আকাশের ব্যালকনি তবুও অস্পষ্ট নিরন্তর দৃষ্টির পথে নীল নীকোনো শিল্পী, লেখক বা কবিকে বুঝতে হলে কিংবা আলোচনা করবার প্রয়োজন হলে আমরা প্রথমেই জানতে চাই, তিনি তাঁর নিজের সৃষ্টিকে বুঝবার জন্যে বিশেষ কোন মাপকাঠি বা সারণী-সংকেত নির্দেশ করছেন কি-না। আর যদি দিক-নির্দেশ একান্তই না করে থাকেন, আমরা বিভিন্ন ব্যক্তিমেধাভিক্তিক দৃষ্টিকোণের সাহায্যে তাঁর সৃষ্টিকে বুঝবার চেষ্টা করে থাকি। এক্ষেত্রে সাহিত্যিক তাঁর সৃষ্ট চরিত্রকে হয় আপন চরিত্রের আদল দেন নয়তো তাঁর দৃষ্ট পরিচিত মহলের চারিত্রিক বৈশিষ্টের আশ্রয় গ্রহণ করে থাকেন। মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে যাঁরা অকৃত্রিম ও মৌলিক কিছু দান করে গিয়েছেন সম্ভবতঃ তাঁদের প্রত্যেকেরই নিজের সৃষ্টি সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ হোক কিংবা পরোক্ষ হোক নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেছেন।
শেক্সপ্যিয়ারের ক্ষেত্রে এ যেন এক বিরাট ব্যতিক্রম। নিজের সৃষ্টির তিনি নিজেই নীরব দর্শক – কোনো ভাবালুতা কিংবা কোনো ভাবোচ্ছাস তাঁকে মতামত প্রকাশে প্রভাবান্বিত করতে পারেনি। জীবন-নাট্যকে প্রকৃতির মত চরম নিরপেক্ষতা নিয়ে তিনি দেখেছেন, অনুভব করেছেন, প্রকাশ করেছেন – কখনো Tragedy, কখনো Comedy আর কখনো Sonnet-এর মাধ্যমে। তাই যুগে যুগে শেক্সপ্যিয়ারের উপর লিখিত সমালোচনা বুঝতে হলে আমাদের এ কথাটি বিশেষভাবে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, সমস্ত সমালোচনার ধারা এক না হলেও ব্যক্তিক অনুসন্ধানের লক্ষ্যে বিশেষ কোনো তারতম্য নেই।
১৭০৯ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৭৯৯ পর্যন্ত অন্ততঃ ৬০ খানা শেক্সপ্যিয়ার সমালোচনা গ্রন্থ প্রকাশিত হয় – এর মধ্যে পোপ, থিওবল্ড হ্যানমার, বেন জনসন, এডমন্ড ম্যাসোন – এর সংস্করণই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। পোপ তাঁর সম্পাদিত সংস্করণে বিশেষ করে শেক্সপ্যিয়ারের মৌলিকত্বের প্রতি ইঙ্গিত করেন। সাহিত্যে মৌলিকতা আসলে কিভাবে নিরূপিত হতে পারে সে প্রসঙ্গে বিবিধ মতবিরোধ থাকতে পারে তবে এ কথা সত্যি যে পার্থিব মানব চরিত্রের আকৃতি প্রকৃতিতে স্বভাবতঃই একটি বিশ্বজনীন ছন্দ মাত্রা পরিলক্ষিত হয়। তিনি মনে করেন যে, প্রকৃতির স্বাভাবিক বিকাশ ঘটেছে শেক্সপ্যিয়ারের সৃষ্টিতে এবং তাঁর অঙ্কিত নর-নারী প্রকৃতিরই প্রতিকৃতি। তিনি বলেন যে, যদি কোন লেখক মৌলিকত্বের দাবী করতে পারেন একমাত্র শেক্সপ্যিয়ারের পক্ষেই তা সম্ভবপর। তাঁর মতে Poetic Justice পূর্ণ বিকশিত হয়েছে শেক্সপ্যিয়ারের নাটকে…
শেক্সপ্যিয়ার University wit-দের (যথাঃ গ্রিন, পীল, লজ্, ন্যাশ, কিভ্ প্রমুখ) দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।। যেহেতু তিনি নিজে ঐ সমস্ত পন্ডিত ব্যক্তিদের পান্ডিত্বের সমারোহে স্বকীয় প্রকৃতিদত্ত মৌলিক প্রতিভার কোনো মিলনক্ষেত্র অবলোকন করেননি। মেধাবৃত্তির প্রতি বরং কটাক্ষ না হেনে তিনি সমমাত্রিকভাবেই ছিলেন নিজের সৃষ্টিতে দ্রবীভূত… তাঁর অবিনশ্বর, অনন্য ও জলন্ত প্রতিভার প্রভাব তথাকথিত University wit-দের যে ম্লান করে দিয়েছে এ ব্যাপারে সুধীজন ও সভ্যমহল নিঃসন্দেহ।
শিল্পী, সাহিত্যিক, নাট্যকার যিনিই হোন সাধারণত তারা ব্যক্তিগত জীবনের ছাপ নিজস্ব সৃষ্টি বলয়ের মাঝে রেখে যান এবং এই সূত্র ধরে পরবর্তীকালের ইতিহাস মূল্য নির্ধারণে এগিয়ে যেতে পারে। শেক্সপ্যিয়ার এ নিয়মের এক মহা ব্যতিক্রম। সূর্যের মত নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিয়ে বিশ্বচরাচরের ঘটনাপ্রবাহ তিনি দেখেছেন, অনুভব করেছেন ও প্রকাশ করেছেন, কিন্তু ব্যক্তিত্বের ছাপ দিয়ে তাঁর সৃষ্টির স্বাভাবিক গতি কখনো অবরুদ্ধ করেননি।
উৎসঃ 'চেতনার অনুষঙ্গ' / সিদ্দিকুর রহমান
____________________________________________
দ্রষ্টব্যঃ কপিরাইটের জন্য এখানে প্রকাশিত প্রতিটি সাহিত্যকর্মই আংশিক আকারে প্রদর্শিত
N.B.: Some stanzas here have been masked to avoid copyright infringement
[ Copyright © 2023 | Anwar Parvez Nur Shishir – All Rights Strictly Reserved ]