কবিতার শৈশব/ অনুরাধা চক্রবর্ত্তী।

আমার কবিতার শৈশব দিন গুলো ঘন সবুজ ছিল,
কোন বিবর্ণ রং কিংবা ভ্যাটের পচা গন্ধ ছিল না সেখানে। নির্মল আকাশের মত মহান ছিল, উদার ছিল, বুলবুলি ডানার মতো নরম ছিল সে শৈশব।
সেখানে ছিল বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা, ছোটদের প্রতি স্নেহ আর ভালোবাসা; হ্যাঁ অকৃত্রিম ভালবাসা।

সেখানে বিজয়া দশমীতে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম ছিল: মাথায় চুমু খেয়ে বড়দের আশীর্বাদ ছিল:
বাবা কাকাদের কোলাকুলি ছিল:আর ছিল নারকেলের নাড়ু :কখনো বাদামি কখনো বা সাদা।

মহালয়ার ভোরে রেডিওতে মহালয়া শোনা ছিল,
তারপর বাবা জ্যাঠার তর্পণ ছিল, মা জেঠিমার
ঘরের ঝুল-ঝাড়া, ঘর পরিষ্কার, বিছানার চাদর কাচা, আলমারি খুলে পুরনো জামা কাপড় রোদে দেওয়া, বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার করা, উঠান নিকানো, প্রতি সন্ধ্যায় তুলসী তলায় প্রদীপ দেওয়া, আরো কত কি ছিল আমার শৈশবে ;
এসবের মধ্যে গড়ে উঠেছে আমার কবিতার শৈশব; আমার রুচি,আমার পছন্দ, আমার শ্রদ্ধা আর আমার ভালোবাসা, স্বার্থহীন, শর্তহীন ভালবাসা।

বেশ ছোট তখন আমি:  বাবা একটা লাল রঙের খাতা এনে দিল। বলল এখানে তুমি লিখবে, তোমার যা লিখতে ইচ্ছে করে মা, তাই লিখবে। আজ বুঝি ওই দিনই আমার শৈশব, কবিতার শৈশবে পরিণত হলো; ওই খাতাটা আজও আছে, অতি সযত্নে বাড়ির আলমারিতে রাখা। অনেকটা যেভাবে তোমরা সবাই দামী গয়না গুছিয়ে রাখো, তেমনি করে গুছিয়ে রেখেছি সেটাকে। বাবা চলে গেছেন অনেক বছর। তখন আমি বেশ ছোট,কিন্তু আজও মনে পড়ে আমার কবিতার শৈশব জন্ম নিয়েছিল বাবার প্রেরণায়; মায়ের স্নেহে,বড়-দাদার আদরে, সংশোধনে,মায়ের গম্ভীর হয়ে যাওয়া শাসনে।
আমার কবিতার শৈশবে ঢুকে আছে, পুজোর আনন্দ,নতুন পোশাকের গন্ধ,বড়দিনের ছুটিতে
মা বাবা, দাদাদের সাথে ভিক্টোরিয়া-ক্যাথিড্রাল চার্চ ,কিংবা রবীন্দ্রসদন প্রাঙ্গণের সাথে।

আজও খুব ভোরে যখন আবছা ঘুম আমার শরীর আর মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন  রাখে, আমি যেন ফিরে যাই আমার শৈশবে: আমার কবিতা মাখা কবিতার শৈশবে।
সেখানে দূষণ নেই, সেখানে স্বার্থ নেই,সেখানে হিংসা নেই, সেখানে কু-পরামর্শ নেই, সেখানে নেই কোন ষড়যন্ত্র। সেখানে কেবল ছোট্ট বুলবুল-দোয়েল-শালিক আর রঙিন প্রজাপতি ফুলে ফুলে খেলা করে''বেড়ায় আজও।
বন্ধ চোখে আমি তাদের স্পষ্ট দেখতে পাই; সে প্রজাপতির ডানায় আমার শৈশব আজও ধরা পড়ে আছে। জানি জেগে চোখ মেলে ওই প্রজাপতি পাবোনা;পাবো না ওই দোয়েল-শালিক কিংবা বুলবুলি'দের।কারন …..

দূষণ আজ সর্বত্র: বায়ু দূষণ, জল দূষণ, শব্দ দূষণ, মৃত্তিকা দূষণ; তার সাথে আছে রবীন্দ্রনাথের বলা হিংসা-দ্বেষ -ছদ্মবেশ:মানে মানবিক দূষণ: এ দূষণ বড় ভয়াবহ, বড়ো ঘৃণার।

এই দূষণ বড় ভয়ানক, বড় মাথা ব্যাথা নিয়ে আসে এই দূষণ। অনেক, অনেক প্রশ্ন রেখে যায় এই মানবিক দূষণ। কেন কেন কেনো?কেন আমরা পারিনা আরো সহানুভূতিশীল হয়ে অন্যের পাশে থাকতে? কিংবা নিঃস্বার্থ অবদান রাখতে?
কেন আমরা অন্যের কবিতা শুনিনা? কেন আমরা অন্যের প্রশংসা করিনা? কেন আমরা অন্যের কবিতা শুনে হাততালি দিতে ভুলে যাই ?কেন আমরা অন্যের ছবি তুলি'না? কেন আমরা অন্যের আনন্দকে হৃদয় দিয়ে স্পর্শ করিনা, কেন,কেন ?

এই দূষণ মাখা পৃথিবীতে তবুও আমি ,আমরা আজও বেঁচে আছি: বেঁচে আছি শৈশব রোমন্থনে!
আমাদের যাদের কবিতার শৈশব আছে,আমরা নিজেদের মতো করে ভালো থাকি,ভালো থাকবো।
আমাদের শৈশব কবিতার শৈশবে পরিণত হয়েছিল যে; তাই আজও ভালো আছি, কবিতার শৈশব কে নিয়ে ভালো আছি : তোমরাও ভালো থেকো।