*দুর্গাপূজার সেকাল-একাল*                 *অনুরাধা চক্রবর্ত্তী*

বর্তমানে বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ ও  জনপ্রিয় জাতীয় পূজা দুর্গা পূজা । এই পূজার অনুষ্ঠান কালে শুধুমাত্র মানবকূলেই নয়, প্রকৃতি জগতেও যেন আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। জলে, স্থলে, আকাশে, বাতাসে যেন সাড়া পড়ে যায়।গাছপালা- ফুল -পাখি সবাই যেন এই পূজার প্রাক্কালে আনন্দে বিভোর হয়ে ওঠে। শরৎ ঋতুতে অনুষ্ঠিত হওয়া এই পূজা সমস্ত মানুষেরই জীবনেই  ছাপ রেখে যায়; তাসে তাদের ব্যক্তিগত জীবন, কর্মজীবন এবং অর্থনৈতিক জীবন, যাইহোক না কেন । তাই দুর্গা পূজা আজ আর শুধু ধর্মের বেড়াজালে আবদ্ধ নয়, ধর্ম-বর্ণ অঞ্চল ও কাঁটাতারের বেড়া অতিক্রম করে দুর্গাপূজা আজ আন্তর্জাতিক পূজায় পরিণত হয়েছে।

*দূর্গা পূজার উত্থান এর ইতিহাস ঃ* আমাদের দেশ ভারতবর্ষে দুর্গাপূজার উত্থানের কথা বলতে বসলে, প্রথমেই যে কথাটা মনে রাখতে হবে, তা হলো দুর্গা পুজোর উত্থান যখন হয়েছিল ,তখন ভারত বর্ষ আজকের মত আয়তনের ভারতবর্ষ ছিল না। তখন ভারতবর্ষ ছিল অবিভক্ত ভারত। পশ্চিমবঙ্গ বা পূর্ববঙ্গ বলে কিছু ছিল না; ছিল অবিভক্ত বাংলা, যা বাংলা বিহার উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত ছিল, সেটাই ছিল ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রদেশ।
বাংলায় দুর্গাপূজা ঠিক কবেই শুরু হয়েছিল এই নিয়ে পন্ডিত ও গবেষকগণের অনেক ভিন্ন ভিন্ন মতামত রয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু পণ্ডিত গবেষক মনে করেন, ষষ্ঠ শতকে সম্রাট আকবরের শাসনকালের পরে, রাজশাহী তাহিরপুরের সামন্ত রাজা কংস নারায়ণ  সর্বপ্রথম ঐতিহাসিকভাবে বঙ্গদেশে মহা আরম্বরে দুর্গাপূজা শুরু করেন। তবে সেই সময়ের দুর্গাপূজা কিন্তু আজকের দুর্গাপূজার মত ছিল না। কারণ তদানীন্তন সমাজ জাত পাত বর্ণ গোত্রে ডুবেছিল । তাই সে সমাজের উচ্চ বর্ণের ও ধ্বনি সম্প্রদায়ের মানুষ পুজায় অংশগ্রহণ করতে পারতেন; অন্য ধর্মের মানুষকে সাদরে সেই পূজার বরণ করা হতোই না। বরং ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় উচ্চ বর্ণ ছাড়া সেই পূজায় বৈশ্য ও শুদ্রের যোগদান ছিল খুবই কম । সেই পুজোয় তারা খুব সামান্য কিছু কাজ করারই সুযোগ পেতো। তাই এক কথায় বলা যায় যে সেই সময় দুর্গা পূজাতে, সমাজের বিশাল একটি অংশ শুধুমাত্র দর্শক হিসাবে উপস্থিত থাকতো।

আবার অন্য এক সম্প্রদায়ের পন্ডিতগণ মনে করেন যে প্রায় ৩০০ বছরেরও বেশি আগে, তাহেরপুরের হিন্দু রাজন, রাজ পরিবার ও মহারাজাগণ এই পুজোর প্রবর্তন করেন শ্রীপুরে। তখন সেই পুজো হতো বসন্তকালে অর্থাৎ বাসন্তী পূজা রূপে, কংসনারায়ণ পরবর্তীকালে শ্রীরামচন্দ্রের অকালবোধন প্রচলন করেছিলেন।

    আবার অনেক পন্ডিতগণ মনে করেন যে ১৬১০ সালে বেহালার সাবর্ণ  রায়চৌধুরীদের মন্ডপেই  প্রথম দুর্গা পূজার প্রচলন হয়।
     আবার অপর এক শ্রেণী বলেন যে শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব এবং কৃষ্ণনগর রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় দুর্গাপূজার প্রথম প্রচলন করেন। সেখানে রাজ উপাধি ও রাজত্ব অর্জনের পরপরই সেই পুজো প্রচলিত হয়।
   যাই হোক, যে রাজাই বা যে জমিদার বর্গই দুর্গা পূজার প্রচলন করুন না কেন, দুর্গাপূজার ইতিহাস যে অনেক পুরনো এ নিয়ে কোন মতভেদ নেই ।

*দুর্গাপূজার একক ধ্রুপদী থিম ঃ*  শুরু থেকেই দূর্গা পূজার সঙ্গে বাংলার বিবাহিত কন্যার তিন দিনের জন্য পিত্রালয়ে আগমনের একটি আবেগঘন যোগাযোগ ছিল। সেই জন্য সেই সময় থেকেই এই পুজোর মধ্যে একটা আবেগ কাজ করতো। এই আবেগ তখনকার দুর্গাপূজার প্রতিমা নির্মাণের মধ্যে ফুটে উঠতো এবং এই প্রতিমাই ছিল তখনকার একমাত্র থিম। একদিকে মা’কে অসুর দলনি মা এবং অন্যদিকে কন্যা হিসেবে কল্পনা করা হতো; সেইসময়ের সেই মূর্তি আমাদেরকে একটি একান্নবর্তী পরিবারের কথা মনে করিয়ে দেয়। যেখানে ডাইনে ও বামে লক্ষ্মী গনেশ সরস্বতী ও কার্তিক কে নিয়ে মা যেন ঘোরতর সংসারী মাতৃরূপে উপস্থিত : তিনি এক মৃন্ময়ী মা। সেই মৃন্ময়ী মা পূজার সময় নিষ্ঠা ও ভক্তিতে চিন্ময়ী রূপে ধরা দেন। তার পদতলে পরাজিত ও  ক্ষমাপ্রার্থী অসুর কখনো’বা অর্ধ মহিষ ও অর্ধ নর রূপে প্রকটমান হয়, আবার কখনোবা রাক্ষস রূপে।

*যুগের পরিবর্তনের সাথে, নতুন নতুন থিমের পূজার প্রচলন ঃ* প্রথমদিকের ধ্রুপদী থিম কে পরিবর্তন দেখা দিল যখন ,বিভিন্ন জমিদারদের মূর্তি পূজা ও মূর্তি নির্মাণে, ভিন্ন ভিন্ন জমিদারেরা দুর্গাপূজাকে নিজেদের পরিবারের ও বংশের সম্মান ও আভিজাত্যের বিষয় হিসেবে দেখাতে শুরু করেন তাই সেই সময় থেকে দুর্গাপূজায় অর্থ লগ্নী শুরু হয়। জমিদারেরা দুর্গা পূজার প্রতিমা তৈরীর জন্য দূর দূরান্তর থেকে কারিগরদের ভাড়া করে নিয়ে আসতেন এবং মাসের পর মাস জমিদার বাড়িতে থেকে কারিগরেরা মায়ের প্রতিমা তৈরীর কাজ করতো। এরপর প্রতিমা মন্ডপ তৈরিতেও অর্থ বিনিয়োগ শুরু হতে থাকে; বিভিন্ন উচ্চ বৃত্তের মানুষ দুর্গাপূজার মন্ডপ নির্মাণে অর্থ লগ্নী করে জমিদারের আত্মা ভাজন হতে শুরু করেন। এই ভাবেই ধীরে ধীরে দুর্গাপূজা কে কেন্দ্রকরে শত শত মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে। বাংলার বিভিন্ন বড় বড় বাড়িতে ধীরে ধীরে এই পুজোর প্রচলন হতে শুরু করে। দেশের বিভিন্ন গ্রামীণ অঞ্চলে বড় বড় বাড়িতে প্রধানত ব্রাহ্মণ বাড়িতে দুর্গা পূজার একক প্রচলন শুরু হতে থাকে। রায়-বাড়ীর পূজা, দে-বাড়ির পূজা প্রভৃতি পূজা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় ।

  ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার পর জমিদাররা বিলুপ্ত হতে থাকে পুজোর ধরন তখন আবার পাল্টাতে শুরু করে। দুর্গাপূজা মালিক ও জমিদারদের আলিশান মহল থেকে এবার নেমে আসে_ মধ্যবিত্ত মানুষের হাতে; জনৈকের ধর্মীয় আচার থেকে দুর্গাপূজা সমাজের সকল শ্রেণীর জন্য উন্মুক্ত হয়ে আসে। খেটে খাওয়া কৃষকরাও তাদের বাৎসরিক আনন্দ দুর্গাপূজাকে সাদরে বরণ করে নেয়। আনন্দ করতে শুরু করে দুর্গাপূজাতে।

তবে সেকালের জমিদারদের মত এখনো বিভিন্ন এলাকার পুজোর মধ্যে রয়ে গেছে একে অন্যকে ছাপিয়ে যাবার বা রেষারেষির ভাব। নগরের ভিন্ন ভিন্ন পূজা এবং সেই সমস্ত পূজা প্রতিমা ও মন্ডপ নির্মাণে নতুন নতুন আইডিয়া এই একে অপরকে ছাপিয়ে যাবার দিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে এর ফলে প্রতিবছরই বাড়তে থাকে দুর্গাপূজায় আধুনিকতার ছোঁয়া এবং নতুনত্বের ছোঁয়া।

    হিন্দু ধর্ম-শাস্ত্র মতে, মা দুর্গা দুঃখ দুর্গতি নাশ করেন অর্থাৎ তিনি দুর্গতিনাশিনী মা। সমাজের সকল অন্যায়কে অসুর হিসেবে ধ্বংস করেন মা দুর্গা। ফলে দুর্গাপূজা করলে সমাজের শান্তি ও সাম্য ফিরে আসবে। এটিই কিন্তু প্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বাস করা হতো।দুর্গা পূজার বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের ছোঁয়ায় বিভিন্ন অলিতে গলিতে পূজিত হয়ে, আজকের থিমের পুজোয় প্যান্ডেলে আলোকসজ্জায় প্রতিমায় একটি  নব্য রীতির ছোঁয়া রেখে চলেছে। এ কথা বলাই বাহুল্য ।

*শান্তি সাম্য ও সৌহার্দ্য নিয়ে আসে এই পূজা ঃ* শুরু থেকে আজ পর্যন্ত দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে বাঙালি তথা সমগ্র বিশ্ববাসীর মনে শান্তি সাম্য ও সৌহার্দ্যবোধ জাগরিত হয় একথা বলাই বাহুল্য। শহরের পুজো গুলিতে অনেক ভিন্নতা রয়েছে যেমন বিভিন্ন মন্দিরে নিষ্ঠা সহযোগে  পূজা হয়, তেমনি বিভিন্ন হাউসিং সোসাইটিগুলোতেও আধুনিকতা মাখা পূজো প্রচলিত আছে। বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা চাঁদা তুলেও দুর্গা পূজা করেন। দুর্গা পূজার সময় বিভিন্ন ক্লাব ও বড় বড় আভিজাত্যপূর্ণ বাড়িতে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দুর্গাপূজা হয় তবে সকলেই নিষ্ঠাভরে মা দুর্গাকে আরাধনা করেন ,শোক দুঃখ ব্যাধি দূর করে সমাজকে সুন্দর ও পবিত্র করে তুলতে।

*মহালয়ার ভরে পবিত্র স্নানের মাধ্যমে মাতৃপক্ষের সূচনা ঃ* আগের মত আজও শরতের উষা লগ্নে মহালয়ার ভোরে আকাশ বাণীতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদার কণ্ঠে চন্ডী পাঠের মাধ্যমে যেন দেবিপক্ষের সূচনা শুরু হয়।
   শুরুর সময় দুর্গাপূজায় তাঁতিদের কাজের চাপ অনেক বেড়ে যেত। সকল ঘরে ঘরে দুর্গাপূজায় নতুন তাঁতের শাড়ি গামছা ধুতি ছোটদের জামাকাপড় অডারি মাল যেত। তাঁতঘর পাড়া থেকে কাপড়ের গাঁটলি নিয়ে পূজা উপলক্ষে বাড়িতে বাড়িতে বিলিবন্টন করে বেড়াতো তাঁতি।

  যুগের পরিবর্তনের ফলে আজ হয়তো এই প্রথা অবসান হয়েছে কিন্তু দুর্গাপূজাতে নতুন বস্ত্র কেনা বা পরার নিয়ম রীতি সমানভাবেই অব্যাহত। বিভিন্ন শাড়ি ও জামাকাপড়ের দোকানে মহালয়ার অনেক আগে থেকেই ভিড় লক্ষ্য করা যায়। আজকাল শীততাপ নিয়ন্ত্রিত শপিংমলেও দুর্গা পূজার জামা কাপড় কেনাকাটার প্রবল ভিড়। চোখে পড়ে।।

শুভ মহালয়ার ভোরে পূর্ণ স্থানের সাথে সাথেই যেন বেজে উঠে দেবীর আগমনী বার্তা শরৎ ঋতুতে শারদীয়া মায়ের অকালবোধন এবং তা নিয়ে সমস্ত বাঙালি তথা বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মানুষের মনে এক বিচিত্র স্পন্দন শুরু হয়ে যায়। শিউলি ফুলের গালিচা বিছানো পথে মাড়িয়ে যেন দেবী মাদুর্গা আসেন মর্তলোকে।  নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, গাছে গাছে টগর এর রাশি। ভ্রমরের আনাগোনা বাড়তে থাকে। দূরের মাঠে কাশির রাশি মাথা দোলাতে থাকে। এই সব টুকরো টুকরো মুহূর্ত আর চিত্রগুলি অতীত থেকে আজও একইভাবে রয়ে গেছে।

*আনন্দঘন মুহূর্ত দুর্গাপূজা ঃ* দুর্গাপূজা মানে উৎসব ও আনন্দের মুহূর্ত। বহুকাল ধরেই বাঙালির একটি আবেগ ও আবেগঘন মুহূর্ত মালা এই দুর্গাপূজা। যেটি অনেক আগেও যেমন ছিল আজও তাই। দুর্গাপূজা তাই মনের গভীরে টুকরো টুকরো অনেক আনন্দের মুহূর্ত পূজার উৎসব যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে তবে সেই আনন্দের মুহূর্ত গুলি মানব হৃদয়ে আগের মতোই দোলা দিয়ে যায়। যারা অনেক প্রবীণ তারা বলেন তাদের ছোটবেলার পূজো অনেক নিষ্ঠাভরে উদযাপন হত আজকের পূজায় নিষ্ঠা হয়তো অনেকটাই কমেছে কিন্তু বেড়েছে সাজসজ্জা মায়ের প্রতিমা ও মন্ডপের আলোর সাজসজ্জা।

দুর্গা পূজা মানেই চারিদিকে নতুন নতুন গন্ধ, নতুন জামা কাপড়, নতুন সাজসজ্জা। দুর্গা পূজার আগে অনেকেই নিজেদের গৃহ রং করার প্রতিটি হিন্দু বাঙালি বাড়িতে দুর্গাপুজোর আগে ঝুল ঝেড়ে বাড়ি পরিষ্কার করবার রীতি আজও রয়েছে। আসন্ন শীতের বাজারে আসে বিভিন্ন সবজি সেগুলি রান্না বান্না করাও প্রচলন আজও বিভিন্ন হিন্দু বাঙালি বাড়িতে লক্ষ্য করা যায়। তবে হোটেল রেস্টুরেন্টের আধিক্য বেড়ে যাওয়ায় আজকাল দুর্গাপূজাতে অনেকেই রেস্টুরেন্টে বা রেস্তোয়ায় খাবার খেতে যান। তা সত্ত্বেও দুর্গাপূজা উপলক্ষে বহু বাড়িতে আজও নারিকেলের নাড়ু, মুরকির মোয়া ,পিঠে পায়ের বিভিন্ন রকমের মিষ্টি বানানো রেওয়াজ রয়ে আছে। মনে পড়ে মা একেক দিন এক এক ধরনের খাবার বানাতেন কোনদিন নারকেলের নাড়ু তো কোনদিন মুরকির -মোয়া । পূজোর কয়েকদিন আমরা সকালে সেসব খেয়েই কাটাতাম আলাদা করে কিছু জলখাবার বানানো হতো না বাড়িতে। পুজোর কয়েকদিন আগে থেকেই সেইসব বানানোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত , মোয়া বানাতে বসে যেতাম। শুধু নারকেলের নাড়ুই নয় তিলের নাড়ু মুড়ির মুড়ির মোয়া  চিঁড়ের মোয়া।

*সব শ্রেণীর মানুষের মনে দোলা দিয়ে যায় দুর্গাপূজা ঃ*  দুর্গাপূজার দিনগুলিতে যদিও যুবক যুবতীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দোলা চোখে পড়লেও ছোট বড় বৃদ্ধ সকলেই দুর্গাপুজোর আনন্দে মেতে ওঠেন। পুজোর দিনগুলিতে ঘোরাঘুরি খুব বেশি আনন্দের হয়ে ওঠে। ষষ্ঠীর ভোরে পূজার ঢাকের আওয়াজে  -- মনের ভিতরে যেন একটা দোলা দিয়ে যায়। অষ্টমীতে নিষ্ঠাভরে মানুষ মাদুর্গাকে বিভিন্ন মন্ডপে গিয়ে অঞ্জলি দেয় উপবাস থেকে। সন্ধি পূজার পর সকলের মন খারাপ হতে শুরু করে। কারণ নবমীর সন্ধ্যা আরতির মাঝেই মায়ের বিজয়ার সুর বাঁচতে থাকে। ঢাকের কাটিতেও পড়তে থাকে সেই বোল “ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ ঠাকুর যাবে বিসর্জন।।”

*বিজয়ায় বিষাদের সুর ঃ*  ষষ্ঠীর  পূজা মন্ডপে ঢাকেতে কাটি পড়তো, কিন্তু দেখতে দেখতে সেই দিনগুলো কেমন করে যেন পার হয়ে যায়। চলে আসে অন্তিম দিন বিজয়া দশমী। সকলের মনই বিষাদে ভরে ওঠে। বড় বড় বনেদি বাড়িতে আজও নীলকন্ঠ পাখিকে উড়িয়ে দেওয়া হয় বিজয় দশমীর দিন। ভাবা হয় ওই পাখি গিয়ে নীলকন্ঠ অর্থাৎ মহেশ্বরকে মা দুর্গার আসার খবর দেয়। ঢাকের বুলি পাল্টে যায়, “ ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ ঠাকুর যাবে বিসর্জন।”

বিজয়ায় ঠাকুর বিসর্জন মন্ডপে হয়ে গেলেও বহু বনেদি বাড়িতে আজও দিনক্ষণ মেনে তবেই প্রতিমা বিসর্জন হয়ে থাকে।। বিজয় দশমীতে ছোটরা বড়দের পায়ের ধুলো নেয়, আর বড়রা ছোটদেরকে আশীর্বাদ দেন; বড়রা নিজেরা কোলাকুলি করে ।এই রেওয়াজ যেন বাঙ্গালীদের একে অপরকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানোর আদর্শ নমুনা। বিজয় দশমী উপলক্ষে অনেক জায়গায় এক সপ্তাহের জন্য দশমীর মেলা বসে যায়। ভারাক্রান্ত মনে আমরা অপেক্ষা করে থাকি আবার দুর্গা মায়ের  আগমনের জন্য ,একটি বছরের অপেক্ষা।

*উপসংহার ঃ* সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব এই দুর্গাপূজা। তবে দুর্গাপূজা আজ আর শুধুমাত্র ধর্ম বা বর্ণের মধ্যে আবদ্ধ নেই। সারা বছর ধরে, বহু মানুষ অপেক্ষা করে থাকেন দূর্গা পূজার জন্য ; কারণ দুর্গাপূজা মানেই শত-শত মানুষের কাজকর্ম । বিভিন্ন পেশার মানুষ এই সময়ে  অনেক উপার্জনের মুখ দেখেন, কেবলমাত্র এই দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে। আমাদের ছোটবেলায় দুর্গাপূজার সঙ্গে প্লাস্টিকের চশমা হাত ঘড়ি বাঁশি জিলাপি পাপড় ভাজা, প্রভৃতি যেন মিশে আছে। বড় হয়ে আজকাল প্লাস্টিকের চশমার বদলে চোখে সানগ্লাস পরি , রেস্টোয়ায় খাবার খাই,পুজোর সংখ্যাও এখন ছোটবেলার চেয়ে অনেক বেশি দেখি চারিদিকে, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি আমাদের ছোটবেলায় দুর্গাপূজার মধ্যে যে আন্তরিকতা ছিল যে নিষ্ঠা ছিল, হয়তো কোন কোন ক্ষেত্রে আজ সেগুলোর অভাব চোখে পড়ে।
দুর্গাপূজা বলতে আজও আমার স্মৃতিতে জেগে আছে বাবার সম্পূর্ণ নিজের পছন্দে এনে দেওয়া নতুন জামা কাপড়। সেই জামাকাপড় দেখে পছন্দ তো হতোই, সাথে হতো ভীষণ আনন্দ; তারপর দিন থেকে শুরু হয়ে যেত সকলকে নতুন জামা দেখানোর পালা।। আজকালের এই আমি সর্বস্ব যুগে অনেক রীতি রেওয়াজের উঠে গেছে দুর্গাপূজায় ! তবুও দুর্গা পুজো সমস্ত বাঙালি তথা বিশ্ববাসীর মনে একটি গভীর ছাপ রেখে যায়।

মহালয়া থেকে শুরু করে যে দুর্গাপুজোর শুভ উদ্বোধন ঘটে, তার বাঙ্গালীর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ অংশ। যা অশুভ শক্তির ওপর শুভ শক্তির জয় এবং মানব  কল্যাণ এর প্রতীক হিসেবে উদযাপন করা হয়।। তাই এই পূজার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট যেমন আছে, তেমনই আছে সাংস্কৃতিক তাৎপর্য, ধর্মীয় তাৎপর্য, সামাজিক তাৎপর্য, অর্থনৈতিক তাৎপর্য।
এইসব কারণেই হয়তো কভিড মহামারী যখন এসেছিল সে বছরও দুর্গা পূজাতে কিছু নিয়ম কানুন ধার্য হলেও পুজো বন্ধ হয়নি। তাই পরিশেষে বলি “আসছে বছর আবার হবে ! আবার এসো মা।”