প্রথাগত মানুষ
আনোয়ার হোসেন বাদল
------------------------
একবার রাজগঞ্জের নুরু স্যার বলেছিলেন
"আমার ছাত্রদের মধ্যে তুমিই যা
এট্টু মানুষ অইলা,
তা বাপধন যারা লেহাপড়া ছাইর্রা
সব কি হরে টরে,
হেরা তো দেহি টাহাইদ্যা লাল হইর্রা
হালাইতেআছে
তুমি পারো না ক্যা?"
মানুষ যে হতে পারিনি
নুরু স্যারকে বললে হয়তো তিনি অনেক কষ্ট পেতেন,
আমার অযোগ্যতার কারন যে কী
তাও জানাতে পারিনি স্যারকে
কী জন্যে যে গেউন্দার টাকাটা ফেরৎ দিয়েছিলাম তা কি কাউকে বলার বিষয়?
ছেছরা স্মাগলার গেউন্দা কারবারী এখন দশ জনের একজন, তাঁর হাতে কোটি কোটি টাকার বিলি বন্টন
লেগে থাকলে লাল নীল আমিও করতাম স্যার।
ছাদ নেই বলে বৃষ্টি হলেই
টিনের ঘরটি পানিতে সয়লব
একটু বৃষ্টিতেই বাথরুমের দুর্গন্ধ,
কাদাময় ঘর, পানিবন্দী জীবন
আমার ভালোবাসা
কথায় কথায় খোটা দেয়
"একখানা ভালো ঘরও বানাতে পারলে না।"
তারে আমি কেমনে বুজাই
দিলের ঘরের পাগল আমি,
মনের ঘরে বাস
আমি তো কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ নই
আমি দালানঘর চাইনি চেয়েছিলাম একটি বাতিঘর
সমাজতান্ত্রিক ক'টি ছেলে মেয়ে আর একজন দেশজ নারী
আহামরি কোন সন্যাসী কিম্বা বিপ্লবী আমি নই
তাই প্রথমোক্ত দুটি'র কথা বাদ দিলেও
শেষোক্তজন ঠিকই পেয়েছিলাম।
যোগ্যতার মাপকাঠিতে নিদেন পক্ষে একটা
ছাদযুক্ত বাড়ি তো থাকতেই হয়
নইলে কি আর মানুষের মধ্যে কেউ
গন্য করে?
নুরু স্যারই তো বলেছিলেন
"লেখাপড়া করে যে,
গাড়ী বাড়ি করে সে''
আমি সেখানে আজীবন ফেলমারা
এক বাউন্ডুলে পথিক।
তবুও এই ছন্নছাড়ার পথ তো আটকে থাকেনি
তাকে আর ওকথা শুনিও না।
নিজগৃহে যে একজীবনের পরবাসী,
একা একা স্বমোহনে কাটে যার নীলকন্ঠী যৌবন
তাকে আর যাই বলা যাক
মৌলিক কান্ডজ্ঞানী বা কাতারবন্দী মানুষ তো বলাই যায় না।
নইলে গার্লস স্কুলের মোকসেদ মাস্টার তো বলেইছিলেন
" ও ব্যাডা মুন্সির পো, দ্যাশ এহোন
মিলিটারীর হাতে
তুমিও তো একদিন মিলিটারী
ছিলা।
উর্দিওয়ালাদের লগে লাইগ্যা
থাহো
টুপাইস কামাইতে পারবা বাপ,
মানুষ অইতে পারবা।"
লেগে থাকা যে কি জিনিস তাই তো জানলাম না
তারপর তো মানুষ হওয়া?
কী করে জানবো?
একাত্তরে বাপজান বলেছিলেন
"নুররা ম্যাট্টিক পাশ করেছে
আক্কেল পাশ করে নাই"
আমারও বোধ হয় আক্বেল পাশটা বাকীই ছিলো
একজীবন যার ভরা গাঙে
সাঁতার কেটে যায়,
তার কি আক্কেল থাকে?
যে মানুষ চলমান পালতোলা
ছৈয়াল
নায়ের মাঝে নিজেকে খোঁজে,
তার কি আক্কেল থাকে?
যার আক্কেলই নেই
তার আবার লেগে থাকা কি?
একবার ছদু পাগলার আখড়ায়
এই আক্বেলহীনের কেটে গেলো তিন রাত
অধিকারী লতিফ মাঝি এসে বললেন
"এ্যাই বেক্কল এহানে থাইক্যা
কি করবি?
যাত্রায় অভিনয় করবি? "
যাত্রাদলে খায় যার জীবন
পূর্নিমায় বান ডাকে যার বুকের খরায়
আকন্ঠ মহুয়া গিলে
পাপমোচন হয়েছে বলে তৃপ্ত হয় যে
তাকে যে যাই বলুক
তোমরা তাকে প্রথাগত কোন মানুষ বলো না।
নুরু স্যার চলে
গেলেন,
মোকসেদ মাষ্টারও
নেই
বাপজানও আমাকে
ছেড়ে
অনন্ত ঘুমে
সবাই-ই একদিন
চলে যাবেন
শরতের শান্ত
পায়রার মতো
একদিন থেমে যাবে
সব
কোলাহল
শুধু মানুষ হবার
গল্পটা থামবে না।
ইদানীং মানুষ দেখতে পাশের বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকি
মানিক সরকারের সদ্য নির্মিত সাততলা বাড়ির দিকে।
মাদক, অস্ত্র, আরও কি কি মামলায় অনেকদিন জেল খাঁটার পর
হঠাৎ কি করে যেন মানুষ হয়ে গেলেন তিনি।
এখন তাঁর চারপাশে কতো মানুষ! একের পর এক বাড়ি
নতুন নতুন মডেলের গাড়ি
মানুষ হতে পারলে যা যা হয় আর কি।
আমি যদিও মানুষ ছিলাম না
এবং হতেও পারিনি
তাই ওসব চাইওনি
চেয়েছিলাম শুধুমাত্র একটি
বাতিঘর,
প্রলেতারিয়েত ক'টি ছেলে মেয়ে
আর
দেশজ একজন মৌলিক নারী
দেশজ নারী তো পেয়েইছিলাম
আর ছেলে মেয়েও
কিন্তু তারাও তো মানুষ হতে চায়
মানুষকে প্রথাগত
এবং প্রত্যাশিত ঘরেই মানায় ভালো।
------------------