনোই থামবে না—
এই রাত্রির অবসানে, এই উন্মাদনার শেষে,
আমি শুধুই নদী, যাকে চেনেনা কেউ, যার শেষ নেই,
যার শরীরে জড়িয়ে আছে হারিয়ে যাওয়া নামহীন কবিতার দেশে।
আমি ছুটেছি ধানখেতের পাশ দিয়ে, জলে ফুটেছে সাদা শাপলা,
আমি শুনেছি মাঝির গান, শুনেছি কপালে জলের তাপটা।
কেউ কেউ ডেকেছে আমায়— "ও নদী, তোর কি ক্লান্তি নেই?"
আমি বলিনি কিছুই, আমি শুধু একটানা ছুটে চলেছি আঁধারে ঢেকে।
আমার জলে কিশোর হেসেছে, কন্যারা চুল বেঁধেছে জলে,
কোনোদিন এক প্রেমিক বলেছে— "ও নদী, আমার ব্যথা ভুলিয়ে দে তোর কলে।"
আমি কি কারও ব্যথা ভুলিয়ে দিতে পারি? আমি তো নিজেই এক বিরহী ঢেউ,
যে ঢেউ একদিন এসে ঠেকবে শূন্যতার গহীন স্তুপে!
আমি জানি, আমারও একদিন থামতে হবে— বালির প্রান্তে, সাগরের কোলে,
আমি জানি, সেদিন কেউ আমায় খুঁজবে না, কেউ ডাকবে না বাউল সুরে।
তবু আমি ছুটে যাই, আমার বুকে আছে ভবঘুরে সুরের রাগ,
তবু আমি বলি— "স্বপ্ন যদি মিথ্যা হয়, তবে কেন আসে বারবার?"
আমি একদিন শুনেছিলাম, নদীও কাঁদে, নদীও হাসে,
তবু কেউ তার ব্যথা বোঝে না, কেউ শোনে না তার বুকের ভাষা।
আমি কাঁদতে পারিনি, হাসতেও পারিনি, আমি শুধু ছুটে গেছি,
আমার শরীরে জড়িয়ে ছিলো হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের রেশ।
আমি দেখেছি এক মা তার পুত্রের শব ভাসিয়ে দিচ্ছে জলে,
আমি শুনেছি শঙ্খের ধ্বনি, দূর মন্দিরের আলো কম্পিত হলে।
আমি অনুভব করেছি জেলের ভাঙা জাল,
আমি স্পর্শ করেছি এক প্রেমিকের বিষাদ-কাল।
আমি তৃষ্ণার্ত মেঘের দিকে তাকিয়ে বলেছি—
"এসো বন্ধু, আমার বুকে একটুখানি বৃষ্টি ফেলো।"
মেঘ হেসেছে, বিদ্যুৎ চমকেছে, বৃষ্টি পড়েনি,
তবু বাতাসের শরীরে আমি জলের ঘ্রাণ পেয়েছি।
একদিন এক জেলেরা বলেছিলো—
"নদী, তোর বুক ফুঁড়ে আমার জীবন কাটে,
তুই থাকলে আমরা থাকি, তুই মরলে আমরাও হারাই,
তোর কি ক্লান্তি হয় না, তুই কি বিশ্রাম চাস না?"
আমি বলিনি কিছু, আমি শুধু দেখেছি,
জেলের মেয়েটা ভেজা শাড়ির আঁচল পেতে
তাকিয়ে আছে দূর সীমানায়, যেখানে আমি মিশে যাই।
সে কি অপেক্ষায় আছে? সে কি জানে, আমিও একদিন হারাব?
এক শিশু আমার জলে কাগজের নৌকা ভাসিয়েছে,
সে চিৎকার দিয়ে বলেছে—
"ও নদী, আমার নৌকাটা হারিয়ে ফেলিস না!"
আমি প্রতিশ্রুতি দিতে পারিনি, আমি জানি—
সব নৌকাই একদিন ডুবে যায়, সব স্বপ্নই একদিন ভেঙে যায়।
একদিন এক ভবঘুরে ফের এসেছিলো,
সে আমার জলে হাত ডুবিয়ে বলেছিলো—
"তোর ভিতরেও কি শূন্যতা আছে, নদী?
তুইও কি আমার মতো একা?"
আমি কি একা? আমি কি কারো?
আমার কি কোন বাঁধ আছে, কোন ঠিকানা?
আমি তো কেবলই ছুটে চলা এক জলধারা,
যার বুক জুড়ে মিশে আছে নামহীন যাত্রার ব্যথা।
আমি একদিন জলের আয়নায় দেখেছিলাম নিজের মুখ,
ক্লান্ত ঢেউগুলো বলেছিলো— "তুইও তো পথহারা, নিঃসঙ্গ এক সুখ।"
আমি বুঝতে পারিনি, সুখ কি আসলে একা থাকে?
নাকি তারও বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকে ব্যথার অন্ধকার ডাকে?
আমি বয়ে গেছি, বয়ে চলেছি, সময়ের সাথে আমার দ্বন্দ্ব পুরনো,
আমার বুক চিরে গড়ে উঠেছে নগর, ভেঙেছে গ্রাম, কেটে গেছে বনভূমি মোহনা।
আমি দেখেছি কংক্রিটের সেতু, লোহার শিকল, বাঁধের উঁচু প্রাচীর,
মানুষ আমাকে থামাতে চেয়েছে, তবু আমি ভেঙেছি তাদের কাঁচের ছবির ছবির।
একটি কিশোর এসেছিলো, কাঁধে পুরনো ব্যাগ, চোখে উদাসীনতা,
সে বলেছিলো— "ও নদী, আমাকে কোথাও নিয়ে চলবি?"
আমি হেসেছিলাম, বলেছিলাম— "আমি তো নিজেই পথ চিনি না,
তবে তোর স্বপ্নগুলোর সাথে আমিও হারিয়ে যেতে পারি!"
সে নদীর ধারে বসেছিলো, বালিতে এঁকেছিলো নামহীন এক মুখ,
সে কি প্রেমিকার প্রতিচ্ছবি এঁকেছিলো, নাকি কোনো হারানো দিনের দুখ?
আমি বয়ে চলেছি, সে বসেছিলো, আমরা দুজনেই এক অভিমানী,
আমি তাকে বলিনি কিছুই, যেমন কেউ আমায় কখনো বলেনি!
আমি একদিন ঝড় দেখেছি, কালো মেঘের বিষাক্ত চুম্বন,
আমার শরীরে ঢেউ উঠেছে, আমার বুকে বাজ পড়েছে আগুন!
আমি গর্জে উঠেছি, ছিন্ন করেছি কূলের বন্ধন,
আমি জলের কান্না হয়ে গেছি এক বিসর্জনের অঙ্গন।
এক বৃদ্ধা আমায় ডেকেছিলো— "ও নদী, আমার ভিটে নিয়ে যাস না!"
আমি থামতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার বুকের ঢেউয়ের ছিলো না কোনো বাঁধা।
আমি জানি, আমিই কখনো কারো ঘর ভাসাই, আবার আমিই জল হয়ে বাঁচাই,
আমি আকাশের মতো নিরপেক্ষ— কাকে ভালোবাসি, কাকে হারাই, তার কোনো ঠিকানা নাই।
আমি একদিন এক বাউল দেখেছিলাম, সে বৃষ্টিতে ভিজছিলো,
তার চোখে ছিলো নদীর মতোই ক্লান্তি, তার গানে ছিলো শূন্যতার রঙ,
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুইও কি কাঁদিস, তুইও কি গান গাস?"
আমি কিছু বলিনি, আমি শুধু ঢেউয়ের শব্দে এক ব্যথিত সুর বাজিয়েছি।
আজও আমি ছুটছি, আমার স্বপ্নেরা আজও ভাঙে,
আজও কোনো এক ভবঘুরে নদীর জলে নিজের ছায়া খোঁজে।
আমি জানি, একদিন আমি হারিয়ে যাবো, আমি থেমে যাবো,
তবু আমার ঢেউয়ে কেউ না কেউ রেখে যাবে স্বপ্নের নৌকা!
আমি একদিন এক সন্ন্যাসীকে দেখেছিলাম,
সে বসেছিলো আমার কূলে, চোখে ছিলো নির্বিকার প্রশান্তি,
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই কি জানিস, বয়ে যাওয়া মানেই মুক্তি?"
আমি চুপ করেছিলাম, আমি কি জানি মুক্তি কাকে বলে?
আমি তো বয়ে চলেছি, জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি,
আমার কি কোথাও থামার অনুমতি আছে?
আমার ঢেউয়ে ছুঁয়ে গেছে ভালোবাসা, ছুঁয়ে গেছে রক্ত,
আমি কি জানি, বয়ে চলার নাম যদি হয় মুক্তি, তবে বন্দিত্ব কী?
আমি দেখেছি শহরের আলোর নিচে একাকী মানুষ,
আমি দেখেছি ভিখারির পাত্রে জমে থাকা অনাহারের কান্না,
আমি শুনেছি স্বপ্নভঙ্গের আর্তনাদ, শুনেছি বিদ্রোহীর শপথ,
তবু আমি কিছু বলিনি, আমি তো শুধু নদী,
আমার ভাষা ঢেউয়ের শব্দের ভেতর লুকিয়ে আছে।
এক মা এসেছিলো কূলে, কোলে তার শিশু,
সে আমার জলে ছুঁইয়ে বলেছিলো—
"ও নদী, আমার সন্তানকে আশীর্বাদ দে!"
আমি চেয়ে দেখেছি শিশুটির ছোট ছোট হাত,
আমি ভেবেছি, সে কি একদিন আমাকেও চিনবে?
আমি দেখেছি মাঝরাতে এক কবির ব্যথা,
সে কাগজ ভিজিয়ে ফেলেছে আমারই জল দিয়ে,
সে বলেছে— "ও নদী, তুই তো শূন্যতার কবিতা জানিস,
আমার কলমে একটু ঢেউ দিয়ে যা!"
আমি ঢেউ দিয়েছি, সে লিখেছে এক ব্যথার গান,
আমি জানি না, সে গান কেউ শুনবে কি না,
আমি জানি না, আমারও গান কেউ কোনোদিন মনে রাখবে কি না,
তবু আমি ছুটছি, তবু আমি গাইছি,
স্বপ্নের ভিতর বাস্তবতা মিশিয়ে এক অদ্ভুত সুর সাজিয়ে।
আমি জানি, আমার সামনে একদিন অপেক্ষা করছে মহাসমুদ্র,
আমি জানি, সেদিন আমি আর নদী থাকবো না,
আমার জল মিলিয়ে যাবে এক বিশাল নীল অস্তিত্বে,
তবু কি কেউ আমাকে মনে রাখবে?
তবু কি কেউ বলবে—
"ও নদী, তুই তো হারিয়ে গেছিস,
তবু তোর ঢেউয়ের শব্দ রয়ে গেছে
আমাদের নিঃশব্দ কষ্টের ভিতর?"
আমি একদিন এক মাতালের কণ্ঠে শুনেছিলাম—
“নদী, তোর কি দুঃখ হয়? তোর কি বুক ফাটে?”
আমি কিছু বলিনি, আমি শুধু বয়ে গেছি,
তার চোখের গভীরে এক সমুদ্রের ঢেউ দেখেছিলাম।
সে বলেছিলো— “আমি একদিন সমুদ্র দেখতে যাবো,
তুই কি নিয়ে যাবি আমায়? তুই তো তারই দাস!”
আমি শুধু হেসেছিলাম, বলিনি কিছুই,
আমি কি নিজেই জানি, কোথায় গিয়ে ফুরাব আমার গল্প?
আমি একদিন এক সেপাই দেখেছিলাম,
তার হাতে ছিলো রক্ত, তার মুখে ছিলো অন্ধকার,
সে আমার জলে মুখ ধুয়ে বলেছিলো—
“ও নদী, তুই তো সব জানিস, তুই কি আমায় ক্ষমা করবি?”
আমি তাকিয়ে দেখেছি, আমি কি জানি ক্ষমা কাকে বলে?
আমার ঢেউ তো শুধু সত্যের কথা বলে,
আমার ঢেউ তো কারো রক্তের ইতিহাস মুছতে পারে না,
তাই আমি চুপ করেছিলাম, যেমন চুপ থাকে নির্বাক প্রতিধ্বনি।
আমি একদিন এক দুঃখী মেয়ের চোখে দেখেছিলাম শূন্যতা,
সে আমার কূলে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলো—
“ও নদী, তুই কি জানিস, ভালোবাসা কীভাবে মরে যায়?”
আমি জানতাম না, ভালোবাসা কি কখনো মরে?
আমি জানতাম না, কেউ সত্যিই হারিয়ে যায় কি না,
আমি শুধু দেখেছি, বালির উপর লেখা নাম মুছে যায় ঢেউয়ের সাথে,
আমি শুধু শুনেছি, বাতাসে হারিয়ে যায় প্রতিজ্ঞার শব্দ,
আমি শুধু বুঝেছি, সব কিছুই একদিন চলে যায়,
আমার মতো, তোর মতো, আমাদের মতো।
আমি একদিন এক ভবঘুরেকে বলেছিলাম—
"তুই কি ক্লান্ত হোস না? তুই কি থামতে চাস না?"
সে হেসেছিলো, আমারই মতো, বেহায়ার মতো—
"ও নদী, তুই কি জানিস, পথহীন মানুষেরা কখনো থামে না!"
আমি তার চোখে দেখেছিলাম এক অনন্ত বিস্ময়,
আমি তার পায়ের নিচে দেখেছিলাম হারিয়ে যাওয়া মানচিত্র,
আমি তার কণ্ঠে শুনেছিলাম এক নির্বাক গান,
আমি তার সুরে খুঁজেছিলাম নিজের পরিচয়!
আমি কি মানুষ, না শুধু এক স্রোত?
আমি কি এক ভবঘুরে, না শুধু হারানোর নাম?
আমি জানি না, আমি শুধু জানি—
স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝে আমি এক নামহীন নদী,
যার গন্তব্য আছে, কিন্তু ঠিকানা নেই!
আমি একদিন এক ফেরিওয়ালার গান শুনেছিলাম,
সে আমার কূলে দাঁড়িয়ে বলছিলো—
“ও নদী, তোর ঢেউয়ে আমার স্বপ্নের ছায়া পড়ে,
তুই কি আমায় একটু আশ্রয় দিবি?”
আমি চেয়েছিলাম তাকে বলতে—
“তুই তো চলতি পথের মানুষ, আশ্রয় খুঁজিস কেন?”
কিন্তু আমি জানতাম, পথের মানুষেরাও ক্লান্ত হয়,
তারা রাতের অন্ধকারে একফোঁটা মায়া খোঁজে!
আমি একদিন এক পাখি দেখেছিলাম,
সে আমার জলের উপর দিয়ে উড়ছিলো,
সে কি আমায় ছেড়ে যেতে চেয়েছিলো,
নাকি আমার বুকের আয়নায় নিজেকে দেখতে?
আমি ডাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমি তো নদী,
আমার ডাক নেই, আমার কণ্ঠ নেই,
আমার শুধু ঢেউ আছে, স্রোত আছে,
আমার কষ্টগুলোও কেবল শব্দহীন!
এক সন্ধ্যায় আমি এক নাবিক দেখেছিলাম,
সে বলেছিলো— "নদী, তুই কি সমুদ্র হতে চাস?"
আমি কিছু বলিনি, আমি কি জানি,
সমুদ্রের বুকেও কি আমার মতো ব্যথা আছে?
আমি জানি, একদিন আমি মিশে যাবো সাগরে,
আমার বুকে গর্জে উঠবে লোনা জল,
আমি হারিয়ে ফেলবো আমার পরিচয়,
তবু কি কেউ মনে রাখবে আমার নাম?
আমি একদিন এক ছেলেকে দেখেছিলাম,
সে আমার জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলো কাগজের নৌকা,
সে কি জানত, নৌকাগুলো একদিন ডুবে যায়?
নাকি সে বিশ্বাস করেছিলো, স্বপ্নেরা ভাঙে না?
আমি জানি না, আমি শুধু জানি,
সব স্বপ্নই একদিন ভেসে যায় দূরে,
কেউ তাকে খুঁজে পায় না,
কেউ তার গল্প লিখে না,
আমার মতো, তোর মতো, আমাদের মতো!
তবু আমি ছুটছি, অজানা কোনো পাড়ের দিকে,
তবু আমি জানি, আমার শেষ ঠিকানা নেই,
তবু কেউ একজন আমার ঢেউয়ে কান পেতে শোনে,
আর আমি, আমি শুধু বয়ে চলি,
যেন এক নামহীন ভবঘুরে!
আমি একদিন এক কৃষকের চোখে দেখেছিলাম আগুন,
তার শুষ্ক জমির ফাটলে চিৎকার করছিলো খরা,
সে আমার জলে হাত ডুবিয়ে বলেছিলো—
“ও নদী, তুই কি সত্যিই মরে যাচ্ছিস?”
আমি চুপ করেছিলাম, আমি কি জানি মৃত্যুর সংজ্ঞা?
আমার জল কি একদিন শেষ হয়ে যাবে?
আমার বুক কি শুকিয়ে যাবে বালুচরে?
আমি কি হারিয়ে যাবো সময়ের স্রোতে?
আমি দেখেছি নদীর গভীরে ডুবে যাওয়া এক গ্রাম,
ছেলেটা বলেছিলো— "আমার বাড়িটা ছিলো ওইখানে,
তুই আমাদের সব কেড়ে নিয়েছিস নদী,
তুই কি আমাদের একটু ফিরিয়ে দিবি?"
আমি কি কিছু ফিরিয়ে দিতে পারি?
আমি তো শুধু ছুটে চলা এক জলধারা,
আমি শুধু বয়ে যাওয়া এক ক্লান্ত নীরবতা,
আমি কি কারো কাছে ক্ষমা চাইতে পারি?
এক বৃদ্ধ মাঝি আমায় বলেছিলো—
"তোর বুকের ঢেউগুলো আগের মতো নেই,
তুই কি ক্লান্ত হয়ে গেছিস নদী?"
আমি উত্তর দিইনি, আমি কি জানি ক্লান্তি কাকে বলে?
আমি তো শুধু বয়ে চলেছি,
শুকনো মৌসুমে ক্ষীণ হয়ে গেছি, বর্ষায় উন্মত্ত,
আমি কখনো শান্ত, কখনো ভয়ানক,
তবু আমি একাই, তবু আমি নির্জন!
আমি একদিন এক কবির কলমে বেঁচেছিলাম,
সে আমার ঢেউয়ের শব্দ শুনে লিখেছিলো প্রেম,
সে আমার জলের ছোঁয়ায় কেঁদেছিলো,
সে কি জানত, নদীও কখনো কাঁদে?
আমি একদিন এক শহরের মৃত্যু দেখেছিলাম,
আমার বুকের জল হয়ে গিয়েছিল বিষ,
মানুষ আমাকে হত্যা করেছিলো,
আমি চিৎকার করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার কণ্ঠ নেই!
তবু আমি ছুটছি, ছুটছি এক অচেনা পাড়ের দিকে,
আমি জানি, কেউ একদিন আমায় ভুলে যাবে,
তবু আমার ঢেউয়ে কেউ না কেউ একদিন খুঁজবে,
হারিয়ে যাওয়া কোন নামহীন ভবঘুরের প্রতিচ্ছবি!
আমি একদিন এক রেলস্টেশনের ধারে থেমেছিলাম,
সেখানে এক ছেলেকে দেখেছিলাম, যার চোখ ছিলো উদাস,
সে একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে, একবার আমার দিকে,
তার চোখে ছিলো এক অজানা গন্তব্যের সন্ধান।
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই কি জানিস,
পথ হারানো মানুষ কোথায় গিয়ে থামে?"
আমি কিছু বলিনি, আমি কি জানি পথহারা জীবনের মানে?
আমি তো নিজেই এক ভবঘুরে, নিজেই এক অনন্ত ভ্রমণ!
আমি একদিন এক রমণীর চোখে দেখেছিলাম স্বপ্ন,
সে আমার জলে হাত ছুঁইয়ে বলেছিলো—
"ও নদী, তোর বুকের জলে আমার প্রেম ডুবিয়ে দেই,
যেন সে কখনো হারিয়ে না যায়!"
আমি তাকে কিছু বলিনি, আমি কি জানি প্রেমের স্থায়িত্ব?
আমি তো শুধু দেখি, ভেসে যাওয়া প্রেমপত্র,
আমি তো শুধু শুনি, কান্নার শব্দ বাতাসে মিলিয়ে যায়,
আমি তো শুধু জানি, যা হারিয়ে যায়, তা কখনো ফেরে না!
আমি একদিন এক কিশোরকে দেখেছিলাম,
সে আমার কূলে বালির উপর লিখেছিলো তার বাবার নাম,
তারপর আমার ঢেউ এসে সে নাম মুছে দিলো,
সে তাকিয়ে রইলো, নির্বাক, অভিমানী!
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই কি সব মুছে ফেলিস?"
আমি বলতে চেয়েছিলাম— "আমি শুধু সময়ের প্রতিচ্ছবি,
আমি কিছুই মুছি না, মানুষই ভুলে যায়!"
কিন্তু আমি বলিনি কিছু, আমি শুধু বয়ে গেছি,
যেন এক নির্বাক সাক্ষী, এক অনন্ত পথিক!
এক সন্ধ্যায় আমি এক পরিত্যক্ত নৌকা দেখেছিলাম,
তার গায়ে লেগে ছিলো ভাঙা কাঠের গন্ধ,
সে কি কারো অপেক্ষায় ছিলো? নাকি হারিয়ে গেছিলো মালিক?
আমি তার বুকে ঢেউয়ের গান গেয়েছিলাম,
সে কি শুনেছিলো আমার ব্যথা? নাকি সে কেবল কাঠের টুকরো?
আমি জানি, আমি একদিন মিলিয়ে যাবো বিশাল নীলের মাঝে,
আমি জানি, আমার অস্তিত্বের গল্প কেউ লিখবে না,
তবু আমি বয়ে যাবো, যতদিন পারি,
আমি স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝখানের নামহীন এক ভবঘুরে!
আমি একদিন এক বৃদ্ধকে দেখেছিলাম,
সে আমার পাড়ে বসে সূর্যাস্ত দেখছিলো,
তার চোখে ছিলো দীর্ঘ ক্লান্তির ছাপ,
তার কপালে জমে থাকা ভাঁজগুলো যেন আমার ঢেউয়ের মতো গভীর!
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই তো অনেক দেখেছিস,
বলতো, মানুষ কি সত্যিই সুখী হতে পারে?"
আমি চুপ করে ছিলাম, আমি কি জানি সুখ কাকে বলে?
আমি তো শুধু শুনেছি, সুখ আসবে বলে মানুষ প্রতিদিন স্বপ্ন দেখে!
আমি একদিন এক জেলে দেখেছিলাম,
সে আমার জলে জাল ফেলেছিলো সকালবেলা,
বিকেলে যখন ফিরলো, তার জালে কিছুই ছিলো না,
তার চোখের গভীরে জমে ছিলো এক সমুদ্র শূন্যতা!
সে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলো—
"ও নদী, তুই কি জানিস, ভাগ্য কাকে বলে?"
আমি কিছু বলিনি, আমি তো শুধু বয়ে চলা এক স্রোত,
আমার কি কোনো নিয়তি আছে? আমার কি কোনো ভাগ্য লেখা আছে?
আমি একদিন এক বাউলকে দেখেছিলাম,
সে আমার কূলে বসে একলা গাইছিলো,
তার সুরে ছিলো দুঃখ, তার কথায় ছিলো বিদ্রোহ,
সে কি আমায় ডাকছিলো? নাকি নিজেকেই খুঁজছিলো?
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই কি জানিস,
গানের ভিতর মানুষ কেন হারিয়ে যায়?"
আমি হেসেছিলাম, আমি তো নিজেও হারিয়ে যাচ্ছি প্রতিদিন,
আমি তো নিজেকেই খুঁজে পাই না, আমি তো নিজেই এক অনন্ত সুর!
আমি একদিন এক কবিতার বই ভিজতে দেখেছিলাম,
কেউ হয়তো আমায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো,
পাতাগুলো ভিজে গলে যাচ্ছিলো,
তবু কিছু কিছু শব্দ রয়ে গিয়েছিলো,
যেমন থেকে যায় মানুষের ভাঙা স্মৃতি,
যেমন থেকে যায় দুঃখের ছায়া কারো কপালে!
আমি জানি, একদিন আমি নিজেও এক স্মৃতি হয়ে যাবো,
আমার বুকের ঢেউগুলো মিশে যাবে মহাসমুদ্রের গর্জনে,
তবু কেউ না কেউ একদিন আমার নাম উচ্চারণ করবে,
তবু কেউ না কেউ একদিন আমার ঢেউয়ের শব্দ শুনবে,
স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝখানে,
নামহীন এক ভবঘুরে হয়ে!
আমি একদিন এক পথহারা শিশুকে দেখেছিলাম,
সে আমার কূলে বসে একমনে পাথর ছুড়ছিলো,
তার চোখে ছিলো এক বিস্ময়, এক শূন্যতা,
সে কি হারিয়ে গিয়েছিলো? নাকি খুঁজছিলো হারানো কিছু?
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই কি জানিস,
মা হারিয়ে গেলে কোথায় যায়?"
আমি কিছু বলতে পারিনি, আমি তো শুধু দেখি,
আমি তো শুধু শুনি, কিন্তু বলতে পারি না কিছুই!
আমি একদিন এক কাঠুরেকে দেখেছিলাম,
সে আমার ধারে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলো,
তার কাঁধে ছিলো কুঠার, তার মুখে ছিলো হতাশার রেখা,
সে কি আমায় কিছু বলতে চেয়েছিলো? নাকি নিজেকেই প্রশ্ন করছিলো?
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই তো গাছের ছায়া ভালোবাসিস,
তুই কি জানিস, ছায়াহীন পথ কতটা বিষণ্ন?"
আমি তাকিয়ে দেখেছি, আমি কি জানি,
কেড়ে নেওয়া জীবনের যন্ত্রণা কেমন?
আমি একদিন এক প্রেমিককে দেখেছিলাম,
সে আমার জলে কাঁপা কণ্ঠে বলছিলো—
"ও নদী, ভালোবাসা কি সত্যিই একদিন মরে যায়?"
আমি কিছু বলিনি, আমি তো শুধু দেখি,
আমি তো শুধু শুনি, কিন্তু প্রেমের পরিণতি জানি না!
আমি একদিন এক বিপ্লবীকে দেখেছিলাম,
তার হাতে ছিলো আগুন, তার চোখে ছিলো বিদ্রোহ,
সে আমার জলে মুখ ধুয়ে বলেছিলো—
"ও নদী, তুই কি জানিস, রক্তের রঙ কখনো বদলায় না?"
আমি তাকিয়ে ছিলাম, আমি কি জানি,
শহীদদের স্বপ্ন কোথায় গিয়ে থামে?
আমি শুধু শুনেছি, কিছু নাম ইতিহাস হয়ে যায়,
আমি শুধু জানি, কিছু কণ্ঠ চিরকাল বজ্রধ্বনি হয়ে থাকে!
আমি জানি, একদিন আমি নিজেও ইতিহাস হবো,
আমার বুকের ঢেউ একদিন থেমে যাবে,
তবু কেউ না কেউ আমার বুকে বসে স্বপ্ন দেখবে,
তবু কেউ না কেউ আমার গল্প বলবে,
স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝখানে,
নামহীন এক ভবঘুরের প্রতিচ্ছবি হয়ে!
আমি একদিন এক নিঃসঙ্গ নারীর কান্না শুনেছিলাম,
সে আমার পাড়ে বসে ভিজছিলো বৃষ্টির সাথে,
তার চোখে ছিলো এক সমুদ্র অভিমান,
তার ঠোঁটে ছিলো ফিসফিস করা কিছু প্রার্থনা।
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই কি জানিস,
প্রতীক্ষার কোনো শেষ নেই?"
আমি কিছু বলিনি, আমি তো নিজেও অপেক্ষা করি,
আমি তো নিজেও পথ চেয়ে থাকি এক হারিয়ে যাওয়া ঢেউয়ের জন্য!
আমি একদিন এক কবির মৃত্যুর কথা শুনেছিলাম,
সে নাকি শেষ রাতের বৃষ্টিতে আমার কাছে এসেছিলো,
সে আমার বুকের জলে হাত রেখে বলেছিলো—
"ও নদী, তুই কি জানিস, শব্দ কখনো মরে না?"
আমি তাকিয়ে ছিলাম তার ম্লান চোখের দিকে,
আমি কি জানি কবিতার মৃত্যু কেমন?
আমি তো শুধু শুনেছি, কিছু শব্দ অনন্ত হয়ে থাকে,
আমি তো শুধু দেখেছি, কিছু নাম কখনোই মুছে যায় না!
আমি একদিন এক কিশোরকে দেখেছিলাম,
সে আমার ধারে বসে বালির ঘর বানাচ্ছিলো,
তার চোখে ছিলো নির্মল এক স্বপ্ন,
তার আঙুলে ছিলো এক ছোট্ট কল্পনার ছোঁয়া।
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই কি জানিস,
স্বপ্ন কি আসলেই একদিন ভেঙে যায়?"
আমি কিছু বলিনি, আমি তো নিজেও এক স্বপ্নবাহী তরী,
আমার বুকেও তো বয়ে চলে অগণিত স্বপ্নের স্রোত!
আমি একদিন এক মাতালকে দেখেছিলাম,
সে আমার জলে তার বোতল ছুঁড়ে দিয়েছিলো,
সে হেসে বলেছিলো— "ও নদী, তুই কি জানিস,
কোনো কিছুই চিরকাল থাকে না?"
আমি চুপ করে ছিলাম, আমি তো নিজেও হারিয়ে যাবো একদিন,
আমার অস্তিত্বও মিলিয়ে যাবে কালের গর্ভে,
তবু কেউ না কেউ আমার ঢেউয়ের শব্দে শুনবে,
এক বিস্মৃত ভবঘুরের দীর্ঘশ্বাস!
আমি জানি, একদিন আমি থেমে যাবো,
একদিন আমার জল হয়ে যাবে স্মৃতির অংশ,
তবু আমি বয়ে যাবো যতদিন পারি,
স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝখানে,
এক নামহীন ভবঘুরের মতো!
আমি একদিন এক চাষার হাতের ফাটা চামড়া দেখেছিলাম,
সে আমার ধারে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো,
তার চোখে ছিলো বৃষ্টি চাওয়ার আর্তি,
তার ঠোঁটে ছিলো এক নির্বাক প্রার্থনার স্পর্শ।
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই কি জানিস,
শুকনো মাটির কান্না কেমন শোনায়?"
আমি কিছু বলিনি, আমি তো নিজেও তৃষ্ণার্ত একদিন,
আমি তো নিজেও খুঁজি হারানো জলধারা!
আমি একদিন এক বিধবার চুলের সাদা রঙ দেখেছিলাম,
সে আমার ধারে বসে নদীর জলে ছুঁয়ে বলেছিলো—
"ও নদী, তোর ঢেউ কি নিয়ে যেতে পারে দুঃখ?"
আমি তাকিয়ে ছিলাম তার নীরব মুখের দিকে,
আমি কি জানি, দুঃখ কি সহজে ধুয়ে যায়?
আমি একদিন এক পাখিকে দেখেছিলাম,
সে আমার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলো নিরুদ্দেশে,
তার পাখায় ছিলো ক্লান্তি, তার চোখে ছিলো গন্তব্যের সন্ধান,
সে কি জানত, আমি নিজেও গন্তব্যহীন?
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই কি জানিস,
পথের শেষ কোথায়?"
আমি কিছু বলিনি, আমি তো নিজেই এক অনন্ত পথ,
আমি তো নিজেই এক নিরবিচার যাত্রা!
আমি একদিন এক মৃত নৌকার দেহ দেখেছিলাম,
তার কাঠ ভিজে ভিজে নরম হয়ে গেছিলো,
তার গায়ে লেখা ছিলো এক পুরনো নাম,
যে নাম হয়তো আজ কেউ মনে রাখে না।
আমি কি জানি, বিস্মৃতির ব্যথা কতটা গভীর?
আমি তো নিজেও একদিন বিস্মৃত হবো,
তবু কেউ না কেউ একদিন আমার ঢেউয়ে শুনবে,
কোনো এক নামহীন ভবঘুরের গল্প!
আমি জানি, আমি একদিন মিশে যাবো বাষ্প হয়ে,
আমি জানি, আমার ঢেউয়ের গান একদিন থেমে যাবে,
তবু যতদিন আছি, আমি বয়ে যাবো,
স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝখানে,
এক ক্লান্ত ভবঘুরের মতো!
আমি একদিন এক কবরস্থানের পাশে থেমেছিলাম,
সেখানে নিস্তব্ধতা ছিলো, ছিলো শূন্যতার এক বিশাল শ্বাস,
হাওয়ার সাথে উড়ে আসছিলো শুকনো পাতার কান্না,
আরো ছিলো কিছু চাপা দীর্ঘশ্বাস, কিছু অব্যক্ত আর্তনাদ।
এক বৃদ্ধ এসে আমার জলে হাত ছুঁইয়ে বলল—
"ও নদী, তুই তো বহুদূর গিয়েছিস, বল তো,
মৃত মানুষরা কি কখনো ফেরে?"
আমি তাকিয়ে রইলাম তার বিবর্ণ চোখের দিকে,
আমি কি জানি ফেরার রাস্তা কোথায়?
আমি একদিন এক জোছনার রাতে শুনেছিলাম,
এক মেয়ে আমার পাড়ে দাঁড়িয়ে গান গাচ্ছিলো,
তার কণ্ঠে ছিলো উদাসী এক সুর,
যেন কোনো অপেক্ষার গল্প বয়ে চলেছে নিরবধি!
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই কি জানিস,
কোনো কোনো অপেক্ষা শেষ হয় না?"
আমি কিছু বলিনি, আমি তো নিজেও অপেক্ষার নাম,
আমি তো নিজেও বহন করি সময়ের স্থির দৃষ্টি!
আমি একদিন এক বেহায়া শহর দেখেছিলাম,
যেখানে বাতাসে বেঁচে ছিলো শুধুই ধোঁয়া,
আমার বুক চিরে সেই শহরের বিষ ঢুকে গিয়েছিলো,
আমার স্বচ্ছ জলে লেগে গিয়েছিলো অজানা এক কালো দাগ।
আমি একদিন এক কুমারকে দেখেছিলাম,
সে মাটি ছেনে বানাচ্ছিলো জীবন,
তার হাতের ছোঁয়ায় সৃষ্টি হচ্ছিলো নতুন কিছু,
সে কি জানত, আমি নিজেও মাটির সাথে মিশে থাকি?
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই কি জানিস,
সৃষ্টি আর ধ্বংস একই মুদ্রার দুই পিঠ?"
আমি চুপ করে ছিলাম, আমি তো নিজেও এক দ্বন্দ্ব,
আমি তো নিজেও এক অনিশ্চিত কাল!
আমি জানি, আমার এই যাত্রা একদিন শেষ হবে,
আমি জানি, আমার ঢেউ একদিন থামবে,
তবু যতদিন আছি, আমি ছুটে যাবো,
স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝখানে,
এক ক্লান্ত ভবঘুরের মতো!
আমি একদিন এক নামহীন ভবঘুরেকে দেখেছিলাম,
তার গায়ে ছিলো ধুলো-মাখা দীর্ঘ পথের ক্লান্তি,
তার চোখে ছিলো এক চিরস্থায়ী অন্বেষণ,
তার হাতে ছিলো না কোনো মানচিত্র, ছিলো শুধু শূন্য দৃষ্টি।
সে বলেছিলো— "ও নদী, তোর কি ক্লান্তি লাগে না?
তুই তো চলছিস অনন্তকাল ধরে,
তোর কি কখনো ইচ্ছে হয় না, কোথাও গিয়ে থেমে যাই?"
আমি কিছু বলিনি, শুধু শুনিয়েছি আমার ঢেউয়ের গান,
সে বুঝতে পারেনি, আমিও তো এক ভবঘুরে,
আমারও কোনো ঘর নেই, কোনো গন্তব্য নেই!
আমি একদিন এক নিঃসঙ্গ আলোর সঙ্গে কথা বলেছিলাম,
সে শহরের আনাচে কানাচে একা একা জ্বলছিলো,
কেউ তার দিকে তাকায়নি, কেউ তাকে ডাকেনি,
তবু সে জ্বলছিলো, নিজের অস্তিত্বের শেষ বিন্দু দিয়ে।
সে বলেছিলো— "ও নদী, তুই তো ছুটছিস দিনের পর দিন,
তোর কি কখনো মনে হয় না, হারিয়ে যাওয়া আলোদের গল্প শুনবি?"
আমি কিছু বলিনি, আমি তো নিজেও এক নীরব আলো,
যে নিভে যাবে একদিন, সময়ের কালো জলে।
আমি একদিন এক অন্ধকারের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম,
সেখানে শব্দহীন কান্না ছিলো, হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের ছায়া ছিলো,
সেখানে কিছু গল্প ছিলো, যেগুলো কেউ শুনতে চায়নি,
কিছু নামহীন কবিতা ছিলো, যেগুলো কেউ পড়েনি।
সেই অন্ধকার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো—
"ও নদী, তুই কি জানিস, বিস্মৃত হওয়া কেমন লাগে?"
আমি কিছু বলিনি, শুধু বয়ে চলেছি,
আমার প্রতিটি ঢেউয়ের সঙ্গে নিয়ে গেছি
নির্বাসিত স্বপ্নদের, বিস্মৃত নামগুলোকে।
আমি জানি, একদিন আমার অস্তিত্ব মুছে যাবে,
একদিন আমার জলের গল্প কেউ আর মনে রাখবে না,
তবু যতদিন আছি, আমি বয়ে যাবো,
স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝখানে,
এক নামহীন ভবঘুরের মতো!