অনিমা,
রাত তখন ঠিক, ২টো ১৭। বাড়িতে পুলিশ এল,
আমি পালিয়ে গেলাম পায়খানার জালনা দিয়ে।
পিছনে পুলিশ, অবশেষে ধরা পড়ি, রাত তখন মৃতপ্রায়।
চুলের মুঠি ধরে, রাস্তা দিয়ে হেঁচড়ে টানতে টানতে
আমাকে ওঠালো গাড়িতে। একটা কাঁক কিংবা মোরগ
তখনও জাগেনি, অথচ দূরে পূব আকাশে সূর্যটা তখন লাল।
সারাদিন অভূক্ত পিত্তি পড়া পেটে
ইন্টারোগেশন রুমে হাজার ওয়াটের বাল্ব, ঠিক চোখের উপর।
দাঁত মুখের উপর ভারী বুটের পাড়া, অভুক্ত পেটে বুটের লাথি।
সারা গায়ে জলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা।
বরফের চাঙড়ে শুইয়ে দিয়ে,
পায়ের তলায় বেতরুলের সজোরে প্রহার।
তবু বেঁচে আছি,
অনিমা, তবু আমি, এখনো বেঁচে আছি।
শুধু এই চিঠি লিখব বলে, বেঁচে আছি।
হাত পা বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখত আমায়
যতক্ষন না আমার চোখ নাক দিয়ে রক্ত ছোটে,
বারবার বলেছিল, শুধু তোমার নাম বলতে,
তাহলেই ছেড়ে দেবে আমাকে।
আমি বলিনি, তারপর-
তারপর হাত পায়ের নখে, ছুঁচ ফুটিয়ে দিয়েছিল, বারবার করে।
এরপর একদিন ভোরে
দুহাতের নখগুলো উপড়ে নিয়েছিল একটা একটা করে।
আমি অসহ্য যন্ত্রনায় তীব্র আর্তনাদ করে গেছি,
আর ওরা আমার চিৎকার ঢেকে দিয়ে করেছে অট্টহাস্য।
অনিমা, তাও আমি বেঁচে আছি! কেন বেঁচে আছি?
কিভাবে বেঁচে আছি? শুধু আমি জানি!
আমাকে দেখার পর মেডিকেল সাইন্সও এখন
কোন থিওরি লিখতে গেলে ভয় পায়।
নখ ছাড়া হাতে কি ভাবে এ চিঠি লিখছি, শুধু আমি জানি।
একদিন আমার শিশ্নের ছিদ্র ও শিরা দিয়ে
তীক্ষ্ণ ছুঁচের দ্বারা ইঞ্জেকশন করে
প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিল পেট্রোল!
অনিমা, আমি এখন পৌরুষ বিকলাঙ্গ, নপুংশক।
নগ্ন দেহের, অঙ্গ উপাঙ্গে ইলেক্ট্রিকের শক-
এখন আমি আর বৃষ্ঠার বেগ ধরে রাখতে পারি না,
পায়ুতে রুল ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে পুলিশ...
তারপরো আমি বেঁচে আছি অনিমা।
শুধু এ চিঠি লিখব বলেই বেঁচে আছি।
জেলে বসে খবর পাই, আমি যখন পালিয়ে যাই,
আমাকে ঘরে না পেয়ে-
বাবার মাথায় রিভলবার ঠেকিয়েছিল পুলিশ...
ভালোই হয়েছে-
বাবা হতে আমি আর পারব না, তাও বলতে পারি
পৃথিবীর সব থেকে ভারী বোঝা হলো,
বৃদ্ধ পিতার কাঁধে জোয়ান পুত্রের লাশ।
ভালো হয়েছে তাঁকে আর সে বোঝা বইতে হয় নি।
প্রবহমান সময়ের পর্দা ভেদ করে
অতিবাহীত সময়ের দেওয়ালে লেগে থাকা
লাল রক্তের কালো ছোপ আমি দেখেছি, অনিমা।
বোনকে
পুলিশ ও সরকারী দলের পোষা গুন্ডারা
সম্মিলিত ভাবে গনধর্ষন করে ফেলে দিয়ে গেছিল রাস্তায়।
জেলে বসে পুলিশের কাছে শুনেছি সে খবর।
আজ ৬ই আগস্ট, কাল ছাড়া পেয়েছি।
নখ ছাড়া হাতের আঙুল আর কাজ করে না।
তবু লিখছি, জড়িয়ে যাচ্ছে সব লেখা,
জানিনা পড়তে পারবে কি না! তাও লিখছি।
আমার জানা তোমার শেষ ঠিকানা,
জানিনা তুমি সেখানে আছ কি না
চিঠি তোমার কাছে পৌছাবে কি না জানি না;
তবুও লিখছি।
তিরিশটা বছর জেলেই কেটে গেল, অনিমা।
তিরিশ বছর আগের কোলকাতা শহরটা পুরো পাল্টে গেছে।
কিচ্ছু চিনতে পারছি না, কাউকে না।
ওরা হয়ত খবর পেয়ে গেছে, আমি ছাড়া পেয়েছি।
এত দিন পরও! ওরা ছাড়বে না আমাকে।
চিঠি যদি পৌঁছায় তোমার কাছে সাবধানে থেকো,
দেখো তোমার পুলিশকর্তা স্বামী যেন জানতে না পারে তুমি
এক নকশাল পন্থিকে ভালোবাসতে;
তোমার শুভ পরিনয়ের কথাও জেলেই শুনেছি।
বোনের কোন খবর পাইনি আর, আত্মীয় স্বজন
কেউ সম্পর্ক রাখেনি আমাদের সাথে,
শুধু আমার কারণে।
আমাদের বাড়ি নাকি, এখন ওদের পার্টি অফিস।
ভাবছি, বেশ্যাখানাগুলোয় একবার খুঁজে দেখব, বোনটাকে।
তোমার সাথে দেখা হোলে, ওকে দুমুঠো খেতে দিও।
ক্ষুদের ভাত খেতে বড় ভালোবাসত।
রেল রোকো আন্দোলনে শুরু আমার বিপ্লবী জীবন,
রেলের লাইন উপড়ে দিয়ে।
রেলবস্তির ধারেই যাবো ভাবছি এবার,
ওখানেই হয়ত কতগুলো যুবক ছেলে;
আমার মাথায় কতগুলো শিশার বুলেট...
থানা পুলিশের পর হয়ত এবার রেল পুলিশ-
তাদের রিপোর্টে লিখবে উদ্ধার হয়েছে,
আমার বেওয়ারিশ লাশ।
সৎকার হবে কোন এক গণচিতায়।
ইতি
নকশাল আসামী